অনেকক্ষন ধরেই একটা সুর যেন বারবার
কানে আসছিল… সুরটা ফিনফিনে অথচ অচেনা,সুরটা চেতনায় ছাপ ফেলে অনেকক্ষণ ধরেই কাছে টানছে কিন্তু কিছুতেই যেন কাছে যেতে পারছি না|
অথচ একদিন এই সুর গুলোই ভরিয়ে রেখেছিল আমার জীবন| এই সা রে গা মা পা ধা নি এই সপ্ত সুরের সাতরঙা রামধনুর জাদুময়তাতেই ভরে ছিল আমার ভেলা | তবে শুধু আমি নয়,আমার সুরের সুখ স্পর্শ পেত আমার চারপাশে ঘিরে থাকা অনেক জোড়া আখি তারা… অনেকেরই হৃদপিণ্ড বেয়ে নেমে আসা শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দও যেন জোরালোভাবে বাড়তো|
বলিরেখায় ভরপুর চামড়া কুচকানো শরীরের সঙ্গে বেমানান তীক্ষ্ণ চোখজোড়া আমাকে একনাগাড়ে দেখতো, তখন মাঝে মধ্যে বিরক্ত হতাম…
তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠতাম….
” কি দেখছো অমন করে, ঠাকুমা?”
কথা বলতে গেলেই ঠাকুরমার গলা থেকে যেন অনেক দূরের একটানা বেহালার ছড়ের মত একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসত| সত্যিই কি আওয়াজটা এমন ছিল, নাকি সেটা আমার সংগীতপ্রেমি মনের কল্পনা কে জানে !
যাই হোক, একটু সুস্থির হয়ে ঠাকুমা আবার আমার দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হেনে বলতেন, “তোকে দেখছি”
এবার আমি হাসতাম, কেটে কেটে বলতাম, “আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখছ তা তো জানি, কিন্তু কি দেখছ তা তো বলবে!”
আবার কিছুক্ষণের জন্য বিরতি, আবার সেই একটানা আওয়াজ, তারপর আবার অমোঘ কণ্ঠস্বরে বেরিয়ে আসা সেই শব্দবন্ধ…
” তোর চালচলন যে আমার ভালো ঠেকে না দিদিভাই ”
আবার সেই এক কথা, আবার সেই একই উত্তর এই জন্যই তো আমি এত রেগে যাই! কোন কথা না বলে বেরিয়ে পড়ি ঘর থেকে| যদিও আমি জানি ঠাকুমা আমার উদ্দেশ্যে নিজের মনেই এখন কি বলছে |
বলছে যে “যেভাবে তুই এখন বিষগাছের চারা বুনছিস, সেই ভাবেই জীবনের অমোঘ নিয়মে মুদারার সা থেকে উদারার সা তেই নেমে আসার মতোই সেই কর্মফল তোর কাছেই ফিরে আসবে|”
এসব শুনলেই রাগে আমার গা রি রি করে … ওই অনেকটা সন্তুর কিংবা জল তরঙ্গের ওই রিনরিনে সুরের মত| এমনিতে আমাকে দেখতে শুনতে মন্দ না… এই কথাটা অবশ্য আমি একটু বিনয় করে বললাম |আমি প্রকৃতপক্ষে যাকে বলে তাক লাগানো সুন্দরী… আমার মরাল গ্রীবার ঈষৎ হেলনে, পটল চেরা দু চোখের দৃষ্টিতে অনেকেই কুপোকাত… সেই ছোটবেলা থেকেই |সেই বালিকা বয়স থেকেই যতই সময় গড়িয়েছে কৈশোর যৌবনের দিকে, ততই বেড়েছে… শুধুই বেড়েছে আমার রূপ লালিত্য আর আমাকে ঘিরে যেন ঘন হয়ে উঠেছে একটা বলয় | ওই মধু ভরা মৌচাকে চারপাশে মৌমাছির মতো |আমার চারপাশের মৌমাছিরা অবশ্য বলাই বাহুল্য, ঠিক সন্ধিপদ শ্রেণীর পতঙ্গ নয় তারা মানুষ এবং অবশ্যই পুরুষ মানুষ| তাদের দু জোড়া সংবেদনশীল চোখ আছে, যেগুলো দিয়ে তারা আমাকে দেখেছে,দেখেছে, ভেবেছে এবং তাদের নিজের করে পেতে চেয়েছে |
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় আমার তেমন মন ছিল না, কোন রকমে টেনেটুনে পাশ করতাম ওই আর কি! যে জিনিসটায় আমার জীবনের সত্যিকারের একমাত্র ভালোবাসা আবেগ নিষ্ঠা ছিল তা হলো সংগীত| ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি আমার অসীম আগ্রহ |তাই যখনই আমি গান গাইতে বসতাম সুর-তাল-লয় বুঁদ হয়ে কাটিয়ে দিতাম ঘন্টার পর ঘন্টা|
এই ভাবেই আমার জীবনটা চলে যাচ্ছিল নামমাত্র পড়াশোনা, মারকাটারি রূপ , গানের চর্চা এবং প্রেম |প্রেম মানে… প্রেমের অভিনয়, প্রতিভাময়ী গায়িকা হওয়ার সাথে সাথে আমি একজন দুর্ধর্ষ অভিনেত্রীও বটে|সেই কম বয়স থেকেই আমার জীবনে প্রেম পত্র এবং প্রেমপ্রার্থীর কোন অভাব ছিল না| আর আমিও আমার রঙিন পেয়ালায় ভরা উচ্ছল ফেনিল জীবনকে খুব উপভোগ করতাম|
যখনই আমার কোনো আকর্ষণীয় কিংবা নিষিদ্ধ কিংবা মূল্যবান জিনিসের প্রতি আগ্রহ জাগতো, তখনই আমার নিত্য নতুন পুরুষের দরকার হয়ে পড়তো| আর এই সখ গুলো আমার মনে প্রায়ই দেখা দিত|দেখা দিতো একের পর এক আকাঙ্ক্ষা আর সেই সাথে বাড়তো আমার প্রণয়ীর সংখ্যাও |
জীবনে এরকম অসংখ্য ঘটনা প্রবাহের মধ্যে একটা দুটো মনে পড়ে, কদমতলা সুপার মার্কেটের দোতালায় অঞ্জলি ফ্যাশনসে একটা সমুদ্র নীল রঙের সাদা চুমকি বসানো চুড়িদারে আমার চোখ আটকে ছিলো| মাঝে মাত্র দুটো রাত্রি| আটচল্লিশ ঘণ্টার ব্যবধানে তখনকার দিনের মহার্ঘ ওই পোশাকটি স্থান পেয়েছিল আমার জিম্মায়| সৌজন্যে আমার তৎকালীন প্রেমিক অনুপের মায়ের হাতের আংটি| ওই চুরিদারটি আমার পাওয়ার ইচ্ছে আর সেটার দাম এর বহর শোনামাত্রই অনুপ তার কর্মপন্থা ঠিক করে নিয়েছিল| স্নান করতে যাবার সময় অনুপের মা তার হাত থেকে আংটি খুলে রেখে যেতেন, করিৎকর্মা ছেলে তখনই সেটা হস্তগত করে দুরের সোনার দোকানে বিক্রি করে ওই চুড়িদারটা আমাকে কিনে দিল আর বাকি টাকাটাও একেবারে নষ্ট হয়নি….. আমার কোমল পদযুগলের শোভাবর্ধন করার জন্য চমৎকার জরি বসানো একজোড়া সোনালী চটিও পেয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে |তারপরেই অবশ্য পাড়ার ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে পুলক আমাকে এক জোড়া সোনার কানের দুল দিয়ে আমার পরবর্তী কয়েক মাসের বিকেলগুলোর মালিকানা পেয়ে গেলো | অবশ্য পরে শুনেছিলাম অনুপের সঙ্গে আমার স্বল্পায়ু সাত মাসের প্রেম পর্ব শেষ হয়ে যাবার পর নাকি ও আমার নাম করে ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করতো, আর কিছুদিন পরেই ও অবশ্য নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল| তাতে অবশ্য আমি বিশেষ মাথা ঘামাইনি কারণ এরকম তো হতেই থাকে |
তখনকার দিনে সিনেমা হিন্দি সিনেমা দেখাসাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য খুনের সম পর্যায়ের অপরাধ বলে মনে করা হতো| কিন্তু আমার যে তখনই আমাদের গোটা অঞ্চলের সবচেয়ে দামি সিনেমা হলে তখনকার সময়ের সবচেয়ে সারা জাগানো অ্যাডাল্ট ফিল্ম দেখার শখ হল| সেই সময় যার সাথে আমার প্রেম প্রেম খেলা চলছে সে হলো সদ্য গোঁফের রেখা গজানো ললিত |ও ওর বাবার মানিব্যাগ থেকে একটা গোটা সিনেমা দেখার সাথে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার খরচা বাবদ বেশ কয়েকটা নোট যোগাড় করে ফেলছিল,আর আমিও খুশি মনে হলএর অন্ধকারে ওর সদ্য গোফ গজানো ঠোটের স্বাদ নিতে নিতে ভাবছিলাম এইতো জীবন!
কিন্তু আমার এই আনন্দময় জীবন যাপনে বাধ সাধল একটা বিয়ে বাড়ি| আলোর রোশনাইয়ে মোড়া আর সানাই এর আওয়াজে অনুরণিত একটা বিয়ে বাড়ি| আর সেই বিয়ে বাড়িতে ঘটলো আমার জীবনের প্রথম বজ্রপাত|
এমনিতে সব বিয়ে বাড়িতেই সবার মুগ্ধ দৃষ্টির আবেশে ঝলসে ওঠা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে |কতবার তো এও হয়েছে যে এখান থেকে আমি আমার পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের সঙ্গী খুঁজে পেয়েছি| কত পতঙ্গই তো বিয়ে বাড়ির আলোর ঝলকানিতে আমার রূপের আগুনে পোড়ার জন্য ঝাঁপ দেয়!
কিন্তু এইবার ব্যাপারটা একেবারে উল্টো ঘটলো,যা আমার কাছে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বার্ষিক গতি স্থান পরিবর্তন এর চেয়েও মারাত্মক এক ব্যতিক্রমী ঘটনা |এই প্রথম আমি জীবনে কাউকে দেখে মুগ্ধ হলাম, কোন পুরুষ মানুষকে দেখে আমার দেহ মন যৌবনে প্রথমবার জেগে উঠলোভালোবাসার আলোড়ন, প্রেমের বিদ্যুৎ তরঙ্গ|হ্যাঁ, আমার মনে প্রথম বার আকাঙ্ক্ষা জাগলো কোন পুরুষকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার |এমনটা কেন হল তার জবাব আমি নিজেই নিজের মনের কাছে অনেক করে খোঁজ বার চেষ্টা করেছি বহুবার, কিন্তু পাইনি, সত্যিই পাইনি!
আমার আর তর সইছিল না| আমি একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছিলাম ওই পুরুষটির পরনের সাধারন পাঞ্জাবিতে, ওর সুঠাম দেহের ঝকঝকে উপস্থিতিতে আর তার অদ্ভুত আকর্ষণীয় পুরুষালি হাব ভাবে, অথচ সেদিন সারা বিয়ে বাড়ি ওকে খুঁজেও ওর কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেও কোনো মুহূর্তেই ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারলাম না | আমি যাওয়ার আগেই ও কেমন করে যেন পিছলে চলে যাচ্ছিল|
আমি অবশ্য তাতে দমবার পাত্রী নই| যার বিয়ে ছিল সে হলো আমার পাড়ার বন্ধু আহেলী | পরদিন সকালেই হানা দিলাম ও ওর বাড়িতে, সেখানে তখন ওর মা কাকিমা জেঠিমা পিসিমারা ওর এবং ওর বরের খাতির-যত্ন নিয়ম পালনে ব্যস্ত |সেসবের কোন তোয়াক্কা না করে আমি সোজা উপস্থিত হলাম ওর কাছে, আমার মনে তখন যেন কত দিনের উপবাসী প্রেমের হিংস্র ক্ষুধা! কাল সারারাত ধরে দু চোখের পাতা এক করতে পারি নি ওই ছেলেটির সঙ্গসুখের কল্পনায়, তাই আজ তার খবর জানার থেকে আমাকে আটকায় কার সাধ্য !
একেবারে পাকড়ে ধরলাম আহেলিকে, তখন ভারাক্রান্ত মন, কান্না ভেজা চোখ কিন্তু আমি ওর দিকে ছুঁড়ে যেতে লাগলাম কৌতুহলী প্রশ্নের ডালি |ওই পুরুষের সম্পর্কে জানতেই হবে আমাকে |আহেলী প্রথমে আমার বর্ণনা শুনে ঠিক চিনতে পারল না তারপরে বলল হয়ত এ ওর মাসতুতো দেওরহতে পারে, নাম তপজ্যোতি | তপোজ্যোতি নামটা যেন আমার কানে সুধা বর্ষণ করতে লাগল, তারপরই আহেলিকে করে ফেললাম আমার সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটা, সেটা হলো ও কোন মেয়ের সাথে এনগেইজড কি না,,তা হলেও আমার যে তাতে বিশেষ অসুবিধে হতো, তা নয় চোখ ধাঁধানো রূপের দৌলতে অনেক শক্ত পোক্ত প্রেম ভেঙ্গে প্রেমিককে নিজের করে নেওয়ার রেকর্ড আমার আছে|
ও বললো, ও এসব ব্যাপার ঠিক জানে না, আগে ছেলেটি এদিকে এই এলাকাতে কোথায় যেন থাকতো,পরে অন্য কোথাও চলে গেছে |আমার বুকটা ছলাৎ করে উঠলো, এ আমার কোনো পুরোনো প্রেমিক নয়তো,এখন হয়তো চিনতে পারছি না |পরমুহূর্তেই মনে হোলো কারো চেহারার এমন বদল সম্ভবই নয়, যাতে আমি চিনতে ভুল করবো, এ একেবারেই অন্য কেউ, নতুন পুরুষ ! আমার অবশ্য ওর সম্পর্কে এটুকু শুনে ঠিক মন ভরল না আমি তক্কে তক্কে রইলাম| দিন গুলো রাত গুলো যেন তপোজ্যোতির কথা ভেবে ভেবেই কেটে যেতে লাগলো |
কথায় বলে সবুরে মেওয়া ফলে,আমারও ঠিক তাই হোলো | আহেলীর বিয়ের কয়েক দিন পরই ওর বাড়িতে নব দম্পতিকে অষ্টমঙ্গলার জন্য আসতে হল |সেখানে কিছু আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব জড়ো হয়েছিল |আমি তো ছিলামই |আস্তে আস্তে ওদের সব মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান একে একে হতে লাগলো, আর আমি শুধু ঠারে ঠোরে দরজার দিকে দেখতে লাগলাম, যদিও আমি জানতাম না যে সে আসবে কিনা তবুও অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলাম| এক অজানা আবেগের বশবর্তী হয়ে খালি মনে হতে লাগলো এই বুঝি সে আসবে… এই বুঝি তার দেখা পাব এক ঝলক|
আগেই বলেছি সুন্দরী সুকন্ঠের অধিকারিনী হিসাবে আমার একটু নামডাক ছিল, তাই আচার অনুষ্ঠান পর্ব একটু একটু করে শেষ হতেই সবাই আমাকে গান গাইতে অনুরোধ করতে লাগলো| আমিও সবাই বলা মাত্রই আমি মনপ্রাণ ঢেলে গাইতে শুরু করলাম| চিরদিনই চোখ বন্ধ করে গাই|অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমি যতই সুরে ডুবে যেতে লাগলাম ততোই যেন আমি দেখতে লাগলাম তপোজ্যোতি যেন আমার সামনে বসে আমার সুরের ধারায় আমারই মতো নিমজ্জিত হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টে|
এরপর আমি নিজে নিজেই বিনা অনুরোধে আরো খান দুয়েক গান গেয়ে ফেললাম| আমি যেন অনুভব করলাম আমার গায়কীর প্রতিটা ক্ষণ পর মুহূর্তে ও আমার দিকে নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে আছে গভীর চোখে | আমার গান শেষ হল| আশা করে ছিলাম ওর মুখ থেকে হয়তো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বাহবা পাব | কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমি চোখ মেলে দেখলাম আমার আশেপাশে আহেলী তার সদ্য বিবাহিত স্বামী কাকা কাকি পিসি পিসেমশাই ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন সকলেই রয়েছে, সবাই এক বাক্যে আমার গানের অকুণ্ঠ প্রশংসা করল কিন্তু ওকে কোথাও দেখলাম না | অবাক হয়ে গেলাম আমি এবারও !
ইতিমধ্যেই আমার গানের স্কুল থেকে রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে একটা ফাংশানের আয়োজন করা হলো|ওই অনুষ্ঠানে যথারীতি আমার একক আর কোরাস মিলিয়ে কয়েকটা গান ছিল |প্রতিবারই মঞ্চে উঠে গান গাইবার সময় লক্ষ্য করলাম যেন তপজ্যোতি একেবারে প্রথম সারিতে শ্রোতার আসনে বসে আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার গান শুনছে |সেই মন পাগল করা দৃষ্টিতে আমি আবারও বিদ্ধ হতে লাগলাম| অনুষ্ঠানের মাঝেই এক বার ছুটে গেলাম সেই শ্রোতার আসনের দিকে কিন্তু ওকে কোথাও দেখতে পেলাম না| মনটা আমার কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল|
বাড়িতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি রেওয়াজে বসতাম| আমার ঘরে| দরজা-জানলা বন্ধ করে| সেই সময় আমার ঘরে কেউ ঢুকতো না |রবীন্দ্র জয়ন্তীর ওই অনুষ্ঠানের দু এক দিন পরে সন্ধ্যে বেলা আমি আমার ঘরে বসে তন্ময় হয়ে সুর সাধনায় মগ্ন| হঠাৎ মনে হল কার যেন গরম নিঃশ্বাস যেন আমার গায়ে পড়ল |চোখ খুলে দেখি ও প্রতিবারের মতোই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে| চোখে সেই একই দৃষ্টি| আমি সঙ্গে সঙ্গে রেওয়াজ বন্ধ করে দিলাম, কিন্তু এ কি ! চোখের সামনেটা যে পুরো ফাঁকা! কেউ নেই !আমি ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরলাম বাড়ির গেট অবধি গেলাম, কিন্তু কারুর আসার বা চলে যাওয়ার কোন চিহ্ন চোখে পড়লো না, বাড়ির কেউও অপরিচিত কাউকে দেখেছে বললো না| তবে এ কি আমার মনের অলীক কল্পনা?
আমার এখন আর কিছুই ভালো লাগে না| নতুন কোন পুরুষ মানুষের কথা চিন্তাতেও আসে না| কিভাবে যেন আমার মন মনন চেতনা জুড়ে শুধুই তপজ্যোতি বিরাজ করতে লাগল| ওর কোনরকম স্পর্শ ছাড়াই শুধু মাত্র ওর দৃষ্টি শক্তির মোহেই আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম !সময়ে অসময়ে ওকে দেখতে লাগলাম, বারবার ওর কাছে ছুটে যেতে চাইতাম কিন্তু ও আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল !আমি ওকে কাছে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠতাম কিন্তু ও যেন কোন অদৃশ্য জাদু বলে থেকে যেত আমার নাগালের বাইরে!
আমি ধীরে ধীরে ঘর বারান্দা স্কুল বন্ধুর বাড়ি পার্ক গানের স্কুল দোকান সব জায়গাতেই ওর উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম| যেন ওর মধ্যেই আমার গোটা জগৎটাই গিয়ে মিশে যেতে লাগলো| এক এক সময় এমন হতে লাগলো আমি যেন চোখ বন্ধ করলেও ওর উপস্থিতি টের পেতে লাগলাম |ও যেন আমার চারপাশে সব সময় ছড়িয়ে রয়েছে| যে আমাকে কাছে পাবার জন্য এত পুরুষ এত কাল অকুণ্ঠ আগ্রহে তাদের সব কিছু দিতে চেয়েছে অথচ আমি নিজের স্বার্থ সিদ্ধির পর তাদের হেলায় দূরে সরিয়ে দিয়েছি সেই আমিই যে পুরুষের জন্য পাগল সে আমায় যেন দূর থেকে অবজ্ঞাভরে সরিয়ে দিতে লাগলো |
আমি কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠতে লাগলাম দিনকে দিন |যেখানে মনে হত ওকে দেখতাম সেখানেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ওর দিকে ছুটে যেতাম অথচ আর কেউ ওকে দেখতে পেত বলে শুনি নি |আমার সমস্ত সত্তার আর যেন কোনো অস্তিত্ব রইল না পুরোটা জুড়েই শুধু ও আর ও |দামি পোশাক গয়না খাবার সিনেমা এসব যেন প্রতি আকর্ষণ যেন আমার জীবন থেকে মিলিয়ে গেল| এমনকি নতুন পুরুষ দোসর খোঁজাও বন্ধ হয়ে গেল| কয়েকবার রাস্তার অন্যপারে ওকে দেখেই বিপদজনক ভাবে ছুটে গিয়েছি| ভাগ্যবশে বা রাস্তার লোক এর সাহায্যে কোনোভাবে বেঁচে গেছি| ওর ধরা ছোঁয়া পাই নি … আমি শুধু চিৎকার করে ওর নাম দেখে গিয়েছি কত দিন হয়ে গেল আয়নায় আর নিজেকে দেখতে পাইনা, দাঁড়ালে শুধু ওকেই দেখতে পাই|
এরপর একদিন হঠাৎ করে আমার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হলো, চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম, বাড়ির লোক পড়িমড়ি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল |উনি কি সব বললেন, ওষুধ পত্র দিলেন, আমি কিছুই বুঝলাম না শুধু আমার চারপাশ জুড়ে যেন ওর অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে লাগলাম আর ওকে একবার কাছে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠতে লাগলাম|
পরদিন মাঝরাতে আমি আমার ঘরে শুয়ে ছিলাম| হঠাৎ করে যেন অন্ধকারে একটা গুনগুন আওয়াজ শুনতে পেলাম |পুরুষালী কন্ঠ অন্ধকারেই খাটে উঠে বসলাম আর স্পষ্ট ওই অন্ধকারেই যেন ওর চেহারাটা আমার চোখে ফুটে উঠল |আমার দিকে তাকিয়ে সুরে বিহ্বল হয়ে যেন গেয়ে চলেছে অপূর্ব সুরমূর্ছনা |আমি আবারও কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে ওর দিকে ছুটে যেতে লাগলাম আর ও ততই দূরে সরে যেতে লাগলো দুর্ভেদ্য প্রহেলিকার মতো | তারপর আমার আর কিছু মনে নেই!
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলাম আমার সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, রক্তে ভেসে যাচ্ছি আমি আর চোখ খুলে রাখার অবস্থায় আমি নেই | রাত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দূরে কোথায় আমার সঙ্গে কী ঘটেছে তা জানি না| পুলিশের সাহায্যে আমাকে ফেরত পেয়েছে বাড়ির লোক এটুকু আবছাভাবে বুঝতে পেরে আবার কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম |সব আবছা ধোয়া ধোয়া তালগোল পাকানো অনুভূতি… শুধু আমার মনের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রয়েছে সেই এক জনের উপস্থিতি আর কানে লেগে আছে সেই সুর| চেতনা সংজ্ঞা অস্তিত্বের এই চরমতম মুহূর্তে আমার কানে গুঞ্জরিত হচ্ছে একটা খুব চেনা মন মাতানো নেশা ধরানো সুর |সুরটা আমার সব কিছুর সঙ্গে কেমন যেন জল ধারার মতো রেখায় রেখায় মিশে বিলীন হয়ে যাচ্ছে !
আমার ঠাকুমা ছিলেন তখনকার যুগে এক বীণা বাদিনী শিল্পী |ওনার কাছেই আমার সুর ও চর্চার হাতেখড়ি| উনি ছোটবেলা থেকেই আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে নিপুন হাতে গেঁথে দিয়েছেন সবকটি সুরের প্রাণময়তা আর যা আমার চরিত্রে অনুরণিত করার চেষ্টা করেছেন তা হল জীবন চর্চার আদ্যক্ষর কিন্তু তা আমার জীবন পথের সঙ্গে মেলে নি| কিন্তু আমার জীবনজগতে ওনার শিক্ষা কান্ডারি হতে না পারলেও আমার অবচেতনায় হয়তো থেকে গিয়েছে ঠাকুমার স্বচ্ছন্দ আঙুলের স্পর্শে গাঁথা জীবন্ত জীবন চেতনার সুর|
জানিনা মস্তিস্কর সুস্থতা আমার জীবনচর্যার সুর তাল লয়কে বাঁধতে পারবে কিনা…
তাই ঠাকুরমার দীর্ঘশ্বাস,নিরাশা আর অনেকের জীবনের অপূর্ণতাই হয়তো আমার মনোজগতে গড়ে তুলেছে এক অভেদ্য আলেয়া…
কর্ম আর ফলের এক অলীক ওঠাপড়া…
জানি না এর শেষ কোথায়…