জীবন থেমে থাকে না

জীবন থেমে থাকে না

বিশেষ করে ঈদের সময়েই এলাকায় বেশি থাকা হয়। এই সুবাদে বাড়িতে না থেকে দিনের সিংহভাগ সময় টাউনে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় থাকি। সবাই এক হই এই সময়টাতেই। আমার একটা বিশেষ মর্যাদা আছে টাউনে। সাথের বন্ধুদের কারো দোকান, এলাকার ছোট চাচার দোকান, ভাই ব্রাদার্সের পরিচিত দোকানে গেলে অনেকেই ক্যাশের যে সিটটা ওটাতে বসতে দিবে, নিজে উঠে। এটা যারা বড় তারা আমাকে ভালোবেসে আদর করে বসতে দেয়। যারা ছোট তারা সম্মান করে আর যারা বন্ধু তারা যেনো ক্যাশে আমাকে বসাইয়া হাফ ছেড়ে বাঁচে। ঐ তুই বয় আমি একটু ঘুরে আসি এমনটা বলে উইঠা যায়। এটাই একটা ট্রেন্ড বলতে পারেন আমাদের এলাকায়। ঈদের পঞ্চম দিন।

চলে যাবো রাতের ট্রেনে। তাই ভাবলাম ফ্রেন্ডের দোকানে সারাদিন বসবো, আড্ডা দিবো, আবার কবে আসবো ঠিক নাই। টুকিটাকি বেচা কেনা দেখে আমিও দোকানদারি শিখে ফেলছি, ওকে হেল্পও করা যাবে। এটা ভেবেই আসছিলাম। কিন্তু আজকের দিনটাতেও হারামীটা আমায় দোকানে একা বসাইয়া লাপাত্তা। এমন সময় বোরকা পরা একজন মহিলা কাস্টোমারের আগমন, সাথে দুইটা বাচ্চা। অহ্ দোকানটা কসমেটিকস্ পণ্যের। ভাববেন না আবার এজন্যই এখানে আইসা বসে থাকি। মতলব অনেক সেনসেটিভ আমার।

লক্ষ্য করছি মহিলা অনেকক্ষণ ধরেই এটা সেটা দেখার চাইতে আমাকেই বেশি দেখছে আড়চোখে। ভাবলাম হয়তো ইতস্তত বোধ করছে আমাকে দেখে। উনাকে বললাম, আন্টি আপনার কী লাগবে বলতে পারেন আমাকে, আর রাহাত একটু বাইরে গেছে চলে আসবে। মহিলা হাসলো বুঝা যাচ্ছে। মেয়েরা বোরকা পরে হাসলেও বোঝা যায়। চোখগুলো বুজে আসে হাসলে। আমিও একটু মুচকি হেসে আবার বললাম আপনার কী লাগবে বলেন। মহিলা কিছু বলতেছেও না। বিপদেই আছি, রাহাতকে ফোন দিবো দিবো এমন সময় মহিলা বলে উঠলো,

– তুমি আমাকে আন্টি ডাকলা ক্যান?
– জ্বি, আপনাকে তো আমি চিনিনা। আর সম্পর্কে বড় বোনটোন নাই এই বয়সের, তাই আরকি।
– কেমন আছো তুমি?
– জ্বি আন্টি ভালো, আপনি?
– আবার আন্টি!?
– কী ডাকবো?

এবার বোরকার মুখোশ খুললো। চেহারাটা দেখার পর আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। নাবিলা। আজকে ওকে আট বছর পর দেখলাম। চেহারা দেখে যে কেউ বলবে ত্রিশ বছরের মহিলা। কত মায়াবী ছিলো মেয়েটা। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন নাবিলাকে আমি ভালোবাসতাম। আবেগে টইটম্বুর ছিলাম তখন। ভালোবাসার জন্য মরে যাবো এরকম। ভালোবাসার কথাটা বলতে পারতাম না। আমি ওকে ভালবাসতাম সেটা একমাত্র তুলিই জানতো। তুলি আমার সেকেন্ড কাজিন। ভালো বন্ধুও। তুলি আমি আর নাবিলা একসাথে পড়তাম। কিন্তু সেকশন আলাদা ছিলো। তুলি আর নাবিলা আলাদা সেকশনে ছিলো আর আমি আলাদা সেকশনে।

আমি তুলির মাধ্যমেই নাবিলার সব খবরাখবর রাখতাম। স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা বটগাছ ছিলো ঐটার নিছে আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম ওকে দেখার জন্য। বটগাছের একটা জায়গায় এখনো লিখা আছে আমার আর নাবিলার নাম। তুলি ওরে নিয়ে এসে গরমের বাহানা করে আমার কাছে এসে দাঁড়াইতো। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। নাবিলা আমার দিকে তাকাইতো না। নাবিলার চোখের বর্ণনা যদি দিতে হতো কবি সাহিত্যিকরা হিমশিম খেয়ে যেতো। ওর চুল আকাশের মেঘের দৃশ্যের চাইতেও সুন্দর ছিলো। হাসলে নিচের চোয়ালের দুপাশের দুইটা বাঁকা গ্যাজা দাত তার সৌন্দর্যকে যেনো বর্গ করে দ্বিগুন করে দিতো। আমি কোন উপমা দিতে পারবোনা। আমি লেখক কিংবা কবি নই। আমি নাবিলাকে একদিন না দেখে থাকতে পারতামনা। ওর একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি ছিলো আমার কাছে, সাদাকালো। মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিরাতে ঐ ছবিটার সাথে যত কথা বলেছি তা লিখলে বড় একটা উপন্যাসের মতো সাইজ হয়ে যাবে।

আমি ভালোবাসতাম, ঐটা ভালোবাসাই ছিলো। এখনকার মতো প্রযুক্তি নির্ভর ভালোবাসা না। আমাদের গ্রামে প্রতি শীতে মেলা বসতো। আমি নাবিলার জন্য লাল চুড়ি কিনতাম, ইমেটেশনের তৈরি গলার হার কিনতাম। আমার ম্যাজিক লাইট ভাল্লাগতো আমি ওর জন্যও কিনতাম। মাটির একটা ব্যাংক, পায়ের আলতা, লিপস্টিক একটা পুতুল একটা আয়না, ছোট একটা হাত ঘড়ি আরো কতো কি। এসব কিনার টাকা চুরি করতাম। আম্মার আলমারিতে কাপড়ের ভাজে রাখা টাকা চুরি করে নিয়ে এসব কিনতাম। তুলিকে দিয়ে একটা একটা করে প্রতিদিন পাঠাতাম। তুলি নাবিলাকে আমার ভালোবাসার কথা যেদিন জানালো এরপর লজ্জায় আমি দুদিন ওর সামনে যাইনি। নাবিলা নাকি কিছু বলে নাই। তার মানে সেও ভালোবাসে। এটাই নাকি সিস্টেম।

আমি এতো কিছু বুঝতে পারতামনা। তুলি যা বুঝাতো সেভাবেই বুঝতাম। নাবিলাকে একদিন কানের দুল কিনে দিছিলাম। তুলিকে বলছিলাম নাবিলাকে যেনো বলে আমি বলছি কাল পরে আসতে। নাবিলা ঐটা পরে আসছিলোও। আমি ফিদা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সুখগুলো এখনো গায়ে কাটা দেয়। তারপর আর নাবিলার দেখা পাইনি। টানা দশদিন বিভিন্ন বাহানার পর তুলি আমাকে বললো নাবিলার আজকে বিয়ে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরেছিলো সেদিন। তুলিকে খুব বকেছিলাম।

আমি পাগলের মতো দৌড়ে গিয়েছিলাম নাবিলাকে তুলে নিয়ে আসতে। গিয়ে দেখি নাবিলা কত হাসিখুশি, কতো সুখি। বউ সেজে বসে আছে। আমি কাছে যাওয়াতে বলছিলো, তোমারতো দেখাই নেই। কই থাকো আজকাল? তোমার তুলিকেই দাওয়াতটা দিয়ে দিলাম। বলেই একটা হাসি দিলো। এই হাসিতে কষ্টের ছিটেফোঁটাও ছিলোনা। নাবিলার কথার ধরন দেখে আমার মনে হচ্ছিলো পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। দৌড়ে আসলাম তুলিদের বাড়িতে। আন্টিকে বললাম তুলি কোথায়? উনি বললেন তুলিতো তর কাছে গেছিলো বললো।

তারমানে আমাদের বাড়িতে। আমি এক ঝটকায় তুলির রুমে গেলাম। একটা টেবিল। টেবিলে চুড়ির বক্সে আমার দেয়া লাল চুড়ি সাজানো। ছোট একটা কলমদানিতে আমার দেয়া কানের দুল। আমার দেয়া আয়নাটা ওর বেডে পরে আছে। ঘরের কোনে ঝুলানো মাটির ব্যাংকটা আমারই দেয়া। শোপিচে রাখা আলতার বোতল। লিপস্টিক। কিছুক্ষণ হাসলাম। বৃষ্টি হয়েছিলো সেদিন। সারাদিন একটা মাঠের কোনে বসে বৃষ্টিতে ভিজে কেঁদেছিলাম। তুলি মীর জাফরের ভূমিকাটা খুব নিখুঁত ভাবে পালন করেছিলো সেবার। তুলির সাথে আজও আমি কথা বলিনা। অনেক লজ্জিত আর ক্ষমা চাওয়ার পরও না।

রাহাত কখন জানি এসে নাবিলার কেনাকাটা প্যাক করে দিলো টেরই পেলাম না। নাবিলা একটা হাসি দিয়ে বলল আসি। চলে গেলো। জীবন থেমে থাকে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত