লিপস্টিক

লিপস্টিক

ড্রয়ার টেনে সব জিনিস হাতড়ে পুরোনো টিনের চ্যাপ্টা বাক্সটা বের করতেই মোনা একঝটকায় ১৫ টা বছর পিছিয়ে গেলো যেন।এই লাল নীল টুনি জ্বলা ঘরের মোহময় ঘোর কেটে একটা সরকারী স্কুলের বিশালাকার খেলার মাঠে পৌঁছে গেল।দিনটা বোধহয় সরস্বতী পুজোর আগে আগের।সবাই এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে নেমন্তন্ন বিলির কার্ড নিয়ে ছুটছে।সবাই আগেভাগে দূরের সব স্কুলের কার্ড বাগিয়ে নিয়েছে বড়দির ঘরে গিয়ে,যাতে ঘুরে ঘুরে সবশেষে বাড়ি ফেরা যায়,এই কদিনেরই তো যা ছুট কড়া নিয়ম অনুশাসন থেকে।সবশেষে বোকাসোকা এই মেয়েটার জন্য পাশাপাশি বিল্ডিংয়ের বয়জ সেকশনের নেমন্তন্ন করার কার্ডটাই বাকী পড়েছিল।

দু পাশে দু তরফের স্কুল বাড়ির মাঝখানে বিশাল এক মাঠ।সেই মাঠের মাঝখানেই নেমন্তন্ন সেরে গুটি গুটি পায়ে ফেরার পথে প্রথম বার পেছন থেকে হাতে গুঁজে দিয়েছিল একটা শক্ত কাগজের খাম।চেনা হাতের প্রথম স্পর্শে শরীরটা তিরতির করে উঠেছিল সেদিন কিশোরী মেয়েটার।মুচকি হেসে লজ্জায় লাল হয়ে একছুটে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন।ফিরেই রোজ ‘মা খেতে দাও’ চিৎকারে বাড়ি মাথায় করা মেয়েটা সব খিদে তৃষ্ণা ভুলে চিলেকোঠায় গিয়ে আগে ঘেমে যাওয়া মুঠোর ভেতর খুব সাবধানে আগলে রাখা খাম টা খুলেছিল।ভেতরে ছিল একটা জলকাগজে মোড়া নতুন লিপস্টিক আর একটা ছোট্ট চিরকুট যাতে লেখা, “কোনোদিন তো পরিস না,প্লিজ সরস্বতী পুজোর দিন পরে আসিস।”

টুকানের দরজায় টোকায় হুশ ফিরল মোনার।সেদিনের চিলেকোঠার সিঁড়ি তে বসা কিশোরীর উথাল পাথাল নিঃশ্বাস ততক্ষণে টাইম মেশিনে চেপে সংক্রামিত করেছে এখনের লালনীল মোনাকেও।মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল মোনা,একদম আবার সেই পরিচিত মোনা।প্রতি মুহূর্তে রঙ বদলানো এখন বাঁ হাতের খেল মোনার,এই রঙ বদলের খেলাতেই তো পেট চলছে,রঙিন জীবন,রঙিন ঘর,রঙিন ঠোঁট।অভ্যস্ত হাতে দরজা আধখানা ফাঁক করে একটা কোমরের পেছন থেকে পার্স বের করে একশো টাকার নোট ধরিয়ে বলল,

– ‘চটপট একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে নিয়ে আয়,মাল পুরো বেহুঁশ,লটকে পরে আছে বিছানায়,হেঁটে ফিরতে পারবেনা,তোর দায়িত্ব কাঁধে করে দিয়ে আসবি বাড়ি অবধি,কাজটা যেন ঠিকঠাক হয়।’

-সে কি গো,এই তো ঢুকল এক গোছা টাকা দিয়ে,মাল্লু আছে গো ভালো,মালদার পার্টি।পুরো মুরগী করেছে ওস্তাদ।এর মধ্যেই আউট!যা বাবা! আমি তো ভাবলাম তুমি ডেকে পাঠালে বাকী রাত থাকবে,তাই খাবার দাবার পাঠাতে।

-ফালতু বকওয়াশ না করে ফোট জলদি।যেটা বললাম সেটা কর।আর তোর ওস্তাদকে কিছু বলার দরকার নেই।যা ফোট।

– এই দেখোনা হাতড়ে আরো কিছু মাল্লু পাও কিনা!পুরো তো লাট মনে হচ্ছে,বাড়িই বা কোথায় বলবে কি করে,কি করে দিয়ে আসবো!

-তুই গেলি!শালা!শুয়ার, যেটুকু বললাম সেটুকু করে উদ্ধার কর,অ্যাড্রেস আমি লিখে দিচ্ছি,তুই ভাগ জলদি।কিরে ফোট!

শেকল ঝোলানো আধখানা দরজার ফাঁকা দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারা টুকান কে চোখ পাকিয়ে এক ধমক লাগাতেই মোনা সে পাঁইপাঁই করে চম্পট দিল।দরজায় ছিটকিনি দিয়ে মোনা আবার খাটে এসে বসল,বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির শব্দ,ঘরে ফ্যান ঘুরছে বোঁ বোঁ করে এই শীতেও।লোকটা পরে পরে ঘুমোচ্ছে চিত হয়ে শার্টের বোতাম খুলে।মুখ থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ।এসেই ঝাপসা চোখে দু চারটে অস্পষ্ট শব্দ বলতে না বলতেই খাটে ধপাস শব্দ করে পড়ে

গেছিল,সেই থেকে ঘাম দিচ্ছে সমানে,আর চুপচাপ মরার মতো পরে আছে।গলা অবধি গিলে এসেছে একেবারে।

মোনা গ্লাসে অল্প হুইস্কি ঢেলেছিল কিছুক্ষণ আগেই,লোকটা ঢুকতে সেই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,আর মুখেই ঠেকানো হয় নি।উঠে গিয়ে গ্লাস টা হাতে তুলে র হুইস্কি টাই ঢকঢক করে গিলে নিল একবারে।ভেতরটা জ্বলে গেল যেন নাভী অবধি।ব্রা এর হুকটা আলগা করে খোলা পিঠে চূড়ো করে বাঁধা চুলটা ছেড়ে দিল।তারপর বিছানায় পড়ে থাকা শরীরটার কাছে গিয়ে মুখটা তুলে ধরে লোকটার মোটা গোঁফের নীচে নিজের টকটকে লাল রঙে রাঙানো ঠোঁট দুটো চেপে ধরতে গিয়েও হঠাৎ ঘেন্নায় সরিয়ে নিল,ছিঁটকে গেল ড্রেসিং টেবিলের কাছে,গা টা গুলিয়ে উঠল।হাতের নীচে আবার পুরোনো টিনের বাক্সটার ছোঁয়া অনুভব করে মনে পড়ে গেল সব।বাক্স টা খুলে,অনেক পুরোনো ফালতু অপ্রয়োজনীয় জিনিসের ডাঁই থেকে খুঁজে বের করল সেই জলকাগজে মোড়ানো লিপস্টিক টা,যেই লিপস্টিক টা কোনোদিনও পরা হয় নি সেই মেয়েটার।তার আগেই মেয়েটার বেস্ট ফ্রেন্ড এসে জানিয়েছিল,সরস্বতী পুজোতেই তারা দুজন ঘুরতে বেরোচ্ছে একলা,একান্তে,নির্জনে,এমনকি ঠোঁটে কাটা দাগ দেখিয়েও দাবী করেছিল তার প্রথম চুম্বনের চিহ্ন বলে।সেদিনও বড্ড ঘেন্না হয়েছিল,বমি পেয়েছিল,ছুটে বাড়ি চলে এসেছিল তাড়াতাড়ি।আর কোনোদিন সেই লিপস্টিক পরা হয় নি মেয়েটার।কোনোদিন লিপস্টিক না পরা

না সাজগোজ করা মেয়েটা আর সাজনি সত্যিই,কোনো সরস্বতী পুজোয় না,কক্ষণো না।তারপর ভাগ্যের ফেরে সেজেছে যে,চড়া রঙে ঠোঁট রাঙিয়েছে যে সে মোনা,সে মানসী নয়,সেই কিশোরী নয়।

জলকাগজের মোড়ক খুলে বিছানায় পরে থাকা লোকটার বোতাম খোলা শার্টের বুকে গাঢ় করে একটা ঠোঁট এঁকে দিল যে সে বোধহয় মোনা নয়,মানসী।কারণ তার চোখ দুটো টকটকে লাল,উপহার পাওয়া ঐ লাল লিপস্টিকের থেকেও বেশী,বোধহয় ১৫ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বেস্ট ফ্রেন্ডকে দেওয়ার মতো সঠিক উপহার টা এতদিনে দিতে পেরেই।লিপস্টিক টা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে, মনে মনে ভাবলো, আস্ত যে মানুষটার শরীর টা পরে আছে নিস্তেজ হয়ে,সে পুরোটাই আজ তার জিম্মায়,চাইলেই এঁটো করে এই শরীর টাকেই ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারতো সে আজ কিন্তু না,বরং ভিক্ষায় ফেরত যাক এই লোকটার সতীত্ব।শুধু লিপস্টিকের দাগটুকু সন্দেহের বীজ পুঁতে দিক ওদের সুখী সুখী সংসারে।

স্বামীর জন্য অপেক্ষারত মহিলার চোখ শুধু রাস্তার দিকে।হঠাৎ ই ট্যাক্সি থেকে কাঁধে করে নামিয়ে দিয়ে গেছে লোকটাকে বাড়ির গেটে,বউয়ের কাঁধে ভর দিয়ে যেতে গিয়ে শার্টের বোতাম খুলে জলজল করে উঠল গাঢ় লিপস্টিকের দাগ,বউটার চোখ তখন লালচে হতে শুরু করেছে সবে,যদিও সে জানে না,এ উপহার টা ঠিক কতটা পুরোনো কাছের বন্ধুর থেকে পাওয়া,আর হয়তো কোনোদিনও জানবেও না।

লিপস্টিক পরতে বড্ড ভালোবাসে মোনা।ওদিকে খুব স্বস্তিতে চড়া করে লাল রঙে ঠোঁট রাঙায় ততক্ষণে পরের কাস্টমারের জন্য!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত