সে

সে

আমার ছোট মেয়ের গলায় মাছের কাঁটা ফুটেছিল।

মাছের কাঁটা যে এমন যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার তা জানা ছিল না। বেচারি ক্রমাগত কাঁদছে। কিছুক্ষণ পরপর বমি করছে, হেঁচকি উঠছে। চোখ-মুখ ফুলে একাকার। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।

অনেক ধরনের লৌকিক চিকিৎসা করানো হলো। শুকনো ভাতের দলা গেলানো, মধু খাওয়ানো, গলায় সেঁক। এক পর্যায়ে আমাদের কাজের মেয়েটি বলল, একটা বিড়াল এনে তার পায়ে ধরলে কাটা চলে যাবে। গ্রামদেশে নাকি এইভাবে গলার কাঁটা দূর করা হয়।

বিপদে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। হাতের কাছে বেড়াল থাকলে হয়তোবা বেড়াল চিকিৎসাও করাতাম। ডাক্তারের কথা একবারও মনে হয়নি। কারণ মনে হলেও লাভ হতো না। আটচল্লিশ ঘণ্টার হরতাল চলছে। ঢাকা শহর অচল। পুলিশের সঙ্গে জনতার কিছু কিছু খণ্ডসংঘর্ষ হচ্ছে বলেও খবর আসছে। দুটো পেট্রোল পাম্পে নাকি আগুন লাগানো হয়েছে। কয়েকজন মারাও গেছে। শহরভরতি গুজব। শোনা যাচ্ছে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছে। তিনি তার প্রিয় গলফ সেট বিক্রি করে দিয়েছেন। একটা হেলিকপ্টার নাকি বঙ্গভবনে রেডি অবস্থায় আছে।

এই অবস্থায় মেয়ে কোলে নিয়ে রাস্তায় নামলাম। মেয়ে একটু পর পর কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করছে— বাবা, আমি কি মরে যাচ্ছি?

সাত বছরের মেয়ে এই জাতীয় প্রশ্ন করলে বুক ভেঙে যায়। আমার নিজেরও চোখে পানি এসে গেল।

যখন প্রয়েজন থাকে না তখন মোড়ে মোড়ে ফার্মেসি দেখা যায়। সেইসব ফার্মেসিতে গম্ভীরমুখে ডাক্তার বসে থাকেন। আজ কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কোনো ফার্মেসি খোলা নেই। দুজন ডাক্তারের বাসায় গেলাম— একজন বাসায় ছিলেন না, অন্যজন মেয়েকে না দেখেই বললেন, মেডিক্যালে নিয়ে যান।

মেডিকেলেই নিয়ে যেতাম তবু কেন জানি সাইনবোের্ড দেখে দেখে তৃতীয় একজন ডাক্তার খুঁজে বের করলাম। ইনি তিনতলায় থাকেন। সাইনবোর্ডে লেখা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। গলায় কাঁটা ফোটা নিশ্চয়ই স্ত্রীরোগ নয়, তবু গেলাম যদি কিছু করতে পারেন।

ডাক্তারের নাম হাসনা বানু। ছোটখাটো মানুষ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। ভদ্রমহিলার মধ্যে মাতৃভাব অত্যন্ত প্রবল। একদল মানুষ আছে যাদের দেখলেই আপনজন মনে হয়। প্রথম দর্শনেই তাকে এরকম মনে হলো। তিনি আমার মেয়েকে চেয়ারে বসিয়ে হাঁ করালেন। গলায় টর্চের আলো ফেলে চিমটা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে এক ইঞ্চি লম্বা একটা কাঁটা বের করে ফেললেন। অতি কোমল গলায় বললেন, মামণি ব্যথা কমেছে?

আমার মেয়ে চুপ করে রইল। সে বোধহয় তখনও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না। ডাক্তার হাসনা বানু বললেন, কী মেয়ে, আমার সঙ্গে কথা বলবে না? আমার মেয়ে হেসে ফেলল।

এখন বলল তুমি কী খাবে? আইসক্রিম খাবে? দিই একটু আইসক্রিম?

ভ্যানিলা আইসক্রিম থাকলে খাব। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভ্যানিলা আইসক্রিম আছে।

ভদ্রমহিলার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। আমি তাকে চিকিৎসার জন্যে কিছু টাকা দিতে গেলাম, তিনি শান্ত গলায় বললেন, ডাক্তারি যখন করি তখন চিকিৎসার টাকা তো নেই, কিন্তু তাই বলে বাচ্চা একটা মেয়ের গলার কাঁটা বের করারও ফি দাবি করব এটা কী করে ভাবলেন? কাঁটাটা বের করার পর আপনার মেয়ের হাসি আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন। এই হাসির দাম লক্ষ টাকা। তা-ই না?

মিসেস হাসনা বানুর সঙ্গে এই হচ্ছে আমার পরিচয়ের সূত্র। পরিচয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তিনি নিউক্লিয়ার মেডিসিন গবেষণায় একটি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন যে গল্পটি বলব সেটি তার কাছ থেকে শোনা। যেভাবে শুনেছি অবিকল সেইভাবে গল্পটি বলার চেষ্টা করছি—

মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বেরুবার পরপর আমি একটা ক্লিনিকে চাকরি নিই। এখন যেমন চারদিকে ক্লিনিকের ছড়াছড়ি, তখন তেমন ছিল না। অল্প কয়েকটা ক্লিনিক ছিল— সবই মাতৃসদন। আমি যে ক্লিনিকে চাকরি নিই সেটা সেই সময়ের খুব নামী ক্লিনিক। ধনী পরিবারের মারাই শুধু আসতেন। সুযোগ-সুবিধা ভালো ছিল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম ক্লিনিক। সর্বসাকুল্যে পনেরোটা বেড ছিল। দশটি এ ক্যাটাগরির, পাঁচটি বি ক্যাটাগরির। এ ক্যাটাগরির ঘরগুলিতে এয়ারকুলার বসানো ছিল। আমরা ডাক্তার ছিলাম তিনজন। প্রধান ডাক্তার মেডিক্যাল কলেজের একজন অধ্যাপক। আমি এবং নাসিমা আমরা দুজন সদ্য পাস করা ডাক্তার। অবিশ্যি সব কাজ আমরা দুজনই দেখতাম। যেহেতু ছোট্ট ক্লিনিক আমাদের কোনো অসুবিধা হতো না। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের ক্লিনিকে আঠারো-উনিশ বছরের একটি মেয়ে ভরতি হলো। প্রথম মা হতে যাচ্ছে। ভয়ে অস্থির। আমি প্রাথমিক পরীক্ষা করে দেখলাম এখনও অনেক দেরি। একেকটা কনট্রেকসানের ভেতর গ্যাপ অনেক বেশি। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, ভয়ের কিছু নেই।

মেয়েটি করুণ গলায় বলল, তুমি তো বাচ্চা মেয়ে। তুমি পারবে? তুমি জান সবকিছু?

আমি হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতেই বললাম, আমি বাচ্চা নই, তা ছাড়া আমি একজন খুব ভালো ডাক্তার। আপনার কোনো ভয় নেই। আমি ছাড়াও এখানে ডাক্তার আছেন। একজন প্রফেসর আছেন। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে দেখবেন।

রুগিণী বললেন, ভাই তোমাকে তুমি করে বলেছি বলে রাগ করনি তো?

না।

আমার এমন বদভ্যাস, যাকে পছন্দ হয় তাকেই তুমি বলে ফেলি।

আমি কাগজপত্র ঠিকঠাক করার জন্য ভদ্রমহিলার স্বামীকে নিয়ে অফিসে চলে এলাম। দেখা গেল খুবই ক্ষমতাবান পরিবারের বউ। সাতআটটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হোমড়া-চোমড়া ধরনের কিছু মানুষ বিরক্তমুখে হাঁটাহাঁটি করছে। একজন অতি বিরক্ত গলায় বলছে, আপনাদের ব্যবস্থা তো মোটেই ভালো না। ইমার্জেন্সি হলে পেশেন্টকে আপনারা কী করবেন? এখানে কি অপারেশন করার ব্যবস্থা আছে?

জী আছে।

আপনাদের নিজস্ব জেনারেটর আছে? ধরুন হঠাৎ যদি ইলেকট্রিসিটি চলে যায় তখন? তখন কী করবেন? মোমবাতি জ্বালিয়ে তো নিশ্চয়ই অপারেশন হবে না?

লোকগুলি আমাদের বিরক্ত করে মারল। দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক বললেন, আপনাদের এখান থেকে আমরা বেশকিছু টেলিফোন করব। দয়া করে বিরক্ত হবেন না। সব পেমেন্ট করা। মানি উইল নট বি এ প্রবলেম।

রুগিণী ভরতি হয়েছেন বিকেলে, রাত নটা বাজার আগেই স্রোতের মতো মানুষ আসতে লাগল। অনেকের হাতে ফুলের গুচ্ছ, অনেকের হাতে উপহারের প্যাকেট। বিশ্রী অবস্থা।

আমি সহজে ধৈর্য হারাই না। আমারও শেষ পর্যন্ত মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম, আপনারা কী শুরু করেছেন? এটাকে একটা বাজার বানিয়ে ফেলেছেন। দয়া করে ভিড় পাতলা করুন। একজন শুধু থাকুন। ডেলিভারি হোক তখন আসবেন।

আমার কথায় একজন ভদ্রমহিলা, সম্ভবত মেয়ের শাশুড়ি হবেন— চোখ-মুখ লাল করে বললেন, আপনি কি জানেন এই মেয়ে কোন বাড়ির TU?

আমি বললাম, আমি জানি না। আমি জানতেও চাই না। সে আমার পেশেন্ট এইটুকু শুধু জানি। আর দশটা পেশেন্টকে আমি যেভাবে দেখব তাকেও একইভাবে দেখা হবে।

আর দশটা বউ এবং আমার ঘরের বউ এক? আমার কাছে এক। জান, আমি এই মুহূর্তে তোমার চাকরি খেতে পারি।

আমি শীতল গলায় বললাম, আপনি আমার চাকরি খেতে পারেন না। চিকিৎসক হিসেবে আমার কোনো ব্যর্থতা পাওয়া গেলে তবেই চাকরি যেতে পারে, তার আগে নয়। আপনি শুধু-শুধুই চাচামেচি করছেন।

ভদ্রমহিলা রেগে গিয়ে স্কাউনড্রেল, লোফার এইসব বলতে লাগলেন। একজন ভদ্রমহিলা এমন কুৎসিত ভাষায় কথা বলতে পারেন আমার জানা ছিল না। বিরাট হইচই বেধে গেল। আমাদের প্রফেসর এলেন। ভেবেছিলাম তিনি আমার পক্ষে কথা বলবেন। তা বললেন না। আমার ওপর অসম্ভব রেগে গেলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে সবার সামনে উঁচু গলায় বললেন-~–হাসনা, তোমাকে এখানে চাকরি করতে হবে না। ইউ ক্যান লিভ।

আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমার প্রফেসর জানেন কত আগ্রহ, কত যত্ন নিয়ে আমি এখানে কাজ করি; অথচ তিনি…

আমি রিকশা নিয়ে বাসায় চলে এলাম। সহজে আমার চোখে পানি আসে না। কিন্তু রিকশায় ফিরবার পথে খুব কাঁদলাম। তখন বয়স অল্প। মন ছিল খুব স্পর্শকাতর।

রাত এগারোটায় প্রফেসর আমাকে নিতে এলেন। করুণ গলায় বললেন, হাসনা খুব কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। তুমি চলে আসার পর ক্লিনিকের কেউ কোনো কাজ করছে না। অসহযোগ আন্দোলন। এরকম যে দাঁড়াবে কল্পনাও করিনি। এখন তুমি চলল।

আমি বললাম, স্যার আমার যাবার প্রশ্নই ওঠে না। আপনি রুগীর আত্মীয়দের বলুন তাকে অন্য কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যেতে।

বলেছিলাম। পেশেন্ট যাবে না। সে এইখানেই থাকবে।

এইখানেই থাকবে?

হ্যাঁ, এইখানেই থাকবে। এবং সে বলে দিয়েছে ডেলিভারির সময় তুমি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকতে পারবে না। এখন তুমি যদি না যাও আমার খুব মুশকিল হবে। আমি খুব বিপদে পড়ব। তুমি তো বাইরের জগতের কোনো খোঁজখবর রাখ না। যদি রাখতে তা হলে বুঝতে এই মেয়ে কোন পরিবারের মেয়ে। বাংলাদেশের মতো দেশে এরা যা ইচ্ছা করতে পারে। তুমি চলো।

স্যার, আমি যাব না। ওরা যা ইচ্ছা করুক।

হাসনা, অন্য সবকিছু বাদ দাও। তুমি পেশেন্টের দিকে তাকাও। সে তোমার ওপর নির্ভর করে আছে। আমার ওপর তোমার রাগটা বড়, না পেশেন্টের প্রতি তোমার দায়িত্ব বড়?

আমি শালগায়ে বের হয়ে এলাম। ক্লিনিকে তখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ওয়েটিংরুমে তিনজন শুধু বসে আছেন। রুগিণীর কাছে দুজন— একজন রুগিণীর শাশুড়ি। তিনি আমাকে দেখেই শীতল গলায় বললেন, রাগের মাথায় কী বলেছি কিছু মনে রেখো না মা। রাগ উঠলে আমার মাথা ঠিক থাকে না।

আমি বললাম, আমি কিছু মনে রাখিনি।

বউমা তখন থেকে বলছিল, সে তোমাকে যেন কী বলতে চায়। তুমি ওর কথাটা শোনো। ও খুব ভয় পেয়েছে।

 

দুই.

আমি মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়ালাম।

মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনারা ঘর থেকে যান মা। আমি ওর সঙ্গে একা কথা বলব। আর কেউ যেন না থাকে।

ভদ্রমহিলা দুজন নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে ঘর ছেড়ে গেলেন। মেয়েটা বলল, ভাই তুমি দরজাটা বন্ধ করে দাও।

তার কি দরকার আছে? আছে। তুমি লক করো। তোমার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা, দরজা বন্ধ করে তুমি আমার পাশে এসে বসো।

আমি তা-ই করলাম। কনট্রেশানের সময় কমে এসেছে। ব্যথার ধকল সামলাতে মেয়েটির খুবই কষ্ট হচ্ছে। তার গলার স্বর পালটে গেছে। মনে হচ্ছে সে অনেকদূর থেকে কথা বলছে। সে আমার হাত ধরে বলল, ভাই তোমার কি রাগ কমেছে?

হ্যাঁ কমেছে।

তুমি আমার গায়ে হাত দিয়ে বলো যে তোমার রাগ কমেছে।

আমি তার কপালে হাত রেখে বললাম, আমার রাগ কমেছে।

আমি তোমাকে তুমি তুমি করে বলছি বলে রাগ করছ না তো? তুমি নিশ্চয়ই বয়সে আমার বড়।

আমি মোটেই রাগ করিনি।

আমি সবাইকেই তুমি তুমি বলি না। যাদের আমার খুব প্রিয় মনে হয়, খুব আপন মনে হয় তাদের আমি তুমি বলি। তোমাকে প্রথম দেখেই আমার ভালো লেগেছে। তুমিও কিন্তু আমাকে তুমি বলবে।

কথা বলতে তোমার কষ্ট হচ্ছে, তুমি বরং চুপ করে থাকো। বড় বড় করে নিশ্বাস নাও। আমার মনে হয় তোমার প্লাসেন্টা ভাঙতে শুরু করেছে।

আর কত দেরি?

এখনও দেরি আছে। রাত তিনটার আগে কিছু হবে না। রাত তিনটা পর্যন্ত তোমাকে কষ্ট করতে হবে।

এখন কটা বাজে?

বারোটা একুশ।

মনে হচ্ছে ঘড়ি চলছেই না।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিছু রুটিনকাজ আছে। এগুলি সারতে হবে। নরমাল ডেলিভারির জন্য বাচ্চার পজিশন ঠিক আছে। তবু ইমার্জেন্সির জন্যে তৈরি থাকা ভালো।

মেয়েটি বলল, যেজন্যে তোমাকে বসিয়েছিলাম তা এখনও বলিনি। তুমি বসো। উঠে দাঁড়ালে কেন? আসল কথা তো বলিনি।

আমি বসলাম।

মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, ওরা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে।

আমি চমকে উঠলাম। এই মেয়ে এসব কী বলছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবোল-তাবোল বকছে না তো?

আমি জানি ওরা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে।

কারা?

আমার শ্বশুরবাড়ির লোকরা। ডাক্তার, নার্স সবাইকে টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছে। তোমাকেও কিনবে। তারপর বাচ্চাটাকে মারবে।

তুমি এসব কী বলছ?

যা সত্যি আমি তা-ই বলছি।

ওরা বাচ্চাকে মারবে কেন?

মেয়েটি জবাব দিল না। ব্যথার প্রবল ঝাঁপটা সামলাবার চেষ্টা করল। আমি তাকে সময় দিলাম। আমার মনে হলো মেয়েটা সম্ভবত পুরোপুরি সুস্থ নয়। হয়তো কিছু অস্বাভাবিকতা তার মধ্যে আছে।

তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না। তাই না?

না।

যা সত্যি তা আমি বললাম।

তুমি জানলে কী করে ওরা বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চায়?

আমাকে বলেছে।

কে বলেছে?

আমার বাচ্চাটা আমাকে বলেছে।

আমি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হলাম মেয়েটার মাথা খারাপ। সম্ভবত সে পারিবারিক জীবনে খুব অসুখী। শ্বশুরবাড়ির কাউকে তার পছন্দ না। সবাইকেই সে শত্রুপক্ষ ধরে নিয়েছে। মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তুমি আমার কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করনি, তাই না?

তুমি ঠিকই ধরেছ। বিশ্বাস করার কথা না। তোমার বাচ্চা তোমাকে কী করে বলবে।

ও আমাকে স্বপ্নে বলেছে। একবার না, অসংখ্যবার বলেছে।

স্বপ্নে বলেছে?

হ্যাঁ স্বপ্নে। গতকাল শেষরাতেও স্বপ্নে দেখেছি।

কী দেখেছ?

দেখলাম আমার বাচ্চাটা আমাকে বলছে— মা সবাই মিলে আমাকে মেরে ফেলবে। সবাই যুক্তি করে আমাকে মারবে। মা, আমি কী করি?

বলতে বলতে মেয়েটি থরথর করে কাঁপতে লাগল।

আমি তাকে বললাম, প্রথমবার যেসব মেয়ে কনসিভ করে তাদের প্রায় সবাই ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখে। যেমন— তারা মারা যাচ্ছে, মৃত বাচ্চা হচ্ছে— এইসব। এর কোনো মানে নেই। মেয়েরা সেই সময় খুব আতঙ্কগ্রস্ত থাকে বলেই এরকম স্বপ্ন দেখে।

আমি জানি আমি যা স্বপ্নে দেখেছি তা-ই হবে, আমার স্বপ্ন অন্য মেয়েদের স্বপ্নের মতো নয়। সবাই যুক্তি করে আমার ছেলেটাকে মারবে।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোমার কোলে যখন ফুটফুটে একটা বাচ্চা দিয়ে দেব, তখন তুমি বুঝবে যে কত বড় মিথ্যা সন্দেহ তোমার মধ্যে ছিল।

মেয়েটার চোখ চিকচিক করতে লাগল। সে গাঢ় স্বরে বলল, সত্যি তুমি তা-ই করবে?

অবশ্যই!

তাহলে তুমি প্রতিজ্ঞা করো। কোরান শরিফ ছুঁয়ে বলো তুমি বাচ্চাটাকে মারবে না। ওরা যখন মারতে চাইবে তুমি মারতে দেবে না।

তুমি ফেরাবে।

একটা শিশুকে আমি খুন করব এটা তুমি বলছ?

তুমি কোরান শরিফ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো। প্রতিজ্ঞার কোনো দরকার নেই।

দরকার থাকুক বা না-থাকুক তুমি প্রতিজ্ঞা করো।

কোরান শরিফ এখানে পাব কোথায়?

আমার সঙ্গে আছে। আমার ঐ কালো ব্যাগটার ভেতর। আমি নিয়ে এসেছি।

রুগীকে শান্ত করার জন্যেই প্রতিজ্ঞা করতে হলো। রুগী শান্ত হলো। তার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। সে চাপাগলায় বলল, আমি জানি তুমি প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবে না। যদি না রাখ তাহলে আমার অভিশাপ লাগবে। আমি তোমাকে একটা কঠিন অভিশাপ দিচ্ছি।

মেয়েটি সত্যি সত্যি একটা কঠিন অভিশাপ দিয়ে বসল। মেয়েটার মাথার যে ঠিক নেই, সে যে অসুস্থ একটি মেয়ে তার আরেকটি প্রমাণ পেলাম। তবে তার এই অসুস্থতা, এই মানসিক যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। একটি হাসিখুশি শিশু তার সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।

সবকিছুই ঠিকঠাকমতো চলছিল।

রাত দুটায় বাইরের দুজন পুরুষ-ডাক্তার এলেন। ডেলিভারির সময় এঁরা থাকবেন। এঁদের মধ্যে একজন আমার পরিচিত। ডাক্তার সেন। বড় ডাক্তার এবং ভালো ডাক্তার।

আমাদের রুগিণী নতুন ডাক্তার দুজন দেখেই আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, এরা কারা? এরা আমার বাচ্চাকে খুন করবে।

আমি বললাম, তুমি নিশ্চিত থাকে। আমি সারাক্ষণ এখানে থাকব। এক সেকেন্ডের জন্যে নড়ব না। তাছাড়া ডাক্তার সেনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁর মতো ডাক্তার কম আছে।

মনে থাকে যেন তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ।

আমার মনে আছে।

প্রতিজ্ঞা ভাঙলে আমার অভিশাপ লাগবে।

আমার মনে আছে।

তার কিছুক্ষণ পরই ভদ্রমহিলার স্বামী আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। খুবই অল্প বয়স্ক একজন যুবক। তাঁকে বেশ দ্র ও বিনয়ী মনে হলো। তবে যে কোনো কারণেই হোক তাকে বেশ ভীত বলে মনে হচ্ছিল। ভদ্রলোক নরম স্বরে বললেন, আপা, আমার স্ত্রী সম্ভবত আপনাকে কিছু বলেছে। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। ও এসব কেন যে বলছে কিছু বুঝতে পারছি না। আমাদের বাচ্চাটা সংসারের প্রথম সন্তান। আমি আমাদের পরিবারের বড় ছেলে। অথচ ওর ধারণা…

আমি ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, আপনি এসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাবেন না।

সব ঠিকঠাক আছে তো আপা?

সব ঠিক আছে।

সিজারিয়ান লাগবে না?

নরম্যাল ডেলিভারি হবে। তাছাড়া ডাক্তার সেন এসেছেন। উনি খুবই বড় ডাক্তার এবং হাইলি স্কিলড।

তাহলে আপনি বলছেন সব ঠিকঠাক হবে?

হ্যাঁ।

রাত তিনটার পর থেকে দেখা গেল সব কেমন বেঠিক চলছে। বাচ্চা নেমে এসেছে বার্থ চ্যানেলের মুখে। এই সময় ডাক্তার সেন বললেন, বাচ্চার পজিশন তো ঠিক নেই। মাথা উপরের দিকে। এতক্ষণ তোমরা কী মনিটর করেছ?

আমিও দেখলাম তাই। এরকম হওয়ার কথা নয়। কিছুক্ষণ আগেই সব পরীক্ষা করা হয়েছে। আমরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে লাগল। এই সময় এত রক্তপাতের কারণই নেই। টকটকে লাল রঙের রক্ত যা ধমনি থেকে আসছে। সমস্যাটা কোথায়?

রাড ক্রস ম্যাচিং করা ছিল—–রক্ত দেয়া শুরু হলো, কিন্তু এটা সমস্যার কোনো সমাধান নয়। মনে হলো রুগিণী বাইরের রক্ত ঠিক গ্রহণ করতে পারছে না।

ডাক্তার সেন গম্ভীর গলায় বললেন, সামথিং ইজ ভেরি রং।

আমাদের সবার গা দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ডাক্তার এসব কী বলছেন!

কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দিল–হঠাৎ করে কনট্রেকশান বন্ধ হয়ে গেল। অথচ এই সময়ই কনট্রেকশান সবচে বেশি প্রয়েজন। শিশুটি কি বার্থ চ্যানেলে মারা গেছে?

রুগিণী ফিসফিস করে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

ডাক্তার সেন ফোরসেপ ডেলিভারির প্রস্তুতি নিলেন আর তখন ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আজকাল বাতি চলে গেলেই ইমার্জেন্সি বাতি জ্বলে ওঠে, তখনকার অবস্থা তা ছিল না। তবে আমাদের কাছে টর্চ, হ্যাজাক, মোমবাতি সবসময় থাকে। সমস্যার সময় ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়–কাজেই প্রস্তুতি থাকবেই। দ্রুত হ্যাজাক জ্বালানো হলো।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরিশ্রম করে ডাক্তার সেন ডেলিভারি করালেন–যে জিনিসটি বেরিয়ে এল, আমরা চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।

কুৎসিত কদাকার একটা কিছু যার দিকে তাকানো যায় না। এ আর যা-ই হোক, মানবশিশু নয়। চেনাজানা পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। ঘন কৃষ্ণবর্ণের একতাল মাংসপিণ্ড। এর থেকে হাতির শুড়ের মতো আট-দশটি খুঁড় বেরিয়ে এসেছে। শুড়গুলি বড় হচ্ছে এবং ছোট হচ্ছে। তালে তালে মাংসপিণ্ডটিও বড়ছোট হচ্ছে। মানবশিশুর সঙ্গে এর একটিমাত্র মিল— এই জিনিসটিরও দুটি বড় বড় চোখ আছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখছে চারদিকের পৃথিবীকে। চোখ দুটি সুন্দর। কাজলটানা।

ডাক্তার সেন হতভম্ব গলায় বললেন, হোয়াট ইজ দিস? হোয়াই ইজ দিস? ফোরসেপ দিয়ে ধরা জন্তুটাকে তিনি মাটিতে ফেলে দিলেন। মেঝেতে সে কিলবিল করতে লাগল। মনে হচ্ছে শুড়গুলিকে পায়ের মতো ব্যবহার করে সে এগুতে চাচ্ছে। আমার সঙ্গের সহকর্মী হঠাৎ পেটে হাত দিয়ে বমি করতে শুরু করল।

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে রুগিণীর জ্ঞান নেই। জ্ঞান থাকলে এই ভয়াবহ দৃশ্য তাকে দেখতে হতো।

ডাক্তার সেন বললেন–কিল ইট। এক্ষুনি এটাকে মেরে ফেলা দরকার।

জন্তটি কি মানুষের কথা বুঝতে পারে? ডাক্তার সেনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র ও তীক্ষ্ণ শব্দ বের হয়ে এল। অত্যন্ত হাই ফ্রিকোয়েন্সি সাউন্ড যা মানুষের স্নায়ুকে প্রচণ্ড ঝাঁকিয়ে দেয়।

ডাক্তার সেন বললেন— অপেক্ষা করছেন কেন? কিল ইট।

জন্তুটি এগুতে শুরু করেছে। শুড়গুলি বড় হচ্ছে, ছোট হচ্ছে আর সে এগুচ্ছে তার মার দিকে। আমরা দেখছি সে মেঝে বেয়ে তার মার খাটের দিকে যাচ্ছে। খাট বেয়ে উপরে উঠছে। আশ্রয় খুঁজছে মার কাছে। যেন সে জেনে গেছে এই অকরুণ পৃথিবীতে একজনই শুধু তাকে পরিত্যাগ করবে না।

ডাক্তার সেন বললেন, আপনারা অপেক্ষা করছেন কেন? কিল ইট।

আবার আগের মতো শব্দ হলো। জম্ভটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাক্তার সেনের দিকে। তার চোখ দুটি মানুষের চোখ। সেই চোখের ভাষা আমরা জানি। সেই চোখ করুণা এবং দয়া ভিক্ষা করছে। কিন্তু করুণা সে আমাদের কাছ থেকে পাবে না। আমরা মানুষ, আমরা আমাদের মাঝে তাকে গ্রহণ করব না। এই ভয়ংকর অসুন্দর ও কুৎসিতকে আমরা আশ্রয় দেব না। সে পশু হয়ে এলে ভিন্ন কথা ছিল। সে পশু হয়ে আসেনি। মানুষের সিঁড়ি বেয়ে এসেছে।

ডাক্তার সেন বললেন, এই জম্ভটিকে যে মেরে ফেলতে হবে এ বিষয়ে কি আপনাদের কারো মনে কোনো দ্বিধা আছে?

আমরা সবাই বললাম না, আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই।

ডাক্তার সেন বললেন, আপনারা কি মনে করেন, এই জম্ভটি হত্যার আগে তার আত্মীয়স্বজনদের মত নেয়া উচিত?

আমরা বললাম না, আমরা তাও মনে করি না।

যে লোহার দণ্ডটি থেকে স্যালাইন ওয়াটারের ব্যাগ ঝুলছিল আমি তা খুলে হাতে নিলাম। জন্তুটি এখন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী সুন্দর বড় বড় শান্ত চোখ! কী আছে ঐ চোখে? ঘৃণা, দুঃখ, হতাশা? জটা খাটের পা বেয়ে অর্ধেক উঠে গিয়েছিল। সেখানেই সে থেমে গেল। বোধহয় বুঝতে পেরেছে আর উঠে লাভ নেই।

প্রথম আঘাতটি করলাম আমি।

সে অবিকল মানুষের মতো গলায় ডাকল— মা, মা।

তার মা সাড়া দিল না।

আমার হাত থেকে লোহার রডটি পড়ে গিয়েছিল। ডাক্তার সেন তা কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। হত্যাকাণ্ডে বেশি সময় লাগল না।

ডাক্তার হাসনা বানুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। এই ঘটনার কী কোনো ব্যাখ্যা আপনি দাঁড় করাতে পারেন?

ডাক্তার হাসনা ক্লান্ত গলায় বলেছিলেন আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই, তবে এই ঘটনার প্রায় সাত বছর পর আমেরিকান জার্নাল অব মেডিক্যাল সোসাইটিতে এরকম একটি শিশুর জন্মবৃত্তান্তের কথা পাই। শিশুটির জন্ম হয়েছিল বলিভিয়ার এক গ্রামে। শিশুটির বর্ণনার সঙ্গে আমাদের জন্তুটির বর্ণনা হুবহু মিলে যায়। ঐ শিশুটিকেও জন্মের কুড়ি মিনিটের মাথায় হত্যা করা হয় এবং রিপোর্ট অনুসারে সেও মৃত্যুর আগে ব্যাকুল হয়ে বলিভিয়ান ভাষায় মাকে কয়েকবার ডাকে।

আপনার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই?

না। তবে আমার একটা হাইপোথিসিস আছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রকৃতি ইভোলিউশন প্রক্রিয়ায় হয়তো নতুন কোনো প্রাণ সৃষ্টির কথা ভাবছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। আমরা প্রাণপণে সেই প্রক্রিয়াকে বাধা দিচ্ছি।

আপনার ধারণা এরকম ঘটনা আরো ঘটবে?

হ্যাঁ। প্রকৃতি সহজে হাল ছাড়ে না। সে চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং সে লক্ষ রাখবে যাতে ভবিষ্যতে আমরা বাধা দিতে না পারি। ঐ যে মা আগে স্বপ্ন দেখলেন তার একটিই ব্যাখ্যা প্রকৃতি শিশুটি রক্ষার চেষ্টা করছে। এ ধরনের প্রোটেকশান দেবার চেষ্টা করছে। এখন সে পারছে না। তবে ভবিষ্যতে সে নিশ্চয়ই আরো কোনো ভালো প্রোটেকশানের ব্যবস্থা করবে।

আপনি কি আপনার হাইপোথিসিস বিশ্বাস করেন? ডাক্তার হাসনা বানু জবাব দিলেন না। তাঁর কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই। জবাব থাকার কথাও নয়। কিছু কিছু সময় আসে যখন আমরা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সীমারেখায় বাস করি। তখন একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাই এবং দেখতে পাই না। বুঝতে পারি এবং বুঝতে পারি না। অনুভব করি এবং অনুভব করি না। সে বড় রহস্যময় সময়।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত