“সকাল সকাল কোন রাজকার্যে ছুটলে শুনি?” – ঠিক বাড়ি থেকে বেরোনোর মুখে আমার রাশভারি বাপের মুখে এই উক্তি শুনে মেজাজটা চটকে গেল | মানুষটা কি কখনও একটু ভালো করে কথা বলতে পারেনা | ওহ!আপনাদের আমার পরিচয়টা দেওয়াই হয়নি | আমি সুকুমার সেন,বিএসসি সেকেন্ড ইয়ার,নেশা ফটোগ্রাফি | আমার পরমপূজণীয় পিতা শ্রী কল্যান সেন আমার জন্যে কখনও কোনও কল্যান করেছিলেন কিনা জানা নেই | সৌমির সাথে দেখা করতে যাওয়ার তাড়াতে বাবার এমন প্রশ্ন শুনে বলেই ফেললাম “টিউশন যাচ্ছি” | লোকটা কি বুঝলো জানি না,আর্কিমিডিসের মত আমার মাথা থেকে পা অবধি লক্ষ্য করে কিছুক্ষন পরে গম্ভীরভাবে বললো “হুমমমম” | বাবাদের এই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই যেন ফেলুদার মগজাস্ত্র লুকিয়ে থাকে | মনে হয় সব কিছু পরিকল্পনা এবার বুঝি বুঝে গেল লোকটা | বেশি কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ‘মিশন সৌমি’র উদ্দেশ্যে |
“কি ব্যাপার এত লেট করলি?শোন বস,আমার সাথে প্রেম করতে গেলে সময়জ্ঞান থাকা দরকার | কতক্ষন অপেক্ষা করে আছি তোর খেয়াল আছে?” – শ্রীমতি ভয়ঙ্করীকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সামলাতে মুখের সামনে কর্নেটো ওয়ালস এগিয়ে দিলাম | আমার বাপকে সামলাতে সামলাতে সৌমিকেও সামলাতে শিখে গেছি | একগাল হেসে মাইয়া তখন বলছে “খালি কর্নেটোটে হবে না বাছাধন,ম্যাক ডিতেও খাওয়াতে হবে” | এরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে কেমন ম্যাক ডির অসহায় জোকারের মত লাগে | সামনে ভ্যালেন্টাইন্স দিবস,পকেটে হাত দিয়ে নিজেকে মিথ্যে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম ‘আল ইস ওয়েল’ বলে | সৌমির আবদার পূরণের জন্যে অনেকগুলো টিউশনি করি এখন | অল্প টাকায় ওর আবদার পূরণ করতে গিয়ে আমার পকেট মাসের শেষে পুরো গড়ের মাঠ | শূন্য গোলপোষ্টের সামনে দাঁড়িয়ে আমি তখন ভাবি “এইভাবে নি:স্ব হতে হতে কোনদিন আমার আর সৌমির রিলেশনশিপটাই না টাইটানিকের মত ডুবে যায়” | সৌমির সাথে ম্যাক ডিটে খেয়ে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম | বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাপ খবরের কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই চেন্নাই এক্সপ্রেসের থাঙ্গাবলির মত গম্ভীরভাবে বললো “হয়ে গেল টিউশন?” | এই ‘বাপ’ প্রজাতিকে দেখলেই কেমন যেন ঈশ্বরের দেওয়া ‘সিসিটিভি’ মনে হয় আমার | সবসময় যেন বিগ বসের নজরের মত প্রচ্ছন্নভাবে বুঝিয়ে চলেছে ‘দিস এরিয়া ইস আন্ডার সিসিটিভি সারভিলেন্স’ |
আমার মনে হল ভাইজানের মত বলি “মুঝপে এক এহসান কার কে মুঝপে কোই এহসান না কার” | তবুও নিজেকে সংযত করে বললাম “হ্যাঁ হয়ে গেছে টিউশন” | কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে তারপর আবার বললো “তোমার মা তোমার জন্যে লুচি,আলুরদম রান্না করে রেখে গেছে | ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নিও” | মায়ের হাতের লুচি,আলুরদম শুনে আমার দিল তখন গার্ডেন গার্ডেন হয়ে গেছে | তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে লুচি আলুরদম খেতে বসলাম | ভাগ্যিস মা ছিল নাহলে এই মানুষটাকে হয়তো অন্য কোনও মহিলা বিয়েই করতো না | আমার বাপ যে কি চিজ,তা জানে জগদীশ | খেতে বসেও শান্তি নেই আবার সেই ভাঙা রেকর্ড বেজে উঠলো “পড়াশোনা কেমন চলছে?আমার রিটায়ারমেন্টের আর ৫ বছর আছে | এর মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে নাও” | উফফফফ! এই মানুষটা একটা কথা এতবার বলে কানের পোকা নাড়িয়ে দেয় যে কোই মিল গ্যায়াতে রাকেশ রোশন এনাকে পেলে জাদুর ভূমিকার জন্যে এনাকেই নিতেন বোধহয় | এই মানুষটার কাছে সূর্যের দিকে চেয়ে ‘ধূপ,ধূপ’ করা এমন কিছু ব্যাপার না | লুচি আলুরদমের থালা সরিয়ে উঠে পড়লাম | মানুষটা তখনও ভাবলেশহীন হয়ে ইজি চেয়ারে বসে আছে |
পরেরদিন সাত তাড়াতাড়ি কলেজ বেড়িয়ে খেয়াল হল আজ আকাশের মুখ ভার | রেনকোট আনতে ভুলে গেছি | সৌমিকে ফোন করলাম “আমার জন্যে একটা ছাতা আনিস,বাড়ি থেকে বেরনোর সময় খেয়াল ছিল না একদম” | সৌমি শুনলাম বেড়িয়ে গেছে বাড়ি থেকে | অগত্যা কলেজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম | কলেজের পরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে | সৌমিকে বললাম “আমাকে অন্তত বাস স্টপ অবধি ছেড়ে দিবি?” | সৌমি দেখি মুখ বেঁকিয়ে বললো “আজ হবে না বস,ফ্যামিলি গেট টুগেদার আছে আজ,আমার সেজকাকু ইউএস থেকে আসছে,তুই একটু ম্যানেজ করে নে সোনা” | ব্যাগ খুলে কলেজের খাতাটা রাখতে গিয়ে দেখলাম রেনকোটটা ব্যাগেই পড়ে আছে | ‘থ্যাঙ্ক গড’ বলে রেনকোট চাপিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম | ঘরে ঢুকতেই মা বললো “মুড়ি আলুর চপ রেখেছি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়” | এখানেও লোকটা আমার পিছু ছাড়েনা | আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো “তোমার ছেলে যেভাবে পড়াশোনা করছে কিছুদিন পর বেকার ভাতা পেয়ে নিজেই চপশিল্পে হাতেখড়ি করতে পারবে আর সেটাও না হলে পাড়ার মন্টুকে বলে রিক্সাশ্রীতে ওর নাম নথিভুক্ত করে দেবো” | মা আহা উহু করে আমার ক্ষতে খানিক প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করলো | আমাদের বাপ ছেলের সংঘাতে মায়ের অবস্থা কাহিল |
আগেরদিন সামান্য বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম কলেজ যাওয়ার সময় | রাতের দিকে জ্বরে জর্জরিত অবস্থা আমার | মাথার কাছে হাতড়াতে গিয়ে ক্যালপলটা পেলাম | মা ভাগ্যিস রেখে গেছে | ক্যালপল খেয়ে একটু সুস্থ লাগলো | ঘুম থেকে উঠতেই মা বললো “দাঁড়া গরম জল করে দি,আজ ওয়েদার ভালো না,ঠান্ডা জলে স্নান করতে হবে না” | জ্বরের মুখে কিছুই ভালো লাগছেনা | মা গরম ভাতের সাথে করলা ভাজা দিলো | বাবা দেখি আবার খবরের কাগজের থেকে মুখ না সরিয়েই মাকে বললো “তোমার নবাবপুত্তুরকে বলো আজ কলেজ গিয়ে কাজ নেই এই বৃষ্টিতে | এমনিতেই পড়াশোনার যা ছিরি” | হেড অফিসটাকে কোনমতে নিয়ন্ত্রণে রেখে নিজের ঘরে চলে গেলাম | কাশিটাও বেশ বেড়েছে | একটু কাশির সিরাপ আনতে পারলে ভালো হত | এইসব ভাবতে ভাবতে ক্যালপলের দিকে চোখ পড়তেই দেখি পাশে গ্লাইকোডিন রাখা আছে | মনে মনে মাকে একটা ধন্যবাদ দিলাম |
প্রায় এক সপ্তাহ পরে কলেজ এলাম | এর মধ্যে একদিনও সৌমি নিজের থেকে ফোন করেনি | কথাবার্তা বলার পর বুঝলাম ইউএসের এন আর আই সেজকাকু সৌমির জন্যে ‘পারফেক্ট পাত্রের’ খোঁজ এনেছে | তাই এখন আমি বিদায় নিলে ওর সুবিধা | রাতে ফিরে নিজের ঘরে ডিম লাইট জ্বালিয়ে বসে আছি | মেজাজ একদম ভালো নেই | হঠাৎ দেখি আমার পিতৃদেব আমাকে ডাকতে এলেন | “শরীর ভালো নেই,আমি কিছু খাবো না,তোমরা খেয়ে নাও” – সংক্ষেপে বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করলাম | এই প্রথমবার আমাকে অবাক দিয়ে বাপি বাড়ি যা মারলো বাবা | শান্তস্বরে আমাকে বললো “শরীর না মন ভালো নেই তোর,যে তোকে কোনদিন ভালোবাসেনি তাকে নতুন করে কি হারাবি বল | সৌমি তোকে কোনদিন ভালোবাসেনি না হলে এক সপ্তাহ কলেজ না গেলে অন্তত একবার ফোন করতো | এই জন্যেই তোকে বারবার বলতাম নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা ঠিক কতটা দরকার | শরীরের যত্ন নে বাবা আর এখন বাপ ব্যাটা মিলে খিচুঁড়ি,ডিম অমলেট আর ইলিশ মাছ ভাজা খাবো | এই প্রথম হাত পুঁড়িয়ে তোর জন্যে রান্না করলাম | নিজের প্রথম ব্রেক আপের উদযাপণটা না হয় আমার সাথেই করলি” | এই প্রথম আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম আর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম এমন একজন অভিভাবকসম বন্ধুর জন্যে | বাবারা আসলে সব জানে আর তাইতো আমার মত অকালকুষ্মান্ডুর দু:খকেও জাস্ট হাসতে হাসতে ‘ফিনিশিং অফ ইন স্টাইলে’ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে জানে |
(সমাপ্ত)