অনেকদিন পর আজ বাইরে বের হলাম। শুভ নিলয়রা এতোটা জোর করছিল যে না করতে পারছিলাম না। বিকেল বেলা শুভ রুমে বলল, তুই কি মরে যেতে চাস , মরতে চাইলে সায়ানাইড এনে দেই ধপাস করে মরে যাবি আমরা সবাই মিলে একদিন কান্না কাটি করব । কলেজে একদিন শোকসভা হবে । সবাই কালো ব্যাজ পরবে । কাজ শেষ , তিলে তিলে শেষ করবি কেন । শুভর জোর করাতে বের হলাম । কতদিন পর কাম্পাসের বাইরে কোথায় ঘুরতে যাচ্ছি , ছয় মাস। ছয় মাস কোন আড্ডা কোন কোলাহলে যাই নি । নিজেকে একা করেছি অনেক বেশি একা । সারাদিন একা রুমে শুয়ে থেকেছি , ইচ্ছে হলে ক্লাস করেছি , খেয়েছি ,না খেয়ে থেকেছি । বাইরে বের হতেই মনে হল নিঃশ্বাস টা বন্ধ ছিল এতদিন , বাতাসের গন্ধ ভুলে ছিলাম । সবাই মিলে ফুড পার্কে খেতে বসলাম । শুভ গ্রিল আর নানের অর্ডার করল । ওরা কথা বলেই যাচ্ছে আমি চুপ করে শুনছি । মাঝে মাঝে হু হ্যাঁ করছি । আসলে দীর্ঘদিন চুপচাপ থাকতে থাকতে এমন হয়ে গেছে কোন কিছুতে মন বসাতে পারিনা । এলোমেলো বাতাসের মাঝে নিজেকে খুব ভাসিয়ে দেই , আনমনে গান গাইতে ইচ্ছে হয়, নিজের ভেতরে গুন গুন করি
কেন পিরিতি বারাইলা রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
ক্যামনে রাখিব তোর মন
আমার আপন ঘরে বাঁধি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
কেন পিরিতি বারাইলা রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি।
ফুড পার্কে অর্ডার করলে একটা বাপার হয় ওরা এক ঘণ্টার আগে খাবার দিবে না বসে থাকতে হয় । নিলয় আর শুভ বক বক করে যাচ্ছে । আমি কিছু শুনছি কিছু না । কিছু ক্ষণ পর একটা ছেলে এসে আমাদের সামনে বসল । ছেলেটি আমার পরিচিত না তবে ছেলেটির সাথে যে মেয়েটি এসে বসেছে থাকে দেখে আমার মাথা আর বেশি এলোমেলো হয়ে গেল । আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল , ছয় মাস পর মিতুর সাথে আমার দেখা । মিতুর দিকে আমি তাকিয়ে রইলাম । মিতু আমাকে কি দেখতে পেয়েছে , ওর মধ্যে কোন ভাবলেশ নেই , সে হেসে হেসে ছেলেটির গল্প করে যাচ্ছে । আমি মিতুর দিকে তাকিয়ে আছি । মিতু আগের চেয়ে খানিকটা ফর্সা হয়েছে । মিতু কপালে টিপ পড়েছে । ছয় মাসে একটা মানুষ খুব বেশি বদলায় না । কিন্তু মিতুর সব গুলো পার্থক্য আমি ধরতে পারছি ।মিতু কফি কালারের একটা ড্রেস পরছে তার সাথে হালকা হলুদ ওড়না । মিতুকে এখনো সেই পরীর মত লাগে। মিতু অপরাজিতা ফুল খুব পছন্দ করে , ইশ আমার হাতে যদি একটা অপরাজিতা ফুল থাকত । ছেলেটির দিকে থাকালাম , সুন্দর ফর্সা , স্মার্ট , ঠিক যেমনটি মিতু পছন্দ করত । ছেলেটির পাশে মিতু কে খুব মানিয়েছে । ওরা দুজন বোধহয় খুব সুখী, খুব । আমার মাথাটা খুব ঝিমঝিম করছে , শুভকে বললাম দোস্ত এক মিনিট আমি একটু বাইরে থেকে আসি। আমি ফুড পার্ক থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম । আমার মাথাটা আরও বেশি ঝিমঝিম করছে । মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ নাক দিয়ে কোন নিঃশ্বাস নেই নি ।
আমি মাঠের মধ্যে ঘাসে উপর শুয়ে আছি । লোকালয়ের বাইরে এই মাঠ টাকে আমি খুব পছন্দ করি, এখানে আমি প্রায় আসি, চুপ করে ঘাসের মধ্যে শুয়ে থাকি , আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে । জল গুলো নিবিড় মমতায় ঘাসগুলোকে ছুয়ে দেয়, আমি কান্নার সাথে প্রেমে মজি , কান্না ঘাসের সাথে গভীর প্রেম করে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরা জল্কে তোয়াক্কা না করে আমি খিল খিল করে হাসি । মাথার উপর বিশাল আকাশ টা ছোট হয়ে আসছে । আমি মিতুর মুখটা মনে করার চেষ্টা করছি । মিতুকে বিভিন্ন কোন থেকে দেখছি । হরাইযনটাল মিতু ভারটিকেল মিতু । বিশাল আকাশের ক্যানভাস জুড়ে মিতু কেবল মিতু।
মিতুর সাথে আমার দেখা হয়েছিল একটা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে । পরীক্ষা শেষ, বাসায় চলে যাওয়ার কথা ছিল। হলের প্রায় সবাই চলে গেছে । আশেপাশে কেউ নেই । আমি টিকেট পাইনি । সন্ধায় শামিম ফোন দিল, কিরে মুরগী একা একা করিস । চলে আয় । শামিমের বাসা শহরে । ভাবলাম হলে একা থাকার চেয়ে আড্ডা দিয়ে আসি । শামিমের বাসায় যাওয়ার পর বলল চল , কাজিনের গায়ে হলুদ হচ্ছে , ঘুরে আসি । শামিমের সাথে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে অর চাচার বাসায় গেলাম । সবাই চারপাশে আনন্দ করছে । আমি কোনার দিকে বসে আছি । শামিম কি একটা কাজে বাইরে চলে গেছে । একা একা ভাবছি । শীতের সময় । হঠাৎ একটি মেয়ে আমার সামনে এনে চা রাখল, বলল,
চা খেয়ে নেন , আপনি কত টুকু চিনি খান । জানিনা , দুই চামচ দিয়েছি । আর লাগলে বলবেন । এতো অবাক হচ্ছেন কেন। আমি মিতু শামিম ভাইয়ার কাজিন । আপনি এখানে একা বসে আছেন কেন । বিয়ে বাড়ি আড্ডা দেওয়ার জায়গা, ভিজে বেড়ালের মত বসে থাকার জায়গা না । আপনি বসে থাকেন আমি আসি।
মিতু খিল খিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল । আমি বসে রইলাম । মেয়েটা কত সুন্দর করে হাসে । আমি বারবার সেই হাসি টা মনে করার চেষ্টা করছিলাম । কি মিস্টি , কি সুন্দর হাসি ।
রাতে ১০ টার দিকে হলে ফিরে আসলাম । মিতুর সাথে আর দেখা হয়নি । আমি বাসায় চলে আসলাম । বাসায় এক সপ্তাহের মতো ছিলাম । বার বার আমি একটি হাসি মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম । মুগ্ধ হাসি । মিতুর মুখ টা ভেসে উঠছিল । আশেপাশে , কেবল একটি বাক্য প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল , আমি মিতু , শামিম ভাইয়ের কাজিন ।
বাসা থেকে হলে ফিরে আসলাম । মিতুর কথা বারবার মনে হত । কেউ হাসলে মন হত এঁর চেয়ে অনেক সুন্দর হাসি মিতুর ।
বাসা থেকে ফিরার দশ দিনের মাথায় , আমার ফোনে একটা কল আসল । আমি ধরতেই বলল,
– দীপ্ত ভাইয়া , কেমন আছেন । বলেন তো আমি কে?
– মিতু ( আমি কেমন যেন অবচেতন মন থেকে বললাম )
– আপনি আমাকে চিনলেন কি করে , আমি শামিম ভাইয়ের ফোন থেকে আপনার নাম্বার নিয়েছি । শুনেছি আপনি ভালো আবৃত্তি করেন । আপনার আবৃত্তির পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছি । আপনি অন্য কিছু ভাববেন না । আজকাল কবিতাতে মেয়েরা পটে না । কাক এবং কবির সংখ্যা নিয়মিত বাড়ছে । চুপ করে আছেন কেন । আপনি দেখতেও ভেজা বিড়াল।কথা বলায় ও ভেজা বিড়াল, ।
– আমি মিন মিন করে বললাম , মিতু আমি কাক কবি না , আর শামিম ভুল বলেছে , আমার আবৃত্তি ভালো না ।
– আমি জানতাম আপনার আবৃত্তি ভালো না । আপনার একটা মাত্র গুন আপনি ভালো ছবি আঁকেন । আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হল , আমি মাঝে মাঝে অনেক কাঁদি , সেই দিন আমি অল্প পরিচিত মানুষদের সাথে কথা বলি । অল্প পরিচিত মানুষদের সাথে এলোমেলো কথা বলা যায় । পরিচিতদের সাথে বললে , তারা ভাবে মেয়েটির মাথা খারাপ ।
মিতু ফোন রেখে দিল । আগের বার মিতুর হাসি ভালো লেগেছিল । এবার মিতুর কণ্ঠের প্রতি তীব্রতা বেড়েছে । আগের বার মিতুর কণ্ঠ এতো মধুর শুনায় নি ।
এঁর পর মিতু মাস খানেক আর ফোন দেয় নি । আমি কেমন একটা অপেক্ষা করতাম । কিন্তু ফোন দিতাম না । একদিন ভাবলাম , বাইরে মোবাইল এঁর দোকান থেকে ফোন দিলে কেমন হয় ফোন দিলাম । আমি বাইরের দোকান থেকে ফোন দিলাম। মিতু কি সুন্দর করে বলল হ্যালো । আমি ফোন রেখে দিলাম । আমার ভিতর দিয়ে শান্তির একটা ধারা বয়ে গেল । আমার মনে হল ইশ , এই মুহূর্তটাতে একটা হ্যালো শুনে মনে হচ্ছে , আমি হাপি আমি হাপি , আমার আর কিছু চাইবার নাই । খুব ইচ্ছে হছে মিতুর পাশে গিয়ে বলি , এক কাপ চা করে দাও চিনি দুই চামচ না , তিন চামচ দিবা । আমি ডায়াবেটিস এঁর রুগি না যে বেশি চিনি খেতে পারব না । এটাই কি ভালবাসা, দুর্বার আবেগ
আমি কবিতা আবৃত্তি করছি ,
বিষাদে বিলীন হয় মন , আমি বিষাদের কেউ নই
আমি স্বপ্নের হাতছানি টেনে এনে মনে প্রিয় স্বপ্নে ভাসি
আমি তোমাকেই খুজি প্রিয় তোমাকেই খুজি
তোমার আকাশ প্রিয় আজ দেয় হাতছানি
সেইদিন সন্ধ্যা বেলা আমার মোবাইলে মিতুর ফোন থেকে ফোন আসে । মিতু বলে ,
– দীপ্ত ভাই , আপনি দুপুরে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন । আপনি জানেন না এই সিম থেকে আমি শুধু আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম । অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন দিলে কেউ কথা বলত । আপনি কথা বলেননি । চুপ করে আছেন কেন ।
– আসলে কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল । খুব ইচ্ছে হয়েছিল ।
-আমি বুঝতে পারছি , দীপ্ত ভাইয়া , আপনি বিভ্রমে ডুবে যাচ্ছেন । আপনার বিভ্রম দূর করা দরকার । আপনি কাল আমার সাথে একটু দেখা করবেন
মিতু ফোন রেখে দিল । আমি চুপ হয়ে বসে রইলাম ।
মিতুর মুখোমুখি আমি বসে আছি । মিতুকে একটা পরীর মতো লাগছে । আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে মিতু কে বলি , মিতু তোমার কপালের টিপ টা অনেক সুন্দর হয়েছে । আমি বলতে পারছি না । মিতু নিরবতা ভেঙ্গে বলল ,
– দীপ্ত ভাইয়া , আপনি বোধহয় আমার প্রেমে পড়ে গেছেন । ভয়াবহ রকমের প্রেমে । আপনি এঁর আগে কোন মেয়ের সাথে কথা বলেন নি দেখে আমার প্রতি আপনার এই তীব্রতা তৈরি হয়েছে । আমি আসলে আপনার মতো ছেলেকে পছন্দ করিনা । আপনাকে দেখার পর আমার মধ্যে একটা মোহ তৈরি হয়েছিল । আমি আপনার মতো একটা ভালো মানুষের সাথে দিব্যি সংসার পাতব । টুনটুনির সংসার হবে । কিন্তু আমি আসলে চাই একটা ছেলে যে চটপটে , সবসময় কথা বলবে , স্মার্ট ঠিক আমার মতো । আপনি আসলে আমার টাইপ না । আমি আপনার সাথে হ্যাপি হব না।
দেখতে সুন্দর হবে চেহারায় মায়া মায়া থাকবে । আপনার মতো না ।
মিতু কথা গুলো বলে চলে যায় । আমি আহত দৃষ্টি নিয়ে থাকিয়ে থাকি । মিতু কে দেখে যাই । খুব ইচ্ছে হয় মিতুকে একটা আইস ক্রিম কিনে দেই । বলা হয় না । মিতু চলে যায় ।
আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । মিতুকে খুব সামনে থেকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে । সেদিন মিতু কে হয়ত বলতে পারিনি , আজ বলতে ইচ্ছে হচ্ছে , মিতু আমি হয়ত তোমার টাইপ না । কিন্তু তোমাকে ভালবাসতাম বিশ্বাসে , মিশিয়ে রাখতাম নিঃশ্বাসে, আমার যা ছিল সবটুকু নিংড়ে দিতাম তোমায় । যে আজকে তোমায় শুধু তোমার টাইপ দেখে ভালো বাসবে একদিন তার কাছে তোমার মূল্য কমে আসবে , সে আর মুগ্ধতা নিয়ে তোমার দিকে তাকাবে না ।
আমি বুক পকেটে বিশ টা প্যারাসিটামল নিয়ে এসেছিলাম । মিতুর মুখ আর বেশি করে ভাসছে । আমি মিতু কে ভালোবাসি মিতুর হাসি দেখতে চাই প্রতিনিয়ত । মিতু কে ভালোবাসছি , মিতুর হাসি মুখ দেখতে । আজ মিতু হাসছে । আমি হ্যাপি । আমি আমার স্বপ্ন গুলো পুরনের জন্য উঠে দাঁড়ালাম । একপাশে ছুড়ে দিলাম প্যারাসিটামল । হয়ত আমার একদিন মিতুর সাথে আমার দেখা হবে , বলব , মিতু আমি তোমাকে আজো ভালবাসি , আমি একটা আশ্রম দিয়েছি , যেখানে ২০ টা ছোট বাচ্চা কে আমি ভালবেসে বড় করছি । তারা যখন হাসে তখন আমি তোমার হাসির শব্দ শুনতে পাই ।
মিতু হয়ত এক মুহূর্তের জন্য ভাববে ইশ মানুষ টা আমাকে এখনো খুব ভালো বাসে । আমার মন আনন্দে ভরে যাবে ।
মনটা হঠাৎ করে ভালো হয়ে গেল । সন্ধ্যা নেমে আসল , সন্ধ্যা টা মিতুর হাসির মতো সুন্দর , আমি গুন গুন করে আবৃত্তি করছি ,
মনে হয় দীর্ঘকাল বাক্সের মধ্যে বন্দী ছিলাম বলে প্রিয়তা তোর ঈর্ষার কাছে পরাজিত
আজ মনে হয় কচ্ছপ হই গায়ে খসখসে চামড়া নিয়ে
কোন এক বিলের পাশে গর্তে পড়ে থাকব অবলীলায়
প্রিয়তা আমি তোমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখে যাব ৬০০ বছর
আমার স্বপ্নে তুমি ভিজবে না তবু প্রিয় তুমি যে আমার
(প্রিয়তা কানে কানে একটা গোপন কথা বলি , তোমার ঈর্ষার আগুনে আমি ঠিকই পুড়েছি ,কেবল তুমি টের পাওনি )
উৎসর্গ- আমার বর্ষাকে যার মুখের একটি শব্দ শুনার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি ।
বি- দঃ – প্রায় সময় দেখি প্রিয় মানুষ টা ছেড়ে চলে সবাই সুইসাইড এঁর কথা ভাবে – একটা ব্যাপার কি জানেন যে আপনাকে ছেড়ে অন্য জায়গা নিজেকে সুখী মনে করে তাকে থাকতে দিন । আপনি তাকে আর সুখী করতে পারবেন না । আপনি আপনার চারপাশের মানুষ কে আনন্দ দিন আর এই মানুষ টার সুখ কামনা করুন । কারন আপনি তো চান সে সুখী হউক ।