এক।
সতের জুলাই, উনিশশো একাত্তর।
গ্রামের নাম সোনাইপুর।
ছোট্ট একটি দোচালা ঘর। সামনে একটি উঠোন। বাড়ির একপাশে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি আর অন্যপাশে মাটির রাস্তা।
উঠোনে মাচা টাঙ্গিয়ে সবজি চাষ করা হয়েছে। কবির বাড়ির দরজার চৌকাঠে অনেকক্ষণ ধরে ঠায় বসে আছে। সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। কবিরের পাশে তার ছোট বোন ফাতেমাও চুপচাপ বসে আছে। বৃষ্টিটা আরও একটু হালকা হলে ওঁরা দুই ভাইবোন রাস্তার মাথায় যাবে। বাবা বাড়িতে নাই। লবন আর তেল কিনতে হবে।
কবিরের বয়স দশ আর ফাতেমার ছয়। বয়স কম হলেও ওঁরা জানে, বুঝে লবন আর তেল নাও পাওয়া যেতে পারে। যুদ্ধ মানুষের বয়স বাড়িয়ে দেয়।
বৃষ্টিটা একটু কমে এসেছে। ওঁরা দুইজন খুব সাবধানে ধীরে ধীরে রাস্তায়ে নেমে এল।
“তাড়াতাড়ি ফিরবি আর কোথাও যাবি না।” মায়ের গলা শুনতে পায়।
আধাঘণ্টা লাগল ফিরতে। লবন-তেল দুটোই পাওয়া গেছে। বাড়ির উঠোনে পা দেওয়া মাত্র বাবার গলার স্বর শুনতে পেল। উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। পায়ে কাঁদা নিয়েই ওঁরা ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। মৌলভি লুতফর রাহমান ওদের বাবা। গ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষক। ওঁরা ধরে নিল, নিশ্চয়ই বড় কোন ঝামেলা হয়েছে। সচারাচর মৌলভি সাহেব উচ্চস্বরে কথা বলেন না।
“মিলিটারিরা নালপুর চলে আসছে।” মৌলভি সাহেবের গলা কেঁপে উঠল, “আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব শান্তিকমিটি করবে। মানেটা বুঝতে পারছ? মিলিটারিরা এই গ্রামে আস্তানা গাড়বে!”
“এত চিন্তা করে কী হবে? আল্লাহ যা ভাগ্যে রাখছেন তা-ই হবে।” মৌলভি সাহেবের গিন্নী সহজ সরল ভঙ্গিতে বলে গেলেন, “আপনি ছেলেমেয়েদের নিয়ে গোসল করে আসেন। আমি রান্না শেষ করি।”
গিন্নীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৌলভি সাহেব ছেলেমেয়েদের নিয়ে গোসল করতে গেলেন।
গোসল শেষ করে খেতে বসার পরও মৌলভি সাহেবের মুখভঙ্গির কোন পরিবর্তন ঘটল না। সেটা দেখে গিন্নী বললেন, “এত কিসব ভাবছেন? কিচ্ছু হবে না। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আছে না। দেখবেন ওঁরা একেবারে সোজা হয়ে যাবে।”
সপ্তাহ না ঘুরতেই দেখা গেল সোজা হয়েছে ঠিকই তবে সেটা গ্রামের মাতবর শ্রেণীর লোকেরা যারা হঠাৎ করেই অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি একাত্ততা প্রকাশ করেছে। এলাকার চেয়ারম্যান সাহেব যিনি একই সাথে মাদ্রাসার সুপার তিনি শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান সেজে বসে আছেন। তার নাম মাওলানা আউয়াল মিয়া। সবাই তাকে আউয়াল হুজুর বলে ডাকে।
মাওলানা আউয়াল মিয়া শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান হবার পর দুইবার মৌলভি সাহেবকে তার বাড়িতে যেতে বলেছেন। এমনিতেই আউয়াল সাহেবের সাথে মৌলভি সাহেবের একটা ঠাণ্ডা লড়াই বহু আগে থেকেই আছে, তার উপর মৌলভি সাহেবের দুই ভাই হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে নানান জনের নানান মন্তব্য সামলাতে না পেরে অবশেষে তিনি মাওলানা আউয়াল মিয়ার বাড়িতে গেলেন।
মাওলানা আউয়াল মিয়া মৌলভি সাহেবকে সম্মান দেখালেন। দেশের অরাজাক অবস্থা নিয়ে আলাপ করলেন। আরও বুঝালেন, এই সময় মৌলভি সাহেবের মত মানুষদের খুব প্রয়োজন।
মৌলভি সাহেব যখন হ্যাঁ-না কিছুই বলছিলেন না তখন আউয়াল সাহেব বললেন, “দেখেন নানান লোকে নানান কথা বলে। আপনার ভাইদের নিয়া বলে, তারা নাকি ওই পাড়ে গেছে ট্রেনিং নিতে গেছে। একবার ভাবেন এই কথা যদি মেজর সাহেব জানতে পারেন তাহলে কী হবে?”
মৌলভি সাহেব কোন জবাব দেন নাই। তিনি সরাসরি বাড়ি চলে আসেন।
দুই
কবির আর ফাতেমা বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে কদম গাছের নিচে প্রতিদিনই দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে দেখা যায় অচেনা লোকজন মালপত্র হাতে চলে যাচ্ছে। প্রতিদিনই মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ছোট হলেও ওঁরা বুঝতে পারে এই মানুষগুলো ঘরছাড়া। যে যা পেরেছে সাথে নিয়েছে। খেয়ে না খেয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে রুগ্ন- ক্লান্ত – হাসিহীন মানুষগুলো চলে যাচ্ছে। কোথায়ে যাচ্ছে ওঁরা সেটা জানে না।
একদিন খবর পেল ওদের গ্রামের মানুষগুলো এই যাত্রায় শামিল হয়েছে। নন্দীপাড়ার শ্যামলরা, উত্তরপাড়ার বশীর সবাই চলে যাচ্ছে। মৌলভি সাহেব বলেছেন, তিনি কোথাও যাবেন না।
তিন
মৌলভি সাহেব তার ছেলেমেয়েদের আপাতত মাদ্রাসায় যেতে নিষেধ করেছেন। বাড়িতে সময় কাটে না। তাই ওঁরা রোজ বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজনের চলে যাওয়া দেখে।
একদিন একটি মেয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ মেয়েটি ফাতেমার কাছে এসে বলে, “একটু পানি খাওয়াতে পারবে? সকাল থেকে পানি খাবারও সুযোগ পাইনি।”
কবির আর ফাতেমা মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে। আর তখন ওঁরা প্রথমবারের মত ভাল করে বাচ্চাটিকে দেখতে পেল। অপুষ্টিতে ভুগে শুকিয়ে গেছে। বুকের হাড় দেখা যাচ্ছে। কবির তার মাকে ডাকে, “আম্মা, একটু দুধ আনেন।”
মা ভিতর থেকে উত্তর দেন, “খাবি?”
“না মা, একটা বাচ্চা, ওকে দিব। আপনি দেখে যান। কী সুন্দর! কিন্তু শুকিয়ে গেছে।”
ওদের মা বাচ্চাটার জন্য দুধ আর বাচ্চার মায়ের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করলেন।
মেয়েটি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল, “আপনাদের কষ্ট দিলাম।”
“কষ্ট হবে কেন? কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করব না কেন? আমরাতো সবাই এখন বিপদে আছি।” কবির-ফাতেমার মা কথাটা বলা মাত্রই মেয়েটি ঝরঝর করে কেঁদে উঠল। কবির-ফাতেমার মা মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তোমার কি হয়েছে? আমাকে বলবে?”
“আমার স্বামী সরকারি চাকরি করত। একদিন আর অফিস থেকে ফেরেনি।” মেয়েটি বলে চলল, “প্রতিদিন ভাবি আজ হয়ত কোন খবর পাব, কিন্তু পাই না। তিনদিন আগে মিলিটারিরা আমাদের বাড়ি এল। আমার শ্বশুর বাড়ির সামনে ছিলেন। তাকে দেখামাত্র গুলি করল। শ্বাশুরী এটা দেখে দৌড়ে শ্বশুরের কাছে গেলেন। ওঁরা তাকেও গুলি করল। তিনিও পড়ে গেলেন। এরপরই শয়তানগুলো আমার ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকে …… ।” মেয়েটি কেঁদেই ফেলল। কথা শেষ করতে পারল না। কবির-ফাতেমার মা মেয়েটিকে বুকে চেপে ধরলেন। একটুপর মেয়েটি বলল, “জ্ঞান ফিরলে দেখি আমার ছেলেটা কাঁদছে। তারপর ওকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলাম। দুইদিন পর আজ কিছু খেতে পেলাম।”
কবির-ফাতেমার মা বললেন, “কেঁদো না, তুমি এখানেই থাক।”
“মিলিটারিরা এখানেও আসবে, তার চেয়ে দেখে ওইপাড়ে যেতে পারি কিনা!”
তারপর মেয়েটি এক পা দু পা করতে করতে অনেক মানুষের ভিড়ে এক সময় হারিয়ে গেল।
চার
কিছুদিনের মাঝে গ্রামের সবাই বুজতে পারল মিলিটারিরা যে কোন দিন এই গ্রামে আসবে।
হঠাৎ একরাতে একদল লোক এসে হাজির হয়। ওঁরা মুক্তিযোদ্ধা, মৌলভি সাহেবকে বলল, “আমাদের আজ রাতে একটু থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।” তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা ভোররাতেই চলে যায়। কিন্তু যাবার পথে মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে।
গ্রামে মিলিটারি আসে।
এলাকার চেয়ারম্যান- মাদ্রাসার সুপার হুজুর- শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান মাওলানা আউয়াল মিয়া মিলিটারি নিয়ে মৌলভি সাহেবের বাড়িতে আসেন। মৌলভি সাহেব বাড়ীতেই ছিলেন।
মৌলভি সাহেবকে দেখেই আউয়াল মিয়া বললেন, “তুমি কি বাড়িটাকে হারামীদের আড্ডাখানা বানাইছ?”
সাথে মিলিটারি দেখে মৌলভি সাহেব ভয় পেয়ে যান। তারপর কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, “আপনার কথা কিছুই বুঝি নাই।”
“বুঝবি, একটু পরই সব বুজবি।”
“চেয়ারম্যান সাহেব ভদ্র ভাষায়ে কথা বলেন।”
“তোর মত হারামির সাথে ভদ্র ভাষা কিসের?” বলেই চেয়ারম্যান মাওলানা আউয়াল মিয়া তার সাথে থাকা কিছু রাজাকারদের নির্দেশ দেন মৌলভি সাহেবের বাড়ি সার্চ করতে।
রাগ সামলাতে না পেরে মৌলভি সাহেব বলে উঠেন, “আমি খুব অবাক হলাম যে আপনার মত একজন সুপার হুজুর আমার অনুমতি ছাড়া আমার বাড়ি তল্লাশি করার সাহস কোথা থেকে পান?” মৌলভি সাহেব রাগে থর থর করে কাঁপতে থাকেন, “একজন মুসলমান হয়ে আর একজন মুসলমানের বাড়িতে বিনা অনুমতিতে যে ঢোকা যায় না সেটা আপনি জানেন না?”
“চুপ শয়তান, বেজন্মা কোথাকার!” বলেই সুপার হুজুর মাওলানা আউয়াল মিয়া মিলিটারিদের বুঝিয়ে দেন এই মৌলভিই নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়। সে-ই নাটের গুরু।
এরই মধ্যে এক রাজাকার বাড়ি থেকে বের হয়ে বলল, “না হুজুর বাড়িতে বাইরের কেউ নাই।”
আর তখন মেজর সাহেব বললেন যে ওই শয়তান টাকে রেখে বাকি সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে।
শুনেই সুপার হুজুর মাওলানা আউয়াল মিয়া হো হো করে হেসে উঠল।
মেজরের হুকুম পাওয়া মাত্রই দুই-তিন জন মিলিটারি ধাক্কাতে ধাক্কাতে মৌলভি সাহেবকে উঠানে ফেলে দিল। বুকফাটা চিৎকার করে উঠলেন কবির-ফাতেমার মা। ছুটে মৌলভি সাহেবের দিকে যাবার চেষ্টা করতেই তার দিকে এক মিলিটারি বেয়োনেট ধরল। অসহায় ভাবে কবির-ফাতেমা দেখতে পেল তাদের বাবাকে লাথি মারছে সুপার হুজুর মাওলানা আউয়াল মিয়া।
তারপর মাওলানা আউয়াল মিয়া এক দৌড়ে মৌলভি সাহেবের বাড়ির ভিতরে ঢুকে এক বোতল কেরসিন তেল নিয়ে আসল। এনেই মৌলভি সাহেবের গায়ে ঢেলে দিল। তারপর নিজের হাতে মৌলভি সাহেবের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল। সাথে যে মেজর ছিলেন তিনি তার পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মৌলভি সাহেবের গা থেকে সেটা জ্বালিয়ে একটা টান দিয়েই বললেন, “ফায়ার।”
পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। মৌলভি সাহেব তার পরিবার আর কবির-ফাতেমাকে কিছু বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু সেটা শকুনের পৈশাচিক হাসিতে ঢাকা পড়ে গেল।
কবির-ফাতেমা মা তার ছেলেমেয়েদের চোখে হাত দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এত কিছু তিনি আর সইতে পারলেন না। জ্ঞান হারালেন।