দিন গুলি মোর সোনার খাঁচায়

দিন গুলি মোর সোনার খাঁচায়

প্রথমদিনই জাকির স্যার ক্লাশে এসে সবচেয়ে মজার আর বোধকরি ঐ মুহূর্তের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি করেছিলেন, তোমরা এক এক করে দাড়িঁয়ে পাশের জনের নাম বল।

তারপর শীতল চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেউ কোন কথা বলবে না, কথা বললে সোজা গেট আউট।

আমি মাঝের সারিতে ছিলাম। একজন একজন করে দাড়াঁচ্ছে আর সবাই কৌতুহলী চোখ দিয়ে তাকে দেখছে। কেউ কেউ পারছে, তবে বেশীর ভাগই পারছে না। যখন আমার এলো আমি দাড়িঁয়ে দাড়িঁয়ে ভাবছি কী সর্বনাশ! কেন যে ছেলেটির নাম আগে জানলাম না! ঠিক তখনই আমার হাতের উপর একটি খাতা চলে এল, চোখ নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি, নামঃ রায়হান।

আমি বললাম, স্যার, রায়হান।
এভাবে রায়হানের সাথে পরিচয়। অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধুত্ব। সত্যিই বলতে কি মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে আমরা জানের দোস্ত হয়ে গেলাম।

তখন সবেমাত্র ক্লাশ শুরু হয়েছে।তাই চারদিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, টিএসসিতে প্রতিদিনই কোন না কোন অনুষ্ঠান লেগেই থাকত, নবীনবরন, কবিতা সন্ধ্যা, নাটক নতুবা সফেনের অনুষ্ঠান, কতকিছু!

একদিন দুপুরে আমরা দুজন পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে সোজা টিএসসির দিকে হাঁটা শুরু করি। বেলা তখন আড়াইটা থেকে তিনটা হবে। দুপুরের খাবার খাইনি। পেটে তখন ইদুঁর দৌড়াঁচ্ছে। ইচ্ছে ছিল হলে গিয়ে খাব। হাঁটতে হাঁটতে দশ মিনিটের মাথায় ডাসে চলে এলাম। আমি পা এলিয়ে বসে পড়লাম । রায়হানকে বললাম, দেখ না সিঙ্গাড়া পাওয়া যায় কিনা?

ডাসের সিঙ্গাড়া এমনিতেই বিখ্যাত। রায়হান সিঙ্গাড়া আনতে চলে গেল। কিছুক্ষন পর দেখি সে কাউন্টারে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। মেজাজ আমার বিগড়ে গেল। আরে শালা, আমি ক্ষিধেয় মরি, আর তুই কিনা…..। হন হন করে ওর দিকে হাঁটা দিলাম। কাছে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম। ও ব্যাটা ঐ মেয়ের কামিজের উপর সস ঢেলে দিয়েছে, আর তা-ই নিয়ে ঝগড়া।

কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে আরও বড় ঘটনা ঘটে গেল। ঐ মেয়েও রায়হানের মুখের উপর সস ছুঁড়ে মেরেছে। কী ভয়াবহ ব্যাপার! সস চোখে গেলে যা হয়, রায়হানের চোখ জ্বলতে থাকে।

এ আপনি কী করলেন? আমি রীতিমত হুঙ্কার দিলাম। মেয়েটিও ঘাবড়ে গেল। সে এবার পানি আর টিস্যু পেপার দিয়ে রায়হানের চেহারা পরিষ্কার করতে শুরু করল।

আর এভাবেই আমাদের নতুন বন্ধু সাদিয়ার আবির্ভাব। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমরা সাদিয়ার মারফত আরও দুইবন্ধু পেয়ে যাই। সাদিয়ার ক্লাসমেট আরাফাত আর জাহাঙ্গীরনগরের নুপুর।

আমরা প্রতিদিন ডাসে এসে একত্র হতাম আর একেক দিন ইউনিভার্সিটির একেক দিকে ঘুরতে বের হতাম। প্রতি বৃহষ্পতিবার জাহাঙ্গীরনগর থেকে নুপুর চলে আসত। তখন আড্ডা হতো মূলতঃ নিউমার্কেটের ফাঁকা চত্তরে। ইউনিভার্সিটির এমন কোন জায়গা নেই যে আমরা একত্রে ঘুরিনি!

একদিন আমরা সবাই আড্ডা দিচ্ছি। তারপরও আড্ডা প্রানহীন। কারন, আরাফাত তখনও আসিনি।আলোচনার মোড় ঘুরে গেল, কেন আরাফাত এখনও আসছে না?

-ও শালা, মনে হয় প্রেমে পড়েছে! সাদিয়া যেন বোমা ফাটালো।

আমরাতো অবাক। কয়েকদিন আগেও আরাফাত বলেছিল এ জীবনে সে বিয়েই করবে না। তো সেদিন ধার্য করা হলো পরবর্তী দিন খোঁজ নিতে হবে আরাফাত কোন মেয়ের প্রেমে পড়েছে। যেহেতু সাদিয়া ওর ক্লাসমেট, সেহেতু দায়িত্বটার প্রাথমিক ভার তাকেই নিতেই হবে। তারপর আরাফাতকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে হবে (?)।

পরদিন সকাল ১১ টার দিকে সাদিয়া আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসে হাজির, চল, আরাফাত এইমাত্র আই আর এর দিকে রওনা হয়েছে।

আমি,রায়হান আর সাদিয়া রওনা দিলাম, অপারেশন শয়তানী হঠাও, আরাফাতকে বাচাঁও।

আই আর এর গেটে গিয়ে দেখি আরাফাতের গাড়ি পার্কিং করানো। ব্যাস, এবার সাবধানে ঢুকে পড়লাম। দোতলায় গিয়ে দেখি ওব্যাটা একটা ক্লাশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে বলে উঠল, তোরা এখানে?

-আমাদের ফেলে রেখে তুই ইয়ে করে বেড়াবি আর আমরা বসে বসে আঙ্গুল চুষব।

এরপর শুনলাম এক করুন কাহিনী। সে যেমেয়েকে পছন্দ করেছে সে আই আর এর চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী(?)। কী সর্বনাশ! আমাদের মিশন দেখছি কাজে নামার আগেই সাফল্য পেয়ে গেছে!

পরের বৃহষ্পতিবার নুপুর এলে ওকে পুরো ঘটনা মসলা মিশিয়ে উপস্থাপন করা হলো। অবশেষে আরাফাত আমাদের সঙ্গে একটা আপসরফা করতে রাজী হলো, আজ যদি সে মিডনাইট সান এ খাওয়ায়, তবে আমরা ওর জন্য ফার্স্ট ইয়ারের একটা সুন্দর মেয়ে খুঁজে বের করব (?)।

এভাবেই আমাদের সময় কেটে যেতে থাকে। ভাবতেও অবাক লাগে মাত্র দেড়-দুমাসের মধ্যে আমরা পাঁচজন কত ঘনিষ্ঠই না ছিলাম। আমরা (নুপুর বাদে) প্রায় প্রতিদিনই রাত ৯ টা পর্যন্ত একত্রে থাকতাম।

একদিন খুব ভোরে আরাফাত এসে হাজির। চল, আশুলিয়া যাব।
কী আশ্চর্য! এত সকালে কেউ আশুলিয়া যায় না কি!
অবশেষে আমি আর রায়হান তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে বের হলাম। রোকেয়া হল থেকে সাদিয়াকে তুলে নিয়ে সাভার যাত্রা শুরু করলাম।

জাহাঙ্গীরনগর থেকে নুপুরকে তুলে নিয়ে সোজা আশুলিয়া যাত্রা শুরু হলো। দুপুরের আগেই সেখান থেকে রওনা দিলাম। কিছুদূর আসার পরই ভাগ্য খারাপ, আরাফাতের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। শেষমেষ সবাই মিলে ঠেলা শুরু করলাম। আমরা পাঁচজন ছেলেমেয়ে একত্রে গাড়ি ঠেলছি আর আশেপাশের লোকজন চোখ বড় বড় করে দেখছে।

যেভাবে আমাদের বন্ধুত্ব হঠাৎ করেই তৈরী হয়েছিল সেভাবেই একদিন শেষ হয়ে গেল। একদিন ভোরে হলে ফোন এলো রায়হানকে গ্রামে যেতে হবে। রায়হান সেদিনই বাড়ী চলে গেল। পরদিন খবর এলো রায়হানকে সাপে কেটেছে। খবর পাওয়ামাত্র আমি,আরাফাত সাতক্ষীরা রওনা দিলাম। দুরত্ব বেশী বলে সাদিয়াকে বাদ দিলাম। গিয়ে দেখি সব শেষ। আমি ভাবতেও পারছিলাম না কোথা থেকে কী হয়ে গেল!

চারদিন পর ঢাকা চলে আসি। রায়হানের জন্য আমাদের মন তখনও অশান্ত, ঠিক তখনই সাদিয়ার বিয়ে ঠিক হয় ইংল্যান্ডের এক প্রবাসী বাঙ্গালীর সঙ্গে। একমাসের মধ্যে বিয়ে,পাসপোর্ট, ভিসা সব হয়ে গেল।

সাদিয়া চলে যাবার পর আরাফাতের সঙ্গে দেখা হওয়া অনিয়মিত হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন শুনি সে ভর্তি বাতিল করে নর্থ-সাউথে চলে গেছে।

আমি আবার একা হয়ে গেলাম। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন স্কুলের বন্ধু আলাউদ্দিন বলল, সে খুলনায় ভর্তি পরীক্ষা দিবে।আমি যেন ওর সঙ্গে সেখানে একটু ভর্তি পরীক্ষা দেই। তো চলে গেলাম ভর্তি পরীক্ষা দিতে। রেজাল্ট বের হলে দেখি আমার ফার্মেসিতে হয়ে গেছি। তারপর ইয়ার গ্যাপ দিয়ে সেখানেই চলে গেলাম।

এখনও আরাফাতের সাথে কথা হয়, সাদিয়ার কিউট দুই ছেলে মেয়ে, সে এখন কানাডাতে, নুপুর অস্ট্রেলিয়াতে।

এখনও মনে পড়ে সেই দিনগুলি, ডাসের আড্ডা, নিউমার্কেটের ফুসকা খাওয়া, আরাফাতের জন্য উদ্ধার কর্মসূচী প্রনয়ন করা। সবই আছে, সেই ডাস, নিউমার্কেট, আরাফাতের গাড়ি। নেই শুধু সেই সময়, মন আর সুন্দর মানুষগুলি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত