প্রেম প্রীতির পত্র

প্রেম প্রীতির পত্র

প্রেম এক অসাধারণ অনুভূতি।সেই অনুভূতি ,আবেগ যখন কালি আর কাগজে সংস্পর্শে ভাষায় প্রকাশ পায় তখন তার রূপ হয় আরো দর্শনীয়। তাই তো যুগে যুগে প্রযুক্তি এগিয়ে গেলেও প্রেমেতে প্রেমপত্রের মিষ্টতা চিরঅমর…

…অসীমাদেবী মেয়ের পড়ার টেবিল পরিস্কার করতে গিয়ে হঠাৎ একটি চিঠি কুড়িয়ে পেলেন।যা দেখে ওনার তো চক্ষু চড়কগাছ। মেয়ে প্রেম করছে!! কোন এক অভিষেক তার মেয়ে প্রীতিকে চিঠি লিখেছে কাব্যি করে।বাড়ির গিন্নীদের রাগ হলে সেই রাগ দেখানোর সবচেয়ে বড় যে জায়গা উনিও সেখানেই রাগ দেখালেন।আপনমনে বই পড়তে থাকা আশোকবাবু হঠাৎ চমকে উঠলেন অতর্কিত এরকম আক্রমণের মুখে।কিছু না বলে উনি কেবল সুবোধ বালকের ন্যায় শুনতে লাগলেন

—দাও দাও মেয়েকে আরো স্বাধীনতা দাও, যা চাহিদা সব মিটিয়ে দাও, যা খুশি করতে দাও দিয়ে উচ্ছন্নে পাঠাও। যেদিন বড় কোন কিছু হবে সেদিন বুঝবে মেয়েকে প্রশ্রয় দেওয়ার ফল।

কী, কেন কিছুই বুঝতে না পারা হতভম্ব অশোকবাবু এবার অসীমাদেবীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে রসিকতা করে বলে উঠলেন
— হে দেবী এহেন রণচন্ডী মূর্তির হেতু কী?
— ঢং না করে এই দেখো তোমার মেয়ের কান্ড, মেয়ে প্রেম করছে!!
চিঠিটা নিয়ে তাড়িঘড়ি অশোকবাবু পড়তে শুরু করলেন

প্রীতি,
সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকে কেমন যেন ঘোরে আছি বুঝলে! কবিতা পাচ্ছে আজকাল, প্রিয় গানগুলোই মনটা সারাদিন গুনগুন করছে, রঙবেরঙের শাড়িতে তোমায় দেখছি, দেখছি প্রজাপতিগুলো উড়ে এসে তোমার চুলে বসছে!যেন মনে হচ্ছে মন আজ বসন্তের আলিঙ্গনে আবদ্ধ।বলতে পারবে এমনটা কেন হচ্ছে? আমিতো সারাদিন ঘুমাই না। তবে এগুলো কি হচ্ছে?

সেদিনের মতো আরো একটা বিকেল কি আসবে না? যেখানে তুমি আমি আর তোমার সেই লজ্জা! যে লজ্জা তোমার কপালে আসা চুলটা আমি সরাতে গেলে একটা মিথ্যে বাধা তো দেবে কিন্তু মনটা বলবে দাওনা চুলটা সরিয়ে ওই চুল ওই কপাল তোমার হাতের স্পর্শ চাইছে! তারপর ধরো সেদিনের মতোই বাড়ি ফেরার সময় একপশলা বৃষ্টিটা আবার নামবে। একটা ছাতায় তুমি আমি আর বৃষ্টির ছোট ফোটাগুলো আমাদের স্পর্শ করে বলবে হাতটা ধর, আরো একটু কাছাকাছি এসে একে অন্যের শ্বাসটা অনুভব কর।
‘চলো প্রীতি কাল বিকেলে দেখা করি’ …

প্রীতিকে প্রীতিবন্দি করে প্রীতির সাথে প্রীতির স্রোতে ভেসে যাওয়ার জন্য প্রীতির থেকে কিছু সময় কি পাবে না প্রীতিপ্রার্থী এই মানুষটি?

আমি জানি তুমি আসবে। অপেক্ষায় থাকবো…
ইতি
ভালোবাসার অভিষেক

— বাঃ বাঃ চমৎকার লেখার হাত ছেলের!অল্পকথায় আবেগটা সুন্দর প্রকাশ করেছে।বেশ রোম্যান্টিকও বটে। আর একটা জিনিস ভাবো এই ইন্টারনেটের যুগেও ছেলে চিঠি লিখেছে, প্রেমপত্র!বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!!
অসীমাদেবীর রাগটা এমনিই দাউদাউ করে জ্বলছিলো। অশোকবাবুর মন্তব্য তাতে ঘি সংযোগ করে। যার ফলস্বরূপ

— ছিঃ ছিঃ মেয়ে প্রেম করছে আর বাবা তাতে মদত দিচ্ছে। কেমন বাবা তুমি যে দায়িত্ব নিয়ে নিজের মেয়ের ভবিষ্যত নষ্ট করছে, আজ আসুক প্রীতি ঘরে দেখাচ্ছি মজা …
অসীমা দেবী বলেই চললেন।
বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অশোকবাবু উঠে গেলেন ধীরেধীরে।
— কী আজব মানুষ তুমি? কিছু না বলে উঠে যাচ্ছো যে!!
অসীমাদেবী চুপ করার পাত্রী নন।ওনার চোখে মুখে বিরক্তি ঝরে পরছে।

… অশোকবাবু আলমারিটা খুলে একটি বাক্স নিয়ে এসে অসীমাদেবীর সামনে খুললেন। যার মধ্যে আছে বেশ কিছু পুরানো কাগজপত্র। তারপর একটি কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন

প্রিয়
অশোক

জানো সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকে আমাদের ওই দেখা হওয়াটাই মনে পরছে। ভালো সময়গুলো বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় কেন বলতে পারবে? সেদিনের ওই দেড়ঘন্টা মনে হলো যেন শুধু পাঁচ মিনিট।এখন আমি চোখটা বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি তোমার ওই পাঞ্জাবির একটা বোতাম খোলা, এলোমেলো চুল, মুখে অল্প দাড়ি আর তোমার সেই মিষ্টি হাসিটা। জানো ভাবনাটা আরো একটু গভীর হলে তোমার মুখ থেকে আসা সিগারেটের গন্ধটাও পাই। তবে এসবের মাঝেও ভয়টা সবসময় জড়িয়ে ধরছে। কলেজ তো শেষের মুখে এবার বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হবে।এদের কাছে কিছু বলা বৃথা। এরা কোন পরিস্থিতিতেই মানবে না এই সম্পর্ক।তুমিতো জানো প্রেমটা এদের কাছে মারাত্মক অপরাধ। এরা এত কেন অবুঝ বলতে পারো…

অশোক বাবু পড়েই চললেন। এই চিঠিটার শেষে আরো একটা চিঠি।
অসীমাদেবী কিছুটা লজ্জায় কিছুটা সংকোচে ছোট্ট বাধ্য মেয়ের মতো মাথা হেঁট করে শুনছেন অশোকবাবুর পত্রপাঠ।

চিঠিগুলো পড়া শেষ করে অশোকবাবু
— দেখো অসীমা প্রতিটা চিঠির শেষে লেখা ইতি, তোমার ভালোবাসার অসীমা কিংবা তোমার প্রেমিকা অসীমা।
অসীমাদেবী কেবল শুনেই চলেছেন।

— অসীমা বিয়ের আগে আমাদের ছয় বছরের প্রেম সেখানে আমরা উভয়ে উভয়কে অন্তত ৭৫-৮০টা করে চিঠি দিয়েছে বা পেয়েছি।সেটা তখন ঠিক ছিলো আর আজ তোমার মেয়েকে কেউ চিঠি দিয়েছে সেটা ভুল? তখন আমাদের প্রেমে তোমার বাড়ির লোক মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করায় তুমিই বলেছিলে কিছু না জেনে প্রেম খুব খারাপ বলাটা ভুল,অন্যায় আর আজ তুমি মা হয়ে গিয়ে নিজেই সেই ভুলটা করছো? আজ তুমি কিছু না জেনেই বাধা দিচ্ছো!! এখন তুমি ভুল নও? আগে জানো ছেলেটার সম্পর্কে তারপর নাহয় বিচার করবে…।

… অনেকটা সময় কেটে গেছে মাঝে। অসীমাদেবী বাধা দেয়নি প্রীতিকে। খোঁজ নিয়ে উনি জেনেছেন অভিষেক বা তার পরিবার বেশ ভালো।তাই উনি আশ্বস্ত। যদিও প্রীতি আর অভিষেকের সম্পর্কটা শেষ একমাস হলো ভেঙে গেছে।ছেলে মেয়েদুটো চাপা স্বভাবের তাই কেউ কিছুই টের পায়নি যদিও দুজনই গুমরে মরছে ভিতর ভিতর।
মায়েদের অদ্ভুত এক শক্তি আছে, ছেলে বা মেয়ে যতই অভিনয় করুক মায়েরা ঠিক বুঝতেই পারে আসল ব্যাপারটা। অসীমাদেবীরও চোখ এড়িয়ে যায়নি প্রীতির লুকনো চোখের জল।

… সেদিন কোন একটা কাজে প্রীতি বাইরে গিয়েছিলো বাড়ি ফিরে ও একদম হতচকিত! ও বিশ্বাসই করতে পারছে না ও যা দেখছে তা কি সত্যি? অভিষেক ওর বাড়িতে ওর মা- বাবার সাথে বসে।

— অভিমানটা বেশী ওরই হয়েছিলো, ওর ইগো-রাগ দুটোই খুব বেশী! হঠাৎ কী এমন হলো যে অভিষেক একদম বাড়ি চলে এলো?

এইসব ভাবতে ভাবতে বিস্ময়ের ঘোরটা কিছুতেই কাটছেনা প্রীতির।
লজ্জায় সঙ্কোচে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো প্রীতি।
— এই তো এসেছে মা আমার
আশোকবাবুর সম্বোধন প্রীতিকে আরো লজ্জায় ফেলে দেয়।
যদিও লজ্জাটা কাটিয়ে সোজাসাপটা প্রীতি প্রশ্নটা মনে চেপে রাখতে না পেরে
— সব ঠিক আছে কিন্তু এসব হলো কীভাবে?
অভিষেকের দিকেই ছুটে যায় প্রশ্নটা।
— আমি নিমিত্ত! যা জানার তোমার মায়ের থেকেই জানো সহাস্য অভিষেকের জবাব।
এবার অসীমা দেবী শুরু করলেন
— আমিতো তোর মা তাই তোর আনন্দ দুঃখ কোন কিছুই চোখ এড়িয়ে যায় না আমার। তুমি যে প্রেম করছো সে টের বহু আগেই আমি পেয়েছি।
লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় প্রীতির।

অসীমা দেবী বলেই চললেন তুই যে মনে মনে শেষ একমাস ভালো নেই সেটা দেখেই বুঝেছি। তো ভাবলাম কী কারণ হতে পারে তখনই ধারনা হলো সম্ভবত তোদের মধ্যে অশান্তি হয়েছে।এখন সমস্যা হলো প্রেমপত্রে আবেগ আর অনুভূতিরা এতটা বেশী জায়গা দখল করে নেয় যে ঠিকানাগুলোর আর কোন জায়গাই থাকে না। আমি লুকিয়ে তোদের প্রেমপত্র হাতড়ে দেখলাম যদি অভিষেকের কোন ঠিকানা পাওয়া যায় কিন্তু সে গুড়ে বালি। কোথাও কিছু নেই। অগত্যা যোগাযোগ করলাম তোর বান্ধবী দিয়ার সাথে। মেয়ে কিছুতেই বলবে না কিছু এক কথা ‘আন্টি আমি জানি না কিছু’ তারপর একটু ধমক দিতে গড়গড় করে বলে দিলো অভিষেকের ঠিকানা।মেয়ের মা হয়ে মেয়ের প্রেমিকের বাড়ি যাওয়াটা বড্ড নির্লজ্জতা হয়ে যায় না? তাই কী করবো যখন ভাবছি তোর বাবাই পরামর্শ দিলো। তোর পত্রপ্রেমী প্রেমিককে একখানা চিঠি লেখার।আইডিয়াটা মনেও ধরলো লিখে ফেললাম

চিঠিখানা। আবারও সেই দিয়ার হাত দিয়েই পৌঁছে দিলাম অভিষেকের কাছে। অল্প প্রশ্রয় আর অল্প ধমকি ‘তুমি না এলে অন্যকিছু ভাবতে হবে আমাদের’ সহ্য করতে না পেরে আমার কথা মতো বেচারা এসে গেছে আজ ঝগড়া মেটাতে।

অসীমাদেবীর কথাটা শেষ হতেই সবাই জোরে হেসে ওঠে একসাথে…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত