এক
আজ তিথিকে আমাদের এই ক্যা্ম্পাসে দেখবো কখনই ভাবিনি। দূর থেকে তাকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেখেছি। তাকে হুট করে দেখে অনেক অবাক হয়েছি। তবে তার মুখে লেগে আছে পূরোনো দিনের সেই মিষ্টি হাসিটা। যেটা দেখে আমি হারিয়ে গেছিলাম কল্পনার রাজ্যে।
কিন্তু তিথি এখানে কেনো? ওর তো এখানে মানে, এই কলেজে থাকার বা আসার কথা না। তবে আমি কি তার সামনে যাবো? না থাক, কী মুখ নিয়ে যাবো আমি তার সামনে? কিসের অধিকারে যাবো, আমি ওর সামনে? অনেক আগেই তো হারিয়েছি সে সব কিছু। হারিয়েছি তাকে।
হারিয়েছি সব অধিকার। এর থেকে বরং দূর থেকেই তাকে দেখি।
হয়ত তাকে দূর থেকে দেখলে কষ্ট হবে। কারণ, ভালোবাসার মানুষকে সামনে পেয়েও যদি কথা না বলার, বা কাছ থেকে দেখার সুযোগ না থাকে তবে সেটা অনেক কষ্টের হয়। কিন্তু আমি যে সত্যিই তার কাছে যাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছি।
– কীরে দোস্ত কী দেখিস? (রাফি)
– কিছু না… চল বাসায় যাবো। (আমি)
হুট করেই রাফির ডাকে কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছিলাম। হয়ত মনোযোগ দিয়ে তিথিকে দেখছিলাম তাই আরকি।
– কেনো রে? প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস আছে চল ঐটা করে আসি। (রাফি)
– নাহ, ভালো লাগছে না। তাহলে তুই কর আমি গেলাম।
– আরে শোন…
আর কোনো কথা না বলেই চলে আসলাম রাফির থেকে। ক্যামপাস থেকে বের হওয়ার সময় তিথিকে আবার আড়চোখে দেখে নিলাম। সে বন্ধুদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।
বাড়িতে এসে কিছুই ভালো লাগছে না। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছি আর ভাবছি তিথির কথা। সেই পূরোনো হাসি, সেই মিষ্টি মনমাতানো হাসির শব্দ। তার খিলখিল হাসিতে যেন মুক্ত ঝরে পড়তো। আমি বারবার হারিয়ে যেতাম তিথির হাসিতে। হারিয়ে যেতাম উদাস দুপুরে তাকে নিয়ে কল্পনাতে। মিশে যেতে ইচ্ছে করতো তার মায়াতে।
কিন্তু তিথি কেন আমাদের কলেজে? ব্যাপারটা আসলেই কেমন লাগছে। তবে এতদিন কেন সে এখানে আসেনি বুঝতে পারছি না…
পরেনদিন কলেজের ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছি, তখনি তিথি সহ ওর কয়েকজন বান্ধবিরা ক্যান্টিনে প্রবেশ করে। আর ঠিক বসে আমার থেকে দূরে পাশের টেবিলে।
– কী দেখিস মাম্মা? (রাফি)
তিথিকে আবারো দেখছি আমি। তবে তিথি আমাকে দেখেনি এখনো। তখনি রাফির ডাকে বাস্তবে ফিরলাম।
– নাহ কিছু না।
– মামা বুঝিতো, ভাল্লাগছে তাই না?
রাফি আমার তাকনোর দিকে লক্ষ্য করে কথাটি বললো
– আরে না… চল এখান থেকে।
– মাম্মা বলো, কোনো ব্যাপার না, আমি সব ঠিক করে দিবো।
–
রাফিকে জোর করেই সেখান থেকে নিয়ে আসলাম। ক্লাস না করেই বাড়িতে চলে এলাম। মনে মনে হেসে উঠলাম রাফির কথা মনে করে,,সে আর কি ব্যবস্থা করবে। ব্যবস্থা তো অনেক আগেই হয়ে গেছে। তবে আজ বড্ড মনে পড়ছে পূরোনো দিনের কথা। মনে পড়ছে সেই..
“পূরোনো অবহমান স্মৃতিগুলো। যে স্মৃতি আমাকে আজো এলোমেলো করে দিচ্ছে নিত্যদিন।
(পূরোনো স্মৃতির মাঝে হারিয়ে গেলাম)
– তিথি তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
তিথি যখন সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো তখনি ওর সামনে যেয়ে কথাটি বললাম।
– হা বল। (তিথি)
– উমম, নাহ আজ থাক অন্য একদিন।
– তোর কি হল রে? কয়েকদিন ধরেই দেখছি তোকে কেমন আপসেট লাগছে।
– আরে না কিছুই হয়নি… চল ফুসকা খাই।
তিথিকে ওখান থেকে নিয়ে চলে আসলাম। তখন আমরা অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। একই ক্লাসে পড়াতে আমরা বন্ধু হইয়ে গেছিলাম একে অপরের।
– কি হল সিয়াম। (তিথি)
– নাহ কিছু না ফুসকা খা।
– কিছু বলবি নাকি আমাকে?
– নাহ
আজ তিথিকে ছমাস ধরে ভালোবাসি বলবো কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছি না। আসলে ভয়ে পারছি না, যদি সে না করে দেয়? তিথি ফুসকা খাচ্ছে আর আমি দাঁড়িয়ে দেখছি তাকে। কেমন যেন আকর্ষনীয় মনে হচ্ছে ব্যাপারটা।
– চল বাসায় যায়। (তিথি)
– হুমম বিলটা দিই।
তিন
তিথিকে আমি সত্যিই ভালোবাসি। বন্ধুত্বের মাঝে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। কিন্তু কেন যে তাকে বলতে পারছি না। যাইহোক কাল বলতেই হবে। এখন ঘুমায়।
(পরেরদিন)
– তিথি তোর সাথে কিছু কথা আছে রে।
– ইডিয়ট রোজ বলিস কথা আছে কিন্তু ডেকে নিয়ে যেয়ে কিছুই বলিস না।
– আজই বলবো আই!
(তিথিকে সবার সামনে থেকে নিয়ে আসলাম)
– কি হল বল… (তিথি)
(একটু চুপ থেকে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম)
– জানিনা ভালোবাসার মানে কি। ভালোবাসাটা কিভাবে হয়। তবে মনে হয় কিছু ভালোবাসা হুট করেই আসে, যেটা তোর প্রতি আমার এসেছে।
– মান।। (খুব অবাক হয়ে)
– মানে হল তোকে আমি ভালোবাসি তিথি।
কিছুক্ষণ নিরাবতা, তিথির মুখে অবাক হওয়ার আভা ফুটে উঠেছে। আর আমি ওর দিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করছি ওর রিএকশনটা কেমন হবে?
– ঠাসস… তোকে আমি বন্ধুত্বের চোখে দেখতাম। আর তুই কিনা বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে আমাকে ভালোবাসলি? তোকে আলাদা ভাবতাম আর তুই কিনা… যা আমার সামনে থেকে, আর কখনো যেন তোকে না দেখি।
সেদিন আমি আর কোনো কথা না বলেই চলে এসেছিলাম ওর সামনে থেকে। এমনকি কলেজটাও চেন্জ করে চলে এসেছি এখানে আজ দুই বছর হল। এতদিনে সিম চেন্জ করেছি। কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখিনি। আমি চাই না কেউ আমার জন্য কষ্ট পাক। কিন্তু তিথি এখানে কেনো? আবারও কি তার জন্য আমার সবকিছু পাল্টাতে হবে? সে কি বুঝতে পারে না তাকে দেখলেই আমার সব অনুভুতিরা সঙ্গ ছেড়ে দেয়। তখন যে সব এলোমেলো হয়ে পড়ি।
চার
পরেরদিন ক্লাস করে সিড়ি দিয়ে যখন নামছি, তখনি-
– কেমন আছিস? (তিথি)
হুট করেই তিথি আমার সামনে এসে কথাটি বললো… যেটা আমি একদমই আশা করিনি। কারণ, সেই ঘটনার পর না আমি কোনোদিন তিথির সামনে গেছি, না ও এসেছে।
– কি হল বলিস না কেনো কেমন আছিস?
– হুমম ভালো…
– হুম সেটা তো আজ কয়েকদিন ধরেই দেখছি, তা আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবি না?
তিথির কথা শুনে আমি আরো অবাক হলাম। কারণ, কয়েকদিন ধরে সে দেখছে মানে? তাহলে সে কি সেই প্রথম দিন থেকেই আমাকে দেখছে? আমিও তো লুকিয়ে দেখেছি তবে সেও কি দেখেছে তেমনি ভাবে?
– ঐ চল কোথাও বসে কথা বলি।
কেমন যেন সম্মোহন এর মধ্যে পড়ে গেলাম আমি। বুকের মধ্যে কেমন ঢিপঢিপ শুরু হয়ে গেছে। কোনো কথা ঠিক ভাবে বলার চেষ্টা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। তখনি তিথি হাত ধরে নিয়ে গেলো কাশফুল ঘেরা এয়ারপোর্ট এর মধ্যে।
দুজনে বসে আছি এক জায়গায়। তবে মাঝে দুরুত্বটা অনেক বেশি। চুপচাপ প্রকৃতি দেখছি। তখনি তিথি বললো-
– তোর গার্লফ্রেন্ড কেমন আছে?
প্রশ্নটা শুনে ওর দিকে তাকালাম। বলে কি ও? আমার গার্লফ্রেন্ড কেমন আছে নাকি? ও কি মজা নিচ্ছে, ও কি জানে না আমি যে এখনো তাকেই ভালোবাসি। সে ফিরিয়ে দিছিলো তো কি হয়েছে? ভালোবাসাটা কি কমে যাবে নাকি? সে আমাকে ভালোবাসে না সেটা তার ব্যাপার কিন্তু আমি যে তাকে বাসি।
– ঐ তুই তো এমন চুপচাপ ছিলি না, এমন কেন হয়ে গেছিস? আর বল কেমন আছে সে?
– প্রথম কথা আমার জিএফ নেই। তো সে কেমন আছে আমি কি জানি?
– যাক বাবা অবশেষে কথা বের হল, আর তোর যে জিএফ নেই সেটা আমি জানি। তোর মত হাদারাম, মাথা ভর্তি চুল, চোখে চশমা পরা ছেলেকে কে ভালোবাসবে শুনি?
– হুমম।
আবার নিরাবতা। চারিদিকে কত কোলাহল, কিন্তু আমার মাঝে আজ কেন এত নিরাবতা? আজ কেন আমি চুপচাপ? আর কেনই বা তিথি এত কথা বলছে? নাহ এর শেষ দেখা দরকার.. বললাম..
– ইয়ে মানে, তিথি আমি ইচ্ছে করেই তোর সামনে আসতে চাইনি। আসলে তুই তো চলে আসলি তখন সামনে। আচ্ছা সরি।
– বাব্বাহ তুই তো দেখি বেশি বোঝা শিখে গেছিস মেয়েদের মত।
তিথির কথা মুনে মুচকি হেসে উঠলাম। আমার হাসি দেখেই সে বললো..
– হাসিস কেনো?
– এই যে মেয়েরা বেশি বোঝে বললি।
– তুই ও বুঝিস।
– আচ্ছা তিথি বাই..আমার কাজ আছে।
কথাটি বলেই উঠে আসতে যাবো তখনি তিথি আমার ডান হাতটি শক্ত করে ধরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি তাকিয়ে আছি ওর চোখের দিকে। কি যেন একটা ওর চোখের মধ্যে আছে। যেটা বুঝার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি এর ছোয়াতেই।
– বস এখানে (রাগি ভাবে)
চুপচাপ বসে গেলাম। তবে এটা বুঝে গেলাম, আজ কিছু এই মুহুূর্তে হতে চলেছে। আবার নিরবতা, নিরাবতা ভেঙে বললাম-
– তা তুই এখানে কেনো?
কথাটি শোনার পর চোখ গরম করে আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বললো…
– এখনো ভালোবাসিস আমাকে?
কথাটি শুনে চমকে উঠলাম। বলে কি মেয়েটা? কি চাই সে আবার? সে কি চাই আমি আবার চলে যায়?
– কি হল বল? ভালোবাসিস আমাকে?
– নাহ
– কিহহ?
– হুমম
– কিন্তু কেনো?
একটু চুপ থেকে বললাম..
– ভালোবাসি না তোকে, কারণ, আগের সেই ভালোবাসাটা এখনো রয়ে গেছে তাই আর নতুন করে ভালোবাসি না আমি। তবে তোর কাছে তো এসব মুল্যহীন। তা কেন জিজ্ঞেস করছিস?
– আমিও তোকে ভালোবাসি।
– হাহাহা।
– হাসিস কেনো?
– স্বার্থ খুজে পেলি নাকি এখন আমার মাঝে?
– মানে?
– মানে কিসের স্বার্থে এখন ভালোবাসিস আমাকে?
(কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো তিথি)
– শোন, প্রথম যেদিন তুই আমাকে বলেছিলি ভালোবাসিস। সেদিন আসলেই অবাক হয়েছিলাম। সাথে রাগও হয়ে ছিলো খুব। কারণ, তোকে বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবতাম না আমি তখন। আর বড় কথা হল, আমি ভালোবাসাতে বিশ্বাসই ছিলাম না। তাই তোকে রাগের মাথায় চলে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু তার ১ সপ্তাহ পরেই বুঝেছিলাম তুই কতটা কাছের ছিলি আমার। সেদিন ফিল করেছিলাম তোকে আমিও ভালোবাসি। কিন্তু তুই যে চলে এসেছিলি সেদিনের পর থেকে। তোকে যে কোথাও খুঁজে পাইনি। আর ভালোবাসাটা বুঝতেও তো সময় লাগে তাই না? প্রোপোজ করেছিলি সেদিন তোর উপর ভালোবাসা ছিলো না, কিন্তু আস্তে আস্তে তোকে ভালোবাসছি আমি। তাই তোকে বহু কষ্টে খুঁজে বের করে এখানে এসেছি। আমাকে প্লীজ ফিরিয়ে দিস না।
তিথির কথা শুনে চুপ করে গেলাম। কেমন যেন হতে লাগলো বুকের মধ্যে, তখনি আমি ওখান থেকে উঠে বললাম..
– ভালো থাক তুই, আমি আর চাই না তোকে।
–
কথাটি শুনে তিথি আমার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। হয়ত সে এটা আশাই করেনি। আমি আর কিছু না বলেই চলে আসছি, কিছুদুর যেতেই ঘুরে তাকিয়ে দেখি, তিথি মাথাটা নিচু করে বসে আছে। তখনি দৌড়ে ওর কাছে গেলাম। পাশে ওর সাথে হেলান দিয়ে ধপ করে বসে বললাম-
– হাদারাম আমি না বুঝলি। হাদারমের স্ত্রী লিঙ্গ তুই। গাধী একটা, আস্ত গাধী…
-… … (অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল)
– শোন আমিও জানি কারো উপর ভালোবাসাটা বুঝতে সময় তো লাগবেই। আর আমি তো তোকে আজও ভালোবাসি পাগলি। এমনি চলে যেয়ে দেখলাম আমাকে ছাড়া কষ্ট হয় নাকি তোর।
– কুত্তা… বিলাই… হাদারাম… তোর কপালে খারাপই আছে।
(কিল ঘুসি দিতে দিতে বললো)
তখনি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম-
– চল ফুসকা খাই।
– হুমম চল…