বাইরে প্রচণ্ড বাতাস…মনে হচ্ছে ঝড় হবে। আজ আকাশে একটাও তারা উঠেনি, সাথে চাঁদটাও কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রান্না ঘর থেকে কিসের জেনো শব্দ… মায়ের বুকটা ধুক করে উঠলো। অতঃপর একটা বিড়ালের আওয়াজে বুকের ধুকধুকানিটা কমলো। কিন্তু পুরোপুরি কমছে না, মনের মধ্যে কি জেনো একটা ভয়…
রেহানা বেগম তার ৬ বছর বাচ্চার (আকাশ) পাশে শুয়ে আছে। আকাশ এর গায়ে ভীষণ জ্বর/ টিনের ঘরের ফুটো দিয়ে বায়ু আসা যাওয়া করছে আর আকাশকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আকাশ বার বার শীতের পরশে কেঁপে উঠছে আর মা’ও সন্তানকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছে… আকাশকে আজ কবিরাজ দেখিয়ে এনেছে। তিনি কিছু গাছগাছড়া দিয়ে বলছেন, “ঠিক হয়ে যাবে…”
ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য তাদের নেই, তাই কবিরাজই তাদের জন্য ঠিক আছে। মায়ের চোখে পানি দেখে আকাশ জিজ্ঞেস করলো, “মা, তুমি কাঁদছো কেন?”
মা’ও চোখের পানি আড়াল করার জন্য ময়লা সাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো, “কই না তো…”
–“আচ্ছা মা, আমার বাবা কোথায়?”
দীর্ঘ ৫ বছর ধরে সন্তান এই একই প্রশ্ন মা’কে করছে… কিন্তু মা কিছু’ই বলতে পারেন না, শুধু চোখের পানি মোছেন।
–ও মা?
–হুম,ক…
–আমার বাবা কোথায়?
–এখন এতো কথা বলা বাদ দে তো… শুয়ে পড়, কাল আবার কবিরাজ কাকুর কাছে নিয়ে যাব…
–মা, কও না, আমার বাবা কোথায়?
–কইলাম না, শুয়ে পড়…
–না, আজ না কইলে শোবো না…
–তোকে রূপকথার গল্প বলছি, শুয়ে পড়…
–না আজ আর রূপকথার গল্প শুনবো না… আজ বাবার কথা বলতেই হবে। মা জানো, আমার সবার বন্ধুর বাবা আছে, শুধু আমার নাই… আচ্ছা মা,আমার বাবা কি মরে গেছে?
মা সন্তানের মুখ হাত দিয়ে চেপে বলে, “না বাবা, অমুন কথা কইতে নেই। তোর বাবা যে এখনো বেচে আছে…
–তাহলে বলো না, বাবা কোথায়? আমাদের সাথে থাকে না কেন? বাবাকে যে বড্ড দেখতে ইচ্ছা করে…
–তোর বাবা যে এখন আমাদের চেনে’ই না… চিনবেই বা কি করে? তিনি এখন অন্য কাউকে বিয়ে করে শহরে থাকে…
–কেন? বাবা কি আমাদের ভালোবাসে না?
–না বাসে না, যদি বাসতোই তাহলে একবারের জন্য হলেও খোঁজ নিতো, আমার খোঁজ না হয় না’ই নিলো, নিজের সন্তানের খোঁজ তো নিতেই পারতো…
এই হলো “রেহানা বেগম” আর তার সন্তান “আকাশ”…
রেহানা বেগম এর জীবনটা আর পাঁচটা নারীর জীবনের মতো স্বাভাবিক না। সেই সকালে কাজে বেরুবে আর আসবে সন্ধ্যার পর ফেরা। তিনি অন্যের জমিতে কাজ করেন… এই সবটাই নিজের সন্তানের জন্য করা… না হলে কবেই যে তিনি এ পৃথিবী থেকে চলে যেতেন।
মাত্র ১৬বছর বয়সে রেহানা বেগম এর বিয়ে হয়… পারিবারিক ভাবেই তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। রেহানা বেগম বিয়ে করেছিলো, আলম নামে একটা ছেলেকে, যিনি ওয়ার্কশপ এ কাজ করতেন। আলমের বাবা নেই… মা’ই রেহানা বেগমকে পছন্দ করেছিলেন। রেহানা বেগম যে সুন্দর ছিলেন, তা কিন্তু নয়… দেখতে মোটামুটি ছিলেন, তবে তার হাতের কাজ ছিলো অতুলনীয়… রান্না থেকে শুরু করে সেলাই এর কাজ সব পারতো। মাথায় ছিলো, বাহারি চুল আর রেহানা বেগম সকলকেই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপন করে নিতো। শুধু পারলো না, একটা মাত্র ছেলেকে… হ্যাঁ, আলমকে… হয়ত আলম রেহানা বেগমকে পছন্দ করতো ন।
বিয়ে হতে না হতেই আলম রেহানা বেগমের উপর অত্যাচার করতে শুরু করে। সবসময় ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতো, অনেক সময় মারধরও করতো। রেহানা বেগম এর শাশুড়ি, আলমকে রাগ করতো, কিন্তু আলম শুনতো না। এ নিয়ে অনেকবার গ্রামে শালিসিও হয়েছে। শালিসির সময় আলম বলতো, “এমন ভুল আর হবে না…” কিন্তু বাসায় এসে পরক্ষনেই শালিসির কথা ভুলে যেতো।
আলম আর রেহানা বেগম এর বিয়ের দেড় বছর পর তাদের ঘর আলো করে আসলো ফুটফুটে একটা পুত্র সন্তান… রেহানার শাশুড়ি নাম দিয়েছিলো, “আকাশ” আকাশের বয়স যখন ৬মাস, তখন রেহানার শাশুড়ি পরলোকে পাড়ি জমায়। এরপর শুরু হয় রেহানার উপর আরো অত্যাচার… রেহানা বেগম অনেকবার নিজের বাপের বাড়ি চলে গেছেন, কিন্তু আলম আবার ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আসতো। কিন্তু কথায় বলে, “কুকুরের লেজ কি কখনো সোজা হয়?”
রেহানার প্রতি অত্যাচার আর কমলো না… রেহানার স্বামী আলম, মাঝে মাঝে মদ খেয়ে এসেও রেহানাকে মারতো… সহ্য করতে না পেরে রেহানা বেগম চিরদিন এর জন্য নিজের বাপের বাড়িতে চলে আসে…
এরপর আলম আবার দ্বিতীয় বিয়ে করে। গ্রামে শালিসি ডাকলে, আলম তার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায়…
এরপর শুরু হয় রেহানা বেগম এর বেচে থাকার লড়ায়… সাথে নিজের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।
অন্যের জমিতে কাজ করে নিজের সংসার চালায়… অনেকবার আত্মহত্যাও করতে চেয়েছেন, কিন্তু সন্তানের মুখ চেয়ে আর করতে পারেননি।
রেহানা বেগম এর চোখে পানি।
সন্তান জ্বরে পোড়া হাত দিয়ে মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, “দেখো মা, একদিন আমি বড় হয়ে চাকরি করবো, তখন আর তোমাকে অন্যের জমিতে কাজ করতে হবে না, আমাদের গাড়ি থাকবে,বাড়ি থাকবে…”
মা তার সন্তানের দিয়ে চেয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে, “তুই তো আমার সব, আমার প্রেরণা…”
–মা, আমার ক্ষুধা লাগছে…
–হুম বাবা, লাগবেই তো… আজ যে সারাদিন কিছুই খেলিনে… তুই শুয়ে থাক, আমি তোর জন্য ভাত মেখে আনছি…
এরপর রহিমা বেগম নিজের সন্তানকে খাইয়ে দিয়ে, নিজে খেয়ে শুয়ে পড়লো আর অপেক্ষা করতে লাগলো, এমন একটা দিনের জন্য… যে দিন তার সন্তানের স্বপ্ন পূরণ করাবে…
তাকে বাঁচতে হবে। হ্যাঁ,তার সন্তানের জন্য বাঁচতে হবে.