হামানদিস্তা

হামানদিস্তা

কতদিন ধরে কর্তাকে বলে যাচ্ছে একটা হামানদিস্তা আনবার জন্য, তা সে তার মনে থাকলে তবে তো? এই রান্না করার সময় টুকটাক থেঁতো বা বাটনা বাটতে সব সময় শীলনোড়া নিয়ে বসতে হয় না। একটা হামানদিস্তা থাকলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

সুদীপার রান্নাঘরে ঢুকলেই মনে পড়ে কথাটা, একটা হামানদিস্তা অবশ্যই দরকার। ছোটবেলায় দেখেছে গরমমশলা থেঁতো, মিষ্টি পান ছেঁচার জন্য মা একটা পিতলের ছোট হামানদিস্তা ব্যবহার করত। বিয়ের পর শাশুড়িকে একটা মাঝারি মাপের লোহার তৈরি হামানদিস্তাতে আদা, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি পেষণ করতে দেখেছে। কোমড়ের সমস্যার কারণে তিনি মাটিতে বসে শীলনোড়া দিয়ে বাটনা বাটতে পারতেন না। আবার শীতকালে পিঠে বানানোর সময় ওই হামানদিস্তাকেই তিনি ধুয়ে মুছে নিয়ে তাতে চালগুঁড়ো করতেন। সেই চালগুঁড়োকে দুধে গুলে নিয়ে মাটির সরায় বানাতেন আসকে পিঠে।

সুদীপার মামার বাড়িতে ছিল কালো পাথরের তৈরি হামানদিস্তা। তাতে পাথরের নোড়া দিয়ে সুদীপার দিদিমা আস্ত সোনামুগের ভাজা ডালকে ভেঙে আধখানা করে নিতেন। সেই আধভাঙা ভাজা মুগের ডাল যখন রান্না হ’ত – তার স্বাদ ছিল অপূর্ব।

শ্বশুরবাড়িতে কখনও কদাচিৎ কোন কিছু গুঁড়ো বা থেঁতো করার সময় শাশুড়ি মায়ের লোহার হামানদিস্তাটাকে তাক থেকে নামিয়ে নিতে হতো। এই ফ্ল্যাটে আসার সময় সেটা যে কোথায় হারিয়ে গেল!

হামানদিস্তার কথা মনে পড়লেই সুদীপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কত কি জিনিস রোজ কিনে আনা হচ্ছে, কিন্তু একটা হামানদিস্তার কথা কারো মনেই থাকে না।

আজ সুদীপার বড়পিসী মৃন্ময়ী আসছেন মুর্শিদাবাদ থেকে। তাই সকাল সকাল স্বামীকে অফিসে রওনা করে দিয়ে সুদীপা পিসীমার পছন্দের রান্নায় মনোনিবেশ করেছে। ওদিকে বড় ডেচকির ভেতর থেকে উঁকি মারছে জলখাবারের জন্য তৈরী সাদা ধবধবে লুচিগুলো, আর একটা ছোট গামলা ভর্তি আলুর দম। প্রণবেশকে দিয়ে আনিয়ে রেখেছে একটা মাটির হাঁড়ি ভর্তি রাজভোগ আর একখোলা মিষ্টি দই।

কলিংবেলের আওয়াজ পেয়েই সুদীপা শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলল। সুদীপার মেয়ে পাপড়ি টিউশন সেরে বাড়ি ফিরল। ও এবার মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।

– জলখাবারে কি বানিয়েছ মা? উঃ, বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে!
-তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নে। এক্ষুনি খেতে দিচ্ছি।
পাপড়ি খেতে খেতে বলল, “মা, আর দুটো লুচি দাও।”
ঠিক তখনই আবার কলিংবেল বেজে উঠল।
সুদীপা বলল, “যাই।”
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পটল ওরফে প্রবীর, সুদীপার পিসতুতো ভাই আর বড়পিসী।
-আরে পটল, তুই কত রোগা হয়ে গেছিস। পিসী, ভালো আছো?
-এখানেই দাঁড়িয়ে কথা বলবি না কি ভেতরে ঢুকতে দিবি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ, আয় আয়, ভেতরে আয়। পিসী, এসো, এসো।
-ও বাবা, পাপড়ি তো অনেক বড় হয়ে গেছে!
-হ্যাঁ রে, ও এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।

সুদীপা সকলকে জলখাবার পরিবেশন করে রান্নাঘরে ঢুকল। আজকের মেনু নবরত্ন ডাল, গোল চাকা চাকা কিন্তু মচমচে আলুভাজা, পোস্তর বড়া, মোচার ঘন্ট, কলমী শাকভাজা, ইঁচড়ের ডালনা, শুক্তো, ছানার কালিয়া আর আমসত্ত্ব-খেজুর-কাজু-কিশমিশের চাটনি। বড়পিসীর সব খাবার নিরামিষ হওয়া চাই।

– ওমা, শীলেতে গরমমশলা থেঁতো করছিস? তোর রান্নাঘরে হামানদিস্তা নেই?
– আর বলো কেন পিসী, সেই বাড়ি পরিবর্তনের সময় হামানদিস্তাটা যে কোথায় হারিয়ে গেল! তারপর থেকে উনাকে বলেই চলেছি, তার মনে থাকলে তবে তো?

– কেন, তোদের এখানে কাছাকাছি কোন দোকান-টোকানে পাওয়া যায় না?
– তা হয়তো বা যায়। কিন্তু আমি কখনো সখনো যখন বেড়োই তখন আর হামানদিস্তা কেনার কথাটা মনেই থাকে না।
– ওটা তো খুব দরকারি একটা জিনিস রে!
এই বলতে বলতে পিসীমা শুরু করে দিলেন একটা গল্প।

– তা সে এক হামানদিস্তা দেখেছিলাম বটে! সে অনেকদিন আগের কথা, বুঝলি। আমার তখন অনেক কম বয়েস। মা-জেঠিমার সাথে সেই সাগরপুরের জমিদার বাড়িতে গিয়েছিলাম দুর্গাপূজার সময়। মস্তবড় ঠাকুরদালানের পিছনেই একটা বিরাট রান্নাঘর। সেখানে ঠাকুরের ভোগ রান্না হোত। রান্নাঘরের সামনে লম্বা টানা বারান্দায় বসে মেয়ে-বৌরা নতুন শাড়ি পড়ে সারি সারি কুটনো কাটছে। আর জমিদার গিন্নী স্বয়ং একটা শ্বেত পাথরের হামানদিস্তায় বোধহয় গরমমশলা থেঁতো করছিলেন। কি সুন্দর নিটোল সে হামানদিস্তা, হাতলে সোনার মোটা তার জড়িয়ে নক্সা করা। আহা, অমনটা আর কখনো দেখিনি, বুঝলি!

রাতে পিসীমা শুধু খই-দুধ খান। কিন্তু নিজে সামনে বসে থেকে প্রণবেশকে খাওয়াবেন। প্রণবেশ যতক্ষণ ধরে খেল, তিনি একটা হাতপাখা নিয়ে সমানে বাতাস করে গেলেন। প্রণবেশ বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল। পিসীদিদার কান্ড দেখে পাপড়ির বেশ মজা লাগছিল।

সুদীপা প্রবীর আর প্রণবেশকে পরিবেশন করছিল, খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হঠাৎ পিসীমা বলে উঠলেন, “বাবা, সুদীপাকে একটা হামানদিস্তা কিনে দিও, ওটা ছাড়া ওর রান্না করতে বেশ কষ্ট হয়।”

– হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ও আমাকে অনেকবার বলেছে, কিন্ত আমি কেবলই ভুলে যাই। আমি কালকেই নিয়ে আসব পিসীমা।

প্রণবেশের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, সে উঠে পড়ল। প্রবীরকে বলল, “ভাই, তুমি আস্তে আস্তে খাও। তাড়াহুড়ো করো না। আমি উঠলাম।”

পাপড়ি আর একটু ছানার কালিয়া চাইল।
সবাই উঠে পড়ার পর সুদীপা খেতে বসল। প্রণবেশ মশারি টাঙাচ্ছে, এই কাজটা সে রোজই করে।

বড়পিসীমা কোথা থেকে একটা মিষ্টি পান এনে বললেন, “সুদীপা, এটা একটু ছেঁচে দে তো। আচ্ছা থাক, তোকে তো আবার সেই শীলনোড়া পাততে হবে। আমি অমনই খেয়ে নিচ্ছি।”

পরদিন সকালেই বড়পিসীমা প্রবীরকে নিয়ে ফিরে গেলেন মুর্শিদাবাদ। প্রবীরের অফিস আছে, তাছাড়া পিসীমার আবার লক্ষ্মীবারের পূজো আছে।

সুদীপার আজ রান্নার তাড়া নেই। প্রণবেশ আজ অফিসে বেরিয়ে গেছে খুব তাড়াতাড়ি। বলেছে, বাইরে কোথাও খেয়ে নেবে। পাপড়ির আজ এক বান্ধবীর জন্মদিন আছে। সেখানে দুপুরে নিমন্ত্রণ। গতকালের সামান্য কিছু তরকারি ফ্রিজে তোলা আছে, সেটা গরম করে নিলেই সুদীপার এবেলার মত হয়ে যাবে।

সুদীপা ওর স্মার্টফোনটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। ফেসবুক তো খেলাই হয় না। হোয়াটসঅ্যাপে গুচ্ছের মেসেজ এসেছে। একে একে সব ডিলিট করল। হঠাৎ কি মাথায় এল গুগলে গিয়ে সার্চ করল ‘হামানদিস্তা’ – অনেক সমার্থক শব্দ পেয়ে গেল, যেমন, পেষণী, ঘট্টনী, কন্ডনী, মুষল, খল, দিস্তা ইত্যাদি ইত্যাদি। ওমা, হানিফ সংকেত বলে একজনের একটা বইয়ের নামও ‘হামানদিস্তা’। ফেসবুকে একটা পেজ আছে ‘হামানদিস্তা’। আবার একটা নিউজ রয়েছে যে, হামানদিস্তা দিয়ে স্ত্রীকে খুন – কি সাংঘাতিক! নিউজটা আর পড়ে দেখার ইচ্ছে হলো না সুদীপার।
প্রণবেশের ফোন এল, “শোন, তোমার হামানদিস্তা কেনা হয়ে গেছে। আমাদের একজন অফিস পিওনকে বলে রেখেছিলাম, সে আজ বড়বাজার থেকে এনে দিয়েছে। রাতে বাড়ি ফেরার সময়ে সঙ্গে নিয়ে যাব।”

সুদীপার গতকাল ইউ টিউবে কিছু রান্না সার্চ করেছিল, সেখানে চালের গুঁড়ো দিয়ে একধরনের ছোট ছোট ভাজা পিঠে তৈরী করার রেসিপি দেখে সে খুব উৎসাহিত হয়েছে। কিন্তু বাজার থেকে কেনা চালের গুঁড়ো দিয়ে ও পিঠে ভালো হবে না বলে সুদীপার মনে হচ্ছে। তাই শাশুড়ির মত চাল ভিজিয়ে রেখে জল ঝরিয়ে আজ সকালে তা গুঁড়ো করতে বসেছে নতুন কেনা স্টিলের হামানদিস্তায়।

রান্নাঘরের মেঝেতে বসে সে খটখট শব্দে মনের সুখে চাল গুঁড়িয়ে চলেছে। ওদিকে প্রণবেশ বিরক্ত হয়ে কানের উপরে বালিশ চাপা দিয়ে পাশ ফিরে শু’ল। এত ভোরে সুদীপা কি করছে কে জানে!

পাপড়ি নিজের ঘরে পড়তে পড়তে বিরক্তভাবে মুখ ফিরিয়ে বলল, “সাতসকালে এখন হামানদিস্তা দিয়ে কি করছ মা?”

সুদীপা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, “পিঠে করব, তাই চাল গুঁড়ো করছি।”
ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে উঠল, “এত সকালে কে এল আবার?” বলতে বলতে সুদীপা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেল। কোলাপসিবল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন লোকজন, সবাই এই ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা। প্রায় প্রত্যেকের চেনা মুখ। সুদীপা একটু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার?”

– আপনার ওই হামানদিস্তার খটখট আওয়াজে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সকালবেলায় এসব কি শুরু করেছেন বলুন তো?

পিছনের বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটু বেশি বিরক্ত। তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠলেন, “আমার ঠিকমত ঘুম না হলে প্রেশার বেড়ে যায়। এই বিচ্ছিরি আওয়াজে আমার ঘুমের দফারফা হয়ে গেছে !”
সুদীপা স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত