শ্বাশুড়ি যখন মা

শ্বাশুড়ি যখন মা

প্রত্যেকটা মেয়ের একটা স্বপ্ন থাকে বিয়ের পর তাঁর শ্বাশুড়ি নিজের মা’য়ের মত হবে।তেমনি শ্বাশুড়ি রা ভাবে ছেলের বউটা মেয়ের মত হবে।মেয়ের মত হয়ে সংসারটা আপন করে নিবে।এই ভাবনাগুলো দু’পক্ষের ভিতর আসা যাওয়া করে।বউ শ্বাশুড়ির সম্পর্কটা খুব একটা যে মধুর হয় এমনটা কম দেখা যায়।কোথাও শ্বাশুড়ি ভালো তো বউ খারাপ।আবার কোথাও বউ ভালো তো শ্বাশুড়ি ভালো হয় না।বাংলার প্রত্যকটা সংসারে এমন ভীতকর পরিস্থিতির শিকার কারো না কারো হতে হয়।তেমন টা আমারও হয়েছে।আমি সবসময় ভাবতাম আমার শ্বশুরবাড়ী শাশুড়ি মা না জানি কেমন হবে?অনেকের সংসার জীবন দেখে মনের ভিতর একটা ভয় তৈরী হয়ে গেছে।ভাবতাম ভয়টা কিভাবে ভাঙ্গবে?

আমি ছিলাম পরিবারের ছোট।তখনও পড়াশুনা শেষ হয়নি।হঠাৎ বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণে হুট করে আমার বিয়ে টা ঠিক হয়ে যায়।বাবা চেয়েছেন আমাকে সংসারী দেখে যেতে।আমার বিয়ের দু’সপ্তাহ পর বাবা মারা যায়।যাই হোক বিয়েটা হুট করে হওয়াতে আমরা দু’জনে অপরিচিত ছিলাম।আমার অবশ্য বর নিয়ে টেনশন যতটা থাকার কথা তার চেয়ে বেশী টেনশন হচ্ছে শাশুড়ি মাকে নিয়ে। বিয়ের সময় শুনেছিলাম আমার শ্বশুর নেই শ্বাশুড়ি মা আছেন।আমার বর রা চার ভাই।বোন নেই।আমার এসব শুনে অস্থিরতা বেড়ে গেছে।কি করে সামলাবো এত বড় সংসার?না জানি শ্বাশুড়ি মা কেমন হবে?ওনি কি আমাকে সহজে আপন করতে পারবে?কত প্রশ্ন মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো তখন।

বিয়ের প্রথম দিন ওদের বাড়ী আসলাম।আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে বরণ করে নিলো।বাসায় অনেক আত্মীয় স্বজন আছেন।যে যার মত করে আমি সবার সাথে পরিচিত হলাম।তবে আমার শ্বাশুড়ি মা’কে আর একবারের জন্য আমার সামনে দেখলাম না।খুব মন খারাপ হলো।এমনিতে বিয়ের আগেও ওনি আমাকে দেখতে যায়নি।সেটার মন খারাপ তো রয়ে গেছে।নতুন করে আরেকটা যোগ হলো।যাইহোক বিয়ের প্রথম রাত মন খারাপ দিয়ে কেটেছে।পরদিন খুব সকালে আমার শ্বাশুড়ি মা দরজায় নক করলো।তখন আমার বর রুমে ছিলো না।ফজর নামাজ পড়ে নাকি ওর হাঁটার অভ্যাস আছে।তাই রুমে শুধু আমিই ছিলাম।নক করার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেখি আমার শাশুড়ি মা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন।আমি সাথে সাথে পা ধরে সালাম করি।আর ভিতরে আসতে বলি।ওনি এলেন আর ঘাটের এক কোণে বসলেন।তারপর আমার হাতটা ধরে বললেন,
” আজ থেকে এই সংসারের সব দায়িত্ব তোমার।ভয় পেওনা আমি সব তোমাকে শিখিয়ে দিবো।অনেক বড় সংসার, এতদিন একা একা সব করেছি।আজ থেকে তুমি আমার সাথে থাকবে”।

এই বলে আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে বুকে টেনে নিলেন।আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম।তারপর ওনি ওনার শাশুড়ির দেওয়া অনেকগুলো গহনা আমাকে দিলেন।আমি নিতে চাইনি।তাও জোর করে আমাকে দিলো।আর বললো ” আমি তুই করে বলবো।কারণ আজ থেকে তুই আমার মেয়ে”। আমি সাথে সাথে কান্না করে দিলাম।ওনি আমার চোখের পানি মুছে দিলেন।আর মনে মনে বললাম।আমি আরেকটা মা পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ্‌।

তখন থেকে সংসারের অনেক দায়িত্ব আমি নিজে পালন করতাম।আমার ভালো লাগতো।শ্বাশুড়ি মা সবসময় আমার পাশে থাকতেন।অনেক কাজে সাহায্য করতেন।আমার তিন দেবর ওরাও খুব সাহায্য করতো।আমার বর ছিলো একদম মাটির মানুষ। ওকে নিয়ে আমার কখনো টেনশন হতো না।বরং সে আমাকে অনেক কাজে সাহায্য করতো।আমার আর শ্বাশুড়ি মায়ের কোন কাজে নাক গলাতো না।আমার পড়াশুনাটাও চালিয়ে যেতে হলো শ্বাশুড়ি মায়ের কারণে।আমার খুব মনে আছে।পরীক্ষার সময় আমি রাত জেগে পড়তাম।আর ওনি মাঝরাতে এসে আমাকে উঁকি মেরে দেখতো।আর জেগেও থাকতো।

আমি বলতাম ” মা আপনার রাত জাগতে হবে না।আমি কিন্তু খুব রাগ করবো এভাবে উঁকি মেরে দেখলে।না ঘুমালে আপনার প্রেসার হাই হয়ে যাবে”।
ওনি এসব হেসে উড়িয়ে দিতো।
আর বলতো ” তুই তো আমার মেয়ে।মেয়ে রাত জেগে পড়বে। মা একটু রাত জাগবে না তা কি হয়?আমার ভালো লাগে তোকে এভাবে দেখতে”।

ওনার মেয়ে ছিলো না বলে আমাকে দিয়ে মেয়ের সব আবদার পূরণ করেছিলো।আমিও কখনো কিছু না করতাম না।ওনার থেকে সব রকমের রান্না শিখেছিলাম।কিভাবে সংসার সামলানো?আত্নীয় স্বজন আপ্যায়ন সবকিছু আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলো।আমার দোষ গুলো ওনি গুণ দিয়ে ঢেকে দিতো।হয়ত নিজের মাও এমন করত না।সবসময় হাসিখুশির মানুষ ছিলো।আমার বিয়ের দু’বছর পর এমন একটা ঘটনার পরিস্থিতির শিকার হবো আমরা কখনো ভাবিনি।হঠাৎ করে আমার শ্বাশুড়ি মা স্টোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান।আমার আমাদের কাছে অন্ধকার নেমে আসে।আমি তো কিছুই ভাবতে পারছিলাম না।কি করবো?ওনি একদম বিছানায় পড়ে গেলেন।নিজে নিজে কিছুই করতে পারতেন না।আমি সেবা করতাম।আমার বর আমার দেবররা খুব সাহায্য করতো।এভাবে এক বছর কেটে যায়।ওনার কোন উন্নতি হয় না।হঠাৎ একদিন আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যান।আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।

ঘরের যে দিকে তাকাতাম শ্বাশুড়ি মা’কে দেখতে পেতাম।আমি অসম্পূর্ণ শ্বাশুড়ি মা’কে ছাড়া।ওনার স্মৃতি আমাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়।ওনি চলে যাওয়ার পর পুরা সংসার আমাকে একা সামলাতে হয়েছিলো।আমার তিনটি দেবর ওদের এক এক বিয়ে দিলাম।ঘরে আরও তিন জা আনলাম।আমাকে শ্বাশুড়ি র মত দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হয়েছে।এই সংসারটা আমার।বিয়ের দ্বিতীয় দিন আমাকে শাশুড়ি মা যে কথা বলেছে।সংসারের দায়িত্ব দিয়েছে।আমি এখনো পালন করে যাচ্ছি। নিজ হাতে তৈরী করা সংসার শ্বাশুড়ি মা আমাকে দিয়েছেন।

আমার বিয়ের বারো বছর চলছে।শ্বাশুড়ি মা চলে গেছে নয় বছর হবে।আমার দু’ ছেলেমেয়ে। তাঁদের কে আমি সবসময় তাদের দাদীর কথা বলি।ওরা এসব শুনতে শুনতে তাঁদের মনে একটা ছবি এঁকে নিয়েছে।আমি চাই তাঁদের মাঝে আমার শ্বাশুড়ি মা বেঁচে থাকুক।এখনো ওনার স্মৃতি আমার মাঝে।চারদিকে এখনো ওনার শূন্যতা অনুভব করি।এ শূন্যতা কখনো পূরণ হবার না।মাঝেমাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়।বুকের ভিতর মুচড়ে উঠে।এই মুচড়ানো টা শুধু আমি অনুভব করি।ঘাট থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় বসি।আর নিজের অজান্তে চোখ বেড়ে জল পড়ে।মনে হয় আমার শ্বাশুড়ি মা আমার পাশে আছেন।আমাকে মাঝ রাতে উঁকি মেরে দেখছেন।

কেউ জানবে না আমি কি হারিয়েছি?কাকে হারিয়েছি?কি অমূল্য সম্পদ আমার জীবন থেকে চলে গেছে।আমার ভালো লাগার ভালো থাকার মানুষ টা আমাকে রেখে চলে গেছে।ওনি ফুলেল বাগান রেখে গেছে।ফুলেল সুভাস নিতে পারেনি।আমি ওনার রেখে যাওয়া বাগান সারাজীবন পাহারা দিবো।যত্ন করবো নিজের জীবন দিয়ে হলেও।
আমি আমার শাশুড়ি মা’কে হারায়নি। আমি আমার নিজের মা’কে হারিয়েছি।যতদিন বেঁচে থাকবো ওনার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবো।এমন শাশুড়ি মা সবার ভাগ্যে থাকে না।শাশুড়ি যখন মা হয়ে যায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত