মা

মা

আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। লোকে বলে ভালো লোকের বৌ চলে যায় না। সে হিসেবে আমি ও ভালো লোক না হয়তো। দেখেশুনে একাবারে গরীব ঘরের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম। এই আশায় যে মেয়ের হিংসা থাকবে না। আমার কথা শুনবে। কিন্তু আমার পোড়া কপাল। সেই মেয়েটাই হলো দুনিয়ার হিংসুটে। আমি সহ আমার পরিবারটাকে একাই আষ্টেপৃষ্ঠে চুষে খেয়েছে। আমাদের কথা বাদ দিলাম। তাঁর যে একটা ফুটফুটে ছেলে আছে সেই ছেলের কথা ই সে একবার ও চিন্তা করে নি। একটা চকলেট বয়ের হাত ধরে চলে গিয়েছে। ছেলেটা প্রতি মুহূর্তে আম্মু আম্মু করে। কিন্তু সোনামণি বলে কপালে চুমু দিয়ে কোলে নেবার জন্য আম্মুর ঠেকা পরে নি। হ্যাঁ সে সুন্দরী ছিলো এবং আছে।চলে যাবার কারণটা চিরকুটে লিখে গিয়েছিলো। লিখা ছিলো যে তাঁর না কী প্রেমের অভাব। আমি ভালোবাসতে পারি নি। আমি আলাদা করে জানি না যে কীভাবে স্ত্রীদের ভালোবাসতে হয়।

আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তাঁর মন গলে নি। আমার বুকে ছেলেটাকে রেখে মাঝ রাতে সে উধাও। আমার আর কী? সমাজের কিছু লোকের কটু শুনতে হচ্ছে। সমস্যা নেই।সহ্য করতে পারি। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটাকে কী বুঝাবো? যে তোমার বাবা ভালোবাসতে পারে না বিদায় তোমাকে রেখে মা অন্য কারো কাছে চলে গিয়েছে। মায়ের কী মায়া। যে মা তাঁকে ফেলে চলে গিয়েছে তাঁকেই সে বারবার ডাকে। আমাকে একবার ও ডাকে না! বাপের ছেলে। মাত্র কদিনেই বাস্তবতা বুঝে গিয়েছে। যে তাঁর মায়ের দুধ পান করার কপাল নেই। প্যাকেট দুধেই অভ্যাস করতে হবে। অদ্ভুত ব্যাপার। ছেলেটা অভ্যাস করে ও ফেলেছে। রাত হলে ই গলাটা শক্ত করে ধরে রাখে। আর আম্মু আম্মু করে। যখন একটু আধটু কথা বলতে পারে তখন শুধু বলে, আম্মু কখন আসবে?  আমি আসবে আসবে বলে আশায় রাখি। কিন্তু ছেলেটার আম্মুর খোঁজ আর পাই না। সবসময় নীরব থাকে। কথাবার্তা কম বলে। আজকে শুক্রবার।

বাইরে বেরিয়েছি ফারাযকে নিয়ে একটু ঘুরতে। যদি ছেলেটার একটু হাসি মুখ দেখতে পারি এই আশায়। কতো গুলো জামা আর খেলনা কিনে দিলাম। নো হাসি। গালগোল ফুলিয়েই রেখেছে। বাচ্চাদের সাথে খেলতে দেই। খেলে না। কান্না করে। শেষমেশ যখন বাড়ির দিকে রওনা দিলাম তখন আম্মু আম্মু বলে কাঁদছে! আশেপাশে তাঁকিয়ে দেখলাম ফারাযের মা তো নেই! দুহাত প্রসারিত করে বলছে, বাবা দেখো আম্মু আসছে। আমি আম্মুর কাছে যাবো। শপিং মলে কতো মেয়েই তো আছে। কাকে দেখে আম্মু মনে হয়েছে আল্লাহ্‌ জানে। তখনই ছেলেটা হেসে দিয়ে বললো, এই তো আম্মু এসেছে। পিছনে ঘুরতেই দেখি একটা মেয়ে ভীত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাযের কাণ্ড দেখে বললোঃ- সরি, আসলে আপনার ছেলেকে চোখ মেরেছিলাম। আমার জন্যই কান্না করছে। দিন আমার কাছে।

আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাচ্চা ছেলেদের ও কেউ চোখ মারে? অদ্ভুত! ফারায মেয়েটার কোলে উঠে একদম চুপ হয়ে গেলো। মেয়েটা বললোঃ- এ কেমন বাবু? নিজের আম্মু রেখে আমাকে আম্মু বানিয়ে দিচ্ছে। আম্মা শুনলে তো আমি শেষ। আচ্ছা বাবুর আম্মু কোথায়? উনাকে আনেন নি সাথে?  মারা গিয়েছে। উফস সরি। ফারায কিছুতেই মেয়েটাকে ছাড়ছে না। আমার লজ্জা লাগছে। অনেকক্ষণ পর মেয়েটা বললোঃ- আন্টির আজকে যাবার সময় হয়ে গিয়েছে। অন্য আরেক দিন কোলে নিতে আসবো ঠিকাছে? এখন বাবার কাছে যাও?  কেনো আম্মু? তুমি যাবে না আমাদের সাথে?  মেয়েটা চোখ বড় বড় করে আমাকে বললোঃ-  বাবুর আম্মুর সাথে আমার চেহারার মিল আছে না কী? চোখ মেরে তো ভালই বিপদে পরলাম। বাচ্চা মানুষ। নিজের মা ভেবে বসে আছে। আমার কাছে দিন ঠিক হয়ে যাবে।

ফারায আসতে চাচ্ছে না। জোর করে আনলাম। কী যে কান্না আরম্ভ করেছে। মেয়েটা ও দাঁড়িয়ে দেখছে। আর চলে যাচ্ছে না। বললামঃ- যাচ্ছেন না কেনো? আপনি না গেলে তো আরো কাঁদবে। কান্না করলে বাচ্চাদের কতো সুন্দর লাগে তা ই দেখছি। আমি আর কোনো কথা না বলে ফারাযকে নিয়ে চলে আসছি। ফারায আমার মাথার চুল টেনে ছিড়ে ফেলছে। অনেক দূর এসে একবার পিছনে তাকালাম। দেখলাম মেয়েটা ফের দাঁড়িয়ে আছে! আমি দাঁড়িয়েছি দেখে আবার দৌড়ে কাছে আসলো। বেশ চঞ্চল মেয়েটা।

এসে ই বললোঃ- না মানে কিছু মনে করবেন না। আম্মু আম্মু শুনতে ভালোই লাগছিলো। এই ছেলে আবার আম্মু ডাক। ফারায ও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, আম্মু। মেয়েটা হেসে বললো, আবার ডাক। তাহলে চকলেট দিবো। ফারায ও করলো অভিমান। আর আম্মু ডাকলো না। আবার চুপচাপ। সারাটা দিন না খেয়ে আছে। রাতে ও কিছু খাওয়াতে পারলাম না। সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গতেই ফারায বললো, তাড়াতাড়ি উঠো না। বাড়িতে আম্মু এসেছে তো। বকবে বেশিক্ষণ ঘুমালে কিন্তু। আমি লাফিয়ে উঠলাম। ভাবলাম ফারাযের মা সত্যিই এসে পরেছে! নিচে নেমে দেখলাম আমাদের নতুন ভাড়াটিয়াদের সাথে মা কথা বলছে। আর সেই মেয়েটা ও সেখানে। মেয়েটার কথা চিন্তা করে খারাপ লাগছে। জ্বালিয়ে মারবে ফারায মেয়েটাকে। মেয়েটা উঁকিঝুঁকি করে ঘরটা দেখছে। উপরে তাকাতেই আমাকে আর ফারাযকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড়িয়ে পরলো। ফারায এক দৌড়ে মেয়েটার কোলে উঠে গেলো আম্মু আম্মু করতে করতে।

মেয়েটা তাঁর মাকে বললোঃ- আম্মা, বিশ্বাস কইরো না। এই ছেলের মাথায় সমস্যা। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে দিলো। আমি ও হাসলাম। বাচ্চাদের মতো। এক দিন যেতেই দেখি বাড়িঘর সাজানো হচ্ছে। অপির বিয়ে। যাক বাবা মেয়েটা একটু রেহাই পাবে।  তাড়াহুড়ো করেই বিয়েটা হচ্ছে বুঝলাম।

ফারায বললোঃ-  বাবা আম্মু এভাবে সাজছে কেনো?  আম্মুর বিয়ে। বিয়ে কী?  বিয়ে মানে হলো খাওয়াদাওয়া। আমরা ও খাবো?  হুম। তাহলে চলো যাই বিয়ে করে আসি। এঁহ, বিয়ে করে আসি মানে?  মানে খাওয়াদাওয়া করে আসি। দাঁড়াও তোমার আম্মুর জন্য উপহারটা নিয়ে নেই?  তাড়াতাড়ি। দুজনে অপির বিয়েতে গেলাম। গেলাম বলতে আমাদের বাড়িতেই। অদ্ভুত ব্যাপার। অপি এরকম সময় হাসছে। মুখ চেপে হাসছে। অপির মা বারবার বারণ করছে কানে কানে। কিন্তু তবু ও হাসছে। বর পক্ষ মনে করলো মেয়ের মাথায় সমস্যা। পাগলী মেয়েকে গছিয়ে দিচ্ছে। এ নিয়ে গণ্ডগোল পাকলো। শেষ পর্যন্ত বিয়ে ই হলো না! তবু ও অপি হাসছে! আশ্চর্য কারবার।

অপির মা বললোঃ- পাগলীর মতো হাসছিস কেনো? কী করবো? আমার খালি হাসি পাচ্ছে। এজন্য হাসবি?  আমার হাসি পেলে আমি হাসবো ই। তোর বিয়ে তুই বুঝতে পারছিস?  বিয়ে বলে কী হাসা যাবে না? তুই কী আর বাচ্চামী বন্ধ করতে পারবি না? কয়টা বিয়ে ভাঙ্গছিস এভাবে? আমার হাসি পায়। আমি কী করবো?অপির মা রেগেমেগে চলে গেলেন। মেয়েটার বিয়ে ও ভেঙ্গে গেলো। নাছোড়বান্দার মুখ থেকে হাসি টা তবু ও গেলো না। এ নিয়ে আরো হৈ চৈ। ফারায ও হাসছে! সবাই খুব গম্ভীর আর এরা দুজন হাসছে। কারণ কী? আজকে সকালে উঠে ছাদে গিয়ে দেখি এরা দুজন বসে কী যুক্তি করছে। আমি ছাদে গিয়েছি তা টের পায় নি। ফারায বললোঃ- আম্মু আমি কাল অনেক বিয়ে করেছি। বাব্বাহ অনেক? তোর আম্মুর কপালে দেখ একটা বিয়ে ই নাই।

আব্বু ও তো অনেক বিয়ে করেছে। তোর আব্বু ও?  হুম। কয়টা বিয়ে করেছে শুনি তোমার আব্বু?  ডাল দিয়ে করেছে একটা, মুরগীর মাংস দিয়ে করেছে একটা। গরুর মাংস দিয়ে করেছে আরো একটা। থাক বাবা আর বলতে হবে না। বলে অপি ফারাযকে কোলে নিলো। গাল বেয়ে পানি পরছে। এবার বুঝতে পারছি মেয়েটা কেনো কাল এতো হাসি হেসেছে। আমি নিচে চলে আসলাম দাঁত মাজতে মাজতে। এসে দেখি আমার আর অপির বিয়ের কথা হচ্ছে! কেমন জানি লাগছে। এক দৌড়ে রুমে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি অপি আর ফারায আমার খাট দখল করে আছে। ফারায আপেলে একটা কামড় দিয়ে বললোঃ- এই দেখো আমার কতো জোর গায়ে। বাবা রোজ খায় আপেল। আমি ও খাই।

তোমার বাবার গায়ে জোর আছে কিন্তু তোমার গায়ে নাই। তাহলে আসো ডিসুম ডিসুম খেলি। দেখি কার গায়ে কতো জোর? না বাবা থাক। তোমার আম্মুর গায়ে জোর নাই। দুদিন ধরে পানি খেয়ে বেঁচে আছি। আমি এহেম এহেম করে ঘরে ঢুকতেই অপি পাশ কাটিয়ে চেতে চাইলো। তাড়াহুড়ো কারণে কলার বাঁকলে পিচ্ছিল খেয়ে আমার বুকে এসে পরলো। আর ফারায তা দেখে তালি দিচ্ছে। ফারাযের শরীরের গন্ধ আমি অপির গা থেকে পাচ্ছি। কী চাহনি আর লজ্জা। বুঝতে পারছি ” জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। মা হতে গেলে মায়ের মন লাগে “

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত