খুব অসহায়

খুব অসহায়

সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকতেই একজন বৃদ্ধ লোক জিজ্ঞাস করল, বাবা কেমন আছো?

—মনে করার চেষ্টা করলাম উনি আমার পূর্ব পরিচিত কিনা, এর আগে কখনো দেখা হয়েছে বলে মনে পরল না। সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা, মাথায় টুপি, মন খারাপের একটা ছাপ তার পুরো মুখমন্ডলে লেগে আছে— জি ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
—ভাল নেই বাবা। তোমার কি কিছুক্ষণ সময় হবে?
—কেন বলুনতো?
—একটু কথা বলতাম আর কি, একা একা আর কতক্ষণ ভাল লাগে বল?

লোকটির কথা শুনে বেশ মায়া হল, সত্যি তো একা একা কতক্ষণ থাকা যায়? বাবার রুমে কেউ একজন না থাকলে বাবা একদম অস্থির হয়ে যান। ইনার হয় তো কথা বলার মতন তেমন কেউ হাসপাতালে নাই—জি বলুন।
—বাবা চল আমরা ঐ গাছটার নীচে গিয়ে বসি। তুমি করে বলছি, কিছু মনে করছো না তো?
—না না ঠিক আছে আপনি আমাকে তুমি করেই বলুন।
—বাবা নাম কি তোমার?
—আমি নিবিড়।
—হাসপাতালে কেন?
—বাবা কিছুদিন থেকে হাসপাতালে ভর্তি তো তাই।
—ও আচ্ছা। তোমার কি খুব তাড়া আছে?
—তেমন একটা তাড়া নেই, হাসপাতালে ভাইয়া, আম্মু আছে প্রয়োজন পরলে কল করবে, বলুন আপনি।
—একটা গল্প বলি তোমায়?
—কিসের গল্প?
—জীবন সংসারের গল্প।
—আচ্ছা বলুন।

পুরুষ মানুষের প্রকৃত জীবন শুরু হয় সংসার জীবন শুরুর পর থেকে, মানে বিয়ে-শাদীর পর থেকে।
—হু,
বিয়ের আগ পর্যন্ত সংসারের প্রতি দায়িত্ব-বোধ পুরুষ মানুষের খুব কম থাকে। পড়াশোনা শেষের পর আমিও দায়িত্বহীন কর্মহীন যুবক ছিলাম। কাজ-কর্ম নাই, দিনে স্ট্রীট রোডে বার কয়েক পদধুলি রাখা, পাড়ার চায়ের দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা গাল-গল্প করে সময় খুব সুখেই কাটছিলো। চাকরি খোঁজার কোন তাড়া ছিলো না। বাবা মাঝে মাঝে বলতেন—সংসারের হাল টা এবার ধর, আমার বিশ্রামের প্রয়োজন। বাবার ওসব কথা শুনে মনটা একটু খারাপ হতো, ব্যাস এতটুকুই। চাকরি মানেই যে জীবনের ষোল আনা স্বাধীনতার বিসর্জন তা আমি বেশ ভালোই বুঝতাম। সবে মাত্র পড়শোনা শেষ করেছি যাক না কিছুদিন এরপর চাকরি নিয়ে ভাবা যাবে।

বাবা একদিন অসুস্থ হলেন। ডাক্তার দেখানোর পর জানা গেল, তার এই ব্যারাম আর নিরাময় যোগ্য না। তারপরও চেষ্টার কম রাখিনি, শহরের বড় বড় নামকরা ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হলো না, সকলের একই কথা, স্বয়ং ঈশ্বর ব্যতীত তাকে কারও পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব না। এইদিকে দীর্ঘদিন অফিস কামাই দেওয়ায় বাবার চাকরিটা চলে গেল।
জমানো টাকায় সংসার চলছিলো। বাবাকে দেখে মনে হতো না তার পশমের গোড়ায় গোড়ায় মৃত্যুর ডাক প্রস্ফুটিত হচ্ছে, মুখে অসুস্থতার কোন ছাপই ছিলো না। হয়তো তিনি শরীরের সব যন্ত্রণা দাঁত চেপে সয়ে গেছেন।
কিছুক্ষণের জন্য তিনি থামলেন এরপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, বিরক্ত লাগছে?

—মোটেই না, বলুন আপনি।

আমি তখন হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছি। পরিবারের জন্য কিছুই কখনো করার কোন দায়িত্ববোধ আমার মধ্যে কাজ করেনি, বাবা অসুস্থ হবার পর থেকে নিজেকে খুবই দায়িত্বহীন, অপদার্থ বলে মনে হচ্ছে। বাবা একদিন বিকেল বেলা আমাকে ডাকলেন।
—বাবা ডেকেছো?
—হ্যাঁরে, ডাকছিলাম। চল বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি।
—কোথায় যাবে?
—এই একটু হাটাহাটি করে আসি, তোর কি কোন কাজ আছে? তাহলে যেতে হবে না।
—নাহ, বাবা চল।

লেকের পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে বাবা বলল, রাহাত!

—বল বাবা।
—আসলে হাটতে আসাটা মূল উদ্দেশ্য ছিলো না, তোকে কিছু কথা বলতে বাইরে আসা। ব্যক্তিগত কথা কি না—তোর কি কাউকে পছন্দ করা আছে? মানে কাউকে পছন্দ করিস?
—নাহ বাবা, তেমন কেউ নাই, কেন বলতো।

—শরীরটা বেশি ভাল যাচ্ছে না বুঝলি, তোদের তো কোন গতি করে দিয়ে যেতে পারলাম না, কখন না কখন চলে যাই তার তো আর ঠিক নেই, যদি পছন্দ থাকে তবে বলতে পারিস।
—নাহ বাবা, তেমন কেউ নাই।
—আমাদের রিনুকে কেমন লাগে তোর?
—ভালোই তো।
—কেন জিজ্ঞাস করলাম, বুঝতে পারছিস তো?
—হ্যাঁ বাবা।
—যদি ওর সাথে তোর বিয়ে দেই, তোর কোন আপত্তি আছে?
—না, বাবা।

—তুই কি সবকিছুতে আমার অসুস্থতার কারণে পজেটিভ উত্তর দিচ্ছিস? দেখ তোকে যে বিয়েটা করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাদকতা নাই, তবে ইচ্ছা হয় তোর বিয়েটা দেখে যাই। আজ বাসায় গিয়ে ভাববি, সত্যিই যদি তোর মন সাড়া দেয় তাহলে কাল আমায় জানাবি।

গল্পের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো সবকিছু আমার চোখের সামনে ঘটছে। বাস্তবে ফিরলাম রাহাত আংকেল ডাকার পর। আংকেল বলল, কফিওয়ালা এসেছে, তুমি কি কফি নিবে? যদি নাও তাহলে বিল কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে আমার কাছে কোন টাকা-পয়সা নাই।

—আপনি কফি নিবেন?
—নাহ বাবা আমি কফি বিশেষ পছন্দ করি না।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, এরপর কি হল?
রিনুর সাথে আমার বিয়েটা খুব দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হয়ে গেল। বিয়ের কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় বাবা সবাইকে তার ঘরে ডাকলেন, আমাকে পাশে বসতে বললেন, আমি বসলাম এরপর রিনুকে ডেকে রিনুর হাত আমার হাতে রেখে বাবা বললেন, মেয়েটা খুব সহজ-সরল, মেয়েটাকে সবসময় দেখে রাখবি। কখনো কষ্ট দিস না। ঘরটা হাঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

বিয়ের পর চার মাস পর্যন্ত বেকার জীবন কেটেছে। এরপর যেই চাকরিটা পেলাম তার বেতন খুব বেশি ছিলো না, কিন্তু চাকরিটা করতে আমি বাধ্য ছিলাম। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলো মাথার উপর একটা ছায়া ছিল। বিয়ে, বাবার মৃত্যুতে সংসারের সব চাপ মাথায় এসে ভর করছিল।

মাঝে মধ্যে অফিসের কাজের মধ্যে স্মৃতির পাতা খুলে বসতাম। ছন্নছাড়া জীবনের পতন মনটাকে বিষন্ন করে তুলত

— যেই আমি কিনা স্ট্রীট রোড, চায়ের দোকানে সারাদিন পরে থাকতাম, সেই আমিই এখন মাসেও একবার স্ট্রীট রোডে যাই না৷ সকাল থেকে সন্ধ্যা আমার অফিসেই কেটে যায়, মাঝখানে কেবল একবার লাঞ্চ ব্রেকে আধাঘন্টার জন্য নীচে যাই।

ছন্নছাড়া জীবনে ছন্দ এসেছে পাড়ার অনেকে বলতো। জীবনের এই ছন্দই প্রত্যেক পুরুষের জীবনকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। পুরুষ জীবনে ছন্দ আসা মানে, রোজ সকালে স্নান সেড়ে গাড়িতে চেপে অফিসে যাওয়া, সারাদিন অফিসে কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলা আবারও গাড়িতে চেপে বাড়ি ফেরা, ভাগ্য ভাল হলে মাঝে মধ্যে সিট পাওয়া যায়, নাহলে পুরো রাস্তা হাতলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আসতে হয়। গাড়ি থেকে নামার পর বাজারে একটু উঁকিঝুকি মেরে বাসায় ফিরে কাপড় ছেড়ে মুখ-হাত ধুয়ে এক কাপ চা হাতে বারান্দায় অথবা ছাদে, এরপর রাতের খাবার শেষ করে দু’চার দশমিনিট টেলিভিশনে চোখ বুলিয়ে নিয়ে রাতকে বিদায় জানানো, এই ছন্দেই পুরুষদের জীবন অতিবাহিত হয়। একেই পুরুষ জীবনের ছন্দ বলা হয়।

আমাদের ঘরে প্রথম সন্তানের জন্ম হলো বিয়ের দুই বছর পর।
—ছেলে নাকি মেয়ে?
—ছেলে।
—এরপর?

ছেলের জন্মের পর সংসারের খরচ দ্বিগুণ বেড়ে গেল, অথচ আমার তখনো বেতন বাড়েনি। অসংখ্যদিন আমি-রিনু খাবারের যন্ত্রণা সয়েছি তবে ফাহিমকে কখনো খাবারের কষ্ট সহ্য করতে হয়নি।

রাহাত আংকেল কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমি জিজ্ঞাস করলাম, এরপর কি হলো আংকেল?
আমাদের ঘরে ফাহিমের পর ফাহাদ, ফয়সাল একে একে জন্ম নিল। ততদিনে চাকরি বদলে অন্য অফিসে ঢুকেছি, মাইনে বেশ ভালই পেতাম। সংসারে তিন ছেলের খরচ, বাজার সদাই করেও কিছু অবশিষ্ট টাকা থেকে যেত। সেই টাকা ফাহিমদের ভবিষ্যতের জন্যে ব্যাংক ডিপোজিটে জমাতাম।

ফাহিমরা দেখতে দেখতে একে একে বড় হল। মা ঘুমের মধ্যেই একদিন ওপারে পাড়ি জমালেন। মাকে হারিয়ে বেশ ভেঙে পরেছিলাম। রিনুকে প্রায় রাতেই কান্নাকাটি করতে শুনতাম। মায়ের অনুপস্থিতি যেন আমার চেয়ে তাকেই বেশি কষ্ট দিচ্ছিল। আমি কাঁদতাম তবে আমার কান্নায় কোন শব্দ হতো না, ভেতরে ভেতরে মনটা আমার ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেত অথচ প্রকাশ করতাম না। পুরুষ মানুষের খুব বেশিদিন শোকের ছাপ মুখে রাখতে নেই।
ফাহিম বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বিদেশ পাড়ি জমাল। এরপর ফাহাদ, ফয়সালও আমাদের ছেড়ে একে একে চলে গেল। পুরো বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। কখনো ভাবিনি ছেলেরা সব আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। ফাহিম-ফাহাদকে বিদেশ যাবার ব্যাপারে আমি কোন বারণ করিনি, ওদের মা খুব করে না করেছিল। মায়ের মায়া উপেক্ষা করে এটা সেটা বুঝ দিয়ে ওরা চলে গেছে।

ভাইদের মধ্যে ফয়সাল ছোট। ফয়সালও যখন ফাহিমদের মতন বিদেশ যাবার সিদ্ধান্ত নিল, বুকের ভেতরটা শূণ্যতার দহনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। তিন ছেলের মধ্যে কেবল ফয়সালকেই বলেছিলাম, তুইও যদি চলে যাস তবে আমরা থাকব কি করে বলত?

—বাবা এই তো চার বছর পরেই ফিরে আসব। দেখতে দেখতেই কেটে যাবে।
দেখতে দেখতেই যে কেটে যায় সে আমার জানা হয়ে গেছে। ফাহিম, ফাহাদ সেই যে গেল আর ফিরে এলো না। প্রথম প্রথম কিছুদিন বেশ যোগাযোগ করেছে, ধীরে ধীরে বাপ-মাকে ভুলে যেতে ভুল করেনি। ফয়সালও ভুলে যাবে।

অবশেষে ফয়সালও একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল। ফয়সাল যাবার পর থেকে রিনু কেবলই থেমে থেমে কাঁদে। আমি রিনুকে নিয়ে পার্কে যাই, ছুটিতে দেশের এক যায়গা থেকে আরেক যায়গা চলে যাই কিন্তু রিনুর কান্না থামে না। রিনুর মতন আমি কাঁদতে পারি না কারণ পুরুষদের কাঁদতে নেই, তবে কে জানে আমার মনে কত ঝড়, বৃষ্টি, টর্নেডো বয়ে যায়?

একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি রিনু বিছানার পাশে মেঝেতে পরে আছে। আমি ডাকলাম, রিনু! রিনু এখানে শুয়ে আছো কেন? উঠ, উঠ এক্ষুনি। রিনু উঠল না, কাছে গিয়ে রিনুর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, এই রাত করে মেঝেতে কেউ শুয়ে থাকে? ঠান্ডা লেগে যাবে তো উঠ, রিনু উঠল না। মনে খটকা লাগল, বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। ভয়ে ভয়ে গায়ে হাত দিলাম। রিনুর শরীর বরফের মতন ঠান্ডা, আমার রিনু শ্বাস নিচ্ছে না, গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পরে শুকিয়ে গেছে, তবে চোখ থেকে থুতনি পর্যন্ত দুটো রেখার স্পষ্ট দাগ এখনও রয়ে গেছে।
“বাবা মৃত্যুশয্যায় রিনুর হাত আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, মেয়েটা খুব সহজ-সরল, দেখে রাখিস, কখনো কষ্ট দিস না”। বাবার কথা রাখতে পারলাম কোথায়?

ছেলেদেরকে জানানোর ইচ্ছে হচ্ছিল না। যেই ছেলেরা সকল মায়া ত্যাগ করে মা-বাবাকে একলা ফেলে চলে গেছে, মায়ের মৃত্যু সংবাদ কতটুকুই বা তাদের মনে দাগ কাটবে?

তারপরও জানালাম।

—উনারা কি এসেছিলো?
—নাহ, ওদের এতো সময় কোথায়? ওরা তিনজনই জানাল, বাবা এখান থেকে চাইলেই তো চলে আসা যায় না, বেশ সময়ের ব্যাপার।

মায়ের মুখ শেষবারের জন্যে দেখার ইচ্ছা ওদের কারই হল না। রিনুর লাশের খাট কাঁধে নিয়ে ছুটলাম গোরস্থানের দিকে। পৃথিবীতে এই একটা মানুষই ছিলো, যে সুখে-দুঃখে সবসময় পাশে থেকেছে, কখনো ছেড়ে যায় নি। রিনুকে হারিয়ে একা হয়ে গেলাম, ভীষণ একা।

—আপনার ছেলেরা আর কখনো দেশে ফিরেনি?
—একবার তিন ছেলেকেই ডেকেছিলাম। বয়স হয়ে গেছে, যে কোন সময় যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে, বিষয় সম্পত্তি তিনজনকে বুঝিয়ে দিয়ে জীবনের শেষ দায়িত্ব পূরণ করতে পারলেই বাঁচি। ছেলেরা বড় হয়েছে যে যে যার যার মতন বিয়ে-শাদী করেছে, বাবা হয়েছে। নাতি-নাতনিদের কখনো কাছে পাইনি, ওসব নিয়ে কোন আক্ষেপ নাই, পৃথিবীতে যেমনি একা এসেছি তেমনি একাই যেতে হবে, শেষ টা বুঝিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু ওরা আর এলো না। আজ ওদের টাকা-পয়সার কোন কমতি নেই, ভিটেমাটি, কিছু পেনশনের টাকা এসব দিয়ে কি হবে ওদের? সেদিনের ছোট্ট ফাহিম যে কিনা গুড়ো দুধ ছাড়া ভাত পর্যন্ত খেত না, তাকে সেই গুড়ো দুধ কিনে দিতে বাবা-মাকে কত-শত বেলা উপোস থাকতে হয়েছে এসব ওরা জানে না। বাবা-মায়েরা সন্তানদের জন্য শত-সহস্র রাত উপোস কাটাতে পারে, কিন্তু তাদেরকে বড় করতে কত কি উৎসর্গ করেছে, কত রাত উপোস কাটিয়েছে, ভাল একটা জামা না কিনে সন্তানদের জন্য খেলনা কিনেছে সেসব প্রকাশ করতে জানে না। আমার বাবা-মাও কখনো প্রকাশ করেনি, আমরাও করিনি, হয়তো ফাহিমরাও করবে না।

বাড়িটা এখন বৃদ্ধাশ্রম। পৃথিবীতে কেবল আমিই তো একা নই, আমার মত অসংখ্য বাবা-মায়েরা একা। পেনশনের টাকা তুলে ব্যাংকে রেখে দিয়েছে, প্রতিমাসে যা লাভ আসে তাই দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের খরচ চলে।

গল্প বলতে বলতে রাহাত আংকেলের চোখ থেকে থেমে থেমে জল ঝরেছে, আমি নিস্তব্ধ হয়ে বসে তার চোখে তাকিয়ে আছি, বলার মত কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আংকেল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন—গল্পটা এখানেই শেষ। বাবা-মাকে কখনো ছেড়ে যেয়ো না, সন্তানদের ছাড়া তারা খুব একা, খুব অসহায়। আজ তাহলে উঠি, বলে আংকেল হাসপাতালের লাশ সংরক্ষণ ঘরের দিকে হাটতে শুরু করলেন। আমি নিশ্চুপ বসে রইলাম।

বাবা সপ্তাহ-খানেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠল। বাড়ি ফেরার কিছুদিন পর সকালে নাস্তার টেবিলে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলাম, একটা সাদাকালো পাসপোর্ট সাইজের ছবিতে চোখ আটকে গেল। ছবির পাশে লেখা—

“মৃত্যুর সাতমাস পর রাহাত হায়দার নামের এক বৃদ্ধকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ”।
পুরো খবর পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। রাহাত আংকেল যিনি নিজে আমার পাশে বসে তার জীবনের গল্প বলেছিল তিনি দীর্ঘদিন থেকে মৃত? তার আত্নাই কি তবে তার দুঃখের কথা প্রকাশ করেছিল আমার কাছে? এইজন্যেই কি তিনি লাশ সংরক্ষণ ঘরের দিকে গিয়েছিলেন? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, তবে একটি ব্যাপার বুঝতে পেরেছি, তিনি আমাকে কখনো বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে বারণ করেছেন, বুঝাতে চেষ্টা করেছেন সন্তানদের ছাড়া বাবা-মায়েরা রাহাত আংকেলের মতনই খুব একা, খুব অসহায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত