ন্যাবাকান্তের গপ্পো

ন্যাবাকান্তের গপ্পো

আজকের কাহিনী যাকে নিয়ে সে হল এককালের বিখ্যাত গায়ক নবকান্ত গায়েন।সুরের ময়েন দিয়ে যে একটা সময় সকলের মন জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা চরিত্তির করেছিল।তাতে ডাহা ফেল মারলেও নবকান্তর থুরি ন্যাবাকান্তর গানের গলা খারাপ ছিল এই কথাটা তার অতি বড় শত্তুরও বলতে পারবে না।এই নবু বা ন্যাবার গানের সুর যখন গগন ভেদ করে দ্রুত দিকে দিগন্তে পাখনা মেলছে;তার খ্যাতির পতাকা পতপতিয়ে উড়ছে, তখন তার গান শোনার জন্য বাচ্ছা থেকে চৌবাচ্ছা সকলেই ছটফটিয়ে মরতো একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই।কোথাও ন্যাবার গান আছে শুনলেই আমরাও অশান্ত হয়ে সেখানে দৌড় লাগাতাম।শ্রাদ্ধ বাসর থেকে অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন,বিদায়ী সভা থেকে অতিথি বরণ, অথবা মনসাপূজা থেকে যম পার্ব্বণ যাইহোক না কেন, এই সমস্ত অনুষ্ঠানে ন্যাবার তখন পাকাপোক্ত অধিষ্ঠান।

”পাখী তুই ঠিক বসে থাক, ঠিক বসে থাক, ঠিক বসে থাক রে, রাম কৃষ্ণনামের মাস্তুলে” —

বলে সুর ধরলেই পাখী কেন ন্যাবার মোটা, কালো, ধুমসো, তালকানা, বেসুরো কাকীও প্যাটপ্যেটে চোখে পাখীর বদলে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতো। ঠিক এই বিশেষ গানটি শোনার জন্যই আমাদের প্রাণটাও ছটফটিয়ে উঠত। মনে হতো পাখী ছাড়াও রাজ্যের ডানাওয়ালা প্রাণী যেমন- আরশোলা, চামচিকে, ফড়িং, মাছি সকলেই ঐ সুরের কাঁপনে যে যার জায়গায় বসে বসে নাচন লাগাবে।কেউ আর উড়বে না।ঠিক যেমন আমরা হাঁ করে ন্যাবাকান্তর মুখের ইস্টাইল,তার শব্দ উচ্চারণের ভঙ্গিমা দেখে হেসে-হেসে কাহিল হয়ে পড়তুম তেমনি পাখী আর পতঙ্গরাও উড়তে ভুলে যেত।ঐ অস্বাভাবিক মুখ বিকৃতি কিকরে করা সম্ভব তা আমরা ছোটবেলায় অনেক গবেষণা করেছি, ভেবেছি আর আয়নার সামনে মুখের ঐরকম বিকৃতি করার চেষ্টা করেছি।সে কথা আর কি বলব।কিন্তু ন্যাবার মত মুখ বেঁকিয়ে অমন নিখুঁত গান কিছুতেই গাইতে পারতুম না।তাই কোথাও ন্যাবাকান্তর গান আছে শুনলেই আমরা যেন হাতে চাঁদ পেতুম।

এই ঘটনাটা তখনকার যখন গানের জগতে এই ন্যাবার খ্যাতি একটু কমে এসেছে।বাজারে তখন ন্যাবাকান্তর পাশাপাশি ভ্যাবলাকান্ত,ক্যাবলাকান্ত,
ছিরিকান্তরাও গানের ছিরি দেখাতে শুরু করেছে।আধুনিক গানের ঢেউয়ে ন্যাবার ভক্তিমূলক গান কোথায় যে মুক্ত হয়ে চলে গেল কে জানে! ন্যাবার বিকট ম্যা ম্যা সুরের ডাক আর কেউ শুনতে চায়না। ন্যাবার ঘরে হাঁড়ি চড়ে না।এরমধ্যে শোকে তাপে, মোটা কাকীর বাক্যবাণের চাপে, ন্যাবার মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে যেতে শুরু করল।

এরই ভেতর খ্যাঁদারামবাবুর শ্রাদ্ধবাসরে গিয়ে ন্যাবা একেবারে একসাথে সকলের ছেরাদ্দ করে বসল।ভাবল আজকাল ভক্তিগীতি তো কেউ শুনতে চায় না,বরং যদি একটা অন্যরকম গান ভক্তিরসের সুরে ভিজিয়ে,ভাবের বন্যা বইয়ে গাওয়া যায় তবে হয়তো লোকে শুনবে।এই বলে বিকট মুখ ভঙ্গী করে-

”কাদের কুলের বৌ গো তুমি কাদের কুলের বৌ? যমুনায় জল আনতে যাচ্ছো সঙ্গে নেইকো কেউ— কেউ— কেউ—।”

বলে ভেউ ভেউ ভেউ করে কেঁদে গান শুরু করল।সেই বিকট চিৎকার আর কান্না শুনে খ্যাঁদারামের আত্মা একলাফে পৃথিবীতে নেমে আসার জোগাড়!মনে হল খ্যাঁদার বৌ আন্না ন্যাবার বিকট কান্না শুনে পগার পার হল বলে।জল দাও, হাওয়া দাও,সে বিষম ব্যাপার।ন্যাবাকে সকলে এই মারে তো সেই মারে।তাকে টাকা পয়সা আর কেউ দিল না।অগত্যা ন্যাবা প্যালার থালাখানা ঝুলিতে ভরে (শ্রাদ্ধবাসরে গান শুনে গাইয়ে কে টাকা দেওয়ার যে থালা) দে ছুট,দে ছুট।আর কি কেউ দাঁড়ায়!

এই ঘটনার পর থেকে গানের অনুষ্ঠান পাওয়ার জন্য ন্যাবা আরও মরিয়া উঠল।এমন সময় গড়িয়ার গড়াই বাড়ী থেকে ন্যাবাকান্তর একটা গানের অনুষ্ঠানের বায়না হল।অন্নপুন্নো পূজোয় ভক্তিমূলক শক্তিশালী গান গাইতে হবে।বড়লোক বাড়ী।অগাধ পয়সা তাদের।তারা আগাম হাজার টাকা দিয়ে তারা ন্যাবার সাথে গানের কথা পাকা করল।তখনকার দিনে হাজার টাকা মুখের কথা নয়।হাতে অগ্রিম টাকা পেয়ে আনন্দিত চিত্তে ন্যাবাকান্ত শান্তমনে আয়না নিয়ে বসে টেকো মাথায় টেরি কাটতে শুরু করল।অবিহাহিত ন্যাবা কাকীর সংসারে দিব্যি ফাঁকি দিয়ে দিন কাটাচ্ছিল।কাকী পষ্ট বলে দিল এখন থেকে গান গেয়ে ন্যাবা সংসারে যদি টাকা দিতে না পারে তো ন্যাবাকান্তর জন্য এইবার থেকে শুধু পান্তভাতই বরাদ্দ।

এদিকে অন্নপুন্নো পূজো সমাগত প্রায়।ন্যাবা একটা বড় দাঁও মারবে। এইবার আর কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।দিনে রাতে গানের তালিম চলছে-

”টাকা মাটি মাটি টাকা আজিকে এই মন্ত্র নিলাম”

বলে ফাঁকা ছাতে নানারকম যন্ত্র বাজিয়ে পাড়ার লোকজনকে বাড়ীছাড়া করবার উপক্রম করছে ন্যাবা।সকলে বলছে-

” ক্ষ্যামা দে বাবা ক্ষ্যামা দে!”

অন্নপুন্নো পূজোর ঠিক দু-তিনদিন আগে গড়িয়ার গড়াই বাড়ী থেকে টেলিফোন এল।গড়াই বাড়ীর গিন্নী রান্নাঘরে কড়াই উল্টে ভীষণরকম আহত হয়েছেন।তার অবস্থা ভাল নয়।এই যায় কি সেই যায়।হায়!হায়! তাই এবারের মত গানের অনুষ্ঠান বাতিল।ন্যাবা যেন ঐ হাজার টাকা ফেরৎ দিয়ে দেয়।ব্যাজার মুখে ন্যাবা ফস্ করে বলে বসল-

”গিন্নী যখন অসুস্থ তখন সিন্নী চড়িয়ে দিলেই হয়।টাকা ফেরৎ নেওয়ার কি দরকার পূজোর আসরে গান নাই হল ছেরাদ্দ আসরেও তো গান গাইতে লাগবে।কেননা এই বয়েসে কড়াই যখন উল্টেছে তা কি আর সোজা হবে?তাই গিন্নীর ছেরাদ্দের জন্য নয় তো অগ্রিম টাকাটা দেওয়া থাক।পরে বাকীটা দিলেই হবে।”

এই কথা শুনে গড়িয়ার গড়াই গিন্নীর ছেলেরা নাকি ন্যাবার বাড়ী এসে ন্যাবার পিঠে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়েছিল।ন্যাবার যেকটা দাঁত ছিল গড়াইদের ছেলেদের হাতের গুণে সব সাফ হয়ে গেছিল।তারপর থেকে হাফ পাগলা ন্যাবা আর কখনও গান গাইবার বায়না করেনি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত