আত্মহত্যা

আত্মহত্যা

ক্লাস সেভেনে থাকতে সব বন্ধুরা আমাকে অনেক ব্যঙ্গ করে ডাকতো বিভিন্ন নামে। এই ধরেন; হ্যাভা, ক্যাবলা, চিকনা, মরা, অপুষ্টি, দাঁতল ইত্যাদি। আমার অনেক কষ্ট হতো। আমি ছোট বেলায় যতটা না বাহিরের দিক থেকে কুৎসিত ছিলাম তার চাইতে হাজার গুন সুন্দর ছিলো আমার মনটা। আমার কল্প শক্তি কোনদিন হ্যাভা, ক্যাবলা এরকমটা মোটেও ছিলো না। আমি শারীরিক ভাবে ছিলাম এমন, সৃষ্টিকর্তা আমাকে এমনটাই বানিয়েছিলেন। বিশ্বাস করেন এখানে আমার কোন হাত ছিলো না। আমি সুন্দর স্বপ্ন দেখতে ভয় পেতাম। খেলতে গেলে বন্ধুরা আমাকে বলতো তুইতো বলের সাথে উড়ে যাবি তুই ক্যান খেলতে আসবি? সবাই হু হু করে হাসতো। আমি কিছু বলতে পারতামনা।

একদিন বাইক থেকে পরে গিয়ে আমার দাতগুলো উপড়ে চলে আসছিলো, তখন সময়ে এতো উন্নত চিকিৎসা আমাদের দেশে ছিলো না, রুট ক্যানেল, ক্যাপ পরানো, স্ক্যালিং, ফিলিং এ জাতীয়। তাই দাতগুলো এলোমেলো হয়ে বসানো হয়েছিলো। তারপর হয়ে গেলাম দাঁতল। আপসোস ছিলোনা, এরমধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে যাই। ক্লাস রুমে পেছন থেকে ছেলেরা ঢিল ছুঁড়তো আমার গায় তাই আমি একেবারে পেছনের সারিতে বসতাম। আমি এমন কঠিন অবস্থাটা ঠেলে পড়াশোনা করতে খুব বেশি কষ্ট হতো জানেন? মাঝে মাঝে মনে হতো পড়াশোনা ছেড়ে দেই, তাও ধৈর্য ধরে সয়ে গেছিলাম।

ছেলে মেয়েদের একটা সময় আসে যখন তার মধ্যে কিছু কিছু আবেগ কাজ করতে শুরু করে, তখন ছেলে মেয়েরা প্রেম করে প্রেমে পরে। মোস্টলি এটা ক্লাস নাইন থেকেই শুরু হয়। হ্যাঁ আমারো তাই হয়। আমার ক্লাসমেটরা অনেকেই প্রেমিকা জুটিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। ডেট করা, আমাকে দিয়ে চিঠি পাঠানো ইত্যাদি ইত্যাদি লুতুপুতু দেখে আমার মনেও কিছু একটা ফুটলো। প্রেম করার ইচ্ছে জাগলো। আমার একজনকে ভালো লেগে যায়। তার নাম ছিলো ঈশা। আমাদের সাথেই পড়তো অন্য সেকশনে ছিলো। এইবার আমার বন্ধুরা খুব সাপোর্ট দিতে লাগলো। আমার এতে ভালোই লাগছিলো, টিভিতে গান দেখলে আমি নিজেকে নায়ক হিসেবে কল্পনা করতাম আর ঈশা’কে নায়িকা হিসেবে। আমরা নাচতাম, রোমাঞ্চ করতাম কল্পনায়। তখনো ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি, এখনকার বিচারে ক্রাশ খাওয়া অবধি সীমাবদ্ধ আরকি।

বন্ধুরা সবাই প্রপোজ করার জন্য নানান কিছু শেখাচ্ছে। অবশেষে একটা দিন নির্ধারণ করা হয় ঈশাকে প্রপোজ করার জন্য। আমার মনে আছে, আগেরদিন সন্ধ্যায় ইস্ত্রি করার জন্য বাজারে নিয়ে আসছিলাম আমার সিল্কের শক্ত প্যান্ট আর কড়া লাল কালারের শার্টটা। পরেরদিন স্কুল ছুটির পর ওর বাড়ির পথে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। বন্ধুরা আমার পেছনে থেকে দেখছিলো। ঈশা আসতেছে, আমার হাটু ঘটঘট করে কাঁপতেছিলো। ঈশাকে বলছিলাম ঈশা একটা “কতা চিলো, ভয়ে “কথা ছিলো” শব্দটাও বের করতে পারছিলামনা। ঈশা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলছিলো, হ্যাঁ বলো কি বলবা। তারপর আমি ওরে ফুল দিলাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো কে পাঠিয়েছে? আমি বলছিলাম আমি। তারপর বলে, ফুল কেনো? আমি বলছিলাম, আমি ভালোবাসি। তখন ঈশা তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে বলছিলো তোমার মাথা ঐ শয়তানগুলো খেয়েছে তাইনা? এখন যদি একটা থাপ্পড় লাগাই তোমার গালে দেখবা তারা কি রকম মজা পায়? এটা বলে সত্যিই ঈশা আমার গালে থাপ্পড় মেরে বসে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আমার সব বন্ধুরা কোলাকুলি করে হাসতেছে।

সেবার থাপ্পড়ের চেয়ে ওদের ব্যবহার আমার খুব কষ্ট লেগেছিলো। ভেবেছিলাম তারা আমার বন্ধু। কিন্তু তারা মজা নেয়ার জন্যই আমার বন্ধু সেজেছিলো জানতাম না। তাও ঈশাকে আমি বলছিলাম ঈশা আমি সত্যি তোমাকে পছন্দ করি। ঈশা বলছিলো আয়নায় নিজেকে একটু দেইখা নিয়ো, যে’না চেহারা বাপরে! এটা নিয়ে প্রেম’ও করতে মন চায়? কিভাবে রে হ্যাভা মিয়া? ওর বান্ধবীরা আর আমার বন্ধুরা সবাই হাসছিলো, সবাই। আমি বাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। ঈশা যে গালে থাপ্পড় দিছিলো, যেখানটায় ওর হাতের ছোঁয়া আছে ওখানে আর ছুঁয়ে দেখিনি। অন্য গালে গুনে গুনে চল্লিশটা থাপ্পড় দিছিলাম আর কেঁদেছিলাম। খুব রাগ করছিলাম উপরওয়ালার কাছে। আমাকে এমন কেনো বানালেন ওনি? আমি কি কোন অন্যায় করছিলাম? আমি কেন এসব ভোগ করছি?

তারপর আর কোনদিন প্রেম ভালোবাসা আবেগকে জায়গা দেইনি এই মনে। ভেবেছিলাম পড়াশোনা করবো পড়াশোনার মতোই। লাগবেনা আমার কোন সঙ্গী কোন বন্ধুত্বতা। একাই এগুবো, জ্বি একাই লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রটা এসএসসি’তে বোর্ডে স্ট্যান্ড করে বসেছিলো। এটা বানোয়াট কিংবা মোটিভ ছিলোনা, এক্সেক এটাই হয়েছিলো। তারপর কলেজ লাইফ, ভার্সিটি, গুড ফ্রেন্ডস, পার্সোনাল লুক, হ্যাডসাম মুভমেন্ট, মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি, ক্যারিয়ার, অটোমোবাইল আর ডক্টর গফ যে কিনা আমাকে অনেক লাভ করে। ইভরিথিং আজ আমার আছে। সব কিছুই পেয়েছিলাম সেই দিনগুলোর জন্য। তারাই বাধ্য করেছিলো এই অবধি এগুতে। তাই হয়তো কবি বলেছিলেন নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো। আজকে তাদেরকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। আমি এতটুকু অবধি আসতে পেছনে একবারো তাকাই নাই। আজকে পেছনে তাকাবো। নিন্দুকদের এখন বড্ড মিস করছি। আজ দেখবো তারা কোথায়।

হ্যাঁ আমার স্কুল ফ্রেন্ডস গ্রুপের মধ্যে চারজন আজ সফল। তিনটা ফ্রেন্ড’ই ছিলো ক্লাসের ফার্স্ট সেকেন্ড আর থার্ড। ফোর্থ নাম্বারটা আমি। বাকি রোমিও’রা কেউ এলাকার বাজারে পান বিক্রি করে। কেউ বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে টানাপোড়ন জীবন যাপন করছে। কেউ বাউণ্ডুলে, কেউ বিদেশ কেউ নিরুদ্দেশ। এবার ঈশাকে খুব দেখতে মন চাচ্ছে। একটা বড় ভাইয়ের মাধ্যমে জানলাম ওর তিনটা বাচ্চা আছে। স্বামী মোটর মেকানিক। এলাকায় গ্যারেজ আছে। ওর বাচ্চার স্কুলে যাওয়ার পথে কোন এক সুন্দর সকালে দাঁড়ালাম। ঈশা তার বাচ্চাকে নিয়ে যখন আসছিল আমি দূর থেকেই ওর হাটা দেখে চিনতে পারছিলাম।

আবেগটা সেই প্রথম প্রপোজের মতোই কাজ করছে। চেহারা দেখার পর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কোথায় সেই সৌন্দর্য? কোথায় সেই ভুবন ভুলানো হাসি? কোথায় সেই কথার তেজ? একটা মধ্য বয়স্ক মহিলা এখন আমার স্বপ্নের নায়িকা। আমি দাঁড় করিয়ে বলেছিলাম, ঈশা ভালো আছো? ঈশা আমাকে চিনতেই পারেনি। আমি বলছিলাম ঈশা আমি রবিন। ঈশা কিছুক্ষণ উপর নিচ তাকালো; মেবি আর কি কি খুঁত অবশিষ্ট আছে খুঁজতেছিলো। পায়নি বলে হয়তো একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলেছিলো অনেকদিন পর দেখলাম। কোথায় আছো? বিয়ে করছো? হাহাহা ইচ্ছা করতেছিলো বলতে আমিতো সবে ছুটিয়ে প্রেম করছি, বিয়ে তো বাকি আছে। মহিলাদের এই একটাই সমস্যা? হাহাহা কিছুই বলিনি। ঈশা বারবার কিছু একটা বলতে গিয়েও পারছিলোনা। যাবার পথে কয়েকবার পেছন ফিরে তাকালো। জীবনের হিসেবটা হয়তো ওর মতে আজ মিলছে না। আমার ভালোই লাগছে। আজকে আমার সব আছে, সব। কারো কাছে হাত পাতার:আর অবশিষ্ট নেই।

আমরা সমাজে এমন অনেকেই আছি যারা সৃষ্টিকর্তার দয়ায় চেহারা, টাকা পয়সা ইত্যাদি পেয়ে অহংকার অহমিকায় আমরা অন্য মানুষকে মানুষ মনে করিনা। আমরা মানুষের দুর্বলতার যায়গাটাতে আঘাত করে মজা নেই। আমরা নিজেও জানিনা আমাদের অহংকার অহমিকায় একদিন আমরাই পিষ্ট হয়ে যাবো। যাদের নিয়ে মজা করি তারা একদিন স্ল্যাজ করবে। সেদিন আমরা থাকবো নিচে তারা থাকবে উপরে। নিজেকে সেদিন লুকোতে বড্ড ইচ্ছে করবে। আমরা পারবোনা লুকোতে। প্রকৃতির নিয়মই এটা। আবার আমাদের মতোই যারা হ্যাভা ক্যাবলা তাদেরকে সৃষ্টিকর্তা পরিপূর্ণ করেই পাঠান। এটা বুঝতে হলে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আর যেন কোন নিউজ পেপারের হ্যাডলাইন এটা না হয় যে; পরিবার, বন্ধুদের, পারা প্রতিবেশীদের ঠাট্টা অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা। হেরে গেলে চলবে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত