জীবন

জীবন

যেদিন মা আমার আর অয়নের কথা জানতে পারলো, আমাকে আর কোন কথা বলার সুজোগ দিলো না! না জানতে চাইলো অয়ন কেমন? না তার জানার ইচ্ছে হলো অয়নের পরিবারের কথা তাদের আর্থিক অবস্থার বৃত্তান্ত! শুধু জানিয়ে দিলো কিছু দিনের মধ্যে তোমাকে বিয়ে দিবো মানসিকভাবে প্রস্তুত হও!

ছোটবেলা থেকেই মা আমদের তিন ভাইবোনকে কড়া শাসনে মানুষ করেছেন।বাবাহীন সংসার হচ্ছে ছায়াহীন সংসারের মতো, কিন্তু তিনি তা হতে দেননি। তিনি ঘরের বাইরের সবকিছু একহাতে একা সামলিয়েছেন। এতো সবকিছু একা করতে গিয়ে নিঃসন্দেহে তাকে অনেক কঠিন অভিজ্ঞতা আর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশেষ করে সেই সময়টাতে যখন আমাদের কাছের মানুষগুলো নিরবে সরে দাড়িয়েছিলো দায়িত্ব পালনের ভয়ে! তার জায়গায় যে কেউ হলে ভেঙ্গে পরতেন, কিন্তু তিনি ভেঙ্গে পরেননি! আমদের যতটুকু যা ছিলো সেইটুকু নিয়ে আর আমাদের তিন ভাইবোনের মাথার ছায়া হয়ে তিনি বেচেঁ থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করেছেন এবং সফলও হয়েছেন।কিন্তু এতকিছু করতে গিয়ে তার সহজাত মাতৃত্বসুলভ আচরণটা কোথায় যেন মলিন হয়ে গেলো ! মাতৃত্বের চেয়েও আমদের উপর তার চলত বেশি কতৃত্ব! আর আমরা ভাইবোনেরাও সেই কতৃত্বটা যুক্তিযুক্ত মনে করতাম, আমরা তার মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতাম।

কিন্তু অয়নের কথা জানার পর তার আমাকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার বিষয় টা প্রথমবারের মতো তার কতৃত্ব খাটানোর অভ্যাসটা আমার কাছে নিষ্ঠুরতার সামিল মনে হলো! তিনি ইচ্ছে করলেই অয়নকে নিয়ে ভাবতে পারতেন, একবার ওকে ডেকে ওর যোগ্যতাও বিচার করতে পারতেন, কিংবা আমদের একসাথে বেচে থাকার ইচ্ছেটাকেও বাচিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু উনি কোন কথা শুনতে নারাজ ছিলেন! আসলে উনার এতো কড়া শাসনের ফাকফোকর দিয়ে বের হয়ে আমি একটা সম্পর্ক গড়েছি সেটা আমার মায়ের আত্নঅহমকে আঘাত করেছিলো! আর সেই আত্নঅহমটাকে পুনরায় যথাযথ জায়গায় নিয়ে এসে তা রক্ষা করাই তার প্রথম দায়িত্ব মনে হলো !না উনি আমাকে চোখে চোখে রাখেন নি, না জোড় করেছিলেন! মা ভালো করেই জানতেন উনার সিধান্তের বৈরিতা করার মতো এতো বড় দুঃসাহস আমার হয়ে উঠেনি!

অয়ন অনেক কেদেঁছিলো, আমাকে অনুরোধ করেছিলো তার সাথে পালিয়ে যেতে! যখন আমাকে রাজি করাতে পারেনি, তখন অভিশাপের পর্ব, আর তুমি আমার চেয়েও ভালো কাউকে পাবে এইসব নাটকীয় কথাবার্তা শেষ করে সম্পর্কটা সারাজীবনের জন্য চুকে গিয়েছিলো!

বিয়ের সিদ্ধান্তটা যত সহজে মা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলো তার চেয়েও সহজভাবে আমার বিয়েটা হয়ে গেলো ইয়াফি নামের সম্পূর্ন অচেনা এক মানুষের সাথে! আমি দেখেছিলাম মায়ের চোখে জল আমার বিদায়ের সময়, কিন্তু সেটা কষ্টের ছিলো না ছিলো গর্বের! তার সন্তান্দের জীবনের সিধান্ত নেওয়ার অধিকার তিনি এখনো হারাননি সেই অপ্রকাশিত আত্নগর্বের!

বিয়ের প্রথম কয়েকদিন মানুষটাকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছিলো , কিন্তু দিন কয়েক যেতেই তার আসল চেহেরা বেরিয়ে আসতে লাগলো! আমাকে তাড়াহুড়ো পাত্রস্হ করাতে মা এতোটাই ব্যাস্ত ছিলেন যে ছেলেদের পরিবার টাকাওয়ালা এর বাইরে তিনি আর খোজ নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেন নি! আমার বর ইয়াফি ছিলেন মাদকাসক্ত ! মূলত তার বাবা মা আমাকে এনেছিলেন বিয়ে সংসার হলে হয়ত তার ছেলে ভালো হয়ে যাবে সে আশায়!মানুষটা বাসায় ফিরতো মাঝরাতে কখনো বা শেষ রাতে, কোন কারন ছাড়াই সে নিয়ম করে আমার গায়ে হাত তুলত, আর যখন নেশা কেটে যেতো তখন আবার অনুতপ্ত হতো , সে আর এই কাজ কখনো করবেনা প্রতিজ্ঞা করতো , আর প্রত্যেকটা রাত আসতো তার সেই প্রতিজ্ঞাটা সহজ করে ভেঙ্গে দিতে! ঘুরেফিরে সেই একি আচরণ সেই একি নিয়ম করে আমাকে কষ্ট দেওয়া ! আমাকে দিয়ে যখন আমার শশুড় শাশুড়ির তার সন্তানকে ভালো করার মনবাসনা পূরন হলো না, তখন উনাদের মনে হলো আমি যাতে বাচ্চা নেই, তাদের পুরোপুরি বিশ্বস একটা বাচ্চা হলে ইয়াফি সেই সন্তানের টানে ভালো হয়ে যাবে!

সবসময়ের মতো আমার কাছের মানুষদের চাপিয়ে দেওয়া এই সিদ্ধান্তটাও মেনে নিলাম! বিয়ের ৬ মাসের মাথায় কনসিভ করলাম। নাহ, মানুষটার আচরনের কোন পরিবর্তন হয় নি ! সেই নিয়ম করে অভ্যাস মতো আমার উপর তার শারীরিক অত্যাচার চলতেই থাকলো! তবে সে না বদলালেও একটা জিনিস বদলেছিলো তার হাতের মার খাওয়ার অভ্যাসটা আমার হয়ে গিয়েছিলো! শরীরটাও অসাড় আর আমি অনুভূতিহীন হয়ে গিয়েছিলাম!

শশুড় শাশুড়ি মাঝে মাঝে আফসোস করতো , আমার বাচ্চা নেওয়া ঠিক হয় নি! তারা বুঝে গিয়েছে ইয়াফি কখনো ভালো হবে না! মাঝে মাঝে আমার শাশুড়ি আমার হাত ধরে কান্নাকাটিও করতো , জেনেশুনে তারা আমার জীবন নষ্ট করেছে এটা জন্য তাদের উপর যাতে দাবি না রাখি, আমি যাতে কষ্ট না পাই। আমার ভাগ্যে লিখা ছিলো সেজন্যেই তার ছেলে আমার জীবনে এসেছে, আসলে ভাগ্যর উপর কারো হাত নেই! এসব কথায় আমি বুঝতে পারতাম না তারা আমার এই দুঃদশার জন্য সহানুভূতি দেখাতো না নিজেদের সাফাই গাইত! তবে তাদের কাছে শুনতে শুনতে আসলেই আমার মনে হতে লাগল আসলেই আমার কপালটাই মন্দ এজন্য আমার সাথে এতো কিছু হয়!

মায়ের সে গর্বিত চাহনিটা মিলিয়ে গিয়েছিলো ! তার কতৃত্বের পর্ব শেষ হয়ে মাতৃত্বটা আবার জেগে উঠেছিলো! সে তার কাছে আমাকে নিয়ে যেতে চাইতো! সে এখানে আমাকে আর রাখবেনা। তার ভয় ইয়াফি যেকোন সময় আমার যেকোন ক্ষতি করতে পারে! আমি মাকে বোঝাতাম আরেকটু চেষ্টা করে দেখি সন্তানের টানে যদি মানুষটা সত্যিই ভালো হয়ে যায়।আসলে আমার শাশুড়ির মুখে একটা বাচ্চা হলে ইয়াফি ভালো হয়ে যাবে এই কথাটা এতোবার শুনেছি যে আমি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম আমাদের সন্তান আমাদের জীবনে কে বদলে দিবে,আর কয়েকটা দিন সন্তানের মুখটা দেখলেই ইয়াফি বদলে যাবে! আসলেই আমার বাচ্চার মুখটা দেখার খুব জলদি ছিলো ইয়াফির! তাইতো আমার সাত মাসের মাথায় আমাকে কিল ঘুসি মেরেও ক্ষান্ত হয়নি পেটে কয়েকটা লাথি দিতেও ভুল করেনি!

আহ,মৃত্যুযন্ত্রনা! কাছের মানুষগুলো জীবনের সিধান্ত নিয়ে যেমন জীবনকে সারাজীবনের জন্য বদলে দেয় এমন করে যদি কষ্ট যন্ত্রণাগুলোও ভাগ করে নিয়ে নিতো!

যমে মানুষে টানাটানি চলেছিলো তিনদিন! যম বেচারা দয়া করে জানটাকে রেখে গিয়েছিলো ! আর আমার বাচ্চাটা,আমার কলিজার টুকরাটা, একেতো সাত মাসের হওয়াতে প্রিমেচিয়োর তার উপর মাথায় আঘাত লাগাতে প্রতিবন্ধী হয়ে দুনিয়াতে এলো !

আর ফিরে যাইনি ঐ বাসায়! শশুড় শাশুড়িও সাহস করেনি আর আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার!

মা ইদানিং খুব অপরাধবোধে ভোগে, তার হুটহাট সিদ্ধান্তে আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো। তবে আশ্বস্ত করতেও সে ভোলে না যে , সে আবার আমার জীবনটা গুছিয়ে দিবে! ইদানিং সে পরিকল্পনা করছে আমার ছেলেটা যে নড়াচড়া করতে পারে না শুধু নাম মাত্র বেচেঁ আছে তাকে সে কোন একটা প্রতিবন্ধী সংস্থাতে দিয়ে দিবে,আর আমাকে নতুন করে আবার বিয়ে দিবে! আমার মা আমার জীবন চিন্তায় এতোটাই বিভোর হয়ে গেছেন যে, বরাবরের মতোই আমি যে কি চাই সেটা ভেবে দেখারও তার অবকাশ নাই!

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ছেলেটাকে নিয়ে দূর কোথাও চলে যাই! সব পরিচিত সম্পর্কের দায়বদ্ধতা থেকে দূর , যেখানে তারা আর আমার জীবনকে প্রভাবিত করতে পারবে না!না আমাকে জড়াতে হবে তাদের সিধান্তে! যেখানে শুধু আমি আর আমার ছেলেটা থাকবো , সেখানে যদি একটু অবসর পাই তাহলে খুজে বেড়াবো আমার আমিটাকে যেটা সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে গিয়ে হারিয়ে গেছে কোথাও !

নাহ, সেটাও সম্ভব নয়! আমার জীবনটা বরাবরই কাছের মানুষদের আর ভাগ্যবিধাতার দয়ার উপর ভর করে চলেছে। আর নতুন করে সেই নিয়ম করা অভ্যাস ভাঙ্গার মতো অবশিষ্ট মানসিক শক্তি আর সাহস আমার নেই!

শুনলাম মা নাকি আজকাল আবার অয়নের খোজখবর নিচ্ছে! কি অদ্ভুত যার নামটা পর্যন্ত একসময় শোনার ইচ্ছে হয়নি তার, আজকাল তার জন্যই সে অন্য কারো দারস্ত হচ্ছে!

মা সত্যিই আমাকে সুখী করতে চায়, না তার ভুলটা শুধরে দায়মুক্ত হতে চায় আমি বুঝতে পারি না! তবে অয়নকে নিয়ে তার ভাবনা টা আমাকে বেশ বিব্রত করছে।মাকে বলেছিলাম অন্তত অয়নকে নিয়ে যাতে সে আর না ভাবে। মা বলল,
—— সে কি রে! তুই ওকে পছন্দ করতি,ও তোকে পছন্দ করে, তাহলে তোদের নিয়ে আমার ভাবতে দোষটা কোথায়?
___ মা তুমি এতোটা নিশ্চিত হলে কিভাবে যে অয়ন আমাকে এখনো পছন্দ করে?
মার উত্তরে খুব অবাক হয়েছিলাম, তার ধারনা ভালবাসা আবার বদলায় নাকি! শুধু নতুন করে একটু ঘষেমেজে নিতে হয়!

আসলে পুরো বিষয়টা এরকম না! আমি ডিভোর্সি তার উপর এক বাচ্চার মা।আমার জন্য উনি যুৎসই পাত্র পাচ্ছেননা।যারাও আসছিলো তারা কেউ এক দুই বাচ্চার বাপ, নয়ত ডিভোর্সি অথবা বউ পালিয়ে গেছে নয়ত মারা গেছে!আমার নাক উঁচু মা এসব মানতে পারছেন না। তাই অয়ন ছিলো তার শেষ ভরসা, মায়ের ধারণা এতে উনার সম্মানও রক্ষা হবে আবার আমিও সুখী হবো ! আর অয়ন আমাকে এখনো পছন্দ করে এটা উনার মনগড়া গল্প!

মা যাকে দিয়ে অয়নের বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো তাকে নাকি অয়নের মা অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর বলে দিয়েছে এতোবড় দুঃসাহস যেন আর কোন দিন না করে। তারছেলে কানা নাকি খোঁড়া যে এক বাচ্চার ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করবে!

তবে মা আজ সকালে আমাকে সান্তনা দিয়ে গেছে অয়নের মার কথায় হবে নাকি, সে অয়নের সাথে সরাসরি কথা বলবে ছেলে রাজি থাকলে বাবামাকে রাজি করানো ব্যাপার না।আর অয়ন তো তোকে পছন্দ করেই সুতরাং চিন্তার কোন কারন নেই!

মায়ের হাতটা ধরে বললাম,
___ প্লিজ মা এইবার অন্তত থামো, আমার আর ভালো করতে চেয়ো না, এতো ভালো আমার সহ্য হচ্ছে না!
মা বললেন,
___শোন ঝিনুক একবার ভুল হয়েছে বলে বারবার ভুল হবে এতো কাচা মানুষ আমি নই। দেখবি এইবার আমি সবকিছু ঠিক করে দিবো!

মায়ের গোমরা মুখটা কেন জানি আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে! আমাকে এসে বলল,
___ঝিনুক অয়নের তোর প্রতি কেমন ভালবাসা ছিলো যে এই কয়দিনেই বদলে গেলো !
আসলে মা প্রথমে ভেবেছিলো হয়ত অয়নের বাবা মায়েরই শইধু অমত। অয়নের সাথে মা যখন সরাসরি কথা বলল অয়ন বারবার তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝাতে চাইছিলো সেটা আর সম্ভব না। কিন্তু আমার নাছোড়বান্দা মা যখন কোন কিছুতেই বুঝতে চাইলো না, তখন অয়ন সরাসরিই বলল , যে তার অন্য একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে সে তাকেই বিয়ে করবে।

মা আমাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বলল,
___তুই চিন্তা করিস না, আমি তোর জন্য অয়নের চেয়েও ভালো পাত্র জোগাড় করবো , বুঝছিস ছেলেটার কপাল খারাপ বলেই এরকম প্রস্তাব মাড়িয়ে গেলো!

এই কয়েক দিনে অয়নকে নিয়ে আলচনায় যেই অস্বস্তিতে ছিলাম আজকে সেই বোঝাটা নেমে গেছে, খুব হালকা লাগছে নিজেকে , তবে তার চেয়েও বেশি খুশী লাগছে এটা ভেবে যে অয়নের জীবনেটা থেমে যায় নি, সে নতুন করে পথ চলা শিখেছে। আসলে ” সময় বদলায় সাথে জীবন বদলায় আর বদলে যাওয়া জীবন অনুভূতিটাও বদলে দেয় আর সহজ নিয়মে অনেক সময় অনুভূতির মানুষটাও বদল হয়”

অয়নের প্রতি আমার আর অনুভূতিটা নেই, যেমন করে সময় তার কাছ থেকেও আমাকে মুছে দিয়েছে।”জীবন বদলাবে এটাইতো জীবনের ধর্ম। ”

আর আমার জীবন?যেটা থেকে হারানোর কিছু নেই সেটা নিয়ে ভাবাও অমূলক! তারপরেও হয়ত কোন একদিন বদলে যাবে কাছের মানুষদের সিধান্তে নয়ত ভাগ্যবিধাতার ইচ্ছায়!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত