শীতের রাতগুলো কেমন যেন রহস্যের গন্ধ ছড়ায় আমার কাছে। কিছুই নেই অথচ অনেক কিছুই আছে। মাঝে মাঝেই এই ব্যস্ত শহরে আমি রাতের বেলা চাদর মুড়িয়ে ঘুরতে বের হই। ব্যস্ত শহরের রাস্তাগুলো ততোক্ষনে নিজের ব্যস্ততাকে হারিয়ে খুঁজছে। সামনে ধোয়াময় কুয়াশা সাথে হালকা শিরশিরে বাতাস। গায়ে একটু কাপুনিও ধরে যায় সময়ে সময়ে। গ্রামে গঞ্জে এসব নিয়ে একটা কথা আছে। ঠান্ডার এই শিরশিরে হাওয়া সাথে শরীরের কাপুনির সাথে নাকি একটা ধোয়াটে সম্পর্ক আছে। এই সময়ে হুঁকা সহ আরও সব মাদকতার জিনিসগুলো নাকি শরীরে উষ্ণতা ছড়ায়। কিন্তু আমার আবার এসবে কিছু মনে হয় নি।
শীতের এই রাতে বিনা কারনে ফাকা রাস্তায় হেটে চলাটার মাঝেই আমি কেমন যেন মাদকতা খুজে পাই। যেখানে করার কিছুই নেই কিন্তু জিবনে শেখার অনেক কিছুই আছে। দিনে হয়তো আমরা এই শহরের ব্যস্ততাকে দেখি তবে রাতে শহরের নিস্তব্ধতার পাশাপাশি বাস্তবতা গুলোকেও দেখি। সেখানে চলমান জিবনের মর্মকথা নিঃশব্দে প্রতিফলিত হয়। হুটহাট দু একটা গাড়ি পাশ দিয়ে চলে যায়। আমি হাঁটতে থাকি। চারপাশের সবকিছু খেয়াল করার পাশাপাশি এ সময়ে পুরনো কথা গুলো ভাবতেও ভাল লাগে। নিজের ভুলগুলোকে দেখতে পারি। আবার অনেক সময় ফেলে আসা কিছু মুহুর্তের কথা মনে করে একা একাই হেসে ফেলি। লোকে এটাকে পাগলামো বলে তবে যে এই পাগলামি করে সেই এটার মজাটা বোঝে। আজও বেরিয়েছি তবে উদ্দেশ্য অনেক। রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে চলি তখন প্রায়ই পাশের আবাসিক বাড়িগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের কথা বার্তা শোনা যায়। কারও বাড়ি চিৎকার চেচামেচিতে ভরপুর আবার কারও বাড়ি একেবারেই নিস্তব্ধ। বুঝতে পারি না কে সুখে আছে আর কে দুঃখে। তবে ফুটপাতের ধার ঘেষে যেসব মানুষগুলো শুয়ে থাকে এরা কষ্ট করেও পরিবারের কথা ভেবে শান্তিতে আছে এটা বলতে পারি। রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যাই তখন অনেককেই দেখা যায় যে ফুটপাতের ওপর শোয়ার ব্যবস্থা করছে। কেউ বা শুয়েই পরেছে। আমি মাঝে মাঝেই তাদের সাথে বসে কথা বলার চেষ্টা করি। এতে করে তাদের জিবন আর সংগ্রামের বিদ্রোহী পরিসংখ্যান গুলো জানতে পারা যায়। এদিক দিয়ে স্টেশন অনেক প্রিয় একটা জায়গা আমার।
প্রিয় হলেও অনেক বিদ্বেষপূর্ণ জায়গাও আমার এটাই। কত কিছুর প্রাপ্তির সাথে শুন্যতার গল্পগুলো আমার স্টেশনকে ঘিরেই। কিছুদিন আগেই স্টেশনে মতিন নামে এক অর্ধবয়স্ক লোকের সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি এই স্টেশনেই রাত্রিযাপন করেন। অনেক জনের সাথে কথা বললেও এই লোকটি একটু অন্যরকম। তার সাথে কথা বললে জিবনের গল্পগুলোর ব্যাখ্যা পৃষ্ঠার বিপরীতে প্রতিফলিত হয়। লোকটি যে এই ব্যস্ত শহরে অনেক ধরনের কাজ করে এসেও রাত্রিরে একটু নরম গদিতে গা মেলে ধরতে পারেনা, এটা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। তার বলা শুধু একটা কথাই বারবার আমার কানে প্রতিফলিত হয় যে মামুন সাহেব জিবনে অনেক কিছুই তো হারিয়েছেন, কখনও কি হিসেব করেছেন যে হারিয়ে যাওয়া অপ্রাপ্তি গুলো আপনাকে কিসের প্রাপ্তি দিয়েছে? আর যা পেয়েছেন সেগুলো কি ভালভাবে আকড়ে ধরতে পেরেছেন আপনি? উনার এই কথাটা আমাকে আবারও আমার জিবন নিয়ে ভাবায়। একদিন উনি আমাকে বলেছিলেন, আচ্ছা মামুন সাহেব বলুন তো, একটা মানুষের বেঁচে থাকতে হলে কি বেশি জরুরী? এমন প্রশ্ন শুনে আমি উনার দিকে তাকালাম। বললাম, কাছের মানুষগুলোকে পাশে পাওয়া জরুরী। এটা শুনে উনি এক নাগারে কিছুক্ষন হেসে বললেন, ভুল বলেন নি আবার অনেকটা ভুলই বলেছেন। আমি কপাল সংকুচিত করে তার দিকে তাকালে উনি বলেন, জিবনে বেঁচে থাকতে গেলে নিজের মধ্যে সন্তুষ্টি থাকাটা জরুরী। মেনে নেওয়ার ক্ষমতা থাকা জরুরী। যদি মানুষ এটা ভালভাবে নিজের মনে গেথে রাখতে পারতো তবে কেউই অসুখী হতো না। ঠিক আপনি যেই প্রাপ্তির খোঁজে প্রায় সময়ই রাতে এখানে আসেন।হয়তোবা আপনিও আপনার জিবনে ঘটে যাওয়া কিছু মেনে নিতে পারেন নি।
স্টেশনে উনার সাথেই বসে আছি। আজ এই কথাটা আবার শুনে আমি উনার থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালাম। ভাবছি, আসলেই কি আমি সবকিছু মেনে নিতে পেরেছি আমার জিবনে। আমি যখন সামনে তাকিয়ে নিজের ভাবনায় বিভোর তখন মতিন সাহেব আবারও বলেন, কিছু অপুর্নতার ভোগান্তি মানুষকে একটু রহস্যময়ী করে ফেলে যার প্রতিফল কিন্তু আপনি। এটা শুনে আমি উনার দিকে তাকাতেই দেখি উনিও সামনে তাকিয়ে আছে। একটু হেসে বললাম, ভাবী কেমন আছে এখন? উনিও হাসলো প্রশ্নটা শুনে। আগের মতই একটু অসুস্থ। চিকিৎসা করাচ্ছি তবে খুব একটা ভালভাবে পারছি না। আমি বললাম, আর আপনার মেয়েটা? উনি বললেন, ও আছে ভালই ওর মায়ের সাথে। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপনাকে? এটা বলেই মতিন সাহেব আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, হুম বলেন। উনি বললেন, আচ্ছা আমার সাথে কথা বলতে আপনার খারাপ লাগেনা? কখনও কি মনে হয়নি যে একটা স্টেশনে পরে থাকা মানুষটা আমাকে এতো কিছু বলে যে আমার কাছে কিছুই না? আমি হাসলাম এটা শুনে। বললাম, আমার যদি খারাপও লাগতো বা আপনাকে এমনভাবেই দেখতাম তবুও কি আপনি মন খারাপ করে বসে থাকতেন? থাকতেন না। কাল সকালেই আপনি আবার আপনার কাজে চলে যেতেন আর রাত্রিরে এখানেই ঘুমোতেন। তাই আমার কোন কিছুতেই আপনার কিছু আসবে যাবে না।
আর আমার কেন যেন কারও ব্যাপারেই এরকম মনে হয় না। আপনি আমি এখানে গল্প করছি। আশেপাশের মানুষজন কেউই আমাকে আপনার কাতারের লোক ছাড়া কিছু ভাবছে না। তাই আমি এসবে ভেদাভেদ খুজি না। মতিন সাহেব আগের মতই একটু হেসে বললেন, গতবার যখন বাড়ি গিয়েছিলাম তখন মেয়েটা একটা জামা চেয়েছিল। ওই পাখি ড্রেস না কি যেন বলে। দিতে পারিনি। মেয়েটা একটু কষ্ট পেয়েছিল সেটা আমি বুঝেছি। তবে মেয়েটাও হয়েছে ওর মায়ের মত। কিছু বঝতে না দিয়ে বলল, এবার তার জামা লাগবে না তবে পরেরবার নিয়ে এলেই হবে। ওর মা বিছানায় শুয়ে থেকে তার মেয়ের এই ছোট্ট অভিনয়টা দেখে যে চোখের পানি আচলে মুচছিল এটা আমার চোখ এড়ায়নি। রাতে মেয়েটা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ওর মা আমার বুকে মাথা রেখে বলেছিল, এর পরেরবার ওর জন্য তুমি পাখি জামাটা নিয়ে এসো কেমন। আমি এখন অনেক সুস্থ হয়ে উঠছি তাই আর এতো ওষুধ লাগে না।
তুমি ওটার টাকা দিয়ে নতুন একটা জামা নিয়ে নিও মেয়েটার জন্য। আমি ওকে তখনি জড়িয়ে নিয়ে কপালে একটা চুমু একে দিয়ে বলি, তুমি চিন্তা করো না আমি সব সামলে নিব। একটু চুপ থেকে ও বলে, আমার জন্য তুমি অনেকটা থমকে গেছো জিবনে তাই না? আমি একটু হেসে বলেছিলাম, আমাকে কি তোমার এরকমটা মনে হয়। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনি তাই তোমায় সাথে নিয়েই আমায় এগোতে হবে। তাই মনোবল ঠিক রেখো। তোমাকে ভাল হতেই হবে। আমাদের স্বপ্নগুলো আমরা পুরন করবই। এসব কিছু শোনার পর ও আমার বুকেই কেঁদে চোখের জল ফেলছিল। এসব কিছু নিয়েই আমি ভাল আছি মামুন সাহেব। তাই সকাল থেকে শুরু করে রাত্রি পর্যন্ত কষ্ট করেও আমি ভাল থাকতে পারি। কিছু আশা আর কিছু পিছুটানই আজ আমার এতো কষ্টের মাঝেও দিনশেষে মুখের হাসিটার কারন। এদিকে আমি চেষ্টা করছি তাদের ভাল থাকার জন্য অন্যদিকে ওরা চেষ্টা করছে আমার কষ্টটুকু ভাগ করে নিয়ে আমার কাধের বোঝা কমানোর জন্য। এসব বলে মতিন সাহেব থেমে গেলো। পরিচয়টা কিছুদিনের হলেও কখনও উনি এতো গভীরভাবে এসব কিছু বলেনি। তাই তার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি তাকে কিছু বলতে যাব কিন্তু তখনি উনি বলল, কাউকে ভালবাসেন? আমি অনেকটা থমকে গেলাম এরকম প্রশ্নটা শুনে। তারপর উনি আবার বলল, অপেক্ষা জিনিসটা অনেক যন্ত্রনার জানেন তো। অনেক কাঠখোর পড়াতে হয় কিছু অপেক্ষার অবসান ঘটাতে হলে। আপনি কি জানেন আপনার চোখ সবসময় কাউকে সামনে খোঁজে। শুনেছি বুকের মাঝে কোন কিছু চেপে রাখলে তার ব্যাথাটা অনেকটা বেড়ে যায় তবে কাউকে বিশ্বাস করে শেয়ার করলে সেটা অনেকটা হালকা হয়ে যায়। এখন বাকিটা আপনার ওপর। মোবাইলটা বের করে দেখলাম রাত প্রায় দুটো বাজে। আজ আর ফ্লাটে ফেরা হবে না। তাই একটু নড়েচড়ে বসলাম। উনাকে দেখলাম ব্যাগ থেকে একটা মুড়ির টপলা বের করে সামনে রাখলো। আমি হাসলাম এটা দেখে। মুড়ি খেতে খেতে কিছু কথা বলে চলেছি…
ট্রেনে করে বাড়ি ফিরবো বলে এই স্টেশনে দাড়িয়ে ছিলাম। ট্রেন স্টেশনে ঢুকতেই গেট দিয়ে ঢুকার কোন অবকাশ পেলাম না। না উঠতে পেরে পেছনে দাড়িয়ে আছি। ট্রেন যখন একটু করে ছেড়ে দিয়েছে তখন আমি একটা জানালায় লাফিয়ে উঠি। তখনও ভেতরে যেতে পারিনি। ভেতরে যেতে পারছিলাম না কারন পা স্লিপ করছিল ট্রেনের বগির বাইরে। তখনি ভেতর থেকে এক মেয়ে আমার দুহাত ধরে ট্রেনে উঠিয়েছে। উঠার পর কোন কথা নেই দুই গালে দুটো চটকানা কে যেন মেরে দিল। আমি সামনে তাকাতেই দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি কিছু বলতে যাব তখনি পাশের একটা মেয়ে বলল, ট্রেনের গেট কি বন্ধ করে দিয়েছিল যে জানালা দিয়ে উঠতে চেয়েছিলেন? তারপর আস্তে আস্তে বলল, কই থেকে যে আসে এরকম লোক আল্লাহই ভাল জানে। আমি কিছু না বলে ঘাড়ের ব্যাগটা রেখে সিটে বসে পড়লাম।
ভাবছি মেয়ে মানুষকে কে বোঝাতে যাবে যে আজ ভিড়ের কি অবস্থা ছিল। তাই মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে একটু জিড়িয়ে নিচ্ছিলাম। তখনি হাতের তুড়ি বাজিয়ে কে যেন বলল, এই যে মি. অলিম্পিয়াড। মাথা উঠিয়ে দেখি মেয়েটি আমাকেই বলছে। মৃদু কন্ঠে বললাম, কিছু বলবেন? ও বলল, আপনি কি আমাকে চিনতে পারেন নি? আমি ভ্রু কুচকে তাকে দেখলাম কিন্তু কোনভাবেই তো মেয়েটাকে চিনতে পারছি না। তাই কিছু না বলে চুপ করেই থাকলাম। তখন মেয়েটি অনেকটা হতাশ মুখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, থানাভিত্তিক ম্যাথ অলিম্পিয়াড, আপনি প্রথম হয়েছিলেন আর আমি দ্বিতীয়। মহানগর মডেল স্কুল। এখনও মনে পড়েছে না, নাকি আরও কিছু বলতে হবে? আমি তখন অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। এখন একটু চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু তার নামটা মনে করতে পারছি না। এমন সময় ও বলল, কি চিনতে পেরেছেন? আমি ওকে চেনার চেষ্টায় দাড়িয়ে পরেছি দেখলাম। তাই সিটে বসে তাকে বললাম, চিনতে পেরেছি পেরেছি। কিন্তু মানে। ও তখন বলেই ফেলল আমি নবনিতা। আমি তখন অনেকটা জোরেই চেচিয়ে বললাম, নবনিতা, হুম, এবার চিনতে পেরেছি। ও তখন হাত দিয়ে আমাকে থামানোর চেষ্টায় বলছে, আস্তে আস্তে। আমিও বুঝতে পেরে বোকার মত দাড়িয়ে আছি। অনেকটা লজ্জা পেয়ে বসে পরলাম। ওকে আবারও দেখলাম তখন। নবনিতাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকটা পরিবর্তন দেখছি তার মাঝে। সেবারের অলিম্পিয়াডে তার থেকে এক মার্কের জন্য আমি প্রথম হয়েছিলাম। সে কারনে ও তখন রাগে আমার সাথে কথাও বলে নি। ওর রাগ দেখে আমার অনেক হাসি পেয়েছিল। সেদিনের পর ওর সাথে আর দেখা হয় নি। ট্রেনে হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেল আর আমি চিনতে না পারলেও সে আমাকে কেমন করে যেন চিনে ফেলেছে। মেয়েটাকে রাগতে দেখলে অনেক সুইট লাগে। তাই বলা যায় সে সময়ে আমার পছন্দ ছিল নবনিতা তাই অনেকদিন পর দেখে একটু উচ্ছসিত।
তার দিকে তাকিয়ে এসব যখন ভাবছি তখন বাম পাশের গালটা কেমন চেন চিনচিন করে উঠল। হাত আমার আপনা থেকেই গালে চলে গেল। থাপ্পরটা কে মেরেছে জানলে ওকে মেরেই ফেলতাম। গালে হাত দিতে দেখে পাশে নবনিতা একটু হেসে বলল, থাপ্পরটা লেগেছে? আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে ওকে বলি, আচ্ছা তুমি কি দেখেছো কে মেরেছে থাপ্পরটা? পাইলে আজ আমি ওকে খেয়েই ফেলবো। ও মুচকি হেসে বলল, পারবে না। আমি বললাম, কেন? ও বলল, কারন থাপ্পরটা আমি মেরেছি। এভাবে কেউ ট্রেনে উঠে? জানো এভাবে কতজন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে? তাই তখন রাগটা সামলাতে পারিনি। আমি একটু থমকে গিয়ে ওকে বললাম, রাগ সামলাতে শেখো নয়তো কিছুই সামলাতে পারবে না। ও কথাটার গুরুত্ব না দিয়ে হেসে উড়িয়ে দিল। আমিও তখন এই কথাটার মর্ম বুঝিনি তাই তার সাথে বিভিন্ন কথা নিয়ে গল্প করছি। এমন সময় পেছনের সীট থেকে কে যেন বলল, নবনি কি এতো কথা বলছিস? আমি যখন পেছনে মাথা উচু করে তাকালাম তখন দেখি এক মধ্যবয়স্ক লোক কথা বলছে। নবনি পরিচয় করিয়ে দিল যে ওর বাবা। আমি সালাম দিলে উনি সালাম নিয়ে বলল, তুমি নবনির পরিচিত কেউ? আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, জি আমরা বন্ধু। উনি উঠে সীটের পাশে এসে বলল, ভালই হল। বাবা তুমি পেছনে যাও তো। ভীড়ের কারনে সীট একসাথে পাইনি। তুমি পেছনে বসো আর আমরা বাপ বেটি একসাথে যাই। নবনিতার বাবা বলে আমি নাও করতে পারলাম না। অগত্যা পেছনে চলে যেতে হল। কোথায় ভাবলাম মেয়েটার সাথে একটু গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। সব গুড়ে বালি। তবে যেতে যেতে মাঝে মাঝেই ওর মুচকি হাসিটা আমার চোখ এড়ায়নি। ট্রেন থেকে নেমে ওর বাবা এসে ঠিক আছে বাবা, ভালো থেকো এসব বলেই কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল।
আমি থো হয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। তারপর প্রায় একমাস তার সাথে কথা বা দেখা কিছুই হয় নি। নবনিতাকে নিয়ে অনেক কিছু কল্পনাতে সাজানো শুরু করেছি আমি যেখানে ভিলেন ওর বাবা। এরপর একদিন এই ব্যস্ত শহরের এক পরন্ত বিকেলে তার সাথে আবারও দেখা হয়ে যায়। টিউশন থেকে যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন কেন যেন মনে হল যে চৌরাস্তায় এক কাপ চা খেয়েই যাই। পথিমধ্যে স্বপ্ন এর শো রুমটা চোখে পরে মনে হল একটা পারফিউম কেনা দরকার। তাই ভেতরে ঢুকে যখন পারফিউম দেখছিলাম তখন পেছন একজন একটা ব্রান্ডের পারফিউম বারিয়ে দিয়ে বলল, এটা দেখুন তো মি.। আমি হাত বারিয়ে পারফিউমটা নিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম নবনিতা দাড়িয়ে। অনেকটা বিশ্বাস হচ্ছিলো না ওকে দেখে। তার কথামতই আমি তাকে বললাম, আর দেখতে হবে না, আমার পছন্দ হয়ে গেছে মিস নবনিতা। ও হাসি মুখটা ধরে রেখেই বলল, আপনি কি শিওর যে আমি এখনও মিস থেকে মিসেস হয়ে যাই নি? আমি পারফিউম টার দিকে তাকিয়ে বললাম, হলেও হতে পারেন তবে আমার পারফিউমটা পছন্দ হয়ে গেছে, আমি এটার কথাই বলছিলাম। তবে সত্যি কি মিসেস হয়ে গেছেন কারও? ও তখন হেসে ফেলে বলল, থাক আর মুখটা কালো করে আপনি করে সম্মোধোন করতে হবে না। আমরা তুমিতেই ভাল আছি। মনটা একটু হালকা হয়ে গেলো কথাটা শুনে তাই আমার মুখ দিয়েও হাসি বেরিয়ে এলো। ওকে বললাম, চা খাবে আমার সাথে? একটু হেসে ও বলল, শুধু কি চা ই খাওয়াবে? আমি হেসে বললাম, চলো তবে। এরপর পারফিউমটা নিয়ে ও সহ একটা ক্যাফে তে বসলাম। চা এর অর্ডার টা দেওয়ার পরই ওকে বললাম, জানো, কেন যেন তোমাকে অনেক মিস করছিলাম আমি। ও মাথা নিচু করে বলল, আমিও অনেক মিস করেছি। আমি তার দিকে তাকিয়ে বলি, তোমার সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি আমি। উপরআলাও মনে হয় চায় যে আমাদের কিছু একটা….।
আমার দিকে তাকিয়ে ও মুখে লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে বলল, আমাদের কিছু একটা কি? আমি বলি, তুমি কি বুঝছো না? ও কিছু বলতে পারছে না। আমি তখন ওকে বলেই ফেললাম, দেখো এতো সাজিয়ে পেচিয়ে আমি কিছু বলতে পারি না। ম্যাথ অলিম্পিয়াড এর দিন থেকেই একটু একটু পছন্দ করি। তবে সেদিন ট্রেনে দেখে খুব বেশি ভাল লেগেছিলো তবে সেটা তোমার হিটলার বাবার সহ্য হয়নি। তবে সেদিন থেকেই তোমাকে আমার কল্পনায় সাজাতে শুরু করেছি। তোমার সাথে যোগাযোগের কোন কিছুই আমার কাছে ছিল না তবে কেন জানি মনে হত তোমার সাথে আমার দেখা হবে। আর আজ সেটাও হয়ে গেল। জানিনা এটাকে ভাগ্য বলে কিনা তবে আমি আর ছাড়তে চাইছি না তোমায়। আমার হাতে তোমার হাত রেখে সামনে এগিয়ে যাবে কি তুমি? কথা দিচ্ছি কষ্ট নয় বরং অল্প অল্প করে জমানো ভালবাসা দিয়ে তোমায় পুর্ন করে রাখবো। এসব শুনে ও শুধু তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। ততোক্ষণে আমি আমার হাত ওর দিকে বারিয়ে দিয়েছি। ও যখন আমার হাতটা হয়তো ধরতে যাবে তখনি এক ছেলে এসে চা দিয়ে গেলো। যার কারনে ও হাত বারিয়ে দিল না। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, কি ধরবে আমার হাতটা? ও এবার আমার দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে বলল, তোমার কি সব কিছুই বলে দিতে হবে? তুমি বোঝো না আমাকে? স্কুলে তোমার ওপর রাগটাই যে তোমার প্রতি মায়া নিয়ে এসেছিল। সেদিন বুঝেছি, কারও ওপর বেশি রাগ করবনা নাহলে কবে যে আবার ভালবেসে ফেলি। এটা শুনতেই আমাদের দুজনের মাঝেই হয়তো এক ঠান্ডা বাতাস ভেতরে শিহরিত হল৷
এরপর আমাদের মাঝে প্রেমের ফুলের কলি ফুটলো। দুজনে দুজনার খেয়াল রাখার পাশাপাশি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ গুলো দেখাতেই ফোনের টাকা ফুরিয়ে শেষ। কিন্তু সমস্যা হল যখন তার আমার মাঝে কোন বিষয় সমস্যা হিসেবে চলে আসতো। এই যেমন আজ এক ছেলে নাকি ওর পিছু নিয়েছে। পরেরদিন বলে, এক বড়ভাই ওকে চিঠি দিয়েছে। আমি ওকে বলি, তুমি এগুলো কেন নেও ওদের থেকে? ও বলে, বড়ভাই, না নিলে যদি খারাপ কিছু করে। আমি মুখ বন্ধ করে সহ্য করি। শুধু এসব নয় আরও অনেক এমন ঘটনার দিয়ে তার সাথে আমার সমস্যা হতে থাকে। ওকে অনেক ক্ষেত্রেই আমি বিভিন্নভাবে কিছু কাজ করা থেকে নিষেধ করি কিন্তু ভুলবসত ও ওগুলো করে ফেলে।
যার কারনে আমি ওকে অনেক বোকাঝোকা করি তবে ও এর বিপরীতে শুধু কান্না করে। ওর কান্নার ফলে ও কতটা কষ্ট পায় জানি না তবে আমি ওর থেকে কম কষ্ট পেতাম না। যেদিন শেষবারের মত ওর সাথে দেখা করি আমি সেদিন নিজের মনুষত্য হয়তো একটু বেশি নিচে নেমে গিয়েছিল। ও খেলতে পছন্দ করে। আর ও যখন ওর প্রতিবেশি ভাইবোনদের সাথে বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলতো তখন পাড়ার ছেলেপেলেরা নাকি অনেক দুষ্টুমি করতো। টোকাই ছেলেপেলেদের যা কাজ আরকি। তাই ওকে বলেছিলাম খেলাধুলা বাদ দিয়ে দিতে। রাস্তায় ছেলেপেলে ওর পিছু নিতো চিঠি দিতো তাই বলেছিলাম বাইরে বের হলে বোরখা পরে বের হতে। কিন্তু না ও মাঝেমাঝেই এসব ভুলে যেতো আর সেদিন সেটা আমি মানতে পারিনি। তাই ওর সাথে অনেক রাগারাগি করে ফেলি। ও তখন আমার সামনেই নিরবে কান্না করছিল যেটা আমার সহ্য হয়নি। তাই সেসময়ে নিজের মাঝে একটা সিদ্ধান্ত নেই যে আমার ওকে স্বাধীনতা দওয়া উচিৎ। আমার জন্য ও ওর অভ্যাসকে কেন ছেড়ে দিবে। অভ্যাসগুলোও তো এক ধরনের ভালবাসা যেগুলো নিত্য প্রয়োজনীয়। তাই তার ভালোর জন্য সেখানে আমি তাকে ব্রেকআপ বলে দেই। ও আমার হাতদুটো ধরে বলছিল যে ও আমার সব কথাই শুনবে তবুও যেন ওকে ছেড়ে না যাই। ওর কান্নাতে আমার চোখ দুটিও একটু ভিজে এসেছিলো কিনা তবে ওর যেন আর কষ্ট নাহয় এটার জন্যই আমি চলে আসি সেদিন। ও মাটিতে বসে পরে কাঁদছিলো তখন। কিন্তু তবুও চলে আসি।
দুদিন পর তার সাথে কথা না বলে কোনভাবেই চলছিল না। অনেক বেশি মিস করেছি এই দুদিনে। তাই ওকে ফোন দিলাম কিন্তু ওর নাম্বার বন্ধ বলছে। আবারও দিলাম একই অবস্থা। ওর বাসা আমি চিনি তাই ঠিক করলাম কাল ওর বাসায় যাবো। পরেরদিন ওর বাসার সামনে মাঠের এক পাশে দাড়িয়ে ওর অপেক্ষা করতে লাগলাম। একসময় দেখলাম বোরখা পরে একজন বের হল। যদিও বোরখা পরে ছিল তবুও আমার বুঝতে কষ্ট হয় নি যে ওটা নবনিতা ছিল। আমি গিয়ে তার সামনে দাড়াই। সে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে ধরলে আমি তার হাত ধরে ফেলি। ও একটা ঝাড়ি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, খবরদার । ভুলেও আমাকে ছোয়ার চেষ্টা করবেন না। আমি তখনি ওকে সামনে গিয়ে সরি বলি। কিন্তু ও সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল, এখন আপনি যেভাবে চেয়েছিলেন আমি সেভাবেই চলব। তবে আপনাকে ছাড়াই। আমিও সরি বলেছিলাম তবে সেটা কারও কানে যায় নি। কেউ তখন বোঝেনি যে অভ্যাসটা ছাড়তেও মানুষের একটু সময় লাগে। এসব বলেই ও চলে যায়। আমি নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারি কিন্তু কি করব? ওকে যখন গালি দেই তখন আমারই কষ্ট লাগে। আমি কেন যেন নিতে পারিনা আমার নিষেধ করা জিনিসগুলো ও করলে। তাই তো ওকে এভাবেই মুক্তি দিলাম কষ্ট থেকে। কিন্তু নবনিতা তো এটা চায় নি। ও তো চেয়েছিলো আমার মত করেই থাকতে। ঠিকি তে বলেছে ও যে অভ্যাসগুলো পাল্টাতেও একটু সময় লাগে। কেন বুঝিনি আমি এসব? পরের কয়েকদিন অনেকভাবে তাকে সরি বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তবে তার খোলা চোখ দুটি থেকে আমি কেবল ঘৃনা আর অবহেলাই দেখতে পেয়েছি। যেই দৃশ্য মনের চোখে ভেসে উঠলে আমার শরীরে শিহরন ধরে যায়। তাই আবারও মিশে যাই এই ব্যস্ত শহরে। একটু খানি ভুলে থাকার চেষ্টায় আর একটুখানি ভালবাসা পাওয়ার খোজে। তবে যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করি সেটা আবারও নতুন করে সব মনে করিয়ে দেয়। আর ভালবাসা, সেটা সবার থেকে পেলেও কেবল মনে হয় আমি নবনিতার থেকে উপেক্ষিত।
অনেকক্ষণ ধরে আমার জিবনে বিষন্নতার গল্পটা বলে যখন মতিন সাহেবের দিকে তাকালাম তখন উনি বললেন, জিবনে অনেক কিছু ঘটিয়েছেন আপনি মামুন সাহেব। তবে একটু পরিপক্কতার অভাব ছিল। আমি মাথা নেড়ে হাসলাম। দেখলাম, মতিন সাহেব আমার মতই একমুঠো মুড়ি হাতে নিয়ে বসে আছেন। টপলাটিতে এখনও আগের মতই মুড়ি রয়ে গেছে। উনি বললেন, নিজেকে কোনভাবে মানাতে পারছেন না আপনি তাই না? আমি এবার সামনে তাকালাম। মনে মনে ভাবছি, মানিয়ে নিতে পারলে কি আর অভিযোগে ভরা মনটা এই রাত্রিবেলা এদিক ওদিক মানুষের গল্পে নিজেকে কাটিয়ে দিতো? সব ঠিক থাকলে হয়তো আজ আমরা বিয়ে করে একসাথে থাকতে পারতাম। পাঁচটা বছর তার সাথে কথা না বলে তার ছবি না দেখে কাটিয়েছি। শুধু মন থেকে একটাই অভিযোগ ছিল যে, আমাকে ক্ষমা করে দিলে কি এমন হতো?
এর কিছুদিন পরে আমি মার্কেটে এসেছি। মতিন সাহেব সামনের বৃহস্পতিবার হয়তো বাড়িতে যাবেন। শুক্রবার, শনিবার তো এমনি ছুটি। সাথে রবিবারও সরকারি ছুটি। এর ফাকে একটু বাড়ি গিয়ে ঘুড়ে আসবেন তিনি। তবে এবারও তিনি তার মেয়ের জন্য জামা কিনতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তাই আমিই তাদের জন্য কিছু কিনতে এসেছি। মার্কেট করা শেষ হলে সন্ধায় বেরিয়ে ফুটপাতের পাশে বসা এক চাচাকে একটা কম্বল,লুঙ্গি আর শার্ট দিলাম। আরও অনেক জনের সাথেই পরিচিতি আছে আমার তাই তাদের জন্য কিছু কিনেছিলাম। সবাইকে সবারটা দিয়ে দিলাম। একটা ছোট লাগেজ নিয়ে মতিন সাহেবের কাছে আসলাম। উনি সবকিছু গুছিয়ে তৈরী। উনাকে বললাম, আমাকে নিয়ে যাবেন?
অনেকদিন হল আমি আমার গ্রামের বাড়িতে যাই না। নিয়ে যাবেন? উনি একটু হেসে বললেন, গরীবের বাড়িতে কি নিজের বাড়ির ছোয়া পাবেন মশাই? আমি হাসলাম এটা শুনে। উনি আরও বললেন, আপনিও এর মাঝে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারতেন। আমি বললাম, পারতাম কিন্তু নিজ শহরের বাতাসটাও মনে হয় আমাকে ঘৃনা আর অবহেলাই দিবে তাই সাহস করতে পারি না। প্লাটফর্মে একটা ট্রেন ঢুকছে তখন। মতিন সাহেব কাধের ব্যাগটি তুলে আমায় বললেন, হয়তো নিজ শহরের বাতাসটাই আপনাকে নিতে আসবে। আমি অহেতুক ধরে হেসে ফেলি। একটু পরেই উনি ট্রেনে উঠে গেল। জানালার পাশে এসে দাড়ালাম আমি। ট্রেনের ভেতর থেকে মতিন সাহেব বলল, জানালা দিয়ে উঠার চিন্তাভাবনা আছে নাকি? একটু হেসে লাগেজটা জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম আর বললাম, ভাবির খেয়াল রাখবেন সাথে আপনার মেয়েটারও। নিজের চিন্তা কিছুদিন পরেই করেন তবে আপনার থেকে এক কাপ চা পাওনা রইলো কিন্তু। ট্রেন ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে। আমি জানালায় হাত দিয়ে আছি। মতিন সাহেবের চোখটা কেমন যেন ভেজা মনে হল। জানালায় দেওয়া আমার হাতটাতেই উনার একটা হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। উনাকে তখন বললাম, ভালভাবে যাবেন। আর চা এর কথা ভুলবেন না। উনি ছলছল চোখেই হাসলেন। ট্রেন চলে গেলে আমি প্লাটফর্মে বসে আছি। ভাবছি এই ধরনের সম্পর্কগুলোর নাম কি? এসবের মাঝে কিসের এতো গভীরতা? কেন মতিন সাহেবের চোখে পানি ছলছল করলো আজ? আমি যদি এতটাই ভাল হয়ে থাকি তবে কেন নিজের থেকে পালিয়ে যাই? আমার কি একটু শান্তি আসবে না কখনও? এসবি যখন ভাবছি লোকের সমাগম অনেকটা কমে এসেছে স্টেশনে। তাই ভাবলাম ফ্লাটে যাই। তখনি পাশে থেকে কে যেন বলল, নিজের শহরকে ছেড়ে কি পরের শহরেই কাটিয়ে দেবে? কেন, নিজের শহরকে নিজের করে রাখতে ইচ্ছে হয় না? আমি এই কন্ঠ শুনে অবাক। অতি পরিচিত সেই কন্ঠ। কতদিন পর আবারও সেই উন্মাদনা। পেছনে ফিরে তাকাতেও ভয় হচ্ছে যদি এটা স্বপ্ন হয়ে হারিয়ে যায়। মাথা নিচু করে তাই চোখের পানিগুলোকে আটকাচ্ছি। তখনি ঘাড়ে কারও হাতের স্পর্শ পেলাম। এবার চোখের পানিগুলোকে আর আটকানো গেলো না। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি নবনিতা দাড়িয়ে। ওর চোখেও পানি। মনের ভেতরে যেন তীব্র অভিযোগ বারবার বলছে, কেন নবনিতা কেন? একটিবার কি ক্ষমা করা যেতো না? ভুলটা কি আমার এতটাই বেশি? একবারও কি ভেবে দেখেছো আমি কেন এমনটা করেছিলাম?
কিন্তু আমার মুখ থেকে কেবল একটা কথাই বের হল, অবশেষে তোমার অভিমান শেষ হল। তোমার রাগ আর অভিমানগুলো এতো দীর্ঘ কেন মেয়ে? রাগের সাথে এতো অভিমানটাও কিন্তু ভাল নয়। সামলাতে পারবে না। ও ক্রন্দন মুখেই বলল, গতবার ট্রেনে এটা বলেছিলে। আমি বললাম, তুমি বুঝেছো কি কেন বলেছি এসব? ও বলল, হ্যা বুঝেছি তবে নিজেকে তৈরী করতে সময় লেগেছে আমার। আমি বললাম, মানিয়ে নিতে পাঁচ বছর দুরে থাকতে হল তোমার? একটিবারও কি তোমার করা অবহেলা গুলো নিয়ে ভাবো নি। ও চোখের পানি মুছে বলল, হ্যা ভেবেছি তবে তোমার সামনে এসে দাড়াতে সাহস পাই নি। ভেবেছিলাম তুমি আসবে কিন্তু..। আমি বললাম, কিভাবে আসি বলো তুমি? কারও ঘৃনার চোখে চেয়ে থাকাটা যে আমার চোখ সহ্য করতে পারতো না। কথা শেষ হতেই ও আমার গালে হাত রেখে বলল, অনেক অভিমান জমেছে আমার ওপর তাই না? অভিমান ভেঙ্গে নিজের শহরকে তোমার করে নিতে পারবে কি? আমি এ কথা শুনে মাথা নিচু করে নিলাম কিছু না বলেই। ও তখন বলল, দেখেছো অভিমান কতটা খারাপ কিভাবে দুজনকে দুরে ঠেলে দেয় বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমিও তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলাম। অনেকদিন পর আমার শহর নিজের করে পেতে চলেছি। এই শহরটা আমার, সাথে শহরের সকাল থেকে শুরু করে পুরো রাতটাও আমার। এই শহরকে আর ছাড়ছি না।
জড়িয়ে রেখেই বললাম, আমাকে একটাবার ফোন করতে পারতে। ও বলল, পারতাম তবে করিনি। কেন তা জানিনা। হয়তো এই অভিমান। তখন আমি বললাম, আচ্ছা বাদ দাও সব। আমরা নতুন করে আমাদের সূর্য উদয় করবো। ও অনেকটা শক্ত করে ধরে বলল, না আমার পুরনো দিনের সূর্য কেই চাই। আমি হাসলাম এটা শুনে। ওকে বললাম, এখানে কিভাবে এলে? আমার খোজ কিভাবে পেলে? ও বলল, তোমার ফ্লাটে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি নেই তাই আশাহত হয়ে বাড়ি ফিরবো বলে স্টেশনে এলাম। আর তখনি তোমাকে ট্রেনে এক লোককে উঠিয়ে দিতে দেখি। সাথে অনেক কিছু কথাও শুনেছি। আমি বললাম, বাড়ি থেকে একা একাই চলে এসেছো তুমি? ও বলল, বাবা বিয়ের জন্য বললে তোমার সবকিছু বলেছি। তাই তো উনি এখানে নিয়ে এসেছেন আমাকে যে তুমি এখনও আমাকে ভালবাসো কিনা? আমি মজা করে বললাম, তোমার ভিলেন বাবাও এসেছে এখানে? তখনি নবনিতা মৃদু গুতো দিয়ে বলল, আমার বাবা হয়। আমি বললাম, ঠিকি আছে তবে তোমার আমার ভালবাসায় উনিই ভিলেন। পাশে থেকে ওর বাবা এসে বলল, হ্যা তোদের ভিলেন আমি। আর শত্রুতা করেই বিয়ে দিব তোদের। খুশি এবার? এবার নবনিতা হেসে ফেলল। ওর বাবা তখন বলল, ওকে কখনও আর কষ্ট দেবে না বুঝেছো? আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। এরপর ওর বাবা বলল, এখন তোমার ফ্লাটে চলো, কাল সকালে ট্রেনে সবাই বাড়িতে ফিরব।
একসাথে বাড়ি ফিরছি। ভাবছি জিবনে কত বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়। কারও ভাতের কষ্ট, কারও পোশাকের কষ্ট আবার কারও কিছু পাওয়ার আকুতি বা ভালবাসার কষ্ট। তবে দিনশেষে সবার জিবনটাই অনেকটা ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ আর রংচটা। তবে বাস্তবে জিবন তো এটাই। অনেকটা আলো আধারের খেলা। এজন্যই বাস্তবতাকে মানতে হয় বুঝতে হয়। জিবনের আসল মানে এটাতেই সীমাবদ্ধ। তাই ভাবছি এখন, মতিন সাহেব কেন যেন বলে গেলো যে শহরের বাতাসটাই আমায় নিতে আসবে। আর হলও ঠিক তাই। সবকিছুর শুরু কেন এই স্টেশনকে ঘিরেই? উদ্ভট সব প্রশ্ন এখন আমার মাথায়। তবে শুভদৃষ্টি গুলো এভাবেই বার্তা দেয় শুনেছিলাম। তবে মতিন সাহেবের থেকে এককাপ চা তো পাওনা রইলই। সেদিন বলা যাবে সবকিছু।