ঈশিতা কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। মুগ্ধ হই। মাথা ঝিম মেরে ওঠে। তারপর ওর দুই গালে আবার থাপ্পর মারতে থাকি। ঈশিতা গেঙিয়ে ওঠে, ওর চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ে। চেয়ারের হাতলের সাথে বেঁধে রাখা হাত দুটো নাড়াচাড়া করতে চায়। কিন্তু পারেনা। আমি ওর মুখে ভালোভাবে কসটেপ পেছিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাড়াই। ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে আধখালি মদের বোতলটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বাকিটা খালি করে ফেলি। তারপর আয়নার দিকে তাকাই। নিজেকে কেমন যেন অচেনা লাগে।
গতকাল রাতে আমি দু’টো খুন করেছি। প্রথমটা সুজয়ের এবং পরেরটা অনিকেতের। ওরা আমার বন্ধু ছিলো। ঈশিতারও বন্ধু। আমরা তিনজন ভার্সিটিতে একসাথে পড়তাম, একসাথে ক্যাম্পাসে আড্ডা দিতাম। ঈশিতার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো অনিকেতের মাধ্যমে। ঈশিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে পড়তো। হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেত আমাদের। তারপর কেমন করেই যেনো আলাপ পরিচয় এবং একসময় ভালোবাসা। আমি ওকে এই একটা বছরে আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সেই ছোটবেলা থেকে আমার বুকের ভীতরে একটা ভয়ংকর ঝড় বয়ে চলেছে। যার কারণে আমি সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম, নিজেকে খুব একলা করে রাখতাম। কিন্তু ঈশিতা আমাকে কেমন বদলে দিয়েছিল। আমিও কেমন করে যেনো আমার সবটুকু জড়তা, একাকিত্ব নিয়ে ঈশিতার মাঝে ডুবে গিয়েছিলাম। ভয়ংকর ভাবে ডুবে গিয়ে ছিলাম।
সপ্তাহে দুইদিন নিয়মিত দেখা করতাম আমরা। হাত ধরে হেঁটে যেতাম ধানমন্ডি লেক অথবা হাঁতিঝিলের ছায়া সুনিবিড় এলোমেলো রাস্তায়। কখনো আবার হুডতোলা রিক্সায় পাশাপাশী বিকেল নেমে আসতো আমাদের। মাঝেমাঝে সুজয় আর অনিকেতের সাথে দেখা হয়ে যেত। ওরা আমাদের দেখে দাঁত কেলাতো আর মজা নিতো। আমি হাসিমুখে ওদেরকে শর্মা খাওয়ার অফার করতাম। বলতে গেলে এই সময়টা ছিলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। অনিকেত সুজয় আর ঈশিতা ছাড়া আমার আর কাছের কেউ ছিলোনা। আমি আমার বিগত জীবন ভুলতে শুরু করেছিলাম ঈশিতা নামক এই মেয়েটির ছোঁয়ায়। প্রতিরাতে আমার দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যেত, তখন আমি ঈশিতার কথা ভাবতাম। ওর ছবি দেখে আবার ঘুমিয়ে যেতাম। আমার অতীত সম্পর্কে এরা কেউ কিছুই জানতোনা। শুধু জানতো আমি আমার এক মামার বাড়ি থেকে বড় হয়েছি। কিন্তু আমার অতীতটা ছিলো অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম।
আমার ছেলেবেলা কাটে সাতক্ষিরা জেলার একটা মফস্বল গ্রামে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই দেখেছি পরিবারের কোলাহল, অশান্তি। সেইসময় আমার বাবা ছিলেন এলাকার চেয়ারম্যানের ডানহাত। সারাদিন পর সন্ধ্যে হলেই গাদাগাদা মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতো। তারপর কারণে অকারণে মায়ের ওপর চালাতো অমানবিক নির্যাতন। আমার দাদিও ছিলো বাবার মতো। কখনো যৌতুকের টাকার জন্য, আবার কখনো অকারণেই দাদি আর বাবা মিলে মাকে মারতো। একদিন বিকেল বেলা আমি ঘরে খাটের ওপর বসে অঙ্ক কষছিলাম। ক্লাস সেভেনের পাটিগণিত অঙ্ক। বাইরে তখনো দাদি আর বাবা মিলে মায়ের সাথে ঝগড়া করছিলো। কিন্তু হঠাৎ মায়ের গগণ-বিদারি চিৎকারে আমি ছুটে বাইরে চলে আসি। এসে দেখি মা উঠোনে শুয়ে গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করছে আর তার মাথা ফেটে গলগল করে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
বাবা তখনো হাতে রক্তমাখা পিড়ি নিয়ে দাড়িয়ে ছিলো। দাদি ব্যাঙ্গ করে বলছিল ” থাক, মরতে দে হারামজাদিরে। মুখপুড়ির এমনিতেতো মরণ নাই। বাপের টাকাকড়ি কিছুই আনবেনা, আবার মুখের ওপর কথা!! মেরে ফ্যাল, একেবারে মেরে ফ্যাল।” আমি তখন দৌড়ে গিয়ে মায়ের মাথাটা উঁচু করে ধরি। মা আমার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়, কি যেন বলতে চায়। কিন্তু পারে না। আমার দুই হাত ভেসে যায় মায়ের রক্তে। আমি কাঁদতে থাকি, মা মা বলে চিল্লাতে থাকি। কিন্তু সেদিন কেউ আমার চিৎকার শোনেনি, কেউ মাকে বাঁচাতে আসেনি। মা মারা যাওয়ার পরেরদিন রাতে আমি আমাদের গাছকাটা লম্বা দা’টা দিয়ে প্রথমে আমার বাবাকে এবং পরে আমার দাদিকে খুন করি। কোথা থেকে এত জোর, এতো সাহস পেয়েছিলাম আমি জানিনা। কিন্তু দাদি আর বাবাকে কুপানোর পর আমার মাথাটা কেমন ঝিম মেরে ধরেছিল। আমি রক্তমাখা দা’টা মাথার কাছে রেখে বারান্দায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ি।
তারপর কতক্ষন শুয়েছিলাম আমি জানিনা, যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলাম আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আর আমার পায়ের কাছে দুজন পুলিশ দাড়িয়ে। আমি মুখ ঘুরায়ে ডান পাশে জানালার দিকে তাকাতেই আমার মাকে দেখতে পেলাম, আমার রক্ত মাখা মাকে। এরপর থেকে প্রায় একবছর আমি কারো সাথেই কোনো কথা বলিনি। আমাকে পুলিশের হেফাজতে রেখে প্রথমে হাজির করাহয় শিশু আদালতে। তারপর আদালত থেকে পাঁচ বছরের জন্য পাঠানো হয় যশোরের পুলের হাঁট এলাকায় “কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্রে”। এর ভীতর আমার লেখাপড়ার সুযোগ ছিলো। কিন্তু আত্মভোলার মতো জড়ো হয়ে একজায়গায়বসে থাকতাম আমি। কি যেনো কি ভাবতাম। এই ক্লান্তিকর দুঃসময়টাতে আমার পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন আমার এক দুঃসম্পর্কের মামা। তিনি সেসময় ফেনি সদর থানার এস পি ছিলেন। এক দুইমাস পরপর আমার সাথে দেখা করতে আসতেন। লেখাপড়ার তদারকি করতেন।
আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবতাম। আবার ঘুমানোর পূর্বে ভাবতাম সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে যাবো। আমার এই মামা হয়তো আমার মনের অবস্থাটা বুঝতেন। সেজন্য প্রতিবার দেখা করতে আসলে আমার হাত ধরে মিনতি করে বলতেন “বেঁচে থাক খোকা। নিজের সাথে কিছু করিসনা কখনো। বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।” আমি এই সংশোধন কেন্দ্র থেকে ছাড়া পাই ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। মামা আমাকে তার নিজের সাথে ঢাকায় নিয়ে যায়। এই মানুষটা আমার জন্য যা করেছেন, যে অসীম ভালোবাসা আমাকে দিয়েছেন তার কোনো তুলনা হয়না। মাথার ওপরে একটা বৃহৎ ছায়ার মতো তিনি আমাকে আগলে রেখেছিলেন।
ঢাকায় আসার পর আমার জন্য একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া করে দেওয়া, নতুন করে আবার লেখাপড়া শুরুকরা থেকে সবকিছুতে তিনি ছিলেন আমার মায়ের মতো। এভাবেই এই অচেনা ঢাকা শহরে শুরু হয় আমার নতুন জীবন। এরপর একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ছোটোখাটো পার্টটাইম জব শুরু করি। নিজেকে একটু একটু করে সামলাতে থাকি। আমি আমার এই গল্পগুলো কখনো কাউকে বলিনি। সত্যি বলতে এগুলো শুনানোর মতো কাছের কেউ ছিলোনা আমার। আমি আমার এই বিবর্ণ গল্পগুলো ঈশিতাকে বলবো ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার বুকের ক্ষত, আগুনে পোড়া অতীত সব একদিন ঈশিতার সামনে বইয়ের মতো মেলে ধরবো। কিন্তু তা হয়নি। বসন্তের এক ফাগুন ঝরা বিকালে ঈশিতা আমাকে ধানমন্ডি লেকের সামনে এসে দেখা করতে বলে। আমি সেদিন হাতে ঈশিতার দেওয়া ব্রাউন রঙের রোলেক্স ঘড়িটা পড়েছিলাম।
ধানমন্ডি লেকে গিয়ে দেখি ঈশিতা আর অনিকেত পাশাপাশী বসে আছে আর সুজয় একপাশে বসে বাদাম খাচ্ছে। আমি হাসিমুখে ওদের দিকে এগিয়ে যাই। সুজয় আমার হাতে বাদামের ঠোঙাটা ধরিয়ে দিয়ে বলে “দোস্ত তোর সাথে এসব প্রেম ভালোবাসা যায়না, তুই বরং বাদাম খা।” আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ঈশিতার দিকে তাকাই। অনিকেত অনেকটা সিরিয়াসলি ভাবে বলে “দোস্ত বিষয়টা আমি ক্লিয়ার করে বলছি। ঈশিতা এতোদিন তোর সাথে যা করেছে সব মিথ্যে, সব নাটক। আসলে আমি আর ঈশিতা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। প্রায় দুই বছরের সম্পর্ক আমাদের।” আমি অবাক হই। ভীষণ অবাক হই। প্রসন্ন বিকেলে ছায়া নিবিড় রাধাচূড়ার নিচে আমি অনিকেত আর ঈশিতার দিকে তাকিয়ে থাকি। এসবের মানে কি অনিকেত! কিসব বলছিস!! অনিকেত আবার বলতে শুরুকরে “দেখ ভাই তুই ব্যাপারটা বুঝবি। তুই সেই প্রথম থেকেই কেমন চুপচাপ থাকতিস, কারোসাথে কোনো কথা বলতিসনা।
তাই একদিন আমরা কথা বলতে বলতে ঠিককরি ঈশিতা তোর সাথে সঙ্গ দেবে, প্রয়োজনে তোর সাথে প্রেমও করবে, তোকে সবার সাথে মিশতে শেখাবে। তবে এই প্লানটা অবশ্য সুজয়ের ছিলো।” সুজয় আমার হাত থেকে বাদামের ঠোঙাটা কেড়ে নিয়ে আবার দাঁত কেলাতে থাকে। অনিকেত আবার বলে “ঈশিতার পরিবার ওর এক আত্বিয়ের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছে।সেজন্য প্লান করেছি সামনের সপ্তাহে আমরা পালিয়ে বিয়ে করবো। কিন্তু তার আগে তোর সাথে বিষয়টা ক্লিয়ার করতে চাচ্ছিলাম।” আমার গোধূলি রঙের ফাগুন আকাশ সেদিন একনিমেষেই বৈশাখে পরিনত হয়েছিল। চারিদিকের ব্যাস্ততা কোলাহল কিছুই আর শুনতে পাচ্ছিলামনা। মনেহচ্ছিলো বুকে কোথায় যেন ভীষণ বজ্রপাত হচ্ছে। আমি অসহায়ের মতো অবিশ্বাসি চোখে সেদিন ঈশিতার দিকে তাকিয়েছিলাম। ঈশিতা মাথা নিঁচু করে শুধু “স্যরি” বলেছিলো।
তারপর অনিকেত এসে আমার হাত ধরে বলেছিলো “দোস্ত ক্ষমা করে দিস। আর আমাদের জন্য দোয়া করিস।” আমার কানে আর কিছুই ঢুকছিলো না। শুধু এক দৃষ্টিতে দূরে ভীড়ভরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বারবার শুধু মনেহচ্ছিল “সব মিথ্যে!! এই প্রিয় মুখ, এই প্রেম,এই পরিচয় সব মিথ্যে!!!” তার অনেকটা সময় পরে ঈশিতা আর অনিকেত আমার সামনে থেকে চলেযায়। তারপর সুজয় আমাকে নিয়ে বাসায় পৌছে দেওয়ার জন্য রিক্সায় উঠে পড়ে। সুজয় সারাটা পথ শুধু বিটলামি করছিল আর বলছিল “টেনশন নিসনা বন্ধু, ফার্স্ট সেমিস্টারের যেকোনো একটা কিউট মেয়ের লগে তোর প্রেম করাই দিমু কথা দিলাম। তাছাড়া ঈশিতা আর অনিকেতের বিয়ে হলেতো আমাদেরই ভালো। কয়েকদিন বেশ জমিয়ে খাওয়া যাবে আর পেটে হাত বুলানো যাবে। তুই বরং কালপরশু একবার এসে আমার কাছ থেকে কিছু ছ্যাকা মারা গান নিয়ে যাস। হে হে ছ্যাকা খেয়ে তোর মুখের যা অবস্থা হয়েছে।”
সারাটা পথ আমি ওর সাথে কোনো কথাই বলিনি। রুমে এসে অনেক্ষন চোখবুজে শুয়ে ছিলাম। ঈশিতার কথা ভাবছিলাম। ওর সাথে কাটানো এই একটা বছরের প্রতিটা মুহুর্তের কথা ভাবছিলাম। ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে কাঁদি। বুকটা হালকা হোক। কিন্তু সেই ছেলেবেলা থেকে আমার চোখের সব জল মনেহয় শুকিয়ে ভীতরটা পাথর হয়ে গিয়েছিল। সোকেজের ভীতর থেকে বিয়ারেরবোতলটা বের করে কয়েকটা চুমুক দিতেই মনেহয়েছিলো “শেষ করে দেবো। সব শেষ করে দেবো।” অনিকেত আর সুজয় মহাখালী ওয়ারলেস গেটএলাকায় ছয়তলা এক ফ্লাটের তৃতীয় তলায় থাকে। গতকাল রাতে আমি যখন ওদের দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিংবেল বাজাই তখন রাত আটটা বাজে। সুজয় দরজা খুলে আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়। বলে “কিরে হালা, ফোন না দিয়ে একেবারে রুমে চলে এসেছিস! কি খবর??”
আমি হাসি মুখে রুমের ভীতরে ঢুকতে ঢুকতে বলি “সেদিন বললিনা ছ্যাঁক খাওয়া গান নিয়ে যেতে। তাই এলাম। কিছু ভাললাগছেনারে বন্ধু। তোর কালেকশান গুলো আমাকে সেন্ড কর। মনটা একদম ভালো নেই।” সুজয় দাঁত কেলাতে কেলাতে দরজা বন্ধ করে। তারপর বলে “চল বন্ধু, আমার রুমে চল। শুধু স্যাড সঙ নয় সাথে ঝাক্কাস জিনিষ দেবো। পুরাই নিউ কালেকশন। শুধু প্লে করবি, দেখবি এসব প্রেম বিরহ সব উধাও হয়ে গেছে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে সুজয়ের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলি “অনিকেত নেই??” নাহ, ও সেই সন্ধ্যেই বেড়িয়ে গেছে। দশটার দিকে ফিরবে হয়তো। দুদিন বাদে বিয়ে, বুঝিসইতো। সুজয় কথা বলতে বলতে আবার হাসে। আমি ওর খাটের ওপরে বসি। ও একটা চেয়ার টেনে বসে টেবিলের ওপরে ল্যাপটপটা ওপেন করে। কিছু স্যাড সঙ আমার পেনড্রাইফে সেন্ড করার পর আমার দিকে চোখ টিপানি দিয়ে একটা ভিডিও প্লে করে। আমি একটানা ওদিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর ধিরে ধিরে উঠে দাড়ায়। সুজয়ের নিকটে গিয়ে পিছন দিক থেকে ওর মাথাটা চেয়ারের সাথে চেপে ধরি।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই পকেট থেকে ছুরিটা বের করে ওর গলায় বেশ গভীর ভাবে একটা পোঁচ দেই। সুজয় ভীষণ ভাবে ছটফট করতেশুরুকরে। ওর গলা ফেড়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। টেবিল ল্যাপটপ সব রক্তে ভেসে যায়। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিলাম। সুজয় চেয়ার সমেত মেঝেতে পড়ে যায়। আমি আলনায় রাখা ওর টি-শার্টে রক্তমাখা ছুরিটা মুছে আবার পকেটে রেখে দেই। এরপর অনিকেতের জন্য অপেক্ষা করি। রাত প্রায় দশটার দিকে অনিকেত এসে দরজায় বেল বাজায়। আমাকে দরজা খুলতে দেখে অবাক হয়ে বলে “তুই এসময়!! কি সংবাদ? সুজয় কৈ?” আমি দরজা লাগিয়ে অনিকেতের দুই হাত ধরি। তারপর বেশ আতঙ্কগ্রস্থের মতো বলি “দোস্ত সুজয় মরে গেছে। কে যেন ওকে মেরে রেখে গেছে।” অনিকেত এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে “কি যা-তা বলছিস মালখোর দের মতো?” আমি এবার আরো খানিকটা সিরিয়াসলি ভাবে বলি “বিশ্বাস কর দোস্ত, সুজয় ওর ঘরে মরে পড়ে আছে। কে যেন ওর গালা কেটে মেরে ফেলেছে।” অনিকেত আমাকে সরিয়ে সুজয়ের ঘরে যায়। টেবিলের ওপর রক্তমাখা ল্যাপটপে তখনো ভিডিও প্লে হয়ে আছে।
অনিকেত পাগলের মতো কিছুক্ষন সুজয়ের বডিটা নাড়াচাড়া করে। তারপর উঠে এসে আমার জামার কলোয়ার ধরে কিছুটা ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বলে “শালা শুয়রের বাচ্চা। তুইই মেরেছিস সুজয়কে। তোকে আমি আমি অনিকেতকে অনুনয় করে বলি “আমি মারিনি অনিকেত। বিশ্বাস কর,আমি মারিনি।” কিন্তু অনিকেত বিশ্বাস করেনা। আমি যত বলি “আমি মারিনি”, ও তত জোরে আমার গলা চেপে ধরে। আমি সুযোগ মতো একহাত দিয়ে ওর কলোয়ার ধরি আর অন্যহাতে ছুরিটা নিয়ে ওর পেটে ঢুকিয়ে দেই। একবার, দুইবার, তিনবার, অনেকবার তারপর আরো অনেকবার। জ্ঞানশুন্যের মতো এলোপাতাড়ি ছুরি মারতে থাকি। একসময় আমার দম শেষ হয়ে আসে। ক্লান্ত হই। দেখি ওর পেঠ চিরে নাড়িভুঁড়ি খানিকটা বেরিয়ে গেছে আর ওর চোখদুটো বড়বড় হয়ে ভয়ঙ্কর ভাবে পিছনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি ঠেলা দিয়ে অনিকেতকে মেঝেতে ফেলে দেই। আলনায় ঝুলতে থাকা টি-শার্টে আবার ছুরিটা মুছতে মুছতে বলি “আমার অগোচরে তোরা যে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখেছিলি বন্ধু, সেই ঘরের প্রতিটি কোনা আমি রক্তে ভিজিয়ে দেবো।” এরপর আজ সকালে অনিকেত আর সুজয়ের মৃত্যুর খবর জানাজানি হওয়ার আগেই আমি ঈশিতাকে শেষ বারের মতো দেখা করার অনুরোধ করি। তারপর ওদের বাড়ির সামনে থেকে বেশ কড়া ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে সোজা আমার রুমে। চেয়ারের ওপর ঈশিতার বৃথা নড়াচড়ার খুটখাট শব্দে আমার ধ্যান ভাঙে। টেবিলের ওপর খালি মদের বোতলটা রেখে আমি ওর দিকে এগিয়ে যাই। ইশিতার ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আতঙ্কে আর কান্নায় চোখদুটো আগের থেকেও বেশী লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। সকালে এখানে আনার পর ওর জ্ঞান ফিরলে প্রথমে আমাকে ভীষণ ভাবে থ্রেট দিতে থাকে। কিন্তু সুজয় আর অনিকেতের মৃত্যুর সংবাদদিয়ে আমি যখন বললাম “তোকেও আজ মেরে ফেলবো।” তখন ও অনেকখানি ভয় পেয়ে যায়। তারপর আমার কাছে কাকুতি করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আমি তখন ওর মুখে বেশ ভালোকরে কসটেপ মেরে দেই।
ঈশিতার দুই গালও টকটকে লাল হয়ে গেছে। আমি একদম ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে যাই। ওর গরম ভয়ার্ত্ব নিঃশ্বাস আমাকে স্পর্শ করে। আমি আবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর হঠাৎ ওর মুখে আমার বাবা আর দাদির মুখ ভেসে ওঠে। আমার মাথার ভীতর ঝিমঝিম শুরুহয়। আমি দুইহাত দিয়ে ঈশিতার গলা চেপে ধরি। আমার শরীরের সব শক্তি দিয়ে ওর গলা চেপে ধরি। ও ভীষণ হাত-পা ছুড়তে চায়, পারেনা। এরপর একসময় শান্ত হয়। একদম পাথরের মতো শান্ত। আমি দুইহাত দিয়ে ওর মুখটা উঁচুকরে তাকিয়ে থাকি। ওর মুখে হাত বুলাই, কপালে হাত বুলাই। আমার খাটের ওপর পড়ে থাকা ল্যাপটপে তখন বেজে চলে.. I hate you, I love you I hate that , I love you. Don’t want to but I can’t put nobody else above you…সন্ধ্যে প্রায় ছুঁয়ে এসেছে। চৈত্রের আকাশ কেমন যেন গম্ভীর হয়ে আছে। মেঘের ঘনঘটায় বেশ অালো কমে এসেছে চারিদিকে। আমি জুতোজোড়া ছুড়ে ফেলে দিয়ে খালি- পায়ে হাঁটছি বনানীর নিউ এয়ারপোর্ট রোডের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইন ধরে। দক্ষিনা বাতাস হু হু করে বয়ে চলেছে।
এই যায়গাটা আমার বেশ প্রিয়। আগে নিজেকে যখন খুব একলা একলা লাগতো তখন প্রায় সময় এই রেললাইনের পাশে এসে বসে থাকতাম। ঈশিতাকে মারার পরে সেই দুপুরের দিকে আমি রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। পুলিশ হয়তো এতক্ষনে আমাকে ধরার জন্য হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেদিকে আমার কোনো খেয়াল নেই। আমি এখন আমার কথা ভাবছি।। আমার বিগত জীবনের কথা ভাবছি। দূরে হুইসেল বাজিয়ে ঢাকাগামী ট্রেন ছুটে আসছে। আমার বুকের ভীতরেও খুব গভীরে আজ হুইসেল বাজছে। আলোহীন বিবর্ণ এই গোধূলিতে আমি আমার এক জীবনের সবটুকু বিষণ্ণতা, হাহাকার হাতের মুঠোই নিয়ে রেললাইনের ওপর শুয়ে পড়ি।
অনেকদিন পর এই প্রথম খুব শান্তি বোধ হচ্ছে আমার। ট্রেন অনেকখানি কাছে চলে এসেছে। আমি দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে জোড়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলি। তারপর শেষবারের মতো চোখ বুজি। দু’চোখে ভেসে ওঠে রঙ হারারনো অস্তগামী একটা বিবর্ণ সূর্যের ছবি, ইশিতার মুখ, আমার মায়ের মুখ। চারিদিকে বেজে চলে প্রশান্ত কোলাহল, একটা পাখির ডাক, ট্রেনের কড়া হুইসেল। তারপর…
(সমাপ্ত)