আনিস সাহেবের বহুদিনের শখ একটা ভাল জাতের বিদেশি কুকুর পোষার। তিনি জানেন, কাঁটাবনের পশু পাখির মার্কেটে আজকাল নানা জাতের ভাল ভাল বিদেশি কুকুর বিক্রি হচ্ছে । তাই একদিন নিজের শখ পূরণের আশায় রওনা দিলেন কাঁটাবনের পশুপাখীর মার্কেটে ।
মার্কেট ঘুরে রীতিমতন হতবাক হওয়ার মত দশা তার । কোন জাতের প্রাণী নেই সেখানে ! হাজারো রকমের রঙ বেরঙের মাছ বিক্রির জন্য ভেসে বেড়াচ্ছে এ্যাকুরিয়ামগুলোতে । কত্ত রকমের বিচিত্র সব পাখি থরে থরে সাজানো খাঁচার মধ্যে বন্দী অবস্হায় অপেক্ষা করছে কোন ধনী ব্যক্তির বাড়ীর শোভা বর্ধনের নিমিত্ত হবার জন্য ! কয়টা দোকানে কিছু ছোট ছোট বর্ণিল কাছিমের বাচ্চা দেখে তো আনিস সাহেবের লোভই হল রীতিমতন তাদের ছুঁয়ে একটু আদর করে দেবার !
কিন্তু না ! তা তিনি করলেন না । কারন তার উদ্দেশ্য একটা কুকুরের বাচ্চা সংগ্রহ করা । তাই অন্যদিকে না ভেবে তিনি মনোযোগ দিলেন কুকুরের দিকেই !
কিন্তু আনিস সাহেবকে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এই কুকুরের বাচ্চা পছন্দ করতে গিয়েও ।
কত্তো রকমের কুকুর এরা বিক্রি করে রে বাবা ? এমন বাহারী কুকুরের অনেকগুলোকে আনিস বলতে গেলে এই জীবনের প্রথমবারের মত দেখছে । এবং বলতে নেই , প্রত্যেকটা কুকুরই তার মন কেঁড়ে নিচ্ছে । ইচ্ছা করছে , সবগুলোকে নিয়ে একসাথে বাড়ী চলে যায় ।
কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না ! পকেটের ব্যাপারটাও ভাবতে হবে ! তাই শেষমেষ খুঁজে পেতে কালো রঙের লম্বা পাতলা গড়নের একটা কুকুর বাছাই করলেন আনিস সাহেব ।
দোকানদার অনেকক্ষন ধরেই আনিস সাহেবের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল । তার অভিজ্ঞতায় সে এখন কে ক্রেতা আর কে নিছকই ঘোরাফেরা করা পশুপ্রেমী দর্শক – তা এখন দেখলেই বুঝতে পারে । এবং আনিসকে দেখেও তার সত্যিই একজন উৎসুক ক্রেতা বলেই মনে হল । যদিও সেই সাথে এও বুঝতে তার বাকী রইল না যে এই উৎসুক ক্রেতাটি কোন শাঁসালো খদ্দর নয় । এর কাছ থেকে মোটা লাভের আশা করা ভুল হবে । এর সাধ থাকলেও সধ্য মনে হচ্ছে খুব সীমিত । সুতরাং এই ভদ্রলোকের সাথে খুব সাবধানে নরম ব্যবহার করতে হবে !
দেখা যাক কি হয় !
এই ভেবে আনিস সাহেবের দিকে এগিয়ে এল দোকানদারটি নিজের আসন ছেড়ে ।
– স্যার , এটা কি পছন্দ হয়েছে আপনার ?
বিনীতভাবে আনিস সাহেবকে জিজ্ঞেস করে বিক্রেতা ।
– অ্যা … হ্যা !
– খুব ভাল স্যার । আপনার অভিজ্ঞতা আছে মনে হচ্ছে ! আপনি পাপি চেনেন নির্ঘাৎ !
– পাপি ?
-মানে এটার কথা বলছিলাম !
সামনের খাঁচায় দাঁড়িয়ে লেজ দুলাতে থাকা কুকুর ছানাটার দিকে ইশারা করে বিক্রতা লোকটা ।
-ও আচ্ছা! তা এটার দাম কতো ভাই?
-স্যার এটা একটা পিওর এ্যালশেশিয়ান! কোনরকম ক্রশ করা হয়নি !
এই বলে বিক্রেতা সবিস্তারে কুকুর ছানাটির বংশগৌরবের মাহাত্ব পুংখুনাপুংখ তুলে ধরলো আনিস সাহেবের সামনে । বলতে নেই, আনিস সাহেব বেশ প্রভাবিতও হলেন বিক্রেতার কথায় ।
– আচ্ছা সবই না হয় বুঝলাম ! তা এটার দাম কত ?
-স্যার অন্যসময় হলে বেশি চাইতাম । কিন্তু আপনি আমাদের প্রথম কাষ্টমার আজকের । আর তাছাড়া আপনার যেহেতু এটা বেশি পছন্দ হয়ে গেছে তাই ছোট করে নেবার মতন দাম বলে দিচ্ছি স্য্যার ! আপনি স্যার দশ হাজারই দেন !
বলে এমনভাবে বিগলিত হাসি হাসলো বিক্রেতা আনিস সাহেবের দিকে চেয়ে যেন রীতিমতন মুফতেই দিয়ে দিয়ে দিচ্ছে জিনিসটা।
-দশ হাআআআজাআআররর !
বোঝা গেল বিক্রেতার হাসি বিন্দুমাত্র আস্বস্ত করতে পারেনি আনিস সাহেবকে ! বরং দাম শুনে চমকে গিয়ে রীতিমতন তোতলাতে শুরু করলেন তিনি ।
– আমি কিন্তু মোটেই বেশি চাইনি স্যার !
– বেশি চাননি মানে ? ভাই বলেন কি ? এই কুত্তার বাচ্চাটার দাম দশ হাজার টাকা ?
– দ্যাখেন ভাই একে কুত্তার বাচ্চা বইলেন না ! এটা এলশেশিয়ানের বাচ্চা !
এবার যেন সত্যিই একটু উষ্মা প্রকাশ পেল বিক্রেতার কন্ঠস্বরে ।
তাড়াতাড়ি তাই নিজেকে শুধরে নেয়ার চেষ্টা করলো আনিস সাহেব।
– আচ্ছা আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে আমার ! তা ভাই , এটা মানে এই পাপিটা দুই হাজার টাকায় দেয়া যায় না ?
– দুই হাজার টাকা !
দাম শুনে বিক্রেতা এমনভাবে তাকালো আনিস সাহেবের দিকে যেন ভিনগ্রহের কোন প্রাণী দেখছে ।
-হ্যাঁ ভাই !আমার বাজেট কম !
অনেকটা যেন অপরাধীর মতই মিনমিন করে বললেন আনিস সাহেব ।
-না ভাই ! এইদামে দেয়া যায় না । আপনার জন্য একদাম আট হাজার টাকা রাখা যেতে পারে । দেখেন ভাই এই দামে কিনলেও আপনি ঠকবেন না ! আপনি ইচ্ছা করলে বাজার যাচাই করে দেখতে পারেন । এই দামে কেউ আপনাকে এমন এ্যালশেসিয়ান দিতে পারবে না !
এবার সত্যিই যেন একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন আনিস সাহেব । খানিকটা সময় নিলেন বুঝি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ।শেষমেষ নিজের ক্রয়ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবধি যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন বুঝি !
যা থাকে কপালে ! এই এ্যালশেসিয়ানটা কিনবেনই !
– ভাই আমি আপনাকে লাষ্ট তিনহাজার দিতে পারবো ! দিয়ে দেন ভাই !
যেন মিনতিই করেন আনিস সাহেব বিক্রেতার কাছে ।
কিন্তু বিক্রেতার মনে হয় মন গলল না । উল্টা যেন খানিকটা উপহাসের হাসিই হাসে লোকটা ।
– না স্যার! আপনার দামের চাইতে দিগুনেরও বেশি দিয়ে আমাদের কিনতেই হয়েছে এটা। তাই দিতে পারছি না । যদিও দিতে পারলে খুশীই হতাম । যেহেতু বিক্রিই আমাদের কাজ ।
বলে একটু থামলো বিক্রেতা লোকটা ।
-আসলে কি জানেন স্যার , তিন হাজার টাকায় আজকাল হয়তো একটার বদলে একজোড়া মানুষের বাচ্চাও কিনতে পারাও সম্ভব! কিন্তু এ্যালশেসিয়ানের মত সৌখিন জিনিস কিছুতেই নয় !
কথা শুনে ভীষণ অবাক হয় বিক্রেতার মুখের দিকে তাকালেন আনিস সাহেব । লোকটা তার সঙ্গে রসিকতা করছে ভেবে কড়া একটা জবাব দেবেন বলে ঠিক করে ফেলেছেন তিনি ।
কিন্তু না, বিক্রেতার মুখের দিকে তাকিয়ে বা কথার মধ্যে এতটুকু উপহাস বা রসিকতার চিহ্নমাত্র খুঁজে পেলেন না আনিস সাহেব !!!!
( সমাপ্ত )