ছেলেটা কাছাকাছি থাকতে চায় সবসময় বলে মনে হয় ডা. মাশার কাছে । এমবিবিএস ও, চাকরী নিয়ে ঢাকা থেকে চলে এসেছে চিটাগাংয়ের এই ’মা ও শিশু’ হসপিটালে । গত কিছুদিন থেকেই দেখছে ও যে, বিশেষ করে শনিবার ছুটির দিনে ৮/৯ বছরের এই ছেলেটা পিছ পিছ ঘুর ঘুর করছে ওর ।
কেমন যেন একটা মায়া আছে ছেলেটার চোখে-মুখে । না পারে কিছু বলতে ওকে, আবার বিরক্তিও লাগেনা । কাজের ফাঁকে ফাঁকে চেয়ে থাকে সময় সময় খানিকক্ষন, আবার ডুবে যায় কাজে । এক আধবার গালও টিপে দিয়েছে ছেলেটার, ভালই লাগে । কেমন যেন মনে হয় ওর, নিজেই বোঝেনা ।
এই ছেলে, তোমার নাম কি ? অবসরের একসময় জিঞ্জেস করে ও ।
দিপু, বলে ছেলেটা ।
দিপু ! তুমি বাংগালী ?
না, মারমা । বাংগালীও বলতে পারো ।
মানে ?
মানে মা মারমা, বাবা ছিল বাংগালী ।
ছিল মানে ! এখন নেই ?
না নেই, মারা গেছে ।
কোলে টেনে নেয় ছেলেটাকে মাশা । আদরও করে কিছুক্ষন ।
মার কাছে যাই বলে ছুট দিয়ে পালিয়ে যায় ছেলেটা ।
আপু কি করো ? পরদিন আবার ডেকে উঠলো ছেলেটা ওর পেছন থেকে । কথা বলছেনা দেখে ওর কামিজের একটা অংশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে দিপু । এক রোগীর সাজেশন দিতে ব্যস্ত তখন মাশা, বাঁ হাতটা দিপুর মাথায় ।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় দিপুর মাকে । আগেরবারে চিকিতসার সময় দেখেছিল থামি (আদিবাসী মেয়েদের লুংগী-ধরনের পোষাক)পরা এক মারমা মহিলা, কিন্তু এবার দেখে আটপৌরে একখানা শাড়ি পরা । মনে হচ্ছে যেন এক বাংগালী মহিলা ।
’নমস্কার’ বলেন ম্যনাচিং, দিপুর মা ।
একইভাবে মাশাও বলে প্রতিউত্তরে ।
আপনারতো খুব ভক্ত হয়ে গেছে দিপু, ও কালকে বলে আপনি তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছেন । আজ তাই আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি মা ।
না, কেন জানি মনে হোল, ওর বাবা নেই বলে খুব অসহায় ও, তাই আদর করতে ইচ্ছা হোল খুব, সেইজন্য আর কি । আমারওতো বাবা …
কথা কেড়ে নিয়ে ম্যনাচিং বলেন, কি হয়েছে আপনার বাবার ?
না, মানে মারা যাননি হয়তো এখনও, তবে নিখোঁজ । অবশ্য এরকম নিখোঁজ হওয়া উনার নতুন নয়, আগেও একাধিকবার হয়েছে এরকম ।
ও আচ্ছা, আমারও বাবা নিখোঁজ হয়ে গেছেন, সে অনেক বছরের কথা মানে প্রায় ২৫/৩০ বছর আগে থেকে উনি নিখোঁজ । আমার মা তাঁর জন্য চিন্তায় চিন্তায় মারাই গেলেন বছর কয় আগে । উনাদের বার্মা (মায়ানমার) যাতায়াত ছিল । শেষবার গিয়ে আর ফিরে আসেননি ।
আশ্চর্য, এতো মিল আমার আপনার সাথে ? আমার, আন্টি, বাবা ইন্ডিয়া যান, ঘুরে বেড়ান । বছরে দু’একটা বইও বের হয় ওনার, ইঞ্জিনিয়ারিং কিছু কাজ জানেন, কাজ করে নিজে কোনমতে চলেন, আর ঘুরেন ।
আপনার মা-কে নিয়ে যাননা ?
মাকে নিয়েও একবার উধাও হয়েছিলেন, আমরা জেনেছিলাম দিনকয় পরে । মাসখানেক বাদে দেখি চলে এলেন আবার । আসলে বাবার কিছুটা মানসিক অসুস্থতা আছে বলে আমার মনে হয় ।
আপনার মা বাধা দেননা ?
বাধা দিলেও হয়না । উনি তো আর বলে যাননা আমরা বাধা দিব বলে ।
কাজের সময় ডা. মাশার এখন, ডাক এসেছে, ছুটতে হোল কাজে । বলে গেল, আপনার বাসাতো কাছেই, অবশ্যই বেড়াতে আসবেন আন্টি । আর দিপুতো যাবে এখন আমার সাথে, চলো দিপু । আপনি ভিতরে বসেন আন্টি ।
পেটের খিঁচুনির কারনে এই হাসপাতালে কয়েকদিন ভর্তি ছিলেন ম্যনাচিং । সেই সূত্রেই ডা. মাশার সাথে পরিচয় । কিন্তু এক পরিচয়েই সম্পর্কের এক বিচিত্র দিগন্ত উন্মোচন হলো যখন তাদের, হৃতপিন্ডের দু-একটি বিট সেই মুহূর্তে তাঁর বন্দই হয়ে গিয়েছিল । ছোটবেলায় বাবাকে পেতেন অনিয়মিত, তারপর একসময় আর কোনদিনই দেখতে পেলেননা । তারপর একসময় বিয়ে হয়, পাঁচমাসের মাথায় স্বামীর সাথে ডিভোর্স । সন্তানহীন ম্যনাচিং ভালই চলছিলেন । অফিসে মূদ্রাক্ষরিকের সকাল-বিকেলের কাজ, আর বাসায় নৈমিত্তিক সময় কাটানো । এমন সময় আসে দিপুর বাবার আহ্বান । ওরই অফিসের বস, ঢাকায় থাকে দুই মেয়ে আর স্ত্রী, আর তিনি এই পাহাড়ে ওদের ইঞ্জিনিয়ারিং বস ।
না, খুব বেশী ভালবাসাসি ছিলনা তাদের মধ্যে । ম্যনাচিং এর একাকীত্ব ওদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার দ্বিতীয় কারন, কিন্তু প্রথম এবং বলা যায় প্রধান কারনই হাসান । লোকটার আহ্বানে কিরকমভাবে যেন মোমের মত গলে যান ম্যনাচিং । গোপনে বিয়ে করেন তারা এক কাজী অফিসে এবং কেটে যায় একটি বছর এরপর ।
বিয়ের পর কেন যেন হাসানের উচ্ছ্বাসটা কিছুটা মন্থর গতি পায় । বিয়ের পরদিনই উদ্ভ্রান্ত রাতে ম্যনাচিং লক্ষ করেন, কেমন যেন অস্বাভাবিকভাবে বলে উঠেন হাসান, বিয়ে করে উনি উনার প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানদের উপর অবিচার করেছেন । ম্যনাচিংকে শপথ করান বিষয়টা গোপন রাখার । ম্যনাচিংও মেনে নেন । হাসান তাঁর কাছে যে আকর্ষনীয় ।
হাসান দেশ এবং রাজনীতির চিন্তা লালন করা এক ব্যক্তি । সারা জীবন দেশ-সমাজের কথা ভেবে এসেছেন তিনি । চিন্তা আছে তার, সাথে কেউ থাকুক বা না থাকুক, একদিন তিনি দেশে গনমানুষের, প্রধানত: তরুন সমাজের সমস্যাগুলি সমাধান-উপযোগী সারাদেশব্যপী একটা সংগঠন গড়ে তুলবেন, বিরাট এক আন্দোলন গড়ে তুলবেন, তরুনদের প্রত্যক্ষ যে আন্দোলনের তোড়ে দেশ থেকে সকল দু:শাসন ধুয়ে-মুছে যাবে । আর ফুটে উঠতে শুরু করবে সুশাসনের আলো, সারাদেশময় । এধরনের চিন্তাধারার একটা আত্মবিশ্বাসী অবয়ব ফুটে থাকত হাসানের চোখে । আর এটাই আকৃষ্ট করে রাখত ম্যনাচিংকে । আহ্বান পেয়ে সাড়া দিতে তাই মোটেই দেরী হয়নি তাঁর ।
কেন আজকে তার ঘুম আসছেনা ! মাশাকে যেদিনই দেখেন, সেদিনই ঘুম আসেনা ম্যনাচিংএর । মনে পড়ে হাসানের কথা । চিকিতসক হিসেবে প্রথম দেখার দিন একটু চমক যে লাগেনি তা নয় । অবশেষে রিলিজের দিন বিঁধে থাকা সেই খটকার অবসান ঘটে ।
দিপুটা এরকম কেন, কিভাবে ও তার এতো কাছের হয়ে উঠছে আস্তে আন্তে, ভেবে পায়না মাশা । পাশাপাশি চলতে চলতে মাশার হয় আংগূল না হয়তো কামিজের প্রাস্ত ধরেই থাকা লাগবে তার । আর সে-ই বা কম কিসে! কথা বলার সময় তারও এক হাত থাকে দিপুর মাথায় । কেন এমন হচ্ছে ? মনে মনে ভাবে, দিপু যদি ওর ভাই হোত, তবে কতই না ভাল হোত ! পিতৃহীন এই ছেলেটিকে নিজদায়িত্বে অতিযত্নে মানুষ করতো ও । মনে মনে ভাবে মা-কে বলতে হবে ।
বাবার নাম শুনে সেদিন ওরকম, মানে ম্যনাচিং কেন কিছুটা চমকে গিয়েছিলেন, সেটাও ছোটখাটো এক রহস্য হয়ে আছে মাশার কাছে । দুবছর একসাথে চাকরীই করেছেন ওরা, কিন্তু সেজন্য ওরকমভাবে চমকে উঠতে হবে ? চমকে উঠেই সামলিয়ে নিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গিয়েছিলেন তিনি, বাথরুমে কি করেছিলেন তিনি ? চোখের পানি আড়াল করতেই তো মানুষ ওকাজ করে থাকে । বাবার নামের সাথে এই মহিলার চোখের পানির সম্পর্কের কারন হতে পারে একটাই । না, বাবাকে ওরকম ভাবতে পারেনা মোটেই মাশা । সরকারী চাকরী করার কারনে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হতে-না-পারার ক্ষোভে অতৃপ্ত বাবা কখনও এতো জঘন্য হতে পারেনা । বাবা সম্পর্কে এই চিন্তাটা মাশার মনে দৃঢ়ভাবে গাঁথা । আর একারনেই বাবা সম্পর্কে এধরনের দুশ্চিন্তা তার কেটে যেতে সময়ও লাগেনি ।
কিন্তু মহিলাকে দেখলেই কেন এই দুশ্চিন্তাটা তার বেড়ে উঠে ? আজ সকালে যখন আবার উনাকে দেখে মাশা, মনে হয় যেন অত্যাচারিতের আধার এক মহিলা তার সামনে দাঁড়িয়ে । কেন এমন হয়, ভেবে পায়না ও । যে বাবা ওর বলতো, রাজনীতিই আমার প্রথম ধ্যান-ঞ্জান, সে বাবার রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা কোথায় গেল, কেন গেল, কেনই বা মহিলা সেদিন বাবার নাম শুনেই বাথরুমে চলে গেল, ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নেয় ও, আজই এবং এখনই জানতে হবে ।
ভাড়া করা ছোট্ট বাসাটায় কলিং বেল বেজে উঠলো ম্যনাচিংএর, রাত তখন বারোটা পেরিয়েছে । জেগেই ছিলেন ম্যনাচিং । দরজা খুলেই ক্লান্ত-শীর্ণ দুটি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেন মাশাকে । জড়িয়েই থাকেন, ছাড়েন যখন বুঝতে পারেন তার চোখের পানি মাশার পিঠে পড়ছে ।
এতো রাতেও ঘুমাননি! চোখ মুছিয়ে দিয়ে জানতে চায় মাশা ।
ঘুমাবো কি মা! তোমাকে যেদিন দেখি, সেদিন রাতে আমার ঘুম আসেনা ।
আমারও এমন হয়, কেন হয় বলতে পারেন আন্টি ?
আন্টি নয় মা, আমি আপনার আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী, আপনারা যা জানতেননা ।
বলেন কি, সত্যি, স্বগোতক্তি করে মাশা । মাথার মধ্যে বিদ্যুত খেলে যায় তার ।
হাঁ মা, তোমার বাবার চোখে স্বপ্ন দেখার কি একটা অবয়ব যেন ফুটে থাকত সর্বদা, যাতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি আমি, তবে তোমার বাবাই এগিয়ে এসেছিলেন প্রথম । বলে চলেন তিনি, আমাকে নিয়ে ঘুরতে ভালবাসতেন, কোনরকম খারাপ নজর ছিলনা আপনার বাবার । বিপ্লবী হওয়ার কারনে স্বপ্ন নিজে দেখতেন এবং আমাদেরও দেখাতেন, একদিন আমাদের এই জনপদে সঠিক একজন জন্মলাভ করবে, নিপীড়িত এই জনগোষ্টির উপর থেকে সংঘটিত সমস্তরকম অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যে শুধু রুখেই দাঁড়াবেনা, জীবন তুচ্ছ করে এগিয়ে যাবে শুধুই অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে । এ সম্পর্কিত কিছু লিখাও ছিল তার । এগুলিই আমাকে মোহিত করে তুলেছিল মা ।
মুখ নীচু করে অনেকক্ষন বসে আছে সোফায় মাশা । বাবার রাজনৈতিক চেতনার বিনাশের শুরু তাহলে এখান থেকেই, ভাবে সে। সম্ভবত: বিয়ের কারনেই তার মনে একধরনের অপরাধবোধের জন্ম হয় এরকম যে, প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের তিনি ঠকাচ্ছেন । এই অপরাধবোধই তাঁর সকল কর্মক্ষমতাকে ম্রিয়মান করে দিয়েছে । আজ আর তিনি বিপ্লবী নন, অপরাধবোধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কোথায় কোথায় যেন । বিপ্লবী সত্ত্বার তেজী ভাবটা মরে গেছে আজ তাঁর। অপরাধবোধ এমনই জিনিস। অনেক কষ্টকর অনুভূতির এসমস্ত জায়গায় বিচরন করতে করতে মনে হয় তার, দিপু! কে এই দিপু ?
কে এই দিপু, মা ?
ও তোমারই ছোটভাই মা, দু:খী ছেলেটাকে এখনও চিনতে পারলেনা মা ?
ছুটে যায় ও পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা দিপুর বিছানায় । তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষন, এই ছেলেটিই তার ভাই, অতি আদরের ছোটভাই ? আহা কি মায়াময় আদল, অনেকটা তার বাবারই মত । এই ছেলেটিই অবহেলায় বড় হচ্ছে, যে নিজেও আনেনা, মমতাময় বাবা বেঁচে আছে ওর । আর থাকতে পারেনা ও, জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে ওরই বিছানায় । নিজ বাসায় ফেরা হয়না আর, আজ রাতে তো নযই, হবে কি-না আর কোনদিন, তারও যে কোন ঠিক নেই আর ।