আজ সকাল থেকেই নিশির মনটা ভালো নেই। ভালো না থাকার কারনটা বুঝতে চেষ্টা করলেও মানতে চায় না সে। এমনিতেই খিটখিটে মেজাজের জন্যে নাম্বার ওয়ান খেতাব দিয়ে বসে আছে ছোট মামা।তার উপর সকাল থেকেই মেজাজটা খিঁচরে আছে। ভীষণ নিঃসঙ্গতায় পেয়ে বসছে নিশিকে।তার ইচ্ছে হয় অভ্র কে কাছে পেতে। দিনের মধ্যে হাজারবার বলে দিতে “অভ্র আমি তোমায় ভালবাসি….. ভালবাসি….. ভীষণ ভালবাসি।অভ্র তুমি আমার। শুধুই আমার”।
আচ্ছা,ভালবাসার রং কি? লাল, নীল নাকি গোলাপী? সত্যিই কি ভালবাসার কোন রং হয়? নাকি ভালবাসার নিজস্ব কোন রঙ নেই। শুনেছি কষ্টের রং নাকি নীল। ভালোবাসলে নাকি কষ্ট পেতে হয়।এই যে আমার বুকে কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাহলে ভালবাসার রং তো নীলই হবে হয়ত।
ভালবাসা কি মিথ্যে হয়? ভালবাসার সাথে সত্য মিথ্যের সম্পর্ক কি? মিথ্যা হলো সত্যের বিপরীত।যা সত্য নয়, তাই তো মিথ্যে। অভ্র আমাকে ভালবাসে…ভীষণ ভালবাসে।আমি এই সত্যের সাথে আবার মিথ্যেকে টেনে আনছি কেন? অভ্রর ভালবাসা কী মিথ্যে? না, তা হতেই পারেনা।তাহলে সে একটিবারও আমাকে ফোন করেনি কেন? আমি না হয় মায়ের কড়া শাসনের কারণে ফোন করতে পারিনি। ফেইস বুকেও বসতে পারিনি। কিন্তু সে? সে তো আমাকে অন্তত একটি বার ফোন করতে পারত? তাহলে কী অভ্র আমাকে ভালবাসে না? নাহ, এভাবে পাগলামো করে সত্য-মিথ্যে যাচাই করা যাবে না।অভ্রর কাছ থেকে স্ট্রেইটকাট জানতে হবে।ধুত্তরি, কী সব আবলতাবল বকছি আমি! যত্তসব আজে-বাজে চিন্তা। অভ্র মিথ্যে অভিনয় করতে পরেই না।অভ্র এমন ছেলেই নয়। ও আমাকে ভীষণ ভালবাসে।
এভাবেই সত্য মিথ্যের বিভ্রান্তি নিশিকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে সকাল থেকেই। কখনো আত্নবিশ্বাসী হলেও নিমিষের মধ্যেই অসহায় করে তুলছে।যেন নিরব লড়াই চলিয়ে যাচ্ছে মনের সাথে।কিশোরী প্রেমের এক অস্থির নিঃসঙ্গতা। নিঃসঙ্গতা থেকেই এমনসব অগোছালো আর এলোমেলো ভাবনায় জাপটে ধরে আছে তাকে। এত অস্থির নিঃসঙ্গতায়ও যেন বুকের এক কোণে টনটনে মেঘের তুফান।তাই ভাবনাগুলো এতটাই খাপছাড়া।
অভ্রর প্রতি নিশির প্রচন্ড বিশ্বাস।জীবনের প্রথম ভালবাসা থেকেই এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে তার। সপ্তা দুই হলো অভ্রর সাথে নিশির দেখা নেই। মোবাইল ফোনেও তাকে কানেক্ট করা যচ্ছেনা।আর ফোন করার সুযোগ কই? লুকিয়ে লুকিয়ে ফোন করলেও মা দেখে ফেলে।মার চোখকে ফাঁকি দেয়া যায় না। মা তো নয়,যেন দক্ষ এক গোয়েন্দ্বা অফিসার।সারাক্ষণ পিছে পিছে লেগেই থাকবে।কি করছ, কেন করছ, ঠিক মত পানি খেয়েছো কিনা,পড়াশুনা কট্টুক হলো।ওহ যত্ত সব নেকামি।
ঈদ আর পূজার ছুটিতে স্কুল কলেজ বন্দ্ব থাকায় এই দূরত্বটা তৈরী হয়েছে। মা বাবার কড়া শাসনের কারণে ছুটির দিনগুলোতে নিশি ঘর থেকে বের হতে পারেনা। বাবার চেয়ে মা-ই বেশি নজরদারি করে। স্কুল বন্দ্ব থাকলে মোবাইল ফোনটাও মা সুইচঅফ করে দেয়।সব ঝামেলা ওই এক জায়গাতেই।এমন কড়া শাসনের কারণে নিশির মানসিক প্রতিভা বিকাশ কীভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা ছোট মামা একদিন তার মাকে স্মরণ করিয়ে দিলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি।
দুই।
নিশির ক্লাসমেট হিমি হটাত করেই নিশির বাসায় এসে হাজির। দুজনেই ক্লাস নাইনে পড়ে।ওরা খুবই ঘনিষ্ঠ। এভাবে না বলে চলে আসায় নিশি চমকে উঠে। ভাবছে, হিমি তো ফোন না করে এভাবে কখনো বাসায় আসে না! ব্যাপার কি? যাক ভালই হলো।অভ্রর জন্যে সকাল থেকেই মনটা খুব খারাপ লাগছিল। সারাদিন আড্ডা মেরে কিছুটা হলেও হালকা হওয়া যাবে।
নিশি আর হিমি।দু জনই বারান্দায় দাড়িঁয়ে আড্ডায় মেতে উঠছে।নিশি বার বার খেয়াল রাখছে তার মার দিকে।মা এসে দেখে ফেলে কিনা। হিমিকে দেখলেই মা একশোটা প্রশ্ন জুড়ে দিবে। কেন এলে? কখন এলে? এত সাত- সকাল কেন এলে? কি সমস্যা? আরো কত্ত কিছু।কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তাই কড়া নজর রাখছে দুজনেই।
হিমি নিশিকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো-
– জানিস অভ্রর সাথে গতকাল দেখা হয়েছে।
যেন আকাশ থেকে পড়ল নিশি।বিশ্বাস করতে চায় না।
-কোথায়?
-নিউমার্কেটে।
-বলিস কি? এই মিথ্যে বলছিস না তো? কি বলেছে অভ্র?
-মানে?
-মানে… আমি কেমন আছি …আমার কথা কিছুই বলেনি?
– না।
-তাহলে?
-তাহলে আর কি?….. আমার সাথে ডেটিং করেছে…
-ফাজলামো হচ্ছে?
-আরে নাহ, বলেছে… বলেছে।তোর জন্যই তো ওইখানে যাওয়া।
-বলিস কি হিমি?
– হ্যা। জানিস,গতকাল অভ্র আমাকে ফোনে হাইজ্যাক করেছে।
-হাইজ্যাক? এ আবার কেমন করে?
-জী ম্যাডাম। রীতিমত হাইজ্যাক। এটাকে হাইজ্যাক বলবো নাতো কী বলবো? ফোন করেই বল্লো, এই তুই এক্ষুনি নিউমার্কেট চলে আয়।খুব জরুরী কথা আছে। ব্যাস, আমি চলে গেলাম।
-তারপর?
-তার আর পর নেই।
-এই ইয়ার্কি মারিছ না তো। ….ওহ আমার আর ভাল্লাগছেনা। কী বলছে জলদি বল।
-বাব্বাহ, এই দেখি লাইলী-মজনু! একদিন তারে না দেখিলে…….
-নিশি, তুই কিন্তু ……
-এই কিন্তু টিন্তু কি রে?
-তুই কী আবার প্রেম ট্রেম করছিস না তো? ডেটিং করে আসলি যে!
-কার সাথে?
-যার সাথে গোপনে দেখা করতে গেলি। যে তোকে রীতিমত হাইজ্যাক করেছে।
– আরে যাহ। কী যে বলিস।যার জন্যে করি চুরি, সেই বলে চোর!
হিমির শেষ কথাটা মুখ থেকে বের হতে না হতেই নিশির মা এসে হাজির।নিশির মা সুফিয়া বেগম। খুব জেদী মহিলা।দুই ছেলে মেয়েকে কড়া শাসনের মধ্যে মানুষ করছে।শাসন তো নয় যেন খাঁচায় বন্দী পাখি। আবীর আর নিশি।আবীর নিশি থেকে চার বছরের বড়।হোস্টেলে থেকে ঢাকা মেডিকেলে পড়ছে।আবীর খুব শান্ত এবং সংস্কৃতি বিমুখ।আর ছোট বেলা থেকেই গানের প্রতি নিশির খুব নেশা।ইদানিং নিশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে এতটা জড়িয়ে যাচ্ছে তাতেও তার মায়ের ওই একই কথা। একা একা ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না।বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যাবেনা। সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে মার সাথেই নিশিকে যেতে হয় অনেকটা কড়া পাহারায়।স্কুলের পর কোচিং এ যেতে হয় তাও মার সাথেই।
সুফিয়া বেগম বারান্দার দিকে খানিকটা এগিয়ে আসতেই হিমিকে দেখে ফেলে। ওদেরও চোখ পড়ছে সুফিয়া বেগমের উপর। নিশি এবং হিমি দুজনই অপ্রস্তুত।দুজনেরই একই ভাবনা কথাগুলো গোয়েন্দা অফিসার শুনে ফেলেনি তো? নিশির চেয়ে হিমির ভয়টা যেন একটু বেশি। কারণ হিমি খালাম্মাকে খুব ভয় পায়। হিমির ধারণা খালাম্মা সব সময়ই তাকে কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখে।নিশির কাছে আসলেই খালাম্মা কড়া পাহারায় রাখে তাকে। ইদানিং সন্দেহটা যেন আরো বেড়েছে। কে জানে, হয়তো টের পেয়ে গেছে মেয়ে প্রেম ট্রেম করছে।
হিমি কখন এলে মা? তোমার মা বাবা ভালো আছেন তো? প্রশ্নটা শেষ না করেই সুফিয়া বেগম দ্রুত বেগে বারন্দায় ঢুকে পড়ে।নিশির পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়।হিমিও খুব কাছে। ভাবখানা এমন যেন ওরা কোনো গোপন ষড়যন্ত্র করছে।এক্ষুনি হাতেনাতে ধরতে হবে।
-ওরা ভালো আছেন খালাম্মা।আপনি? হিমি নিচু গলায় উত্তর দেয়।
-ভালো আছি রে মা।কত দিন হলো তোমার মা বাবাকে দেখছিনা।
আয়েশী ভঙ্গিতে উত্তর দিলেও মনের কথাটি যে এটি নয় তা হিমি ভালো করেই বুঝতে পারে। হিমি খুব ভালো করেই চিনে এই গোয়েন্দ্বা মহিলাকে।মুখে বলে একটা আর করে আরেকটা। এটাই তাঁর স্বভাব।এক্কে বারে ষ্টার জলসার বাংলা সিরিয়ালের কুটনি নারী চরিত্রগুলোর মত।
তোমরা কী নিয়ে গল্প করছিলে? প্রশ্ন করেই শুরু হলো সুফিয়া বেগমের স্বভাবসুলভ গোয়েন্দাগিরি। কী যেন প্রেম ট্রেম এইসব নিয়ে বলাবলি করছিলে? কে সেই ছেলেটি? কী তা নাম বলছিলে .. অভ্রু .. না অভ্র কী যেন।একদম লুকাবে না আমার কাছে।কড়া ধমক দিয়ে জানতে চেয়ে মুহুর্তেই ভোল পাল্টায় সুফিয়া বেগম। আদুরে গলায় বলে আমাকে খুলে বলতো মা।
ইস কথায় যা ঢং। ম্যা ম্যা করে যত্ত সব নেকামি।হিমি বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।নিশিও মায়ের উপর প্রচন্ড ক্ষেপে যায়।কিন্তু মার কাছে রাগ প্রকাশ করার সাহস নিশির নেই।বান্ধবীর সামনে নিজের মেয়েকে এইভাবে কেউ জেরা করে? লজ্জ্বায় মাথা হেড হয়ে যায় নিশির।
তিন।
সকাল থেকেই কী এক বিভ্রান্ত্রির বেড়াজালে আটকে ছিল নিশি। হিমির আগমনে কিছুটা আশার আলো খুঁজে পেলেও মায়ের এমন আগ্রাসী নেকামি সবকিছুই যেন তছনছ হয়ে যায়।নিশি ভাবছে তাঁর মা কী কান পেতে সবগুলো কথাই শুনে ফেলছে? তা হলে তো আর রক্ষা নেই।যেমন করেই হোক গোয়েন্দ্বা মা সত্য উদঘাটন করেই ছাড়বে। বলা তো যায়না। মার স্বভাবটাই এমন।সুফিয়া বেগমের ধারণা ওই হিমি মেয়েটাই যত্ত সব ঝালেমার কারণ।হটাত বাসায় আসছে নিশ্চয়ই কোনো একটা মতলব নিয়ে।
খালাম্মার এমন আচরণে হিমিও লজ্বা পায়। যেন এই মুহুর্তে পালাতে পারলেই বাঁচে। হিমি চলে যায়।
হিমি আকস্মিক চলে যাওয়ায় নিশির অস্থিরতা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যায়।অভ্রর কোনো কথাই আর হিমির কাছ থেকে শোনা হলনা। কী বলতে চেয়ে ছিল অভ্র? কেন হিমিকে ইমার্জেন্সি কল দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে? এসবের কিছুই আর জানা হলনা। স্কুল খুলতে এখনো দিন কয়েক বাকি। মায়ের কড়া শাসনের বেড়াজালে খিটখিটে মেজাজের নিশিকে সত্য মিথ্যের বিভ্রান্তি নিয়েই আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
ভালবাসার নিঃসঙ্গ যন্ত্রনায় নিশির বুকের এক কোণে টনটনে মেঘের তুফান বেড়েই চলছে।