এই শুরু হলো…… ধুর আর ভাল্লাগে না !!!
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠে বসলেন অপরেশ বাবু… কুকুর গুলোর চিৎকারে কান পাতা দায়; এই একবার শুরু হলো চলবে সেই ভোররাত পর্যন্ত , কতদিন নীলিমা কে বলেছেন ওদের খাবার দেওয়া বন্ধ করো ; খাবার পায় আর এই বাড়ীর সামনে থেকে নড়ে না , তা কে শোনে কার কথা !!! আবার বারান্দার কোণে ওদের থাকতে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছিল , কি ভাগ্যিস রাজা খবর পাঠালো ওর ইতালিয়ান স্ত্রী নিয়ে আসছে , তাই সে যাত্রা কোনমতে ঠেকানো গেছিল… বৌমাটি অবশ্য শাশুড়ির এহেন ছেলেমানুষিতে বেশ আমোদই পেয়েছিল , তাঁরও নাকি ভারী শখ একটি ববটেইল পোষার ; সেটা কি বস্তু ভগবান ই জানেন তবে নাম শুনলেই মনে হয় বেশ বনেদী কুকুর……….কোথায় সে আর কোথায় এই নেড়ি গুলো ; আবার নামের বাহার আছে ……….রানী, টেপি, গজা ,সব নীলিমার দেওয়া আদরের ডাক !!! নাহ , ঘুম আর আসবে না…..তিনি বহুবছর যাবৎ অনিদ্রার রুগী, ওষুধের কল্যাণে আসা ঘুম একবার ভাঙলে আর আসেনা ; একটু চা পেলে ভালো হত কিন্তু রাত ৩’টের সময় আর গৃহযুদ্ধ বাধানোর সাহস পেলেন না………লন্ডন প্রবাসী ছেলের উপহার আইপড টা নিয়ে এসে বসলেন বারান্দায় আর তারপরই বুঁদ হয়ে গেলেন মান্না দে সাহেবের সুরের জাদুতে, আহা ! কি গানই না গেয়েছেন…….’ পুঁছো না ক্যায়সে ম্যায়নে রয়েন বিতায়ি ‘ !!!
অপরেশ বাবুদের বাড়ীটা শহরের একেবারে দক্ষিন প্রান্তে,শহর না বলে শহরতলি বলাই ভালো, কিছু বছর আগেও পিন কোডে দক্ষিণ ২৪ পরগণা লেখা হত; চারপাশটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে……হাইরাইজ , মল আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সেজে উঠছে তাদের ছোটো জনপদ……….তাও কিছু সবুজ, অনুপ্রবেশকারীর মতো ইতিউতি উকি দেয় ….একটা পাগলা কোকিল, এক ঝাঁক নাছোড় ছাতারে , দু’টো ভীরু বুলবুলি, একটা একরত্তি টুনটুনি এখনো তাদের স্বর্গের বাগানের অধিকার ছাড়েনি……….টুনটুনিটার ডাকে ঘুম ভাঙলো অপরেশবাবুর , নীলিমা কখন গায়ে একটা শাল জড়িয়ে দিয়ে গেছে, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন………ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নেবেন………………
ওকি !!! এখনো শুয়ে আছ যে….জ্বরটা আবার এসেছে বুঝি !!!
আজ কিছুদিন ধরেই ভোরের দিকে নীলিমার জ্বর আসছে, রোগাও হয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ ……….হবে না ! শরীরের ওপর এত অত্যাচার সহ্য হয়, সারাদিন ধরে কি যে এত কাচাকাচি – মোছামুছি করেন , আসলে বাতিক ,নাতি হওয়ার খবরে সেটা আরও বেড়েছে, সারাদিন ধরে ছেলের পাঠানো ছবি দেখেন আর চোখের জল ফেলেন……..কষ্ট কি আর তাঁর হয়না , কিন্তু তিনি বাস্তববাদী মানুষ…….আরে বাবা !! যেটা হওয়ার নয় তা নিয়ে ভেবে কি হবে , আর তাছাড়া এই সারাদিন ধরে ‘একা হয়ে গেলাম, একা হয়ে গেলাম’ এই হাহুতাস ওনার সহ্য হয়না ,একা আবার কি ? দিব্যি আছেন, সকালে চা খেয়েই বাজারে চলে যান, সেখানে এক প্রস্থ আড্ডা সেরে বাড়ী, তারপর স্নান খাওয়া সেরে দুপুরে কোনদিন ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কোনদিন বাড়ীতেই খবরের কাগজ বা বই পড়া, কোনদিন টেলিভিশনে ভাল ছবি থাকলে দেখা, সপ্তাহান্তে মাঝে সাঝে ছেলেবেলার বন্ধু পরিতোষের বাড়ী যান, সেখানে পান ও ভোজন সহযোগে আড্ডা হয়, মোটের ওপর ভালই আছেন, এই বয়েসে যতটা ভাল থাকা যায় আর কি !!! নীলিমা অবশ্য বরাবরই এরকম, মনে আছে একবার রাজার জন্মদিনে ভুল করে অফিস ট্যুরে চলে গেছিলেন বলে নীলিমা বেশ কয়েকদিন বাক্যালাপ বন্ধ রেখেছিলেন…….নাঃ! আজই একবার ডঃ লাহিড়ীকে ফোন করতে হবে…………….
ডঃ লাহিড়ীর গম্ভীর মুখটাই সেদিন সব বলে দিয়েছিল, মনে মনে নিজেকে প্রস্তুতও করে নিয়েছিলেন……আর তাছাড়া এই স্টেজে আর করার কিই বা থাকে , কোনদিনও কিচ্ছু বুঝতে দেয়নি নীলিমা,বড় অভিমানী ছিল আর উনিও……
ফেরার পথে, নীলিমাকে যেন কথায় পেয়েছিল…….কলকল করে কত কথা বলে যাচ্ছিল……বুঝতে পেরেছিল কি সময় ফুরিয়ে আসছে, তাই কি সব না বলা কথা বলে নিতে চাইছিল ?? উনি আশ্চর্য হয়েছিলেন নিজের ওপরে, কই যতটা কষ্ট হওয়া উচিৎ ততটা কষ্ট তো ওনার হচ্ছে না, সত্যি বলতে কি ঠিক কি রকম লাগা উচিৎ সেটাই যেন তিনি ঠিক করতে পারছেন না !!! নীলিমার কথা নয়, উনি ভাবছিলেন- ওনার লেখার সরঞ্জাম কে গুছিয়ে রাখবে? সবার হাতের ধুতি কুঁচোনো ওনার পছন্দ হয়না, নীলিমা ছাড়া কে করবে সে সব? ছোটবোন অঞ্জু ছেলেবেলায় বলতো ‘দাদা, তুই বড় স্বার্থপর !!! বাবা তোর পড়াশোনার জন্য এত করলো নিজের কথা কখনো ভাবেনি, সেই বাবার শেষ সময়ে তুই ডাক্তার ডাকতে যেতে পারলি না,বললি কাল পরীক্ষা এখন পড়া ছেড়ে কি করে যাব?? বাড়ীওয়ালা প্রফুল্ল বাবুরাই যা করার করলেন ‘; উনি অবশ্য কোনোদিনই এসব কথার ধার ধারেননি, সব সময় নিজেকে বুঝিয়েছেন যা করেছেন ঠিক করেছেন, বাবাও তাই চাইতেন………নিজেকে বঞ্চিত করে বাবা তার জন্য যা করেছেন, সেটা উনি নষ্ট হতে দিতেন কিভাবে !!! ধ্যাৎ কি উল্টোপাল্টা ভাবছেন……
‘আমাকে একটু ফুচকা খাওয়াও না গো !’ নীলিমার গলার আওয়াজে চমক ভাঙে, ধমকে উঠতে গিয়ে কি ভেবে থেমে যান…….বাড়ীর সামনের পার্কটার কোনায় যে ছেলেটি ফুচকা নিয়ে বসে, গুটি গুটি হেঁটে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ান দু’জন……..এখনও বিকেল,ভিড় সেরকম ছিল না, ছেলেটি শালপাতা এগিয়ে দিতে, দোনোমনো করে নিয়েই ফেলেন, তারপর খাওয়া ভুলে তাকিয়ে থাকেন নীলিমার দিকে……..নীলিমা যেন আজ ১৬ বছরের কিশোরী……’আরও একটু ঝাল দাও তো আলুতে,একটু ধনেপাতা………তেঁতুল জলে গন্ধরাজ লেবু দিয়েছ তো’………তীব্র আশ্লেষে তেঁতুল জলের শেষটুকুও চেটে নিচ্ছিলেন, যেন জীবনটাকেও ওভাবেই চেটেপুটে নিতে চান…….এক কণাও যেন অপচয় না হয় .
‘কালী , এই কালী এদের এখানে কে খেতে দিল ?’ অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করেন অপরেশ বাবু !!
বাড়ীর ঠিকে কাজের মেয়ে কালী, কাঁচুমাচু মুখে এসে দাড়ায় ‘ মা বলল এখানেই দিতে, এখন তো আর নীচে নামতে পারে না………এখানে দিলে জানলা দিয়ে দেখতে পাবে ‘ !!!
অসহায় বোধ করেন অপরেশ বাবু , জানেন পর্দার আড়ালে দু’টো কান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওনার কথা শোনার , অপ্রসন্ন মুখে সরে আসেন তিনি, রানী এসে পায়ে মাথা ঘষে যায়, যেন বলতে চায় – আমাদের তাড়িয়ে দিও না গো !!!
এ নীলিমার ভারী অন্যায়, জানে উনি বেড়াল – কুকুর ভালবাসেন না, তবু………..অসুস্থ বলে কি এমন স্বার্থপর হয়ে যেতে হবে !!!
এই বেড়াল- কুকুর পোষার সখ নীলিমার বরাবরের, মনে আছে বিয়ের পর পর এ নিয়ে বাড়ীতে কম অশান্তিও হয়নি; তখনও ওনার মা বেঁচে, পুরনো দিনের নিষ্ঠাবতী মহিলা, রোজ গোপালের ভোগ না দিয়ে জলস্পর্শ করেন না, এ হেন মায়ের ঠাকুরের বাসনে মুখ দিল কুকুরে-
‘আমাকে আজই উলুবেড়ে রেখে আয়…….এ অনাছিস্টির সংসারে আমি আর একমুহূর্ত থাকব না!’
কোনমতে হাতেপায়ে ধরে মা কে সে যাত্রা শান্ত করেছিলেন, কিন্তু নীলিমাকে বোঝায় কার সাধ্যি, এক গোঁ ধরে রইলো –
‘আমি কোনো ভুল করিনি, সবাই যদি কৃষ্ণের জীব হয় তাহলে আমার লালীও তাই…..ও বাসনে মুখ দিয়েছে তো হয়েছে টা কি ‘?
উফ্ফ সারা জীবন এই ভাবে জোর করে জিতে গেল…………এখনো সেই এক গোঁ, জেদ ধরে বসে আছে যেন, চিকিৎসা করাবে না !
পরিতোষ সেদিন বলছিল নীলিমাকে একবার ডঃ বাজপায়ী’র কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা, ওর চেনা কে আছে তাড়াতাড়ি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে ……..একবার বিপ্লব কেও ফোন করতে হবে, মুম্বই যেতে হলে টিকিটের ব্যবস্থাটাও…….!!!
‘কই, কি হলো, কি ভাবছ?’
‘রাজা টার কথা বড্ড মনে পড়ছে জান ! ওর ছেলেটা না, একদম ওর মুখ বসানো…….সেই চোখ, সেই নাক!!’
‘ফোন করব ? নাতির গলা শুনবে নাকি ?’
‘ফোন……নাহ! থাক , ওরা এখন কাজে বেড়োবে…….সানি কে না সারাদিন ডে কেয়ারে রেখে যায় জানো ?’
‘কি আর করবে, সারাদিন দেখবে কে ওকে ? যে দেশের যা রীতি !’
‘হ্যা ! যে দেশের যা রীতি………এইটুকু বয়েসেই মায়ের কোল ছাড়া !!’
‘চলো, এবার মুম্বাই থেকে ফিরেই তোমাকে নিয়ে যাব ওদের ওখানে !!’
‘সত্যি !!’
অপরেশ বাবু অবাক হয়ে দেখলেন, নীলিমার চোখে মুখে যেন আলো জ্বলে উঠলো…….
‘এই শোন, আমাকে না একদিন ঐ শপিং মল না কি বলে, ওখানে নিয়ে যাবে, সানির জন্য কিছু কিনব……জানো তো রাজার সেই লাল সোয়েটারটা, আমি বুনে দিয়েছিলাম সেটাও আমি রেখে দিয়েছি যত্ন করে, যা সুন্দর মানাবে না ওকে , এত্ত ফুটফুটে হয়েছে বাচ্চাটা…….রাজা টা তিলের নাড়ু খেতে ভালবাসে, কালীকে বলতে হবে গুড় টা পাঁক দিয়ে দেওয়ার জন্য…….নীনা জানো তো রসগোল্লা খুব ভাল খেয়েছিল, তুমি সুধীর কে পাঠিয়ে কে. সি. দাশ থেকে একটু নিয়ে এস তো আর রেশম শিল্পী থেকে একটা বালুচরী শাড়ি, হলুদ রং টা মেয়েটার খুব পছন্দ……..’
নাঃ! মুম্বই নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আর দেয়নি নীলিমা…………যাক ! যে যাওয়ার সে তো যাবেই, ইদানীং নীলিমার জীবনের প্রতি অনীহা এসে গেছিল, প্রায় সারাদিনই বলতেন ‘বুড়ো বয়েসে , নাতি নাতনী নিয়ে খেলা আর আমার হলনা !!!’ যাক , ওকথা উনি আর ভাবতে চাননা………….রাজা অবশ্য আসতে পারেনি, তবে ফোনে সারাদিনই খোঁজ খবর নিচ্ছে ছেলে – বৌমা দুজনেই, উনি বলে দিয়েছেন ‘ যে চলে গেছে, সে তো আর ফিরবে না……তাহলে আর কাজকর্মের অসুবিধা করে মিছিমিছি আসা কেন ?’ অন্য বাবা মায়েদের মত অকারন অভিমান ওনার নেই, আরে বাবা ! ছেলে মেয়েগুলোর দিকটাও তো বুঝতে হবে……….নীলিমা হলে,অবশ্য নিশ্চিত ভাবেই দু’কথা শুনিয়ে দিত !!!
সিরিটির শ্মশাণে, যখন নীলিমা কে চুল্লীতে ঢোকানো হচ্ছিল চুল্লীর খোলা দরজা দিয়ে বাইরে আসা লালচে আলোয় নীলিমার মুখটা যেন সেই বিয়ের দিনের লাল চেলি , চন্দনে সজ্জিতা নববধূর মত লাগছিল, ঠোঁটের কোনে একটা আলতো হাসি লেগেছিল কি ? ঠিক যেমনটা ছিল শুভ দৃষ্টির সময়…………হঠাৎ শিরদাড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত টের পান, এ কাকে বিদায় জানাতে এসেছেন তিনি !!!
‘অপরেশ …..অপরেশ ‘
কাঁধে মৃদু চাঁপ অনুভব করেন, পরিতোষ দাড়িয়ে আছে –
‘কি হল তোর ? ঠিক আছিস তো ? চা খাবি ?’
‘চল’
গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হাতের আঙুলগুলোর যেন সাড় ফিরে পাচ্ছিলেন………………..এত শীত লাগছে কেন???
চারপাশের পৃথিবীটাকে কমলা আলোয় মুড়ে দিয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, নেমে আসছে ধূসর সন্ধ্যে………আচ্ছা রাজার ওখানে এখন ক’টা বাজে?? একটা ফোন করবেন ওকে!! থাক……..হয়ত অফিস থেকেই ফেরেনি, আর কিই বা বলবেন…….’তোমার মা কে রেখে যাচ্ছি !!!’
চারপাশ টা হঠাৎ কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে…..!!!
ক’টা দিন যেন ঝড়ের গতিতে কেটে গেল, কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছেন, বোন অঞ্জু আর ওর স্বামী আশিস; অপরেশ বাবু কোনদিনই বাড়ীতে অতিথি আসলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, নীলিমাই চিরটাকাল অতিথি আপ্যায়নের তদারকি করে এসেছেন…….আজ নীলিমার শ্রাদ্বানুসঠান, অপরেশবাবু যেন হাঁফিয়ে উঠছিলেন……কিছুটা হয়ত বিব্রতও হচ্ছিলেন, নীলিমা যে তাকে কি বিপদেই ফেলল; একটু একা হতে দিচ্ছে না এরা ওনাকে…….দ্যুত! নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে উঠলেন অপরেশবাবু, কি আবোল তাবোল ভাবছেন!!! নীলিমা বড্ড লোকজন ভালবাসতো, খুব আমুদে স্বভাবের ছিল, কতদিন হয়েছে ছুটির দিনে বলা নেই কওয়া নেই পরিতোষ আর দু’তিনজন বন্ধু এসে হাজির দুপুর বেলায় ; এসেই হুকুম ‘খুব ক্ষিদে পেয়েছে বৌদি শিগগির ভাত দিন !’ কোনদিন নীলিমাকে বিরক্ত হতে দেখেননি, হাসিমুখে এই ভালবাসার আব্দার সহ্য করেছে নীলিমা…………’দেখো নীলিমা, আজও আমি কোনো ত্রুটি হতে দেব না, তুমি থাকলে যেমন যত্ন করতে, আমিও ঠিক সেরকমই আপ্যায়ন করব’ নিজেকেই বলেন অপরেশবাবু –
যাক , সব কাজ ভালোভাবে মিটে গেছে……..পরিতোষ আর ওর স্ত্রী পূরবী, ছোটবোন অঞ্জু ভগ্নীপতি আশিস সকলেই এ’কদিন ওনাকে যথেষ্ট সঙ্গ দিয়েছে, অঞ্জু তো আরও কিছুদিন থেকে যেতে চাইছিল,উনি ই বারণ করলেন, আর তাছাড়া সুধীর তো রইলই, ওনার ১৭ বছরের পুরনো ড্রাইভার………..নাঃ !! রাত অনেক হয়েছে, এবার শুয়ে পড়বেন……………..!!!
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল অপরেশ বাবুর, একটু জল খেলে হতো…….’নীলিমা, একটু জল………!!!’
বলতে বলতে মাঝপথে থেমে গেলেন……..গত চল্লিশ বছরের সঙ্গিনীটি যে হাজার বার ডাকলেও সাড়া দেবে না ,তা যেন হঠাৎ উপলব্ধি করলেন…..উফ্ফ্ বড্ড গরম আজ, জানলা গুলো কি একটু খুলে দেবেন ??? যাক, এখন একটু স্বস্তি বোধ করছেন……নীলিমার নিজের হাতে লাগানো কামিনী ঝোঁপ অকৃপণ হাতে গন্ধ বিলোচ্ছে…….সেটা তো জ্যষ্ঠের শেষই ছিল নাকি আষাঢের প্রথম, যখন নীলিমাকে নিয়ে শান্তিনিকেতন গেলেন……..এক আকাশ তারার নীচে নীলিমার গলায় ‘ আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি জ্বলে ‘……..কত কথাই যে মনে পরে যাচ্ছে…….সেই রাজার সাইকেল শেখার সময় পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে রক্তারক্তি, সেও ছিল এক নিদ্রাবিহীন রাত, ওনার শত উপরোধেও নীলিমাকে রাজার কাছ থেকে সরানো যায়নি……..গরমটা হঠাৎ বেড়ে গেল না !!! আজ কি বৃষ্টি হবে !!!
একটু বারান্দায় বসলে কেমন হয়………..প্রথম যখন বাড়ী বানালেন,নীলিমা পইপই করে বলে দিয়েছিল চওড়া এক ফালি বারান্দার কথা …..সেও আজ ২৫ বছর আগের কথা,তারপর নীলিমার নিজের হাতে লাগানো গাছের ছায়ায় , রাজার টলমল পায়ের ছাপে কখন যেন বাড়ীটা ঘর হয়ে উঠলো, শান্তির আশ্রয়……….তারপর এসে জুটলেন তেনারা, রাণী টেপী গজার দল……উফ্ফ্ কি জ্বালাতনটাই না করত !!! রাত নেই দিন নেই খালি ডাকাডাকি……কই,কোথায় তোরা? এতদিন জ্বালিয়ে কোথায় পালালি হতভাগার দল? ডাক………পৃথিবীটা কি একটা মৃত গ্রহ হয়ে গেল ? চারপাশে এত নৈশ্যব্দ কেন…….কত কিছু তোমাকে বলা হলোনা, নীলিমা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ ???………….কোথায় গেলি হতভাগার দল, আয় এক্ষুনি আয়, ডেকে ডেকে আমার মাথা খারাপ কর……..অনেক সহ্য করেছি তোদের,আজ পালালে চলবে কেন……….আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে,আয় তোরা…….ডাক, ডাক…………
শহরতলীতে বৃষ্টি নামলো!!!