এই শহর

এই শহর

এখন আমি লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আমার সিরিয়ালের জন্য।গলায় কিছুটা সমস্যা হওয়ার কারণে হাসপাতালে এসেছি ডাক্তার দেখাতে।হাসপাতালের নাম হলো শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদা লাইন।দুপাশেই দীর্ঘ লাইন।পুরুষদের লাইনে দাঁড়ানো একজন লোকের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।কিন্তু মহিলাদের লাইনে দাঁড়ানো কয়েকজন মহিলা এক নাগাড়ে চিল্লাচিল্লি করেই যাচ্ছে।আগে যাওয়া নিয়ে,লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করেই যাচ্ছে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ডাক্তারের রুমে ঢোকার সুযোগ হয়।কিন্তু সরকারি হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী বসার আগেই শুধু সমস্যার কথা শুনেই ঔষুধ লেখা শেষ।কিন্তু এই ডাক্তারই যখন কোনো ক্লিনিকে বসবে এবং ৫০০ টাকা ফি দিয়ে দেখানো হবে তখন খুব ভালভাবে দেখে বুঝে তারপর চিকিৎসা করবে।আসলে সবই টাকার খেলা।

ডাক্তার দেখানো শেষে এসে পরছিলাম তখন দেখলাম জরুরি বিভাগে একটা ছেলের গলায় মোটা পাইপ দিয়ে সাবান মেখে দিচ্ছে।বুঝতে দেরি হলো না বিষ খেয়েছে ছেলেটা,এখন পেট পরিষ্কার করা হচ্ছে।একজন মানুষ কতটা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়লে যে এই পথটা বেছে নেয় সেটা খুব কম জনই জানে।ছেলেটার সাথের সবাই কান্নাকাটি করেই শেষ।ছেলেটার সব কাজ করছিল অন্য একটা লোক।যাকে তথাকথিত ভাষায় বলা হয় দালাল।যাদেরকে কেউই পছন্দ করে না কিন্তু তারা মানুষের অনেক উপকার করে।যখন হাসপাতালে কোনো রোগীকে নিয়ে কেউ আসে তখন তাদের মাথা কাজ করে না।ঠিক তখন এই দালাল নামের লোকেরাই তাদের সব বুঝিয়ে দেয়,তাদের কে অনেক সাহায্য করে।তাদের দোষটা হয়তো এখানেই যে তারা এই উপকারের বিনিময়ে টাকা রোজগার করে।

ঘারিন্দা রেলস্টেশনে এসেছি এক খালাতো ভাইকে নেয়ার জন্য।সে ঢাকা থেকে আসবে তাই রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছি।রেলস্টেশনে নানান ধরণের মানুষের দেখা পাওয়া যায়।সবাই নিজের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য কতই না উদগ্রীব হয়ে থাকে।আমি হাটছি স্টেশন প্লাটফর্মে হঠাৎ দেখলাম সামনে থেকে একজোড়া যুবক-যুবতী হেটে আসছে।কিন্তু মেয়েটার পড়নে রয়েছে একটা টাইট টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্ট।মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে এই ধরনের পোশাক পড়ে।হয়তো তার স্বামীর কথায় সে এরকম পোশাক পড়েছে।তার সাথের ছেলেটা একবার মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে আবার অন্য সবার চোখের দিকে তাকাচ্ছে।হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে আমার বউকে যে এরকম পোশাক পড়িয়েছি এটা দেখে অন্যরা মজা নিচ্ছে কিনা।ট্রেন চলে আসায় আমি সেদিকে চলে গেলাম।কিন্তু ভেতরে খুব রাগ হতে লাগল।ভাবলাম,কিভাবে কোনো একটা ছেলে তার বউকে এরকম পোশাক পড়িয়ে রাস্তায় বের হতে পারে।তার কি চক্ষুলজ্জা বলতে কিছু নেই নাকি সে নিজেই নিজের বউকে সস্তা পণ্য হিসেবে মূল্যায়ন করে।কারণ কোনো বিবেকবান পুরুষ তার পরিবারের কোনো মেয়েকে বেপর্দা হয়ে চলতে দেবে না কখনো।আমরা টিভিতে,রাস্তাঘাটে এরকম বেপর্দা অবস্থায় যাদের দেখি তারা শিক্ষিত হলেও বিবেকবান নয়।

রেলস্টেশন থেকে ভাইকে নিয়ে বের হওয়ার পর সোল পার্কের সামনে দিয়ে আসার সময় ভাবছিলাম,এই জায়গাটা একটা সময় কত সুন্দর ছিল।এখানে নিজেদের পরিবার নিয়ে সবাই আগে অনেক সুন্দর সময় কাটাতে পারতো।কিন্তু এখন এটা হয়ে গেছে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা আর অশ্লীলতা করার উপযুক্ত জায়গা।

শুক্রবার বিশেষ একটা দিন,জুম্মার দিন।যেসব মুসল্লি পুরো সপ্তাহ মসজিদের ধারে কাছেও যায় না তারাও এই দিন মসজিদে যায় নামাজ পড়তে।আমি একটু তাড়াতাড়িই গোসল করে তৈরি হয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম।পথে একটা ঘটনা চোখে পড়ল।কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারাও মসজিদে যাচ্ছে।তো তাদের মধ্যে একজন অন্য একটা ছেলেকে বলছে…
_কিরে তুই বাড়ির সামনে খারাইয়া রইছা।নামাজে যাবি না?
_নারে যামু না,তোরা যা।এহনো গোসলই করি নাই।
_যাবি না মানে।জুম্মার একটা দিন,তাড়াতাড়ি গোসল কইরা আয়।আমরা খারাইলাম।
_না,তোগো দেরি হবো।যা তোরা।
_বাইনচোদ,দেরি হবো মানে।তাড়াতাড়ি আয় খারাইলাম।
_কিরে নামাজের কথাও কস আবার বকাও দেস,কাহিনি কি?
_কাহিনি আবার কি।প্রথমে তো ভালমত কইলাম,হালায় শুনেনা।তাই বকা দিলাম।আর ও তো বন্ধু,ওরে বকা দিমু না

তো দিমু কারে।বকা দিছি তো কি হইছে,নামাজের কথাই তো কইছি।

আমি আর না দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম।ভাবলাম,এটাই হলো বন্ধুত্ব।যাদেরকে মন খুলে সব বলা যায়,যাদের সামনে কোনো লজ্জা করে না তারাই তো বন্ধু।

টাঙ্গাইল ক্লাবে এসেছি একটা বিয়ের দাওয়াতে।বর্তমানের বিয়ের অনুষ্ঠান গুলোতে আর আগের মত মজা নেই।এখন বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই শহরের বড় কোনো ক্লাবে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করা,কিছু ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা।এখানেও ঠিক এরকম হচ্ছিল।দেখলাম আশে পাশের সবাই যার যার মতো ছবি তুলতে ব্যস্ত।এক মহিলা তার কোলে একটা বাচ্চাকে নিয়ে বিভিন্ন ভাবে ছবি তুলছে।বাচ্চাটাকে যেরকম করতে বলছে সেও সেরকম করছে।ভাবলাম আমরা ১০ বছর বয়সেও মোবাইল কি বুঝতাম না আর এখন ১০ মাস বয়সেই একটা বাচ্চা বুঝে যায় মোবাইল কি!

ডিসি লেকে এসেছি এক বন্ধুর সাথে।অবশ্য সে এসেছে তার জিএফ এর সাথে দেখা করতে।এসব কাজে একা যাওয়া যায় না বলেই হয়তো আমাকে তার সাথে আনা।ডিসি লেকের ভেতরে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম।বসে কথা বলছিলাম সবাই।কিন্তু একটা ঘটনায় নিজেরাই লজ্জা পেয়ে জায়গাটা ত্যাগ করলাম।দেখলাম একটা ছেলে আর মেয়ে এসে আমাদের পাশের বেঞ্চে বসে কথা বলছে।তাদের পোশাক আর চলাচলের ধরণেই বোঝা যাচ্ছিল তারা বর্তমানের অত্যাধুনিক মানসিকতার তরুণ-তরুণী।কিন্তু তারা যে এতটা অত্যাধুনিক সেটা ভাবতে পারিনি।কিছুক্ষণ পর তারা দুজন একে অপরকে কিস করা শুরু করল লল।এমনকি সেই মুহূর্ত গুলোকে ক্যামেরাবন্দী করার জন্য মোবাইলে সেল্ফি তুলল।তারা যে একটা পাবলিক প্লেসে আছে এবং তাদের পাশে যে আমরা আছি হয়তো সেটা তারা ভুলে গিয়েছে। এজন্যই নির্দ্বিধায় এসব করছে।আমরা নিজেরাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সেখান থেকে বেরিয়ে পরলাম।

বের হওয়ার পর অটোর জন্য অপেক্ষা করছি।দেখলাম ৮-৯ বছরের একটা ছেলে অটোরিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কয়েকটা ছেলেমেয়ে ছেলেটাকে দেখে বলতে লাগল…

_তুমি এই বয়সে স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে রিক্সা চালাচ্ছো কেন।এসব করা তো ঠিক না।
_আমি যদি রিক্সা না চালাই তাইলে আমাগো খাবার দিবো কেরা।আফনেগো মত মাইনসেরা খালি বড় বড় কথাই কইতে পারেন আর কিছু না।

কথাটা বলেই ছেলেটা খালি রিক্সা নিয়েই চলে গেল।আমি তাকিয়ে আছি ওর চলে যাওয়ার দিকে।প্রতিনিয়ত কতই না সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় ওকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত