ফোনের ওপারে ‘ফোঁস ফোঁস’ করে কান্নার শব্দ শুনে অনন্যা একটু চমকে উঠল। বলল, ‘কি হল মা সেটা তো আগে বল।’
ওপাশ থেকে কোনও শব্দ উচ্চারিত নাহলেও অনন্যা নিশ্চিত যে ফোনটা ওর মা অঞ্জলিদেবীই ধরেছেন। প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে অনন্যা বিরক্ত হল কারন ও জানে, ফোনটা যে অনন্যা করেছে ওর মত অঞ্জলিদেবীও সে বিষয়ে নিশ্চিত। প্রায় প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে এই সময় অনন্যা বাড়িতে ফোন করে। প্রবাসে থাকার কারনেই বিকেলবেলার এই ফোনটা ওর কাছে খুব জরুরী। ফোনের এই আলাপ হাসি না কান্না, রাগ না বিরক্তি কি দিয়ে শুরু হবে তা অনন্যা কোনওদিনই আগে থেকে টের পায় না। এবিষয়ে অঞ্জলিদেবীর কৃতিত্ব অদ্বিতীয়। ওনার হাসি, কান্না বা রাগ থেকে আসল ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভবও।
অঞ্জলিদেবীর কথা বলার নিজস্ব কিছু স্টাইল আছে। অনন্যা সাধারণত ফোন করেই বলে ‘খবর টবর দাও।’ অঞ্জলিদেবী শুরু করেন, ‘একটা ভালো খবর আছে’ অথবা ‘একটা খারাপ খবর আছে’ এরকম বাক্য দিয়ে। পুরো কথাটা উনি কিছুতেই একবারে ভাঙেন না। একে একে উন্মোচিত হয় কার খবর, কোথাকার খবর, কি খবর ইত্যাদি। ভাল খবরটি সরকারী কর্মচারীদের দুই শতাংশ ডিএ বৃদ্ধিও হতে পারে আবার পাশের বাড়ির পোষা কুকুরটির একসঙ্গে ছ’টা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার খবরও হতে পারে। খারাপ খবর, ওনাদের গ্রামের কোন ছেলের বাড়ির কাজের মেয়েকে বিয়ে করা হতে পারে আবার ঝড়ে ওনাদের একমাত্র পেয়ারা গাছের ডাল ভেঙ্গে যাওয়াও হতে পারে। অতএব কিছুটা ধারনা করে নেওয়াই যায় যে ফোনে এই বাক্যালাপ কত দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। এই নিয়ে অঞ্জলিদেবীর সঙ্গে ওনার স্বামী আনন্দবাবুর নিত্য খিটিমিটি। ফোনটা যে কাজের জিনিস সেটা নাকি অঞ্জলিদেবীকে আনন্দবাবু অনেক বছর ধরে চেষ্টা করেও বুঝিয়ে উঠতে পারেন নি। তাই ইচ্ছে করেই আনন্দবাবু স্ত্রীকে মোবাইল ফোন কিনে দেন নি। কথা বলার সময় সামনে থাকলে উনি একটু লাগাম ধরে রাখার চেষ্টা করেন।
অনন্যা মাঝেমাঝেই শুনতে পায় অঞ্জলিদেবী বলছেন, ‘ফোনটা আমি করি নি, মামনি করেছে।’ মাসের শেষে বিলের পরিমান দেখে প্রথম আক্রমণটা যাতে অঞ্জলিদেবীর ওপর না হয়, তাই সেফ সাইডে থাকা। এসব দিনে ‘এই লোকটা সামনে থাকলে কথা বলা যাবে না।’ বলে অঞ্জলিদেবী ফোন কেটে দেন। অন্যথা ফোন নিজে থেকেই কেটে যায়। কখনও অনন্যার ফোনে চার্জ শেষ হয়ে যায়, কখনও বা পয়সা। নিয়ম মেনে ‘ছাড়ছি’, ‘ভালো থেকো’, ‘রেখে দিলাম’, ইত্যাদি বলে ফোন রাখা হয় না।
অনন্যা বিরক্ত হয়েই বলল, ‘আশ্চর্য, তুমি কিছু বলবে তো!’
‘তোর বাবা…’
‘আরে বাবার কি হল, শরীর খারাপ? পেটের অসুখ?’
‘না, রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে।’
‘মানে, বুড়ো বয়সে এ আবার কি? বাড়িতে কেউ ছিলে না নাকি যে আটকাতে পারলে না? খুঁজতে পাঠাও নি কাউকে? নিশ্চয় তুমি ঝগড়া করেছিলে। বাবাকে যদি খুঁজে না পাওয়া যায়!’ অনন্যা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে প্রথমেই মার উপর দোষ আরোপ করে দেয়।
‘আরে খুঁজে না পাবার কিছু নেই, মামার বাড়ি গিয়েছে।’ অনন্যার উদ্বেগ অঞ্জলিদেবীর কান্নাকাটিকে এক ধাক্কায় যেন উধাও করে দেয়।
‘যাক। মামার বাড়িই তো গেছে, পালিয়ে গেছে বলছ কেন? কি হয়েছিল কি? বাবার এসব খুব অন্যায়, এত বয়েস হল এ আবার কি ছেলেমানুষি!’
অঞ্জলিদেবীর গলা পুরো স্বাভাবিক, ‘কি অপরাধ জানিস? কাল তারাপদবাবু এসেছিলেন। বুঝতে পেরেছিস তো তারাপদবাবু কে? তোর বাবার প্রাণের বন্ধু, উনি তো রিটায়ার করে চন্দননগরে বাড়ি করেছেন। বন্ধুকে মাংস না খাওয়ালে তো আবার তোর বাবার মন ভরবে না। সন্ধ্যেবেলা গিয়ে খাসির মাংস নিয়ে এল। এদিকে তারাপদবাবুর আলসার। মাংসটা একটু জমিয়ে রান্না করেছিলাম। তা ঝালে একটু ঝোল হতে পারে না বল?’
এই ফাঁকে অনন্যার ছেলে অপু ক্রিকেট খেলে এক গা ধুলো নিয়ে দুপদাপ করে ঘরে ঢুকল। এক হাতে ফোন কানে চেপে রেখে অপুকে সোজা বাথরুমে নিয়ে গেল অনন্যা। অপু জল ঢালতে শুরু করলে জল ঢালতেই থাকবে, যতক্ষণ না গিয়ে ওকে টেনে বের করে আনা হচ্ছে। তাই দু মগ জল নিজেই ঢেলে দিল অনন্যা আর ভেজা অপুকে টেনে বের করে কলটা বন্ধ করে দিল। এত কিছুর মধ্যে অঞ্জলিদেবীর পুরো কথাটা ঠিক মত ওর মাথায় ঢোকে নি। ও শুধোল, ‘কিসের ঝোল?’
‘ঝালে ঝোল।’
‘উঃ তোমাকে নিয়ে পারি না। ঝোলে ঝাল হয়েছিল নাকি?’
অপু গামছা হাতে দাঁড়িয়েই আছে। হাল্কা করে একটা চাঁটি মেরে অনন্যা ওর গা মোছাতে শুরু করল।
‘হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস। ওই হল।’ অনন্যা যে ঠিক ধরতে পেরেছে তাতেই অঞ্জলিদেবীর গলায় স্বস্তি। বেশ গল্প বলার মুডে পৌঁছে গেলেন উনি, ‘তো ঝোলে ঝাল হয়ে যাওয়াতেই তোর বাবার রাগ। রাতে শুতে গিয়ে, ঝাড়া দুঘণ্টা আমার সঙ্গে ঝগড়া করল। আমার নাকি এই পঁয়ত্রিশ বছর সংসার করেও একটু বুদ্ধিশুদ্ধি হয় নি। আহা নিজের যেন কত বুদ্ধি! আর কাজকর্ম তো নেই। এক গ্লাস জলও নিজে নিয়ে খাবার মুরোদ নেই বাবুর, আর বড় বড় কথা। তারাপদবাবু সকালবেলা বিশ্বভারতী ধরে বাড়ি গেলেন আর তোর বাবা জামাপ্যান্ট পরে ব্যাগ নিয়ে সেজেগুজে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাবে শুধোতে বলল, মামার বাড়ি। ময়লা জামাটা গায়ে দিয়ে গেল জানিস। এসব তো তাকিয়েও দেখে না। চোখের সামনে পরিষ্কার জামা থাকলেও দেখতে পাবে না। সব তো হাতে হাতে পেয়ে অভ্যেস। ওই জামাটা কাচব বলে বাইরে নামানো ছিল সেখান থেকেই নিয়েছে। আমি আর বলি নি, যে ওটা পরে যেও না।’
‘ঝগড়া করার সময় কি তুমি স্টপওয়াচ চালিয়ে রেখেছিলে নাকি? চিরকালই তো বাবার ‘মামার বাড়ি ভারি মজা’, যাবার জন্যে শুধু একটা ছুতো পেলেই হল। এতে কান্নার কি আছে? রেগে চলে গেল বলে মন খারাপ নাকি, ময়লা জামা পরে গিয়েছে, লোকে বলবে তুমি পতিসেবায় ফাঁকি দিচ্ছ তার জন্যে? তবে পারও বাবা তোমরা। একদিন ছেড়ে থাকতে পার না আর দিনরাত ঝগড়া!’ কথা বলতে বলতেই এক গ্লাস দুধ অপুর নাকে ডগায় নামিয়ে দিয়েছিল অনন্যা। অপু নিজে দুধটুকু খেলে ও নিজেকে ধন্য মনে করবে। অনন্যা দেখল অপু সেটা এখনও স্পর্শ করে নি। একটা ছোট্ট করে খোঁচা দিল ও অপুর পিঠে, চোখের ইশারায় দেখাল দুধের গ্লাসটা।
‘সবকিছুর তো একটা শেষ আছে। ঝগড়াটা শেষ না করে মাঝ পথে ঝুলিয়ে গেলে মন খারাপ করে কিনা বল!’ এতক্ষনে আসল কারণটা খোলসা করে বললেন অঞ্জলিদেবী।
সামনের দেওয়ালে ডিজিটাল ঘড়িটা তখন অনন্যার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে। অপুকে হোমওয়ার্ক করাতে হবে। তারপর একঘণ্টা রান্নাবান্না। বাকি একঘণ্টা খাওয়ানো ও খাওয়া শেষ করে তিনঘণ্টার মধ্যে বিছানায় নিজের শরীরটা ছুঁড়ে না ফেলতে পারলে ও পরদিন সকালে উঠতে পারবে না। মা যদি দুঘন্টা ধরে ঘটে যাওয়া ঝগড়ার বিবরণ শোনায় তাহলে ওর কালকের অফিস চৌপাট হবে। এদিকে অনন্যা যে ফোনে আড্ডা মারছে অপুও তার একশ ভাগ সুযোগ নেবে। হাজার খোঁচা মারলেও দুধটুকু শেষ করবে না। বই নিয়ে বসার তো প্রশ্নই নেই। যতক্ষণ না পুরো মনোযোগ ওকে দেওয়া হচ্ছে ও নিজের মনে পা দুলিয়েই যাবে, যেমন এখন দোলাচ্ছে, নির্বিকার চিত্তে।
বিরক্তিটা প্রকাশ করেই ফেলল অনন্যা। মাকে মাঝখানে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলল, ‘তোমাদের এই ঝুলন্ত ঝগড়ার নিষ্পত্তি হলে আমাকে জানিও। আর এ নিয়ে কান্নাকাটির কিছু নেই মা। তুমি তো জানই বাবার দৌড় কতদূর? তুমি বাবাকে ছেড়ে দুচারদিন পার করতে পারলেও বাবার সে ক্ষমতা নেই। এবার আমি ফোন রাখব। অপুকে পড়াতে হবে।’
বোধ হয় তাতেই অঞ্জলিদেবীর নাতির কথা মনে পড়ে গেল, ‘দাদুভাইএর খবর কি রে, ভালো আছে তো? কতদিন যে ওর পাকা পাকা কথাগুলো শুনি না! তুই ও তো ফোনে বলিস না কিছু।’
‘বলার সুযোগ দাও তুমি আমাকে? তবু ভাল, আমাদেরও যে সমস্যা আছে বা ভালো থাকা, খারাপ থাকা আছে, তোমার মনে আছে দেখে আমি খুশি হলাম।’ বলে অভিমান ভরে ফোন কেটে দেয় অনন্যা।
দুদিন পরের কথা। বাবার ফিরে আসা নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা অনন্যার ছিল না। কিন্তু ওর খুঁতখুঁতানি ছিল মা’র জন্যে। পরশু ওরকম ফোন রেখে দিয়েছিল। কাল অফিসে অডিট ছিল, সারাদিন নিঃশ্বাস ফেলার সময় ছিল না। আজ শুক্রবার, পরপর দুদিন ছুটি। তাড়াহুড়ো নেই। অপুও পার্কে গিয়েছে। স্টার এক দুই তিন ডায়াল করে অনন্যা দেখল যা টাকা আছে তাতে আধঘন্টা কথা হয়ে যাবে। ফোনটা করে মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও বলল, ‘বেশি টাকা বা সময় নেই, আজ সর্টে সাড়তে হবে।’
‘ঠিক আছে বাবা তাই হবে। তুই, অনুপম, অপু সব ভালো আছিস তো!’ সেদিন যে অনন্যা বলেছিল ‘আমাদেরও সমস্যা, খারাপ থাকা, ভালো থাকা আছে’ তারই আফটার ইফেক্ট। প্রথমেই ওরা কেমন আছে জিজ্ঞেস করে নিলেন অঞ্জলিদেবী। অনন্যা একবাক্যে বলল, ‘আমরা তিনজনেই ভাল আছি। এবার তোমাদের খবর বল। তোমরা সবাই ভালো তো?’
‘হ্যাঁ, আমরা তো ভাল, কিন্তু!’
‘কিন্তু কি হল?’
‘একটা খারাপ খবর ছিল।’
‘উঃ, আবার সেই নাটক। বলি না এরকম বললে টেনশন হয়। তাড়াতাড়ি বল কি হয়েছে?’
‘ইয়ের কাল থেকে খুব অসুখ রে। বর্ধমানের হাসপাতালে ভর্তি আছে।’
অঞ্জলিদেবী এতগুলো তথ্য দিতে পারবেন কিন্তু ‘ইয়ে’টা কে প্রথমে কিছুতেই বলবেন না।
অনন্যার বুকের ধুকপুকুনি বাড়ে। রেগে গিয়ে বলে, ‘তো ইয়েটা কে বলবে?’
‘সোমা।’
অনন্যা ভাবে নামও একটা খুঁজেখুঁজে বের করেছেন মা। অনন্যাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে ডজন খানেক সোমা। সবচেয়ে বড় কথা ওর ভাইএর বৌএর নামও সোমা। ওর বুকের ভেতরে ধড়াস করে ওঠে। নিমেষে মনে পড়ে যায় আকাশের কথা, অনন্যার ভাইয়ের ছেলে, অপুর থেকে এক বছরের ছোট, মাত্র চার বছর বয়স। কি হল, যদি কঠিন কিছু হয়, কি হবে? শুধু কি আকাশের, ভাইএরই বা কি হবে! এক নিমিষে এতকিছু ভেবে নিয়ে অনন্যা শুধোয়, ‘কোন সোমা?’
‘কীর্ণাহারের সোমা।’ কথাটুকু শুনে বুকের ভেতরে অতিরিক্ত চাপ অনেকটা কমলেও হৃৎপিণ্ডের শব্দ তখনও যেন নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে অনন্যা। অঞ্জলিদেবীর অবিরাম বাক্যস্রোত ওর কানে ঢুকছে কিন্তু মাথায় ঢুকছে না।
‘তুই চিনতে পারছিস না? আরে সোমা হল গিয়ে ভোটামামার বৌমা। ভোটামামা কে বুঝতে পারছিস তো? মামার মেজকাকার ছেলে, খুব রোগা, যাকে বলে তালপাতার সেপাই। ভোটামামা বললেই আমার আবার মনে পড়ে যায়, বেশ কবছর আগে কীর্ণাহার হাইইস্কুলে এক অনুষ্ঠানে প্রনব মুখার্জী আসছিলেন, ওনার হেলিকপ্টার নামা দেখতে গিয়েছিল সব। এখন বোধ হয় হেলিকপ্টার আর কীর্ণাহার পর্যন্ত যায় না। বোলপুরে ডাকবাংলার মাঠেই নামে। সেই হেলিকপ্টার নামার সময় হেলিকপ্টারের ডানার হাওয়ায় ছিটকে গিয়ে পুকুরের জলে পড়ে গিয়েছিল ভোটামামা। সেই ভোটামামারই তো দুই ছেলে, নিলয় আর প্রলয়। ওই যে কোণের ঘাটের উল্টোপারে বাড়ি। ছোটবেলায় ওদের বাড়ি অনেকবার গিয়েছিস। চেষ্টা কর দেখ মনে পড়ে যাবে। কোণের ঘাট বুঝতে পেরেছিস তো? তোরা যখন ছোট ছিলিস, কীর্ণাহার গেলে সবাই দল বেঁধে ওই পুকুরে চান করতে যেতাম। তোরা ওই পুকুরে সাঁতার কেটেছিস কত!’ একটু সময়ের জন্য বোধ হয় অনন্যার চিন্তাশক্তিও লোপ পেয়ে গেল। একটা অসুস্থতার খবর দিতে গিয়ে ওর মা প্রনব মুখার্জী থেকে শুরু করে একটা পুকুরের রেফারেন্স দিতে শুরু করেছেন। তাল রাখতে পারছে না অনন্যা। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ‘আশ্চর্য!’
‘তোর বাবার মত কথায় কথায় ‘আশ্চর্য আশ্চর্য’ করিস না তো। দাঁড়া আগে তোকে মনে করিয়ে দি, তারপর আসল ঘটনাটা বলছি। ওই যে একবার গোষ্ঠ উৎসবের সময় মামিমা টেনে নিয়ে গেলেন ওদের নতুন বাড়ি হয়েছে দেখাবেন বলে। ওদের বাড়িতে সেই বড় বড় থালা। তাতে মুড়ি, পিঁয়াজি, পাঁপড় ভাজা, জিলিপি এইসব খেতে দিয়েছিল। আর তুই বলেছিলি, এরা কি সব রাক্ষস নাকি, কতটা করে খায়, এত বড় বড় থালা কেন? কি লজ্জায় যে ফেলেছিলি আমাকে! কোথায় কি বলতে হয় সে জ্ঞান তো ছিল না। কম মার খেয়েছিস তার জন্যে! সে তুলনায় কিন্তু তোর ছেলে অনেক ভদ্র সভ্য।’
ধীরে ধীরে একটা বহু পুরনো ছবি ভেসে উঠছে অনন্যার মনে। ছবিটা আসলে ওর মা এঁকে দিচ্ছেন। তা সত্ত্বেও অনন্যা বিরক্ত হয়ে অঞ্জলিদেবীকে থামায়, ‘চুপ কর দেখি। চিনতে পেরেছি, তুমি আসল কথাটা বল। সিরিয়াস কিছু হয়েছে নাকি? কীর্ণাহার বা সিয়ানে হল না, বর্ধমান নিয়ে যেতে হল কেন?’
অঞ্জলিদেবীর এই ভোটামামা আনন্দবাবুর মামার খুড়তুতো ভাই। আনন্দবাবু, ওনার মামা বা পাড়াতুতো মামারা সব আনন্দবাবুর সমবয়সী। ওনাদের সবাইকেই অনন্যা চেনে। ছোটবেলায় ও অনেকবার ঠাকুমার সঙ্গে গিয়েছে। পরে নিজের পড়াশুনোর চাপ বেড়েছে, কাজ বেড়েছে, তারও পরে চাকরি ও বিয়ে হয়ে যেতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই প্রজন্মের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েকে অনন্যা চেনে না। অনেকেরই নাম মার মুখ থেকেই শোনা। অঞ্জলিদেবী বা আনন্দবাবুর নিয়মিত যাতায়াত আছে ওখানে। আনন্দবাবু বড় হয়েছেন মামার বাড়ি থেকে। এখনও মামার বাড়ি গেলে কেমন ছেলেমানুষ হয়ে যান উনি। দেখে মনে হয় গোটা পাড়াটাই যেন ওনার মামার বাড়ি।
কি হয়েছে সেকথা বলতে শুরু করেছেন অঞ্জলিদেবী, ‘কাল রাত তখন সাড়ে নটা। উপরের ঘরে সোমা ওর ছেলেটাকে পড়াচ্ছিল। আর নীচে মলয় টিভি দেখছিল। নীচ থেকেই মলয় চেঁচিয়ে ডেকেছে ‘খেতে দেবে এস’, লাইন চলে গেয়েছিল বোধ হয়। সোমা বলেছে, তুমি হ্যারিকেন নিয়ে এসো। আমি নীচে যাই নাহলে প্রীতম ভয় পাবে। প্রীতম তো অপুরই বয়েসি।’
মলয়ের বাবা চাকরি সূত্রে ম্যাসাঞ্জোরে একা থাকতেন। ওনার পরিবার গ্রামের বাড়িতেই থাকত। এখন উনি কোথায় থাকেন মাকে জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না অনন্যা। তাছাড়া অপুর বয়েসি একটি বাচ্চার মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে শুনে, তাকে না চিনলেও অনন্যার মনটা ভার হয়ে যায়।
অনন্যা ধৈর্য ধরে শুনছে ওর মার কথা, ‘তারপর মলয় উপরে গিয়ে ছেলের কাছেই শুয়েছিল। ছেলেটা তখনও পড়ছিল। নীচে সোমা ভাত বেড়ে ডাকলে তবে দুজনে নামবে।’
অনন্যা ছোট্ট করে একটা অ্যালার্ম বাজিয়ে দিল ‘মা, ছোট করে বল।’
‘হ্যাঁরে বাবা, তাই তো বলছি। এমন সময় জোরসে দুম করে কিছু পড়ে যাবার শব্দ হল। মলয় উপর থেকে চিৎকার করেছে ‘কি হল, সোমা পড়ে গেলে নাকি?’ কোনও সাড়া নাই। মলয় ছুটে নেমে এসে দেখে, একদিকে জলের বালতি আর একদিকে সোমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তুই বল ওই অন্ধকারে কল থেকে জল আনার কি দরকার?’ শেষে প্রশ্নটা অঞ্জলিদেবী অনন্যাকে করেন।
‘সেটা আমি বলতে পারব না, তুমি তাড়াতাড়ি বল, কি হয়েছে আর কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে?’ অনন্যা শুধোল যাতে অঞ্জলিদেবী সোজা সোমার শারীরিক অবস্থার কথায় আসেন।
‘বলছি তো বাবা, দাঁড়া না। মলয় দেখে, দাঁত লেগে গিয়েছে। ওর অবস্থাটা একবার চিন্তা কর। ওই ছোট ছেলে নিয়ে ও কি করে? ভোটামামা তো কবে ঘরে থাকে কবে থাকে না ঠিক নাই। মামি মরার পর থেকে কিরকম হয়ে গিয়েছে। মলয় আর নিলয়েরও হাঁড়ি আলাদা। মলয় বুঝতে না পেরে, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পাশের বাড়িতে শ্যামলকে ডেকেছে। জ্ঞান ফেরে নি বলে ওই রাতের বেলাতেই ট্যাক্সি করে বোলপুরে নিয়ে এসেছে। নিলয় রাতেই আমাদের বাবুর ফোনে ফোন করেছিল। যদি যেতে পারে ওদের সুবিধে হয়। তা বাবুরতো আবার মোটরসাইকেলে তেল ছিল না। ও বলে দিয়েছিল, সকালবেলা যাবে। যে ছেলে আটটার আগে বিছানা ছাড়ে না, সে দেখি পাঁচটার সময় জামাপ্যান্ট পরে উপর থেকে নেমে আসছে। আমার তো সারারাত ঘুম হয় নাই। ওকে দেখে আমার বুকের ভেতরটা আঁতকে উঠেছে। কার কি হল রে? বাবুকে শুধোলাম।’
এই বাবু অনন্যার ছোট ভাই। বিষম সংকট ছাড়া ও সকালের ঘুমের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে না। তবে লোকের বিপদে আপদে এমনকি সব শেষ হয়ে যাবার পরও শ্মশান পর্যন্ত ও পাশে থাকে। বোলপুরের আশপাশে গ্রামেগঞ্জে আত্মীয়স্বজন ও চেনাপরিচিতরা ডাক্তার দেখানোর সময় নির্বিচারে ফোন করে বাবুকে দায়িত্ব দেয় ডাক্তারের কাছে নাম লেখানোর। অনেকসময় বাবুকে ওদের সঙ্গে যেতে হয়। সবাই বলে এ যুগে এরকম ছেলে আর কজন আছে!
‘মা তোমার হিস্ট্রি না বলে কাজের কথাটা শেষ কর। আর তোমারই বা কি হয়েছিল, বাবার সঙ্গে আবার ঝগড়া? রাতে ঘুমোও নি কেন?’ কথাগুলো বলেই অনন্যা জিভ কাটে। মা আবার অন্য লাইনে ঢুকলেই চিত্তির।
অঞ্জলিদেবী অন্যদিকে গেলেন না বটে কিন্তু বলতে শুরু করলেন, ‘রাতের বেলাতে খেয়েদেয়ে শুয়েছি। ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। ঠিক সেইসময়ে ল্যান্ড ফোনটা বাজতে শুরু করল। এত রাতে কি দুঃসংবাদ কে জানে? কত রাত তাও বুঝতে পারছি না। বেশিক্ষণ রিং হলে আবার তোর বাবা জেগে যাবে। ওই মানুষ একবার জেগে গেলে আর দেখতে হবে না। নিজে টেনশন করবে আর সারারাত আমাকে জ্বালিয়ে মারবে। আমি ছুটে গেলাম ডাইনিঙে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। একবার দেখছি এগারোটা, একবার দেখছি একটা। একবার দেখছি এগারোটা, একবার দেখছি একটা। একবার দেখছি এগারোটা…’
‘উঃ তোমার এগারোটা-একটা বন্ধ করবে নাকি আমি ফোনটা রেখে দেবো?’
‘এগারোটা না একটা বুঝতে পারার আগেই ফোনটা বেজেবেজে থেমে গেল। তারপর খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, আবার যদি বাজে। এই অবসরে চোখে জল দিয়ে দেখি, বেশি রাত নয় এগারোটা পাঁচ।’
বলার ভঙ্গিতে মনে হয় একটা না হয়ে এগারোটা হওয়ায় অঞ্জলিদেবী খুব স্বস্তি পেয়েছেন।
‘ঝাড়া আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলাম কিন্তু ফোন আর বাজলো না। আবার গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সারারাত টেনশনে ঘুম হল না। ভোরবেলা উঠে পড়েছি। বাবুর মুখেই শুনলাম, রাতেই ওরা বর্ধমান নিয়ে গিয়েছে। তখন আমি দুয়ে দুয়ে চার করে ফেল্লাম। তাহলে ওদেরই ফোন ছিল।’
‘বেশ, বাবার সঙ্গে থেকে তোমার অঙ্কে বুদ্ধি খুলেছে বুঝতে পেরেছি। তোমার ফোনের গল্প শেষ হয়েছে আশা করি। এবার বল, ভাই কি গিয়েছিল বর্ধমান?’ গলায় একরাশ ঝাঁঝ এনে অনন্যা বলে।
‘হ্যাঁ। শুধু কি বাবু? আজ তো বর্ধমানে একদল লোক। শ্যামলরা দুই ভাই, নিলয়, সোমার বাপের বাড়ির লোক। এদিকে তোর ভাই। ভাই আবার সোমার ছেলেটার সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছে। ছেলেটার কথা ভেবেই আমার বুক টনটন করছে। হতভাগা ছেলে, ঠাকুমাও নাই, দিদিমাও নাই। এখন মায়ের কিছু হয়ে গেলে কি হত? আজকের দিনটা শ্যামলের মায়ের কাছেই আছে ছেলেটা। ঝামেলা কিছু করে নাই, খেলছে ধুলছে, ভালই আছে। ওই টুকু ছেলে ও আর কি বুঝবে, মা কি জিনিস!’ মলয়ের যে শাশুড়ি নেই সে খবরটা অঞ্জলিদেবী এই সুযোগে দিয়ে দিলেন।
অনন্যা বলল, ‘হ্যাঁ, মা আসলে জিনিসই বটে। আসল কথাটা এখনও বললে না। আমি না রাখলেও এবার ফোনটা কেটে যাবে। আমি আর করতে পারবো না তখন। টাকা নেই।’
‘বলছি তো বাবা, দাঁড়া না। সিয়েনের ডাক্তারে বলেছে, এত জোরে পড়েছে, ব্রেনে আঘাত লাগতে পারে ওরা রিস্ক নেবে না, বর্ধমানে নিয়ে গিয়ে স্ক্যান করাতে হবে। সিয়েনে স্ক্যান করার মেশিন আবার খারাপ। কপাল খারাপ হলে যা হয়, মেশিনটা এই সময়েই খারাপ হতে হল? নাকি ছমাস নমাস ধরে খারাপ হয়ে পড়ে আছে তাই বা কে জানে! সরকারি ব্যাপার স্যাপার, ওদের তো আবার আঠারো মাসে বছর। লোকগুলোর মার খেয়েও লজ্জা নাই। সিয়েনের লোকে তো সুযোগ পেলেই পেটায়। ডাক্তারগুলো মারের ভয়েই তো অর্ধেক ট্রান্সফার নিয়ে নেয়।’
‘তারপর স্ক্যান হয়েছে কিনা বল!’
‘হ্যাঁ।’
‘স্ক্যানে কিছু ধরা পড়েছে?’
‘না।’
‘তাহলে কি হয়েছে? এখন কেমন আছে?’
‘এখন তো বলছে ভালোই আছে। দুপুরে ভাত খেয়েছে। ডাক্তার বলেছে শরীরে রক্ত কম, দুর্বল, তাই এরকম হয়েছে। ভয়ের কিছু নাই।’
অনন্যার যেন বুক থেকে পাথর সরে যায়।
‘এই কথাটা সোজাসুজি বলা যাচ্ছিল না মা?’
ওপাশে অঞ্জলিদেবী ফিক করে হাসলেন। অনন্যা যেন দেখতে পেল ওর মার সেই ফিচেল হাসি আর চকচকে চোখ। যার জন্যে আনন্দবাবু বলে থাকেন, ‘আমার ছেলেমেয়েগুলো একজনও তোমার জন্যে সিরিয়াস হল না, সব কটা ফক্কর।’ অঞ্জলিদেবী বেশ একটা বিজয়ী বিজয়ী ভাব গলায় ফুটিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কেন রে তোর টেনশন হচ্ছিল? তাহলে আমার কথা ভাব এতবছর ধরে কতজনকে নিয়ে ঘর করছি। তোদের তো সব ছোট পরিবার সুখী পরিবার। আমাদের যে কত টেনশন! তারপর তোর বাবার কান্ড শোন। সেদিন রাগ করে পালিয়েছিল, ফিরে তো আর এক কান্ড…’
লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অনন্যার ফোনে টাকা শেষ। ওর বাবার কাণ্ড আর শোনা হল না। তাড়াতাড়ি রিচার্জ করাতে হবে। মাকে যতই মেজাজ দেখাক না কেন বাবা মায়ের রাগ থেকে অনুরাগে পরিবর্তনের গল্পটা না শোনা পর্যন্ত যে অনন্যারও শান্তি নেই।