জানিনা কেন আপেক্ষিক ভাবে নিজের প্রতি দায়হীন হয়ে পড়ছি দিন দিন। দিনের অর্ধেক সময় শুধু একটা প্রবাহমান চলন্ত ঘড়িতে পুঁতে রেখেছি নিজেকে। চারপাশে যা হচ্ছে ,তা হতে দাও, এতে আমার কোন তোয়াক্কা নেই, এই রকম একটা ভাব গলা টিপে আছে। মাঝে মাখে কলমের ফাঁকে নিজের অস্তিত্বকে ধরে রাখার যে চিরন্তন লড়াইটা লড়ে যাচ্ছি সেটা ভাষা পাচ্ছে না কথা বলার। বোবা বটগাছের শিকড় হয়ে হারিয়ে যাচ্ছি মাটিতে। অনেক গভীরে।
ঠিক এমন সময় বাস্তবতা জিনিসটা মনে হাতুড়ি মারে। চোখের পাতার উপর উদাসীনতা মাটি খুঁড়লে সেখানে নতুন চারাগাছ লাগায়। আস্তে আস্তে ছোট ছোট ভালোলাগা ইমারতের গাম্ভীর্যে বড় হয়। লিখতে বলে আবার। কিন্তু কি লিখব! লেখার জন্য চাই রসদ আর ভাবনা। অবশেষে বিষণ্ণতা হাতড়ে চোখ খুলি। আসলে চোখ খুলে থাকলে বাস্তব নিজে এসে ভাবনার সিন্দুকে নিজের প্রচ্ছদ পুরে দিয়ে যায়। আমি শুধু সেটা দেখে হাবি জাবি কিছু একটা লিখে ফেলি মাত্র।
বৃহস্পতিবার দিনটা সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন দিন। নিজের ইউনিটের কাজ সামলে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে ডিউটি দিতে হয়। একা। যাদের সিজার হয় তাদেরকে এই ওয়ার্ডে অবজারভেশনের জন্য রাখা হয়। প্রায় কুড়িটা বেড আছে। প্রত্যেক বেডে সদ্য মা হওয়া মায়েরা বিশ্রাম নেয়। এদের প্রত্যেকের পাশে ছোট্ট বাচ্চা গুলো গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে। কেউ কাঁদে, তো কেউ হাত পা ছোঁড়ে, তো কেউ মায়ের দুধ খায়।
মায়েদের মুখে একটা প্রশান্তি থাকে সবসময়। নিজের সন্তান সব সময় নিজের অস্তিত্বের রূপ হয়। ছোট্ট পুতুলের মত সদ্য প্রাণগুলোকে হাতে নিয়ে এরা সবাই তলপেটে অতখানি কাটার যন্ত্রণাকে বেমালুম ভুলে থাকে।
একদিক থেকে রাউন্ড দিয়ে ডানদিকের শেষ বেডের কাছে এসে দেখলাম একজন কমবয়সী মেয়ে ঘুমোচ্ছে। মেয়েটির বয়স উনিশ বছর। রোগাটে গড়ন। মাথার চুলগুলো উস্কখুস্ক হয়ে ছড়িয়ে আছে চারদিকে। কপালের ভাঁজে আবছা হয়ে আসা সিঁদুর আর হাতের শাঁখা পলা দেখে ওকে বাঙালি বলে বুঝতে অসুবিধে হল না। একটা হাতে চ্যানেল করা আছে, তাতে স্যালাইন চলছে পাশের স্ট্যান্ড থেকে। মেয়েটি ওই হাতটা কপালের উপর রেখে যন্ত্রণার ঘুমে ডুবে রয়েছে। আর ওর ছোট্ট ফুটফুটে ফুলের মত ফর্সা বাচ্চাটা ওর ডান পাশে শুয়ে আছে। মুখটা অনবরত নেড়ে চলেছে বাচ্চাটা, তার সাথে ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাতও নাড়ছে ক্রমাগত। লক্ষ্য করলাম কোনভাবে মায়ের দুধের বোঁটাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে ওর। খিদেয় ছটফট করছে ব্যাটা!
আমি মেয়েটিকে ডেকে বললাম, ” মা শুনছ ?”
ডাকে সাড়া দিল মেয়েটি। চোখ খুলতেই কেমন একটা আলুথালু হয়ে গুটিয়ে নিল নিজেকে। করুন চোখে আমার দিকে তাকাল সে। আমি বললাম, ” এটা তোমার প্রথম বাচ্চা ?”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মেয়েটি। একে বয়স কম, তারপর প্রথম সন্তান। ওর অগোছালো আলুথালু ভাবটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রথমবার যারা মা হয় তারা এরকমই হয়। বুঝে উঠতে পারে না কি করবে আর কি না করবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ” মা সিজার কখন হয়েছে তোমার ?”
” সকাল দশটায়।” শুকনো শুকনো উত্তর দিল মেয়েটি।
” আচ্ছা বেশ। এখন কেমন আছো ?”
” পেটে বড্ড ব্যাথা স্যার।” কম্বলের উপর দিয়ে পেটের উপর হাত রাখল মেয়েটি। ব্যাথা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তলপেটে অতখানি কাটার ব্যাথা মারাত্বক। ওষুধ পত্র চললেও একটা ব্যাথা থেকেই যায়।
আমি বললাম, ” ব্যাথা তো একটু করবেই মা। পেট কাটা হয়েছে তো তোমার। ওষুধ দেওয়া আছে, আস্তে আস্তে কমে যাবে সব।”
মাথা নেড়ে কথাটা বিশ্বাস করে নিল মেয়েটা। অসহায় অবস্থায় মানুষের মুখের কথাই মনে জোর আনে। ভরসা দেয়। আমি ওর বাচ্চাটার দিকে দেখিয়ে বললাম, ” তুমি ওকে একটু খাওয়াও মা। ওর খিদে পেয়েছে। দুধটা ধরাও ঠিক করে ওকে।”
নিজেকে একটু টেনে টুনে জায়গা করে নিল মেয়েটি। তারপর দুধের বোঁটাটা পুচকিটার মুখে দিতেই দেখি সে ব্যাটা মন প্রাণ ভরে দুধ খেতে লাগল। হাত পা ছোঁড়াও একটু কমে এলো ওর। শান্ত হয়ে গেল বেচারি। মেয়েকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সারা মুখে একটা প্রশান্তির প্রলেপ ছড়িয়ে পড়ল সদ্য মা হওয়া মেয়েটির।
সমস্ত কাজ শেষ করতে আরও দু ঘন্টা লাগল। শেষে ক্লান্ত দেহটাকে টানতে টানতে যখন ওয়ার্ড থেকে বের করে নিয়ে আসছি তখন দেখি মেয়েটি অল্পবিস্তর কুঁজো হয়ে নিজের মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়েছে। একটা হাত মেয়ের ছোট্ট গায়ের উপর রেখে বেচারি নিজেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আর পুচকিটা দেখলাম মায়ের গালের উপর একটা হাত তুলে দিয়ে মায়ের কোলের গরমে বিন্দাস ঘুমাচ্ছে।
দেখতেও ভালো লাগে। বাস্তবটা সত্যিই অপূর্ব।