বউ তোমারে না কইছি এমন ধারা কতা আর কইবা না! তারপরও ক্যান কও? কি কমু কও ডর লাগে তো! আমি হুনছি অনেক পোয়াতি মেয়েই বাচ্চা জন্মানোর সময় মারা যায়। হগোল্লে তো মরে না। তোমারও কিছু অইবো না। আল্লার ওপর ভরশা রাখো।
আপনার কতাই যেনো সত্যি অয়। আচ্ছা হোনো আমি মইরা গেলে কি আপনে আবার নিকা করবেন? আবার ঐ কতা! বলছি না এবার চুপ যাও। হের চেয়ে তুমি খিরকি দিয়া বাইরে দেহো। কি সুন্দর চাঁন্নী রাইত। বাইরেডা কেমন ঝকঝকা। তোমার মনে আছে এমনই এক চাঁন্দের রাইতে প্রথম তোমারে দেখছালাম। দ্যাইখাতো আমার মাথা খারাপ আইয়া গেছিলো কোন মাইয়া মানুষ অত্ত সুন্দরও অয়। আপনে তো সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। আমারে দ্যাখার এক মাসের মাথায় ঘরের বউ কইরা আনলেন। কি করমু কও।যদি তোমাকে অন্য কেউ নিকা কইরা ফালাইতো। তাইলেতো মরা ছাড়া দ্যাহেন বাজে কতা কইবেন না। আমারে আরেকজনে কেম্মে নিবে? আল্লায় আমারে আম্মের বুহের বাম পাশের পাজর দিয়া বানাইেচে। হের মানে আমি জন্মজন্মাতর খালি আম্মেরই থাকুম।
বৌ অনেক রাইত অইছে। তুমি ঘুমাও। কেম্মে ঘুমামু আম্মের বুকে মাথা না দেলে তো ঘুম আহে না। বৌ তুমি খুব ভ্যালা গো। এতক্ষন কথা হচ্ছিতো গ্রাম্য অজো পাড়াগায়ের এর দম্পত্তির সাথে। লোকটির মানে ঘরের কর্তার নাম রাজা মিয়া আর কর্তির নাম মুক্তিমন বিবি। তার বর ভালোবেসে তাকে বৌ বলেই ডাকে। মুক্তি সাত মাসের প্রেগনেন্ট। গ্রাম্য পরিবেশে গড়ে ওঠা তাদের ভালোবাসার কিছু স্বপ্ন নিয়ে লিখবো আজ। তাদের স্বপ্ন গুলো সোজা সাদা মাটা। অল্পতেই তারা খুশি তাই তাদের স্বপ্নের নাম দিলাম #গ্রাম্য_স্বপ্ন । রাজা মিয়ার ঘরে তার বাবা মা আর এক ছোট ভাই আছে। সবাই মুক্তিকে ভালোবাসে। হ্যা তাদের মধ্যেও আনমন হয় কিন্তু তাদের স্বপ্ন গুলো যতটা সরল ততটাই সাজানো।
খুব সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গে মুক্তির। নামাজ পড়ে সকালের খাবার বানাতে গিয়ে দেখে শ্বাশুরি খাবার বানাচ্ছে। সেটা দেখে বললো
মুক্তিঃ আম্মা আমারে ডাক দিলেই তো পারতেন।
শ্বাশুরিঃ কেমন কতা কস? এহন তোর বিশ্রাম নেয়া লাগবে। ঘরের কাম কয়দিন আমি করলে মইরা যামু না। আমার প্রথ্রম নাতি নাতিন। যত্ন আত্নি করমু না। আর তুই তো আমার বৌ না আমার ম্যাইয়া। তাইলে তোরে দিয়া এহন কাজ করাইলে মরার পর আল্লার কাছে কি কমু। যা মা তুই গিয়া একটু ঘুমা।
মুক্তিঃ আম্মা বাড়ির বৌ বেলা কইরা ঘুমাইলে মাইনষে কি কইবো।
শ্বাশুরিঃ মাইনষ্যের কতার ধার আমি ধারি না। আমার বৌ ঠিক জগৎ ঠিক।
মুক্তিঃ আম্মা মনে হয় কোন সময় অনেক সাওয়াবের কাজ করছিলাম। হের কারনে আইজ আম্মেগো মত ঘরের বউ হইতে পারছি। পরিবারের সবাই মিলে মুক্তির খুব খেয়াল রাখতে ছিলো। রাজা মিয়া তার ভালোবাসায় মুক্তির জীবনটাকে কানায় কানায় পূর্ন করে তুলেছে। মুক্তির শ্বশুর শ্বাশুরির ভালোবাসা আর স্নেহ তার জীবনটাকে মুধুময় করে ফেলেছিলো। কিন্তু কথায় আছে না অতি সুখ কপালে সয় না। মুক্তির প্রসব বেদনা উঠলো। জন্মদিলো ফুটফুটে এক ছেলে । কিন্তু কপাল দোষে মুক্তিকে বাঁচানো গেলো না। যাবার আগে মুক্তি রাজা মিয়াকে বললো
মুক্তিঃ শোনেন আপনি কিন্তু একদম ভাইঙ্গা পরবেন না। পোলাডারে দেইখেন। আর ভ্যালা একটা মাইয়া দেইখা নিকা কইরা লইয়েন। আর পারলে আমারে ক্ষমা কইরা দিয়েন আপনারে একলা রাইখা যাইতেছি তাই।
শেষ নিঃশ্বাস মুক্তি রাজা মিয়ার বুকেই ত্যাগ করলো। মুক্তিকে বুকে নিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠলো রাজা মিয়া। মুক্তির বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুরি, সবাই ভিষন কাঁদলো। কারন সবাই মুক্তিকে ভিষন ভালোবাসতো। বিজয় দিবসের দিন জন্ম হয়েছিলো বলে মুক্তির দাদা ওর নাম মুক্তি রেখেছিলো। কিন্তু সে আজ সকলের সব বাঁধন মুক্ত করে চলে গেছে পরপারে। আজ মুক্ত। কিন্তু তার সাথে থেকে গেলো কিছু আফসুসস। সাজানো কিছু গ্রাম্য স্বপ্ন। মুক্তিকে কবর দিয়ে কবরের পাশে বসে অনেকক্ষন কাঁদলো রাজা মিয়া। সবাই তাকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করছে। সন্ধ্যা অবদি সেখানে বসে ছিলো সে। পরে কয়েকজন মিলে ধরে বাড়ি নিয়ে যায়। মুক্তি চলে যাবার পর ওদের বাড়ি থেকে যেনো প্রান চলে যায়। বাচ্চাটা মায়ের দুধের অভাবে কাঁদে। তাকে অনেক চেষ্টা করে থামানোর। কিন্তু দুধের শিশু কাউকে বলতে না পারলেও মায়ের অভাব ঠিকই বুঝতে পারে। বুঝতে পারে তার মায়ের শূন্যতা।
মুক্তির মারা গেছে প্রায় পাঁচ মাস হলো। পাঁচ মাসে বাচ্চাটা দাদির কোলে মাকে খুজে পেয়েছে। রাজা মিয়ার জন্য অনেকে অনেক বিয়ের প্রস্তাব আনা শুরু করছে কিন্তু রাজা মিয়া কিছুতেই রাজি হয় না। এদিকে রাজা মিয়ার মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। রাম্মিকে দেখা শুনা করতে তার কষ্ট হয়। ও হ্যা রাজা মিয়া আর মুক্তি মিলে তাদের ছেলের নাম রাম্মি ঠিক করেছিলো। সবার অনুরোধে মায়ের কথা ভেবে আর রাম্মির দিকে তাকিয়ে রাজা মিয়া বিয়ে করতে রাজি হলো। কিন্তু মনে একটাই ভয় ছিলো সৎ মা রাম্মিকে ভালোবাসবে তো? মুক্তির মৃত্যুর ছয় মাসের মাথায় রাজা মিয়া নাজমা নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে। নাজমা দেখতে ততটা সুন্দর না হলেও একেবারে খারাপ না। নাজমার বাবা খুব গরিব। যার কারনে নাজমাকে তারা রাজা মিয়ার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলো। বিয়ের কাজ শেষে যখন নাজমা আর রাজা মিয়াকে এক ঘরে দেয়া হলো। রাজা মিয়া নাজমাকে বললো
রাজা মিয়াঃ দেহো বৌ আমি তোমারে রাম্মির দেহা শুনা করতে কমু না। কারন কেউই আরেক জনের সন্তানরে নিজের সন্তার মানতে পারে না। তুমি রাম্মিরে ভালোবাসতে না পারলেও অর লগে খারাপ ব্যবহার কইরো না। কারন মা মরা পোলা। ও তো তোমারেই অর মা মানবে। তুমি যদি অরে পোলা মানতে নাও পারো তাইলেও একটু সহানুভুতি দেখাইও। বাকিটা তোমার ইচ্ছা। আরকেটা কতা আমি এহোনো মুক্তিকে ভুলতে পারি নাই। তোমার লগে বিবাহিত জীবন শুরু করোনের আগে আমার কয়দিন সময় লাগবে।
নাজমাঃ আইচ্ছা কিন্তু আমি যদি আপনের কাছে আইজ কিছু চাই দেবেন?
রাজা মিয়াঃ আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে দিমু।
নাজমাঃ আইজ থেইকা আমি রাম্মির মা হইয়া থাকতে চাই। আপনার বৌ হিসাবে আপনি তহন অধিকার দিয়েন যহন আমারে ভালোবাসতে পারবেন। হের আগে আমি রাম্মির মা হইয়া থাকতে চাই। আইজ হইতে রাম্মি আমার পোলা। কোন দিন রাম্মিরে আপনে কইবেন না যে আমি রাম্মির আপন মা না। কতা দেন আমারে। নাজমা কথা শুনে রাজা মিয়ার বুক ভরে গেলো। খুশিতে চোখের কোনেড় অসজ্র জল এসে ভির করলো। চোখের জল মুছে বললো—-
রাজা মিয়াঃ ঠিক আছে বৌ। কতা দিলাম।
শুরু হলো নাজমার নতুন পথ চলা রাম্মিকে মানুষ করার। নাজমা সত্যিই সৎ মায়ের থেকে সৎ নামটা মুছে দিলো। রাম্মিকে সে নিজের ছেলের মতই মানুষ করতে লাগলো। রাম্মির প্রতি নাজমার নিখাদ ভালোবাসা দেখে রাজা মিয়াও তাকে ভালোবেসে ফেললো। নাজমা ধীরে ধীরে পরিবারের সবার মনে জায়গা করে নিলো। নাজমা সবসময় মুক্তিকে নিয়ে সম্মান সহকারে কথা বলতো। রাম্মির বয়স যখন পাঁচ বছর তখন রাম্মি মুক্তির সাদাকালো ছবিটা নাজমাকে দেখিয়ে বললো
রাম্মিঃ মা এইডা কার ছবি?
নাজমাঃ বাবা এইডা তোমার বড় মায়ের ছবি। সবসময় ওনারে সম্মান করবা। ওনার কারনেই তোমারে পাইছি। ওনি খুব ভালা মানুষ ছিলেন।
রাম্মিঃ ওনি আমার বড় মা হইলেও তুমি আমার মা। আমার মা! খুশির অশ্রু মুছতে মুছতে নাজমা বলে
নাজমাঃ কত জন্মের পুন্য মিলাইয়া তোর মত পোলার মা অইছি তা কেবল আল্লাহ মাআবুত জানে। মুক্তি বুবুজানরে যদি পাইতাম তার একটা সালাম করতাম তারপর তাকে জড়াইয়া ধইরা কইতাম বুবুজান তোমার লইগা আইজ আমি এমন সোনার সংসার পাইছি। আল্লাহ তুমি মুক্তি বুবুজানরে বেহেশত নসীব কইরো। আল্লাহ তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া যে তুমি আমারে এমন স্বামী সন্তান আর সংসার দিছো।
রাজা মিয়াঃ হাচা কইছো বৌ। সারা জীবন শুকরিয়া আদায় করলেও তার ঋন শোধ অইবো না। বৌ তোমার কাছে আইজ আমি একটা জিনিস চামু দিবা?
নাজমাঃ কন! আমার সব কিছুতো আপনেরই।
রাজা মিয়াঃ আমি অহন পোলার বাপের লগে লগে মাইয়ার বাপও অইবার চাই।
নাজমাঃ কি যে কন। সরম লজ্জা সব পান্তা ভাত দিয়া খাইছেন নাহি! পোলার সামনে কিসব কন। আমার তো এহন একটাই আশা! রাজা মিয়াঃ কি বৌ?
নাজমাঃ আমার রাম্মি বাবা বড় অইয়া বড় ডাক্তার অইবো কবে! মানুষের সেবা করবো। আর যেনো কোন মা মুক্তি বুবুজানের মত অকালে না মরে তার ব্যবস্থা করবো। অবশেষে কিছু পূর্ন অপূর্ন ছোট ছোট স্বপ্ন দিয়ে তৈরী হলো কিছু গ্রাম্য পরিবারের গ্রাম্য স্বপ্ন। রাম্মি কখনো মায়ের অভাব বুঝতে পারেনি। নাজমা ওকে নিজের সাত রাজার ধন মানিকের মত লাগলে রেখেছে। সুখে চলছে ওদের সংসার। পূরন হচ্ছে ওদের গ্রাম্য স্বপ্ন।