ইসমত আরাকে দেখে চিনতে পারছিলাম না। তিন বছরে একী হাল হয়েছে শরীরের! তিন বছর আগে যখন সে কাজের উদ্দেশ্যে লেবানন যায় তখনও বেশ রূপবতী এবং স্বাস্থবতী মেয়ে ছিল সে। অথচ এখন তার অবস্থা এমন হয়েছে যে চেনা-ই যায়না। চেহারা দেখে আমিও তো প্রথমে চিনতে পারি নি। বিমান বন্দরে একটা ট্রলি ঠেলে ঠেলে যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল আমি ভাবলাম কে না কে! আমি এক দিকে সরে গিয়ে তার যাবার রাস্তা করে দিলাম। তারপর সে যখন ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল এবং কাঁদতে শুরু করল তখন কান্নার শব্দ শুনে আমি ভাল করে তাকাই তার দিকে এবং চিনতে পারি যে এতো আমাদেরই ইসমত আরা।
মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বিধবা হয় মেয়েটি। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ঢাকায় দু’টি পোষাক কারখানায় চাকরী করত। দু’জনেই ছিল এসএসসি পাশ । তাই তুলনামূলক ভাল কাজই তারা করতো পোষাক কারখানায়। আশুলিায়ায় স্বামীটির কারখানার ভয়াবহ আগুন তার স্বামীটিকে কেড়ে নিয়ে তাকে বানায় অকাল বিধবা। আর তার পাঁচ আর তিন বছর বয়সের ছেলে দু’টিকে বানায় অকালে পিতৃহারা।
প্রেমের বিয়ে ছিল তাদের। প্রেমের টানে পালিয়ে ঢাকায় এসে বিয়ে করেছিল। স্বামীকে হারানোর পর ইসমত আরার আর শহরে কাজে মন বসেনি। ফিরে আসে গ্রামে। গ্রামে এসে স্বামীর ভিটায় উঠেছিল। তার শ্বশুর শাশুরি বেঁচে নেই। তার এক দেবর আর এক ননদ আছে। ইসমত আরা স্বামীর মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকার এবং বিজিএমইএ’র কাছ থেকে মোট দুই লাখ টাকা পেয়েছে। সেই টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছে ছেলেদের ভবিষ্যতের জন্য। ভাবছে নিজে টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে ছেলেদের নিয়ে বেঁচে থাকবে। ছেলেদের লেখাপড়া শিখাবে।
কিন্তু তার দেবর আর ননদ ঝামেলা শুরু করে দিল। তারা বলছে- ‘ইসমত আরা পরের মেয়ে। যেকেনো সময় বিয়ে বসে চলে যাবে আরেক বেটার ঘরে।’ তাই তাদের কথা হল তারা-ই বাচ্চা দু’টির প্রকৃত অভিভাবক। আর সেই সুবাদে তাদের দাবী হল ভাইয়ের ক্ষতিপূরণের টাকা তাদের জিম্মায় দিতে হবে। তারা ভাইয়ের ছেলেদের দেখেশুনে রাখবে। মানুষ করবে।
ইসমত আরা ভাল করেই চিনে তার দেবর আর ননদকে। তাদের চোখ পড়েছে ঐ দুইলাখ টাকার ওপর। সে দুই সন্তানকে নিয়ে চলে আসে বাবার ভিটায়। বৃদ্ধা মা আছে তার আর আছে ভাই ও ভাবী। ভাই-ভাবী দুজনই তাকে বেশ ভালভাবেই গ্রহণ করল। এমনকি ভাই নিজের টাকায় তাকে একটা সেলাই মেশিনও কিনে দিল।
এরই মধ্য এক সময় বড় ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় ইসমত আরা। আর নিজে ঘরে থেকেই সেলাইয়ের কাজ করে আয় রোজগার যা হচ্ছিল তাতে দিন চলে যাচ্ছিল একরকমে। ইসমত আরার চোখে মুখে একটাই কেবল স্বপ্ন খেলা করে, তার ছেলে দু’টোকে লেখাপড়া শিখাবে। অনেক বড় হবে তারা। তাদের বাবার স্বপ্নগুলো পূরণ করবে একদিন।
ভালই চলছিল ইসমত আরার জীবন যতদিন না আদম ব্যাবসার দালাল শরীফ মিয়ার সাথে তার সাক্ষাৎ হয় :
‘গার্মেন্ট ভিসা। পঁচিশ হাজার টাকা বেতন তার উপর বোনাস তো আছেই। পাঁচটা মাত্র ভিসা পাইছি। প্যাসেঞ্জার যাইতে চায় কম হলেও পাঁচ পাঁচে পঁচিশ জন। দুই লাখ চাইলও রাজী। কিন্তু আমি শরিফ মিয়া টাকার গোলাম না। মানুষের উপকার করতে পারলে আমি যে সুখ পাই সেই সুখ টাকায় পাই না। তাই আপনার উপকার করতে চাই। ছেলে দুইটার ভবিষ্যৎ তো আপনাকেই চিন্তা করতে হবে। ঘরে বসে মেশিন চালিয়ে পারবেন ছেলেদের উচ্চ শিক্ষিত করতে? দেখেন চিন্তা করে। আপনি গেলে আমি দেড় লাখেই ছাইড়া দিমু ভিসা। আমার লাভের দরকার নাই’ – এভাবে ইসমাত আরাকে নানা কথা বোঝায় শরিফ মিয়া।
ইসমত তখন আমার কাছে এসেছিল পরামর্শের জন্য। সব কিছু বিস্তারিত জানিয়ে বলল-‘ আজিম ভাই আপনি শিক্ষিত মানুষ। কলেজে পড়ান। আপনি ভাল বুঝবেন। কী করি বলেন তো?’
আমি না করেছিলাম তাকে। আমার না শোনে হঠাৎই তার চোখমুখ কেমন কঠিন হয়ে গেল। বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠেই বলতে লাগল,
‘আজিম ভাই আমার কথা ভেবে ভেবে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন। আমি কোনো দিনই আপনার হব না। আপনি আমার চাচাত ভাই। আমি আপনাকে ভাইয়ের মতই দেখি। তাছাড়া আমি তো আপনার যোগ্যও নই। আপনি আপনার উযুক্ত কাউকে বিয়ে করে ঘরে আনেন। চাচির মনে কতো কষ্ট আপনার জন্য।’
একটানা কথাগুলো বলে দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় সে। আমি তার ভালর জন্যই কথাগুলো বলেছিলাম। কিন্তু সে বুঝল না। কোন মরীচিকার মোহে সে এখন অন্ধ। কারও কথাই সে এখন শুনবে না। আমার কেবলই জীবনানন্দ দাশের মরীচিকার পিছে কবিতাটি মনে পড়তে লাগল তখন:
“ধূম্র তপ্ত আঁধির কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে
সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে
ছুটে যায় দুটি আঁখি!
-কত দূর হায় বাকি!
উধাও অশ্ব বল্গাবিহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে
পথে পথে তার বাধা জমে যায়-তবু সে আসে না ফিরে!”
শেষ পর্যন্ত দুই লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের এক লাখ ক্যাশ করে আর বাকী পঞ্চাশ হাজার ধার দেনা করে পাড়ি জমায় স্বপ্নের লেবাননে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে স্বপ্নভঙ্গ হল। পোষাক কারখানার পরিবর্তে দেখা গেল বাসা-বাড়ির চাকরানীর কাজ করতে হবে তাকে তা-ও বলতে গেলে পেটে ভাতে। ফেরার কোনো পথ নেই। কারণ গৃহ কর্তা টাকার বিনিময়ে তাকে সংগ্রহ করেছে। তাই তাকে বাধ্য করল চাকরানীর কাজ করতে এমনকি যৌন নির্যাতন পর্যন্ত চলত অহরহ।
এক সময় ইসমত আরার পরিবার- মা,ভাই-ভাবী জানল বিষয়টি। কিন্তু মানসম্মানের ভয়ে কাউকে বলল না কিছু। কোনো একদিন দুঃসময় শেষ হবে সেই আশায় দিন গুণতে থাকল অসহায় এই পরিবারটি।
লেবাননের সেই গৃহকর্তার অগোচরে পরিবারের দয়ালু কেউ কেউ লুকিয়ে তাকে দেশে ফোন করতে দিত। তো একদিন সেই ফোন করার সময় ইসমতের মনে হল আমার কথা। আমাকে ফোন দিয়ে জানাল সব। ক্ন্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলল, ‘আজিম ভাই আমাকে এখান থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন।’
শুরু করলাম দৌড়ঝাঁপ। আমার এক ক্লাশমেটের বাবা ফরেন মিনিষ্ট্রিতে যগ্নসচিব। ধরলাম তাঁকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক স্যার বিখ্যাত এক মানবাধিকার সংগঠনের সাথে জড়িত। তার অতি প্রিয় ছাত্র আমি। ধরলাম স্যারকে।
এই কদিন নানা জায়গায় ঘুরে আর ইন্টারনেট ঘেটে আমি বেশ কিছু তথ্য পেলাম। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিকের দেশ লেবান। যেখানে কর্মরত প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি নারীদের ৬০ হাজারই গৃহপরিচারিকা। বাংলাদেশি ও নেপালি নারীকর্মীদের উপর অতি সাম্প্রতিক বিশেষ জরিপ অনুযায়ী, ৮২ শতাংশ নারীকর্মীকে তাদের মতের বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। প্রতিদিন ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন ৬২ শতাংশ নারী। এক মাস বা বেশি সময়ের জন্য বেতন আটকে রাখা হয় ৫৪ শতাংশ নারী শ্রমিকের। কখনও একা বাইরে যেতে দেওয়া হয় না ৯০ শতাংশকে। আর সাপ্তাহিক ছুটির অধিকার থেকে বঞ্চিত ৯১ শতাংশ নারী।
জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বাইরে থেকে তালাবদ্ধ রেখে কাজ করতে বাধ্য করা হয় ৫০ শতাংশ নারী শ্রমিককে। রান্নাঘরে ঘুমান ১৯ শতাংশ, ব্যালকনিতে ৭ শতাংশ, বাথরুমের কাছেও ঘুমাতে বাধ্য করা হয় অনেককে। ভালো খাবার খেতে দেওয়া হয় না ৩২ শতাংশকে। মারাত্মক যৌন নিগ্রহের শিকার শতকরা ১০ শতাংশ নারী। বাংলাদেশি নারীকর্মীদের উপর অব্যাহত যৌন নির্যাতনের ব্যাপকতা বিশেষভাবে হাইলাইটেড হয়েছে উক্ত জরিপে।
একটি অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম এমন একটি রিপোর্ট :
‘অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এমন একজন ব্যক্তি লেবাননে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে আছেন যার স্ত্রীর নিজেরই গৃহকর্মী নির্যাতনের মতো অপকর্মের ইতিহাস রয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় লেবানন প্রবাসী দুই লাখ বাংলাদেশি নারীদের সুখ-দুঃখ দেখভালের দায়িত্বে আজ সেই রাষ্ট্রদূতের। গৃহপরিচারিকার স্বার্থ রক্ষায় যিনি নিজের ঘরেই ছিলেন উদাসীন, তিনি কী করে আজ লেবাননে হাজার হাজার স্বদেশী নারীদের কান্না থামাবেন?’
যাই হোক অবশেষে ইসমত আরাসহ মোট সতের জন মেয়েকে লেবানন থেকে উদ্ধার করে আনা হয় স্যারের সেই মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায়। পরারাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ও যথেষ্ট সাহায্য করেছে। যাই হোক বিমান বন্দরে যখন ইসমত আরাকে চিনতে পারলাম এগিয়ে গেলাম তার কাছে। স্বান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলাম। আমি যতই তাকে থামাতে চেষ্টা করি ততই বেশি সে কাঁদে। আমি গ্রাম থেকে একটা মাইক্রো ভাড়া করেই বিমান বন্দরে গিয়েছিলাম। কোনো রকমে তাকে বিমান বন্দর থেকে বের করে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল প্রশস্ত রাস্তা ধরে। ড্রাইভার দেখি আমার প্রিয় একটি গান প্লে করল:
“কি আশায় বাঁধি খেলাঘর
বেদনার বালুচরে
নিয়তি আমার ভাগ্য লয়ে যে
নিশি দিন খেলা করে।।
হায় গো হৃদয় তবুও তোমার
আশা কেন যায় না
যতটুকু যায় কিছু তার পায় না
কিছু তার পায় না
কে জানে কেন যে আমার আকাশ
মেঘে মেঘে শুধু ভরে।।”