চৈত্রের দুপুরের খরতাপ ছড়িয়ে পড়েছে সবর্ত্র। হাইওয়ের পীচ বরাবর তাকালে মনে হবে রাস্তায় জমে রয়েছে পানি। বাজারের প্রতিটি মানুষের গায়ের জামা ঘামে ভিজে গেছে। স্বস্তি পাচ্ছেনা কেউ। তবুও জীবন থেমে থাকেনা, থাকার নয়।
বাজারের এক জায়গায় একটা ছাতার নীচে বসে জুতা সেলাই করে চলেছে ১৫/১৬ বছরের একটা ছেলে। আনিস ওর নাম। একটু আগে ওদের স্কুলের এক স্যার সংবাদ দিয়ে গেছে, ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে ও। রেজাল্ট যে হয়েছে আজ, তা-ও জানতনা আনিস। কাজের মাঝেই ডুবে থাকতে হয় যে ওকে সারাক্ষন।
আনিসের বাবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছেন। ছোট ছোট দুই ভাইবোন ওর। ওরাসহ মাকে নিয়ে থাকে আনিস বস্তির মতো ছোট্ট একটা রুম ভাড়া নিয়ে। অভাবের সংসার ওদের, তবুও পড়ালেখার উপর ওর আজন্ম টান, এটা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারেনা ও। তাই শত কষ্টেও ওটা ছাড়তে পারেনি। বাসায় বিদ্যুৎ নেই, সে সামর্থও নেই ওদের। কেরোসিন কেনার পয়সায়ও টানাটানি, তাই সন্ধার পর রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় চলত ওর পড়াশোনা বেশ কিছুক্ষন।
স্টারমার্কস নিয়ে এসএসসি পাশ করেছে আনিস। শিক্ষকদের পরামর্শে জেলাশহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে ও। ঋণ নিয়ে একটা ভ্যান কিনেছে ও, যা চালিয়ে কলেজে যাতায়াত করে এবং আয়ও হয় তাতে, যে আয়ে সংসার চলে ওদের।
এখানেই পড়ে সঞ্চিতা। প্রচন্ড মেধাবী সে-ও। পাশের উপজেলায় বাড়ী। বাবা-মা কেউ নেই সঞ্চিতার, দরিদ্র খালার কাছে মানুষ। খালার সাথে সেলাইয়ের কাজ করে সঞ্চিতা। কলেজে ভর্তি ও পড়াশুনার খরচ বেড়ে যাওয়ায় দু’একটা টিউশনিও করতে হয় সঞ্চিতাকে।
একই জেলার মেধাবী এবং একই শ্রেণিতে পড়ে বলে পরিচয় হতে দেরী হয়না আনিসের সাথে সঞ্চিতার। কথাবার্তা খুবই কম হয় ওদের। যেদিন হরতাল থাকে, বাস বন্দ্ব থাকে, আনিসই পৌঁছে দেয় সঞ্চিতাকে, ওদের প্রায় দশ কিলোমিটারের মতো দুরের বাসায়।
লজ্জায় নত হয়ে বসে থাকে তখন সঞ্চিতা, কোন কথা বলেনা।
কথা কেন বলছনা সঞ্চিতা?
কী বলব? তুমি কষ্ট করে ভ্যান চালাচ্ছ, আমার খুব খারাপ লাগছে বসে থাকতে।
শব্দ করে হেসে উঠে আনিস, বলে, আমাকে তো এই কাজই করতে হয় সারাদিন। তাছাড়া ফেরার সময়তো আয় হবে আমার।
তাহলে এখন কেউ হাত তুললে উঠিয়ে নিও।
তা নেব, তবে এখন তোমার সাথে পড়াশুনার গল্প করতে করতে যাচ্ছি, এটাও তো উপকারই।
পড় কখন আনিস?
আসলে আমাকে পড়তে হয় কম। কারন ক্লাসে আমি স্যারদের কথাগুলো অত্যন্ত মনযোগ সহকারে শুনি এবং মনে রাখতে চেষ্টা করি।
খোদা তোমাকে স্পেশাল করে সৃষ্টি করেছেন আনিস।
এজন্যই তো মুচিগিরি করেছি আর এখন ভ্যান চালাচ্ছি।
অনার্স মার্কসও তো পেয়েছ, আর্টস্ থেকে এরকম, তা-ও শারিরীক প্রচন্ড শ্রম করার পরও। সত্যি তুমি আশ্চর্য আনিস।
হরতাল-ধর্মঘট থাকায় এর মধ্যে প্রায় ৫/৬দিন আনিসের ভ্যানে করে বাড়ী গেছে সঞ্চিতা। আনিসই ওকে এরকম দিনগুলিতে খুঁজে নিত। একদিন সঞ্চিতা বলে ওকে, কেন আমাকে খুঁজে নাও আনিস এরকম হরতালের দিনগুলিতে?
এটা আসলে আমার দায়িত্ব মনে করি আমি। তুমি অসহায় একটা মেয়ে, বাস বন্দ্ব, কেমনে বাড়ী যাবা! বলে আনিস।
কিছু বলেনা সঞ্চিতা। মনে মনে ভাবে, আনিস কী তবে ভালবাসে ওকে! হাবে-ভাবে তো তা মনে হয়না।
এভাবেই দিন চলতে থাকে ওদের। এইচএসসি পরীক্ষায় দু’জনই ওরা আবার অনার্স মার্কস পায়। এবার উচ্চশিক্ষা নেয়ার পালা।
কী করবে এখন? আনিসই প্রশ্ন করে।
আমার শিক্ষাজীবন বোধহয় আর এগুবেনা আনিস।
অসম্ভব, বলে আনিস। অন্য কোন উপায় যদি না থাকে, আমি তোমাকে পড়াব সঞ্চিতা তুমি নিশ্চিত থাক।
কেন পড়াবে আমাকে? আজ পেতেই হবে উত্তরটা, ভাবে সঞ্চিতা।
হেসে বলে আনিস, কেন, তুমি অতো সিরিয়াস হচ্ছো কেন, মেধাবী তুমি, কমপক্ষে টিউশনি করে হলেও নিজের খরচ চালাতে পারবে, অসুবিধা কোথায়?
না, এসব আমিও জানি, তুমি বলো আমার ব্যপারে তোমার কেন এতো কৌতুহল।
কিছুদিন থেকে আনিস লক্ষ্য করে আসছে সঞ্চিতা ওর উপর কেমন যেন দুর্বল। ক্লাসে হঠাৎ চোখ পড়লে অথবা ভ্যান চালাত চালাতে কোন কারনে পেছন তাকালে দেখতে পেত আনিস, কেমন উদাস মনে তাকিয়ে আছে সঞ্চিতা ওরই দিকে নিবিষ্টমনে। আজ এটার ফয়সালা হয়ে যাওয়া দরকার, ভাবে ও।
বলে, দেখ সঞ্চিতা, আমরা দু’জনেই দরিদ্র পরিবারের। আর দরিদ্রের দারিদ্র থেকে মূক্তির পথ পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া, তাই বলছিলাম—
আমাকে সাহায্য করবে, এইতো! কথা কেড়ে নিয়ে বলে সঞ্চিতা।
হা, তাইতো।
আর কী কিছুই না? সরাসরিই বলি, তুমি কী আমাকে ভালবাসনা?
দেখ সঞ্চিতা, তুমি যে ভালবাসার কথা বলছ, সেটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। খুবই সুন্দর একটা মেয়ে তুমি, কোনদিক দিয়ে তোমার কোন কমতি নেই।
তবে!
আসলে আমি দেশের কাছে দায়বদ্ধ। দেশের জন্য আমাকে কিছু করতে হবে।
জানি আনিস, দেশ আমাদেরকে দিয়েছে খুবই কম। তবে সেজন্য আমরা এটাও বলতে পারিনা যে, কিসের দেশ! তোমার মতো আমিও এদেশের কাছে আমার ঋণ রয়েছে বলে মনে করি। তবে শুধুমাত্র সেজন্য কাউকে ভালবাসা যাবেনা, আমি তা মনে করিনা।
তোমার উপর আমার অগাধ টান আছে সঞ্চিতা। কিন্তু আমি কোন সম্পর্কে জড়াতে চাইনা, যা আমাকে কর্তব্যে অবিচলিত হতে বাধা দিবে।
অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সঞ্চিতার ভেতর থেকে। বলে, জানি এখনও কোন সম্পর্কে জড়াওনি তুমি আনিস। তবে কোনদিন যদি সিদ্ধান্ত পাল্টাও, আমার কাছে না আসা কোরনা। বড় যে ভালবাসি আমি তোমায়।
আর দাঁড়ায়না ও। পিছে ঘুরে হনহন করে চলে যায় আর আনিস চেয়ে চেয়ে দেখে ওর চলে যাওয়া।
এর পাঁচ বছর পর ঘটে দু’টি ঘটনা। রাজশাহী মেডিক্যাল হতে ডাক্তার হয়ে বের হয় সঞ্চিতা আর আনিস ঢোকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। ততোদিনে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স করে ও বিসিএস পরীক্ষায় কোটাবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে এবং একদিন দায়িত্বরত ম্যাজিষ্ট্রেটকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করে জেলে ঢোকে।
জেলখানায় একদিন আগমন ঘটে সঞ্চিতার। পাঁচ বছর পর আবার ওরা মুখোমুখি হয়।
আমার যে তোমাকে ছাড়া আর চলবেনা আনিস।
চমকে ওঠে আনিস। বলে, দেখছনা আমি জেলে আর এরকম জেল আমার ভাগ্যে আরো হবে যে।
কেন, আরো হবে কেন?
দেখ সঞ্চিতা, মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান আমি, যে মুক্তিযোদ্ধা শত্রুর গুলি খেয়েও বুক চিতিয়ে দেশের মানচিত্র রক্ষায় এগিয়ে গেছে, থামেনি। এগিয়ে যেতে যেতে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়েন যিনি। সেই আমি কেমনে থামব বল?
থামতে তোমাকে হবে কেন আনিস? তোমার মতো তুমি এগিয়েই যাবে।
তার পরিণতি কী তুমি জান?
জানি হয় মৃত্যু অথবা সারাজীবনই জেল।
জেনে তবে আজ কেন এসেছ সঞ্চিতা?
তোমাকে আজ আমি আমার একান্তই নিজের করে নিতে এসেছি আনিস।
প্রশ্ন না করে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে আনিস ।
হাঁ, আমি তোমাকে জোর করে হলেও আমার একান্তই নিজের করে নিব আনিস, আজ এবং এখনই। প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি আমি।
না করেনা আনিস, জানে আজ না করে কোন লাভ হবেনা।
সঞ্চিতা আজ অনেক বড় ডাক্তার, মেডিসিনে এমডি করেছে ও। চিকিৎসা করে অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে। গরীবদের কাছে তো কোন পয়সা নেয়ই না, অন্যদের কাছ থেকেও অতি ন্যুনতম, জীবনধারনের জন্য যা না হলেই নয়।
আনিসের আর বের হওয়া হয়না জেল থেকে। সকলের সাথে তার যোগাযোগ বন্দ্ব শুধু স্ত্রী হিসেবে সঞ্চিতা ছাড়া। রাজনীতির কী জাল বুনে চলেছেন জেলে বসে তা শুধু তিনিই জানেন, আর কাউকে জানতে দেয়া হয়না।
দীর্ঘসময় ধরে তিনি জেলে আছেন, নিউটনের থার্ড ল মতে এটারও যে প্রতিক্রিয়া আছে একটা।