তিশার সপ্ন

তিশার সপ্ন

পদ্মফুল চিনেন? খুবই পবিত্র একটা ফুল। জানেন তো ওই ফুলটার জন্ম নোংরা জায়গাতেই হয়।। দুইবছর আগে একটা মেয়েকে পড়াতাম।ছোট মেয়ে,  ক্লাস ফাইবে পড়ত। মাসিক ২০০ টাকা বেতনে পড়াতাম। তাও ঠিকমত পেইড করতনা। এতটাই গরীব ছিল ওরা। মেয়েটার নাম তিশা। আমাদের পাড়াতেই থাকত। একদিন আমি সকাল ১০টা নাগাদ কেরাম নিয়ে বসেছিলাম। এমন সময় তিশা ও তার মায়ের আগমন।তিশা দূর থেকে আঙ্গুল তাক করে তার মাকে বলল ঐ যে সেতৃু দা। তাড়াতাড়ি যাও, গিয়ে বল। তারপর ওর মা আমার কাছে এসে একটু ইতস্ততভাবে বলল আমার তিশাকে একটু পড়াও না বাবা। পাঁচশ টাকার নিচে কেউ পড়াতে চাইছেনা। আমরা গরীব মানুষ মাসে মাসে এতটাকা কোথায় পাব।

তিশার বাবা একটা দুইবছর ধরে বিছানায় পড়ে আছে। দিনে দেড়শ টাকার ওষুধ লাগে তেনার জন্য। তুমি যেকোনসময় আমার মেয়েটাকে একটু পড়াও। আমার সাধ্যমত আমি তোমাকে টাকা দিব। না। আমার সময় নেই। আমি সরাসরি তিশার মায়ের মুখের উপর কথাটা বলে দিলাম। কারন টাকা ছাড়া আবার কিসের পড়া। আমার কাছে সময়ের একটা দাম আছে। তোমরা যদি এমন কর আমাদের মত গরীব মানুষের ছেলেমেয়েগুলা যাবে কোথায়। কাল রাতে তিশা আমাকে কেঁদে কেঁদে বলছিল ওর ক্লাসের সবাই স্যার ধরে ফেলছে তাই আজ তোমার দুয়ারে আসলাম। ফিরিয়ে দিওনা বাবা। আমার মেয়েটা যে পড়তে চাই।

তৃষার মায়ের চোখে জল দেখে আমার কেমন জানি একটু মায়া হল। গরীব মানুষ। ঠিকমত দুবেলা খেতে পারেনা। বললাম- ঠিক আছে। বিকালে অন্তরদের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েন। তৃষার মা তার বিবর্ণ -মলাট শাড়ির আচলে চোখে মুছতে মুছতে বলল আমার মাথায় যে পরিমান চুল আছে সে পরিমান তোমার হায়াত হোক। আর্শিবাদ করছি জীবনে আরো বড় হও। তিশা সামান্য দূরেই দাড়িয়েছিল। ওর মা কাছাকাছি যেতেই ছোট গলায় বলল মা,  সেতু দা আমাকে পড়াবে বলছে তো? তিশার মা মুখে কিছু না বলে শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাকাল। ওরা দুজনেই প্রচন্ড খুশি হয়েছে। ঘরে গিয়ে তিশার বাবাকে বললে হয়ত তিনিও খুশিতে আত্মহারা হবেন। আমি আবার কেরাম খেলায় মনোযোগ দিলাম।

বিকালে অন্তরকে দশমিনিটের মত পড়িয়ে ফেলার পর তিশার আগমন। ওর ব্যাগটা যখন টেবিলের উপর রাখল তখন খেয়াল করলাম ব্যাগটা কম করে হলেও দুইবছরের পুরনো। উপরে কলম রাখার পকেটের চেইন নষ্ট, কাঁধের ফিতা ছেড়া তাই গিটু দেয়া। আসা মাত্রই ও বইখাতা সব বের করে নিল। দুইজন একই ক্লাসে, একই স্কুলে পড়ে। তাই আমার জন্য একটু সুবিধাই হল।দুইজনকে একই পড়া লিখতে বললাম।ছট করে লিখে ফেলল তিশা। ওদিকে অন্তর তখন কলম ঘষতে ব্যস্ত।একেবারে নির্ভুল লেখা তার। সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম মেয়েটা মেধাবী। “গোবরে ফোটা পদ্মফুল”

তিশার গায়ের রং ফর্সা। তবে সঠিক যত্নের অভাবে সেটা ঈষৎ মলাটে হয়েছে। ওর মুখ থেকে শুরু করে হাত-পা সবখানে ফেটে গেছে। শীতকালে এমনটা হয় যদি ক্রীম কিংবা লোশন গায়ে না মাখা হয়। শীতকালটা যেন তাদের কাছে যমের কাল। ঘরে ভালো মোটা কম্বল আছে কিনা কে জানে। থাকলে হয়ত ওটাতে চারজন গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে। কোনরকমে রাত কাত করে। এতকিছু ভাবছি কারন দ্বিতীয়দিন তিশা যে সোয়েটার গায়ে দিয়ে এসেছিল ওটা পাতলা, ময়লায় ভর্তি। দেখে মনে হবে কেউ কয়েকশীত পার করে তারপর তাকে পড়তে দিয়েছে। তবুও তিশা কোনরকম অাক্ষেপ ছাড়াই খুশিমনে গায়ে দিচ্ছে।

তিন বোনের মধ্যে তিশা সবচেয়ে বড়।বাকি দুবোন এখনো ছোট। রাস্তা দিয়ে আলতো আলতো কথা বলে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায় ওদেরকে।একমাস হয়ে গেল। পরবর্তী মাসের সতেরো তারিখের দিকে তিশার মা এসে আমার হাতে দুইটা একশ টাকার নোট গুজে দিল। ভেবেছিলাম তিনশ টাকা তো অন্তত দিবে। যাইহোক এটা নিয়ে আমার মনে তেমন সংকোচ নেই। কারন তিশা প্রচন্ড পরিমানে ভালো মেয়ে ছিল। প্রতিদিনের হোমওয়ার্ক করে আনত।রেগুলার স্কুলে যেত। ওইটুকু বয়সে ও খুবই সিনসিয়ার ছিল।ওর মত স্টুডেন্ট আমার জীবনে দুইটা পাইনি। আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম ওর প্রতি। কয়েকমাস পর তিশাদের পরিবারে কালো ছায়া নেমে আসল। একরাতে ওর বাবা ঘুমের ঘোরে মারা গেল। খবরটা শুনার পর আমি নিজেও ব্যাকুলিত হলাম। কিন্তু এটা হওয়ার ছিল।

পাড়ার কয়েকজন লোক মিলে কানাঘুষা করতে শুনছিলাম শেষের দিকে তিশার বাবার শরীরে নাকি ক্যান্সার প্রবেশ করেছিল। চাইলে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা যেত।টাকার অভাবে ভালো ডাক্তারের কাছে চেকআপ করানো হয় নি বলে মারা গিয়েছে। আমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম তিশা ও তার মায়ের বিলাপ কান্না। তিশার বাকি দুইবোন বাবার পাশে বসে মায়ের কান্না দেখছে। তারা বুঝতে পারছেনা তাদের বাবার কি হয়েছে। তারা মনে করছে প্রতিদিনের মতই তাদের বাবা ঘুমিয়েছে। একটা পরিবারে পুরুষেরা হল বটগাছের মত। তারা সর্বদা পরিবারকে সুরক্ষা দেয়। যখন সেই পুরুষ বটগাছটাই কোন পরিবার থেকে চলে যায় তখন সে পরিবারে দুঃখ- দুর্দশার আর সীমা থাকেনা। তিশাদের সাথেও ঠিক এমনটাই হয়েছে।তিশার বাবা মারা যাওয়ার পর মাস দুয়েক পাড়ার লোকজন টাকা তুলে দিয়েছিল।কেউ চাল দিয়েছিল, কেউ ডাল দিয়েছিল,  কেউ ময়দা দিয়েছিল।

এরপর থেকে আর তেমন খোঁজ নেয় না কেউ। চাল ডাল কেনার টাকা নেই। সমীর দোকানি বাকিতে চাল দিতে চাইনা আর। কারন তার হিসেবে অনেক টাকার জের হয়েছে। বাকিতে তো আর দোকান চলে না। ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েকে রেখে কোথাও যেতেও পারেনা তিশার মা। আগে তিশার বাবা ছিল বলে মেয়েদুটোকে বাবার কাছে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে চলে যেতেন তিশার মা। এখন কার কাছে রেখে যাবে ওই দুটো ছোট ছোট বাচ্চাকে। ঘরের পিছনেই বিরাট বড় পুকুর। কখন ওই পুকুরে নেমে যাবে তার ঠিক নেই। তিশাও ঘরে থাকেনা। সকালে স্কুলে যায় চারটায় ঘরে ফিরে।তিশার মায়ের চিন্তার শেষ থাকেনা। তার ইচ্ছে হয় ঘর সংসার সব ছেড়ে দূরে কোথায় চলে যেতে। বিষ ফাঁস খেয়ে তিশার বাবার কাছে পৌঁছাতে। কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে চেয়ে তার সেই ইচ্ছেটা ভাঙ্গা কাচের মত টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

তারপর একদিন তিশার মা আমার রুমে এল। আমি তখন শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছিলাম। ওনাকে দেখে বললাম কাকি বসেন। বাবা আমার মেয়েটা তোমাকে ঠিকমত পড়া দিতে পারছে তো? আসলে কদিন ধরে ওকে নিয়ে একদম বসতে পারছিনা। এমনিতে ও সারাক্ষণ বই নিয়েই পড়ে থাকে। তিশা প্রতিদিন পড়া দিতে পারে আমাকে। আপনি শুধু ওর দিকে একটু নজর রাখবেন। ঠিকমত খাচ্ছে কিনা। ঘুমুচ্ছে কিনা। আসলে ওদের পরীক্ষার বাকি আর মাত্র বিশ দিন। এরমধ্যে যদি কোনকারনে অসুস্হ হয়ে পড়ে তাহলে সমস্যা। আচ্ছা বাবা আমি দেখব।

এরপর তিশার মা আর কিছু না বলে শাড়ির আচলের গিটু থেকে কিছু একটা বের করতে লাগল। টাকাই হবে হয়ত। তারপর টাকাটা আমার হাতে গুজে দিতে দিতে বলল এটা রাখ বাবা। সময়মত তোমার টাকা দিতে পারিনা বলে মন খারাপ করোনা বাবা। বুঝোই তো আমাদের অবস্হা। চারটা একশ টাকার নোট। গত তিনমাস পড়িয়ে চারশ টাকা দিল।জানিনা সে টাকাটা কোথা থেকে ধার করে এনেছে। নাকি দিনরাত রনজিত বাবুর ঘরে গাধার মত খেটে আয় করছে। বললাম কাকি টাকাটা আপনি রাখেন। আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে। আপনি টাকাটা দিয়ে একমাস তিশার জন্য গরুর দুধ রোজ নেন। সেটাই ভালো হবে। দুইশ টাকা হলেও নিজের কাছে রাখ বাবা। না কাকি আমার লাগবেনা। তারপর তিশার মা খুশিমনে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।

পরদিন পড়ানোর সময় তিশাকে জিজ্ঞেস করলাম- তোর সপ্ন কি তিশা?  পড়ালেখা করে কি হতে চাস? দাদা,  আমার পাইলট হওয়ার সপ্ন আছে। পাইলট কারা বল তো? যার আকাশে বিমান পরিচালনা তাদেরকে পাইলট বলে। তোর পাইলট হওয়ার সপ্ন একদিন পূরন হবে। শুধু মন দিয়ে পড়ে যা। ঠিক আছে? ঠিক আছে দাদা। আস্তে আস্তে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এল।আমি প্রথমদিন গিয়েছিলাম তিশা আর অন্তরকে নিয়ে সেন্টার চিনিয়ে দিতে।এরপর অার যাইনি। তিশার মা সেন্টারে যেত না। অন্তরের মায়ের সাথে সে যেত আর আসত। দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। একমাস পর রেজাল্টের দিন আমি তখন প্যান্ট-শার্ট পড়ে সম্ভবত কোথাও যাচ্ছিলাম। জায়গাটার নাম এখন ঠিক মনে পড়ছেনা। হঠাৎ রুমে তিশার আগমন। কিছু বুঝে উঠার আগেই ও আমার পা ছুঁয়ে সালাম করল।বললাম- পাস করছিস? শুধু পাস করিনি দাদা। গোল্ডেন এ প্লাস পাইছি আমি। দেখলাম দরজার কিনারে দাঁড়িয়ে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে তিশার মা। বললাম এটাতো আরো খুশির খবর।মিষ্টি খাওয়া সবাইকে।

তিশা চুপ হয়ে গেল। আমি বুঝেছি ওর চুপ থাকার কারন।পিছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা পাঁচশ টাকার কচকচে নোট বের করে বললাম ধর এটা নে। বাজার থেকে মিস্টি এনে পাড়ার সবাইকে মিস্টি মুখ করা। খেয়াল করলাম তিশার মা ওখানে আর নেই। তিশা প্রথমে টাকাটা নিতে চাইনি।একপ্রকার জোর করে ওর হাতে দিতে হয়েছে টাকাটা।বাইরে দাড়িয়েছিল তিশার মা। তারপর খুশিমনে দুজনেই চলে গেল।বুঝলামনা ওদের খুশি দেখে অামার চোখের কোণে কেন জল জমে গেল।

 সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত