ঠিক গন্ডগ্রাম না হলেও শহরের কাছাকাছি একটি গ্রামে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। বাড়ীর দু’পাশের একপাশ দিয়ে একটি বড় রাস্তা এক উপজেলায় এবং আরেকপাশ দিয়ে একটি সরু রাস্তা শহরের দিকে চলে গেছে। বাকী দু’দিক খোলা, যেখানে শস্য বোনা হয় বিভিন্ন রকমের। কেউ কেউ সবজিও বুনেন। আমার মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে যখন সরষে গাছের হলুদ রংযে ছেয়ে যায় প্রান্তরটি। বড়ই মধুর লাগে তখন। বাড়ীর পাশেই ছিল একটা পুকুর। ছেলেবেলায় বান্ধবীদের নিয়ে নেচে নেচে এই প্রান্তরে এবং পুকুরেই বিচরণ করতাম দিনের অনেকটা সময়। মায়ের মারের কথা যখন মনে পড়ত, তখনই শুধু ক্ষান্ত হতাম।
না, ছাত্রী মোটেই ভাল ছিলামনা আমি, বান্ধবীরাও নয়। একসাথে আমরা স্কুলে যেতাম এবং কিছুটা লোকদেখানো পড়াশুনাও করতাম মায়ের মার এড়ানোর জন্য। এতেই হয়ে যেত,ফেল করিনি কোনদিনই।
বাড়িতেই থাকত বড়বোন, এক স্কুলের শিক্ষিকা, বছর বছর জন্ম দিত সন্তানের আর পালতে হোত আমাকেই। বড়ভাই রাজশাহীতে উচ্চশিক্ষায় রত। খুব ছোটবেলায় অভাগা আমি হারাই প্রানপ্রিয় বাবাকে, যার কিছু স্মৃতি আজও কাঁদায় আমাকে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেন জানি কান্না বেরিয়ে যেত তাঁর মৃত্যুরও অনেক বছর পর পর্যন্ত।
গ্রামের মতো শহর অথবা শহরের মতো গ্রাম, যেটাই বলি না কেন, স্বপ্ন কিন্তু দেখতাম অনেক উঁচু আমি। আমি স্বপ্ন দেখতাম একজন ভাল মানুষের সাথে নাটকীয়ভাবে আমার সম্পর্ক হবে।
ছেলেটা আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু হাসান । ছুটিতে ভাইয়া যখন বাড়ী আসতো, অনেক গল্প করতো তার । একটু না-কি পাগলাটে ধরনের । একদিনের গল্প এরকম – ইলিশ মাছ রান্না করেছিল দুপুরে হাসান । রান্নাতো নয়, বেশী করে পানি দিয়ে ঝোল করা পানসে রান্না । কিছুটা রেখে দিয়েছিল রাতে খাবে বলে । কি একটা উপলক্ষে যেন ওরা সেদিন বিকেলে শহরে যায়, ভাইয়াও গিয়েছিল । এসে ভাইয়া হাসানের সাময়িক অনুপস্থিতিতে ঝোলের কিছুটা খেয়ে ফেলে । হাসান সেটা জানতে পেরে ছুরি নিয়ে তেড়েছিল ভাইয়াকে ।
মাস্তান না-কি হতে চেয়েছিল হাসান কলেজে । তাই ইচ্ছে দিয়েই কাউকে কাউকে মেরে বসত ও, আবার কাউকে মিছেই মারার ভান করত, মারার জন্য চিৎকার করত, ফাল পাড়তো । এভাবেই কলেজে মাস্তান হিসেবে একটা ভাবমূর্তি তৈরী হয়ে উঠেছিল তার । আবার ডাইনিংযে যেদিন খাসীর মাংসের ব্যবস্থা থাকত, সেদিন হাসানের জন্য চর্বির বাটি রাখতে হোত অর্থাৎ ওটা না রাখার মতো বুকের পাটা সংশ্লিষ্টদের থাকতোনা ।
কলেজে ভাইয়া জাসদ ছাত্রলীগ করত আর হাসান বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী । চতুর্থ বর্ষে এসে ভাইয়া নেতৃস্থানীয় হয়ে ওঠে । আর হাসান কলেজে ছাত্রমৈত্রীর সুচনা করে বলে সে আহ্বায়ক । রাজশাহীতে তখন বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর প্রভাব বেশী থাকায় এই কলেজে ছাত্রলীগ-জাসদ ছাত্রলীগ বনাম বিএনপির ছাত্রদলের মধ্যকার বিবাদ কখনও সংঘটিত হলে অথবা বিবাদের উপক্রম হলে হাসানের কাছে রিকোয়েস্ট আসত শহর থেকে মৈত্রীর ছেলেদের এনে প্রতিপক্ষকে একটু শায়েস্তা করার অথবা ভয়-ভীতি দেখানোর । শহরের নেতারাও জানতে চাইত, এরকম করলে তাদের রাজনীতির প্রসার কিছুটা হলেও হবে কি-না ? হোক না হোক, হাঁ-সূচক জবাব দিত হাসান ।
গল্প শুনতে শুনতেই কখন যেন ভালবেসে ফেলি আমি হাসানকে প্রচন্ডভাবেই । ভাইয়ার কাছে গল্পগুলি শুনে ওকে নায়কই মনে হতো আমার । একটা সময় মনে হতো, হাসান আর আমার জগত ছাড়া অন্য আর কোন জগত থাকতে পারে নাকি ! পরম করূনাময় খোলা তা’লার নিকট প্রার্থনা করতাম ওকে যেন পাই । মুচকি হেসেছিলেন বোধহয় তিনি তখন ।
ভাইয়ার পাশ করার পর তার চাকরীর সুবাদে ঢাকায় চলে আসি আমরা । হাসান চলে যায় এক উপজেলায় চাকরী নিয়ে । ঢাকাতেই কাংখিত দেখা হয় আমাদের যখন একদিন সে আসে তার চাকরীগত কোন একটা কাজে ঢাকায় । না, আমাকে ভালবাসার কোন চিহ্নই নেই তার চলনে-বলনে । ছোটবোনের মতোই কথাবার্তা । হতাশ হয়ে পড়লাম আমি । মনে হলো দেখা না হলেই ভাল হতো ।
একতরফা প্রেম কতদিনই বা থাকে আর ! আমারও কেটে যেতে সময় লাগলনা । ইতিমধ্যে হাতছানি না এড়াতে পেরে একজনের সাথে জড়িয়ে পড়ি । সজিব নামের ছেলেটাকে দেখে সজিবই লাগত, মনে হতো অনেক পোড়খাওয়া ছেলে ও, দুনিয়াদারি সম্পর্কে অনেক জ্ঞান-গরিমা রাখে ছেলেটা । কলেজে যাওয়ার পথে প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত ওকে । বুঝে গিয়েছিলাম তা শুধুমাত্র আমারই জন্য । আমিও দেখতাম তাকিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে । সম্পর্ক হওয়ার পর কেন জানি ছেলেটা আমাকে ওর সাথে পালিয়ে যেতে বলত । কিছু বুঝতে পারতামনা পারিবারিকভাবে কেন ও এগোতে চায়না । আমারও নাটকীয়ভাবে বিয়ে করার সাধ, কেমন করে যেন বুঝে গেছিল ও সেটা । সম্পর্ক শুরুর মাত্র ছয়মাসের মধ্যে কাউকে কিছু না বলে একদিন অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাই সজিবের হাত ধরে আমি ।
হাসানের সাথে আবার আমার দেখা দীর্ঘ একুশ বছর পর । ভাইয়াও আমেরিকায় দীর্ঘদিন, কাজেই হাসান চ্যাপ্টার আমার কাছে ক্লোজই হয়ে গেছিল । এলোমেলোভাবে হাটছিলো হাসান রাস্তা দিয়ে সেদিন । দেখতে পেয়ে গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে চলে এসেছি সোজা বাসায় ।
আগের ভঙ্গিটার রেশ তখনও আছে ওর মধ্যে, প্রশ্ন করে সংসার কেমন চলছে তোমার ?
আমি তো সংসার করিনা । আর এসব শুনে আপনি কী করবেন হাসান ভাই ।
কোন প্রশ্ন না করে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে হাসান ।
তাকানোর ভঙ্গিতে রাগ হলো আমার । কিন্তু উত্তর দিতে হবে, তাই দেরী না করে বলি, সজিবের হাত ধরে ঘর ছাড়ার পর দেখি ওর কিছুই নেই, মানে ভগ্ন সংসার ওদের । বাবা তার মাকে ত্যাগ করে, মা-ও আরেকটা বিয়ে করে, সজিবেরও শিক্ষার দৌড় মাত্র ইন্টার । ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়ার কাছ থেকে যৌতুক এনে দেয়ার জন্য চাপ দিত, মারধর করত । অবশেষে একদিন আধাচেতন অবস্থায় নিজেকে আমি নিষিদ্ধ পল্লীতে আবিষ্কার করি আর দীর্ঘ দশটা বছর সেখানেই কাটাতে বাধ্য হই ।
অবাক করা এক আবেশের মধ্য দিয়ে শুনে যায় কথাগুলো হাসান । বলে, আর এখন ?
আমার বড়বোন শুধু জানত আমার এই দুর্ভাগ্যের কথা । একদিন মাস্তান নিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়, হাতে ধরিয়ে দেয় ভাইয়ার দেওয়া এক কোটি টাকা । আরপর তো দেখতেই পাচ্ছেন এই পূনবার্সন কেন্দ্র খুলে বসেছি, এখানে আমার সাবেক সহযাত্রীদের পূনর্বাসন করি আমি সাধ্যমতো ।
কথায় কথা এগিয়ে চলে । হাসানের বউ সরকারী বড় কর্মকর্তা, বছর দুই ওদের মুখ দেখাদেখি, কথাবার্তা সব বন্দ্ব । ওর দেমাকমতো চলতে বাধ্য করত ও হাসানকে । না চলাতে এই অবস্থা ওদের ।
চলমান সংলাপেই বুঝতে পারি হাসানও প্রচন্ডভাবে ভালবাসত আমাকে । আমাকে বলতে ওর সঙ্কোচ হতো, তবে বলতো । কিন্তু সেই সময়ের আগেই আমি অধৈর্য হয়ে ঘটনা ঘটিয়ে ফেলি, যে ঘটনায় একা কেউ নই, আমরা দু’জনই আজ অন্যমানুষ, দু’জনই আজ ছিটকে পড়েছি আমরা জীবনের মূল স্রোতধারা থেকে ।
রাত গভীর হয়, আমাদের কথা ফুরায়না । একসময় প্রস্তাব আসে এক হয়ে যাওয়ার আমাদের । সরাসরিই না করে দেই । হাসান ভাইয়ের উপর আমার প্রচন্ড অভিমান রয়েছিল যে তখনও আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার জন্য ।
আমার প্রানের হাসান ভাই গত হয়েছেন চার বছর হয় । আজকের মতো প্রতিবছর তার মৃত্যুদিবসে এবং হাঁপিয়ে ওঠার দিনগুলিতেও ঢাকা থেকে আমি চলে আসি এই শহরে, বসে থাকি সারাদিন তার কবরের সামনে । আশপাশেই নাস্তা করি, ভাতটাত খাই, আবার আসি আর চেয়ে থাকি হাসান ভাইয়ের কবরের দিকে । মনে হয় হাসান ভাইয়ের অনেক কাছে আছি আমি। একরাশ প্রশান্তি নিয়ে রাতের বাসে ফিরি আবার ঢাকায় ।
যতদিন বেঁচে আছি, এটাই যে আমার সবচেয়ে জরুরী কাজ ততদিন ।