কুয়াশার কারনে দৌলতদিয়া ঘাটে সেদিন প্রচন্ড জ্যাম ছিল। ১০/১২ ঘন্টার আগে ফেরী চলাচল শুরু হবেনা। প্রত্যুষের এই সময়টায় করার কিছু থাকেনা, নাইট জার্নির পর কতক্ষনই আর বসে থাকা যায় বাসে! হাঁটাহাঁটি শুরু করি। দেখি দৌলতদিয়া রেলস্টেশনের উঁচু প্ল্যাটফর্ম। ওটা ধরে কিছুদুর এগোতেই দেখা যায় একটা জটলা। কাছে গিয়ে দেখি এক মহিলার নিথর শরীর পড়ে আছে আর তাঁর শরীর ধরে থেকে কেঁদে চলেছে ৩/৪ বছরের একটা বাচ্চামেয়ে।
শিশুটির পাশে গিয়ে বসি, হাত রাখি ওর মাথায় । ও তাকায় আমার দিকে। আমিও তাকাই। দেখি চোখ দু’টোতে অদ্ভুৎ এক মায়া জড়িয়ে আছে শিশুটির। ওর মা মারা গেছে ভেবে মাথা থেকে হাত সরাইনা আমি। তখনই দেখি, ক্ষীণ কন্ঠে মহিলা বলে ওঠেন, ওকে দেখেন ভাইয়া, আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই। আমি তো আর বাঁচবনা, কে দেখবে ওকে?
বাবা কোথায় ওর?
প্রশ্ন করতেই মাথা এলিয়ে পড়ে ওঁর, অন্য জগতে চলে যান তিনি। সম্ভবত: এই কথাটি বলার জন্যই বেঁচে ছিলেন উনি।
শিশুটির মাথায় হাতরেখে হতভম্ব হয়ে পড়ি আমি। ট্যুর শেষে ঢাকা ফেরার পথে এই অবস্থায় পড়ে মনে যে প্রশ্নটা জাগে, তা হলো, কী করব এখন আমি! ঢাকায় আমার রয়েছে এক মেয়েসহ স্ত্রী। আবার অবলা এই শিশুকে ফেলে কেমন করে আমি এখান থেকে সরি?
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি শিশুটিকে নিয়ে যাব, রাখব আমার সংসারে, আমার মেয়েটার সাথে বড় হবে ও। কোলে তুলে নেই ওকে, বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি শক্ত করে। তনিমা নামে ডাকতে থাকি ওকে আর আমাকে বাবা ডাকতে বলি।
আমার তনিমা বেড়ে উঠতে থাকে। প্রথম দেখাতে আমার স্ত্রী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল, তবে মায়ময় চাহনীর অসহায় এই শিশুটিকে নিজের করে নিতে খুব বেশী সময় নেয়নি ও। ধীরে ধীরে আমাদের মেয়ে সঞ্চিতার সাথেও আর পার্থক্য থাকেনা তনিমার। একই সাথে ওদের খাবার, একই সাথে স্কুল যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, সব একসাথে। হাঁফ ছেড়ে বাচি আমি। সংসারে অশান্তি কার ভাল লাগে!
সঞ্চিতার সাথেও ভাব হয়েছে ওর। ঘাড় ধরাধরি করে চলতে শিখিয়েছি ওদের, যে অভ্যাসের কিছুটা এখনও আছে ওদের।
ব্রেন খুব ভাল শিশুটার, কোন বিষয় একবার বুঝিয়ে দিলে ওর মাথায় যেন ঢুকে যায় সেটা। স্মরনশক্তিও খুব ভাল ওর।
কোনদিন কোন আবদার করেনা মেয়েটা। মাঝে মাঝে অনেকদিন পর পর শুধূ আমার কোল ঘেঁষে এসে আমাকে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে ও। আমি বুঝে ফেলি। নিয়ে যাই ওকে ওর মা মারা যাওয়ার জায়গাটায়। অনেকক্ষন বসে থাকে ও ওখানে এবং একসময় চলে আসি আমরা।
তখন ওর বয়স আট বছর প্রায়। যথারীতি আমাকে জড়িয়ে ধরে একদিন বলে, বাবা, আমার বাবা কোথায়? চোখ ভিজে যায় আমার। বলি ওকে, কেন রে মা, আমি তো তোর বাবা। কেন জানি আমার চোখ ভেজা দেখে চুপ করে যায় ও।
প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকে মেয়েটা। আমি ব্যাথা পাই। ও বোঝে সেটা। বুঝতে পারি আমাকে খুশি করার জন্য আমার সাথে পাকা মেয়ের মতো আচরণ করা শুরু করে ও তখন। চোরাচোখে তা দেখি আমি এবং ধরাও পড়ে যাই অনেক সময়।
এভাবে নিজ সন্তানের মতো বেড়ে ওঠে আমার তনিমা। তনিমা যে আমার মেয়ে। মনেই হয়না যে ওকে আমি কোন একদিন কোথাও থেকে এনেছিলাম।
আমার তনিমা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে যেদিন ম্যাট্রিক পাশ করল, জীবনে সবচেয়ে বেশী আনন্দ আমি পেয়েছি সেদিনটায়। এরপর ইন্টার, তাতেও গোল্ডন জিপিএ-৫। আমার তনিমা এখন বুয়েটে পড়ে, একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবে ও ইনশাল্লাহ।
একদিন ওর বইগুলি ঘাঁটত ঘাঁটতে ওকে লেখা একটা চিঠি নজরে আসে। নীচে নাম লেখা রাজু। বুঝলামনা, চিঠিটা খুললাম।পড়তে থাকি চিঠিটা-
“আপনি জানেন গত আটটি বছর আপনাকে পাবার জন্য আমি চেষ্টা করেছি । দু’চারদিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিন আপনার স্কুল এবং কলেজের পথে আমি দাঁড়িয়ে থেকেছি আপনাকে শুধুমাত্র একনজর দেখার জন্য। আপনি কেন বোঝেননা, আপনার দিকে একটু সময় শুধুমাত্র চেয়ে থাকবার জন্যই আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি।
দুনিয়াতে অনেক মেয়ে আছে এবং রাগ করবেননা, আপনার চাইতে সুন্দরও আছে অনেক। ছেলেদের মধ্যেও আমার চেয়ে অনেকে সুন্দর আছে যেমন। তবে আপনার মধ্যে যে কী আছে, আমি সেটা জানিনা। শুধু জানি আপনাকে ছাড়া আমার চলবেনা। মনে রাখবেন আমি কিন্তু আপনার জন্য সারাজীবনই অপেক্ষা করবো।
আমার মনে হয়না আপনি আমাকে ভালবাসেননা। আমাকে আপনি কোনদিন অবজ্ঞাও করেননি আমি জানি। এতো মনমরা হয়ে থাকেন কেন? কী দুঃখ আপনার?
সাড়া দিচ্ছেননা কেন? আর কতো অপেক্ষা করাবেন আমাকে? এই চিঠি পেয়ে আমার ক্ষতি হওয়া রোধ করতে চাইলে সাড়া দেবেন।
আসলেই আপনাকে আমি ভীষনভাবে ভালবাসি।”
আমার ঈর্ষা হলো, আমার তনিমাকে ও চিনে ফেলেছে! আমার তনিমার আসল রুপ ও ধরে ফেলেছে। তনিমার সন্মতি থাকলে ও আমারই মতো ভাগ্যবান হয়ে যাবে। অনেক বছর আগে কোন একদিন শিশু ওকে বুকে তুলে নিয়ে যে ভাগ্যবান হয়ে আছি আমি। আর একজন তবে এই ভাগ্যবান হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আসার অপেক্ষায়?
আসলেই তো, আমার তনিমা সেই ছোট্টটি নেই যে এখন আর।
কেমন বড় হয়েছে তনিমা, দেখতে ইচ্ছে হলো একদিন।
রাজু কে তনিমা? একদিন খেতে খেতে ওকে জিজ্ঞাসা করি।
বিষম খেয়ে ওঠে ও, কোন কথা বলেনা।
ওর মাকে চোখে বলি, পরে বলব।
সেদিন রাতে আমার শোয়ার ঘরে আসে তনিমা, যে ঘরে শিশু ও পাঁচবছর আমার বুকে-পিঠে-কোলে ঘুমিয়েছে। এই ঘরে নির্দ্দিধায় প্রবেশ করে ও।
বাবা আমি কী করব, তোমার আদেশের অপেক্ষায় কিছু বলিনি ওকে। জানি আমাকে লেখা চিঠিটা পড়েছ।
আমার অনুমতি আছে মা, আমার মনে হয়েছে ছেলেটা খাঁটি।
আমারও বাবা, তবে — ,
জানি, খুলে বল ওকে তোর অতীত।
ভয় করে বাবা।
যদিও জানি, তুই পারবি, তবে আমাকে সাথে রাখতে চাইলে রাখতে পারিস।
সে-ই ভাল হয় বাবা।
পরদিন এক রেষ্টুরেন্টে আমরা দেখা করি রাজুর সাথে।
চোখে আমার অনুমতি নিয়ে তনিমাই প্রথম জিজ্ঞেস করে ওকে, আমার মা পতিতা ছিলেন জানেন?
ঠিক সেভাবে নয়, তবে আমার চুড়ান্ত সন্দেহ তা-ই ছিল।
মানে!
আপনাকে আমি আপনার বাবার সাথে দৌলতদিয়া যেতে দেখেছি, একদিন ফলো করে দেখেছি। মনে করেছি, সবোর্চ্চ এটাই হবে।
তবুও আপনি পেছাননি!
আমি কিছু বলতে যেতেই তনিমা বাধা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রাজুকেই জিজ্ঞেস করে, আমি ওনার ঔরসজাত নই জানেন?
ভয়ের একটা শিহরণ বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া দিয়ে। রাজুও চমকে গিয়েছিল। বলল, এটা জানতামনা, তবে এতে আমার কিছু যায় আসেনা তনিমা। আমি চিনি জানি তোমাকে শুধু। আর তোমার পিতা-মাতার দায় তোমার ওপর বর্তাবে কেন? কারো কোন অপরাধ থাকলে তোমার তো কোন অপরাধ নাই।
স্বস্তি পেলাম। ওকে বলি, চমকালে কেন বাবা? এটা ভেবে কি যে, একেবারেই চালচুলোহীন তনিমা?
ও বলে, না বাবা, চালচুলোহীন হলেই বা কী! আপনাদের অনুমতিসাপেক্ষে ওকে তো আমি আমার অর্ধ্বাঙ্গীনি-ই মনে করি।
আমি রসিকতা করিনা। বলতে পারতাম ওকে যে, আমার তনিমাকে ছিনিয়ে নিলে বাবা তুমি। বলিনা। বরং মুখে প্রশান্তি আর চোখে কিঞ্চিৎ জল নিয়ে প্রস্থান করি।
মেয়েদের একসময় বাবার ঘর ছাড়তেই যে হয় ।