আজ ফাল্গুন ঝরা বসন্ত। উদাস দুপুরে বইছে উত্তাল বাতাস। অনন্ত হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। মাথার উপর প্রকান্ড আমগাছটা ছাতার মতো ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে গাছটির গোড়া থেকে চারদিকে ১০ হাত পর্যন্ত। পানির পিপাসা লেগেছে তার। সেই সকাল থেকে ঘুরতে ঘুরতে চলেছে এসেছে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোয়। মনটা তার কয়েক দিন ধরেই ভীষণ খারাপ। অনুপ্রভা থাকলে এই এই ফাগুন ঝরা বসন্তে কীনা আনন্দের হতো। হাতে হাত ধরে যুগলবন্দী হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো যেত। কিন্তু অনুপ্রভা নেই; ছলনা করে অনন্তকে ফেলে চলে গেছে অন্যের হাত ধরে। বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি অনন্ত। সদ্যমাত্র বিয়ে। সংসারও তেমন বেশিদিন হয়নি। তিনমাস কি তার চেয়েও আরও কম। অনুপ্রভা বেশি থাকতো মা-বাবার কাছেই। শ্বশুর বাড়ি আর কয়দিন থেকেছে সে। শ্বাশুড়ীর খেদমতও তেমন করেনি। রান্না বান্নাতেও কাঁচা। রাঁধতে গেলে ভাত পুড়ে ফেলতো। নুন দিতে ভুলে যেত। তবুও অনন্ত অনুপ্রভার রান্নার প্রশংসার ঢোল পিটিয়েছে। স্ত্রীকে নিয়ে এমন বাহবায় অনেককে হিংসায় ফেলে দিত। কিন্তু প্রসংশার সেই মুহুমুহু বার্তা এখন বিষন্ন বাতাসে বিষাদ করে তুলেছে অনন্তর জীবন।
অনন্ত কবিতা লিখে। ভীষণ ভালো লিখে। অনলাইন ব্লগ, নিউজ পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা তার। গত ফেব্রুয়ারি ১০ তারিখটি ছিলো তার ২৯তম জন্মদিন। জীবন থেকে ২৯টি বসন্ত হারিয়েছে সে। সময় গড়ায়, জীবন পাল্টায়। সময়ের গতিধারায় জীবনের রং,রুপ,আকার-আকৃতির পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন হয় পছন্দ, স্বাদ আর আহলাদের। বয়সের তরীতে দোলা দিয়ে যায় যৌবনের উত্তাল হাওয়া। প্লাবিত হয় যৌন জোয়ার। সেই যৌবনের উত্তপ্ততায় তারুণ্য কবির কবিতাও হয়ে উঠে আবেগী যৌবনের। যে কবিতা পড়লে শরীর-মন কীসের এক মিলনের ডাক আসে। শরীর কামনা করে আরেকটা শরীরের। মন কামনা করে আরেকটা মনের। সেই তরুণ কবিকে পেয়েছিল অনুপ্রভা। যার কবিতাগুলো অনুপ্রভা গভীর রাত পর্যন্ত পড়তো। আর বলতো অনন্ত-তোমার কবিতাগুলো আমার জীবনের কথা বলে দেয়। কঠিন বাস্তবতাকে বিশেষ অভিজ্ঞতায় কবিতায় তুলে ধরতে পার। বাসরের দ্বিতীয় দিনে অনন্ত তাঁর লেখা কবিতা আবৃত্তি করে শোনায় প্রিয়তম স্ত্রী অনুপ্রভাকে। অনুপ্রভা বিমুগ্ধ হয়ে নতজানু হয়ে বলেছিল-অনন্ত তোমার স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই। তোমার পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাতে একটু অধিকার দাও। সেই অনুপ্রভা আজ নেই; চলে গেছে অন্যের হাত ধরে। যার হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল সেও তার পর হলো। সেও গ্রহণ করলো না অনুপ্রভাকে। অনুপ্রভার জীবনে এখন চারপাশ ঘেরা ঘোর অন্ধকারে কারাবাস জীবন। তবুও জানতে ইচ্ছে করে-ও কেমন আছে? হোক সে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এক সম্পর্ক। জীবন থেকে মানুষ হারিয়ে যায়, কিন্তু তার প্রেম-ভালবাসা হারিয়ে যায় না। এটা যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকে। হয়তো অনুপ্রভা এখন অনন্তকে সহ্য করতে না পারে; ভালবাসার মূল্যায়ন করতে না পারে; তাই বলে কি অনন্ত তার ভালবাসার মূল্যায়ন করবো না! আমি তো অনুপ্রভাকে মন থেকে ভালবেসেছি। সার্বক্ষনিক তাকে লালন করে চলেছি। দেহের প্রতিটি রক্তকণিকার শিরা-উপশিরায় তাকে অনুভব করি। তার শরীরের ঘ্রাণ অনুভব করি। রাতের বিছানায় ঘুমাতে গেলে তাকে বিছানায় অনুভব করি, তাকে কি ভুলে যাওয়া এতোই সহজ! স্বার্থ দিয়ে হয়তো শরীর কেনা যায়, কিন্তু মন তো কেনা যায় না। ভালবাসতে মন লাগে। সে মনকি অনপ্রভার আমার প্রতি ছিল? আজ এই উদাস দুপুরে অনুপ্রভাকে ভীষন মিস করছে অনন্ত। একবার ফোন করে জানতে চেয়ে বলবে-“অনুপ্রভা কেমন আছ ? অনুপ্রভা কি তার এই অসহায় সময়ে বিস্মিত হয়ে উত্তরে ‘কে অনন্ত ! (এই টুকুই বলে বাকশক্তি হারাবে)…। ‘হ্যাঁ অনুপ্রভা আমি সেই অভাগা অনন্ত। যাকে তুমি ডিভোর্স লেটার দিয়ে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটিয়েছিলে। কেমন আছ অনুপ্রভা? অনুপ্রভা কি আর উত্তর দিবে? দিবে না জেনে অনন্ত গেয়ে উঠে-
‘নিজেরই ভুলে তুমি দূরে চলে গেলে
অপরাধী করে আমাকে
আমি তো ছিলাম খেলার পুতুল
তোমারই সাজানো নাটকে।
অনুপ্রভা তুমি বুঝলে না
এ বুকে জমানো কত যন্ত্রনা…………..
অনন্ত হাটছে শুকনো পাতার উপর দিয়ে। শুকনো পাতাগুলোও মর্মর শব্দে জীবন-যৌবন হারানোর শোকে মুমুর্ষমান। গাছ থেকে ঝরে পড়ছে হলদে রাঙা পাতাগুলো। ওই হলদে পাতাগুলোরও কষ্ট আছে, অপ্রকাশে আর্তনাতের বিলাপ ঝরাচ্ছে। সময়ের নীলাখেলায় ওরাও মানুষের মতো ঝরে পরে জীবন থেকে। পথভিষ্ট হয় মানুষের। গৃহিনীদের চুলার আগুন জ্বলানোর বস্তু হয়। চিতায়পুড়ানো লাশের মতো দাউদাউ করে জ্বলে শুকনো পাতাগুলো। মৃতজীবনের যেন কোন দাম নেই। কিন্তু প্রয়োজন আছে। মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য জীব। জাতির হাড়-হাড্ডি পর্যন্ত এরা গোগ্রাসে গিলতে পারে। অনন্তর মনটা আজ ভালো নেই। বন্ধু শিহাব তাকে বাসা থেকে নিয়ে না আসলে ঘরের কম্পিউটারেই সময় কাটিয়ে দিত। ফেসবুকে ফিলিপাইনের বন্ধু মারিয়ার সাথে চ্যাটিং-এ কাটিয়ে দিত দিনটা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আনন্দতম জিনিসটি হলো মন ভালো থাকা। সুস্থ্য সুন্দর শরীর ফুরফুরে আমেজের দৃঢ় ভূমিকা রাখে এই মন। সেই মনটাই আজ ভালো নেই অনন্তর। গত জানুয়ারির ৮ তারিখ থেকেই অনন্ত বিরহ ভাইরাস জ্বরে ভুগছে। কত আশা ছিল অনুপ্রভাকে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বানাবে। বাজারে একটা চিকিৎসা কেন্দ্র খুলে দিবে। রোগীরা এসে সেবা নিবে। কখনো কি ধারণা ছিল অনুপ্রভা তাকে ফেলে অন্যের হাত ধরে চলে যাবে? অনিশ্চিত একটা ভবিষ্যত বেছে নিবে সে। অথচ অনুপ্রভার সেই স্কুল জীবনের প্রেমিক বন্ধুর কাছ থেকেও বিচ্ছেদ ঘটলো। অহংকারের একি অধ:পতন। মানুষের কি সাধ্য আছে, সুন্দর সুখ সমৃদ্ধ ভবিষ্যত সে নিজের হাতে তৈরি করে নিতে; যদি সৃষ্টিকর্তা সহায় না হোন! সৃষ্টিকর্তাও কোনদিন অনুপ্রভাকে ক্ষমা করবেন কীনা জানি না। সে তার স্বামীকে ধোঁকা দিয়েছে। প্রতারণা করে অন্যের হাত ধরে চলে গেছে। অথচ তাকে একমুহুর্ত ভুলতে পারে না অনন্ত।
অনন্ত হাটছে ফের বাড়ির দিকে। বাড়িতে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি মা হয়তো অপেক্ষা করছে ছেলের জন্য। ছেলেটা কয়দিনেই কেমন যেন রোগাটে হয়ে গেল। বিচ্ছেদের শোকে কীনা হাল! মায়ের চোখ জুড়ে শোকাতুর সামদ্রিক ঝড়। এই ফাগুন ঝরা বসন্তে ঝরে পরা হলুদ রাঙা পাতার মতো জীবন থেকে অনুপ্রভা নামক ছলনাময়ী নারীও ঝরে পড়েছে অনন্তর। অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে কম্পিউটারে। ফেসবুকে দীর্ঘ সময় নিয়ে বিরহ কিছু স্ট্যাটাস লিখে। বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং করে। মনের দু:খগুলো শেয়ার করে। গুগল থেকে মনের কষ্টের সাথে মিল রাখা দু:খগুলো ইমেজ সার্চিং করে খুজে বের করে। পরে নিজের ওয়াল পোষ্ট কিংবা টাইম লাইনে শেয়ার করে। ফেসবুকটাই যেন এখন ওর প্রিয় প্রেমিকা। টেবিলে খাবার সাজিয়ে মা তার ঘরে শুয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর পর ডেকে বলছে-অনন্ত এসেছিস? আসলে খাবার খেয়ে নিস। মা- পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে আপনজন। এমন আপনজন আর খুজে পাওয়া যাবে না। অনুপ্রভা স্বামীকে ফেলে চলে গেছে চরম স্বার্থপরের মতো কিন্তু মা কি তার সন্তানকে ছেড়ে চলে যাবে? অথচ দুজনই নারী। কিন্তু দুজনের ভিতর কত বিস্তর ফারাক। আজ অনন্তের চোখ বেয়ে ঘুম নেমে আসছে। অনেক রাত। সময়ের কাটায় রাত চারটা। রাতের খাওয়া হয়ে উঠেনি। টেবিলে খেতে বসলেই চোখের আয়নায় ভেসে উঠে স্ত্রী অনুপ্রভার ছবি। হাসিঝরা শব্দ। ভাসমান চোখের পর্দায় এসে হাজির হয় অনুপ্রভা। টেবিলে সাজানো খাবার থালায় বেরে দিচ্ছে সে। মাঝে মাঝেই সে হাজির হয়েছে অনুপ্রভা। আবার হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে যায়। অনন্ত ঘুমানোর আগে কিছুদিনের অভ্যাসগত কারণে একটা বেনসন টেনে নেয়। যদিও সে ধুমপান পছন্দ করে না। প্রতিদিনের মতো এখন সে বেনসনটা ধরাবে। বালিশের লুকানো পেকেটটা বের করে আনে সিগারেট। ধরাতে যাবে; হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেল সিগারেটটা। এরমধ্যে বিদ্যুত চলে গেল। বাইরে শুরু হয়েছে বৈশাখীর মতো ঘূর্ণিপাকের বাতাস। অথচ অনেক রাত।