খুট করে একটা শব্দ হতেই ঘুমভেঙে গেল। আমি মাথা উঁচু করে চোখ মেলে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড এক আঘাতে অস্ফুট আর্তনাদ করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছিল। কাছেই কে যেন খুকখুক করে হেসে উঠল।
বললো, “ভয় পেলি নাকি ? আরে ওটা তো বাতাস ! ওর সঙ্গে বোঝাপড়া করেই তো তোকে সারা জীবন কাটাতে হবে। ভয় কি ? নিজেকে শক্ত কর।”
আমি আবার তাকালাম। কিছুই দেখা যায় না। শুধু উপরের দিকে ছোটছোট আলো। বললাম, “আমার যে সত্যি ভয় করছে! কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।”
“দিবাকর ?”
“ওই সূর্য আর কি ! কেউ বলে রবি, আদিত্য, ভাস্কর, মার্তন্ড – আমি বলি, দিবাকর। ওই যে উপরে আকাশের যেদিকটা একটু ফর্সা দেখাচ্ছে, ওটা পূবদিক। দিবাকর ওদিক দিয়েই আসবে। ওর উল্টো দিক পশ্চিম। আর ওই যে ওদিকে আকাশে একটা উজ্জ্বল আলো দেখতে পাচ্ছিস, ওটা ধ্রুবতারা। ওদিক উত্তর আর তার উল্টো দিক হল দক্ষিণ। নিচে ধরণী, উপরে আকাশ। আকাশের তারাগুলো এখনো আলো দিচ্ছে বটে, তবে দিবাকর আসলে ওদের ছুটি, ওরা চলে যাবে। তোর কোনও ভয় নেই, শুধু নিজেকে শক্ত কর।”
আমি নিজেকে শক্ত করতে করতে মাথা উঁচু করে চারদিক দেখার চেষ্টা করছিলাম। চারদিক থেকে এত আঘাত!
বললাম,”তুমি কে ? আমাকে সাহস দিচ্ছ আর শুধু শক্ত হতে বলছো?”
“আমি ? আমি তোর দিদু। তোকে পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব তো আমার। তোর সামনে ওই যে নদী, তার ওপাশে ধানক্ষেত তারও ওপাশে জনপদ।”
আমি মাথা উঁচু করে নদী দেখার চেষ্টা করলাম। চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে উঠল কি যেন। দিদু বললো,”ওটাই নদীর জল। কুলকুল করে বয়ে চলেছে।” আমি আরও উঁচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। পূব আকাশ একটু যেন ফর্সা হয়ে এসেছে। চারদিক আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। হঠাত্ তীক্ষ্ণ চিত্কার শুনে চমকে উঠলাম! ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে চাইলাম। ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাতর কন্ঠে ডাকলাম, “দিদু!”
“ভয় পাস না, ওটা পাখি বন্ধু, গান শোনাচ্ছে। এখন কত পাখিই গান শোনাবে! তোর বিপদের কোনও কারণ নেই। নিজেকে শক্ত কর!”
আমি কাঁপতে কাঁপতে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। মাথা উঁচু করে আবার চারদিক দেখতে লাগলাম। সত্যি এবার বেশ দেখতে পাচ্ছি। চারদিকে কত কিছু! উপরের তারা গুলো চলে গেছে। পাশ ফিরে তাকালাম, দেখলাম আমারই মত-তবে খুব মোটা একজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।
বললাম, “তুমিই কি দিদু ?”
“হ্যা, তবে দিবাকরের আসার সময় হয়ে গেছে। ওই দেখ!”
আমি তাড়াতাড়ি পুবদিকে তাকালাম। বেশ সাদা হয়ে গেছে আকাশ। হঠাত্ করে আমাকে চমকে দিয়ে শতশত আলোর বর্শা ছুটে এল। দিদু বললো, দেখেছিস কত রঙ! লাল, হলুদ, বেগুনি, কমলা, নীল, সবুজ আর আসমানী। লালের প্রাধান্যটাই বেশি। এই এখনি থালার মতো মস্ত বড় দিবাকর লাল পোশাক পরে দেখা দেবে। তবে লাল বেশিক্ষণ থাকবে না, একটু পরে সোনালী হবে তারপর সাদা। ওই দেখ আলোর খেলা !”
আমি বিস্ময়ে হা করে দেখছিলাম। সত্যিই কত রঙ! কিসের যেন অজানা এক প্রত্যাশায় আমার ভিতরটা ফুলে ফুলে উঠছিল! চারদিক কত উজ্জ্বল! রঙিন বর্শা গুলো কেমন একটার সাথে আরেকটা মিশেমিশে যাচ্ছে! সবগুলো রঙ মিলেমিশে উপরের আকাশটা ছেয়ে যাচ্ছে লালে!
হঠাত্ নদীর দিকে তাকিয়ে দিদু চিত্কার করে উঠল,”ওই যে – মস্ত বড় – ওই যে টকটকে লাল, ওটাই দিবাকর!”
দিবাকর ! আমি মাথা উঁচু করে দেখতে চেষ্টা করছিলাম। দিবাকর তার রঙ দিয়ে দিয়ে সবকিছু রঙিন করে দিছিল। লাল রঙ সোনালী হয়ে গেল। সব কিছু
ছুঁয়ে ছুঁয়ে উপরে উঠতে লাগলো দিবাকর। আমি কেমন যেন উত্কণ্ঠা আর আবেগে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।ছুঁয়ে দিল দিবাকর আমার দেহ! সঙ্গে সঙ্গে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কি যেন উথলে উঠল আমার ভিতরে! আমি ফিসফিসিয়ে গাঢ় কন্ঠে ডাকলাম,”দিদু !”
দিদু হাসলো। বললো, “কি, তোর খিদে পেয়েছে না ? নে, হাত পাত!”
আমি দুহাত পেতে দিলাম। কি আশ্চর্য, খাবার! আমার দুহাতে খাবার! হাত পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে! দিদু বললো,”খা। যতক্ষণ ইচ্ছে, প্রাণ ভরে খেতে থাক। যখন আর ইচ্ছে করবে না, তোর কাছে ওগুলো রেখে দিস, পরে খাবি।”
আমি খেতে লাগলাম। ইস, কত স্বাদ! পৃথিবীটা কত সুন্দর !
আমার দিন কাটতে লাগলো মহা আনন্দে ! ইচ্ছে মতো খাই দাই আর খেলা করি।সেই সঙ্গে চলে জ্ঞানার্জন। যে পাখি বন্ধুদের গান শুনে ভয় পেতাম, এখন তাদের গান ভাল লাগে। ওদের সাথে আমিও গান গাই। বাতাস বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি খেলি। কখনবা চলে দিনভর হুটোপুটি। দিদুর কাছ থেকে কত কিছুই না শিখছি। আমার সবচেয়ে ভাল লাগে, খেতে আর খেলতে। একদিন দিদুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা দিদু, আমি এখানে এলাম কি করে?”
“সে এক কান্ড!”দিদু বললো, “তুই এসেছিলি এক বন্ধুর কোলে চড়ে। তোর থেকে সব ময়লা পরিস্কার করে রাখলো ওই ওখানে। তখনও তুই ঘুমিয়েছিলি। আমি আর আমাদের এই আত্মীয় প্রতিবেশীরা সবাই মিলে তোকে ঢেকে দিলাম। তারপর শুরু হল বৃষ্টি। সে কি বৃষ্টি! তারপর একদিন ঘুম ভাঙল তোর, তুই এলি। আমি সঙ্গে সঙ্গে তোর মা কে খবর পাঠিয়ে দিলাম।”
“মা ! কোথায় আমার মা ? দিদু, আমি মা র কাছে যাবো, মা কে দেখবো !”
“ওরে আমার গাবুয়া সোনা! মা কে তো দেখতে পাবি না। তোর মা বাবা থাকে অনেক দূরে। তবে কথা বলতে পারবি। তোর মনের যত কথা বলে দে, বাতাসের কানে কানে নিমেষে পৌঁছে যাবে।”
আমি ব্যাকুল হয়ে বললাম, মা, মা কোথায় তুমি ? আমি তোমাকে দেখবো, তোমার কাছে যাব!”
“না রে, মাণিক! আমার কাছে আসা যাবে না। আমরা তো চলি না। আমরা যে বৃক্ষ! তুই তোর দিদু কে দেখ, তাহলেই আমাকে দেখতে পাবি। দিদুর কাছ থেকে সবকিছু শিখে নে। আমরা ভালই আছি।”
আমি দিদুর দিকে তাকালাম। আমার মা তাহলে এমনি! বললাম, “আচ্ছা দিদু, আমরা চলি না কেন ?”
“কারণ চলার দরকার নেই। বিধাতা আমাদেরকে এতই ক্ষমতা দিয়েছেন যে আমরা ইচ্ছে করলে ফল আর বীজ ছড়িয়ে সারা দুনিয়াটাই ঢেকে দিতে পারি। কাজেই চলার দরকার কি? বিধাতা আমাদেরকে কত কিছু দিয়েছেন। নিচে ধরণী, উপরে আকাশ আর বায়ুর বিশালতা। আরও দিয়েছেন, দিবাকরের কিরণ, জলদ আর জলধি। আমরা যে সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি! আমাদের জন্যই এই পৃথিবী! এর প্রতিটা জীব বেঁচে আছে আমাদের দয়ায! আমাদের ফুল-ফল, শাখা-পল্লব, রস-ছাল–এমনকি মূল পর্যন্ত প্রতিটা জীবের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য !আমরা না থাকলে সমস্ত পৃথিবীটাই যে মরে যাবে! আমরাই বিধাতার উত্কৃষ্ট সৃষ্টি!”
“উত্কৃষ্ট কি দিদু ?”
“উত্কৃষ্ট অর্থ, সবচেয়ে ভাল।”
“আর সবচেয়ে ভালনা কি ?”
“আমরা ছাড়া সব। এই যে চারদিকে যত জীব জন্তু দেখছিস–সবাই নিকৃষ্ট। তবে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব হচ্ছে ,মানুষ !”
“মানুষ ? তারা কারা? তাদের তো দেখি না ! .”
“দেখবি । তারা থাকে ওই যে দূরে। নদীর ওপারে ওই ক্ষেত খোলা, তারও ওপাশে।তারা মাঝেমাঝে আসে, দস্যুর মতো আসে! ঘাস, লতা পাতা মাড়িয়ে, দুমড়ে, ছিঁড়ে আসে ! তারা আসে ফুল আর ফল নিতে। একটা ফুল নিতে গিয়ে দশটা কুঁড়ি ছিড়ে ফেলে, একটা ফল পাড়তে গিয়ে গণ্ডা গণ্ডা কচিফল ছেঁড়ে, পাতা ছেড়ে , ডালপালা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দেয়! তারা আমাদের কেটে-ছিড়ে-উপড়ে নিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে – আমাদেরই দেওয়া খাদ্যশস্য সিদ্ধ করে খায়। তারা আমাদের দিয়ে গৃহ নির্মাণ করে, গৃহের আসবাবপত্র তৈরি করে, যানবাহন বানায়, আবার যানবাহন চলাচলের জন্য রাস্তার উপর পেতে দেয়। অথচ আমরা তাদের কত না উপকার করি! আমরা তাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন সরবরাহ করি, তাদের ত্যাগ করা ক্ষতিকর কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস শুষে নিয়ে বায়ু পরিশুদ্ধ করে দিই। দিবাকরের কাছ থেকে রঙ নিয়ে ফুল ফল রঙিন করি, তারা তা উপভোগ করে। আমাদের জন্যই জলদ জল ঝরায়, জলধির জল ফুরায় না, জলজীব বেঁচে থাকে। মানুষ তা ভোগ করে। অথচ একমাত্র তারাই আমাদের প্রতি কখনো কৃতজ্ঞতা জানায় না । বরং তারা ধারালো কুঠার বানিয়ে আমাদের শাখা দিয়ে হাতল বানায় আর আমাদেরই কাটতে থাকে। তারা আমাদের শরীরে করাত ঢুকিয়ে কুরে কুরে আমাদের মারে!”
“ইস , কি নিষ্ঠুর! আমরা কি কোনও প্রতিশোধ নিতে জানি না, নাকি পারি না, দিদু ?”
“না রে সোনা, প্রতিশোধ নিতে পারি, কিন্তূ নেই না। অবশ্য কেউ কেউ চেষ্টা করেছে। বিষাক্ত ফল, রস আর কাঁটা দিয়ে মানুষ মেরেছে। কোন কোন মানুষ খেকো গাছ, খেয়েও ফেলেছে। কিন্তূ এই নোংরা কাজের জন্য তাদেরকে দুর্গম আর বিজন স্থানে নির্বাসিত হতে হয়েছে। আমরা যে শ্রেষ্ঠ আর উত্কৃষ্ট জাত ! উত্কৃষ্ট দের আচরণ তো কখনো নিকৃষ্ট হতে পারে না !”
“মানুষ কেন এত নিকৃষ্ট হল, দিদু ?”
“কারণ তাদের লোভ খুব বেশি! তারা চায় ক্ষমতা আর প্রভুত্ব! প্রতিটা মানুষই পৃথিবীর সব সুখ একাই ভোগ করতে চায়! তারা মানুষ না ! মানুষ নামের অমানুষ ! তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কামড়া কামড়ি করে। যুদ্ধ করে ছোট আর দুর্বল দেশকে ধ্বংস করে। তারা জাত আর ধর্মের নামে নিজেদেরকে বিভক্ত করে একজাত আরেক জাতকে এবং এক ধর্মের লোক আরেক ধর্মের লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধ্বংস করে …”
“দাঁড়াও, দাঁড়াও, দিদু, দেশ, জাত, ধর্ম –এসব কি বলছো ? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আমাকে বুঝিয়ে বলো !”
“ও…তা ঠিক, বুঝবি কি করে ! সে এক বিরাট ইতিহাস ! এই যে একটা পৃথিবী –এখানে আমরা বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ মিলে মিশে থাকি, একই বিধাতার উপাসনা করি, তারা তা করে না । মানুষরা পৃথিবীর নানা স্থান নিজের দখলে নেয়ার জন্য বর্ণ, ভাষা, আচার – আচরণ আর ধর্ম অনুযায়ী টুকরো টুকরো করে ভাগ করেছে, আর এক একটা ভাগের নাম দিয়েছে – দেশ। পৃথিবীতে বিভিন্ন বর্ণের মানুষ আছে, আছে তাদের বিভিন্ন ভাষা আর আচরণের মধ্যে পার্থক্য। এই পার্থক্যের কারণে সৃষ্টিকর্তার উপাসনাও তারা বিভিন্ন ভাবে করে। ফলে বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব হয়েছে।”
“সে কি দিদু ! ধর্ম আবার বিভিন্ন হয় কি ভাবে ? সৃষ্টিকর্তা বিধাতা যে একজনই !”
“হ্যাঁ, প্রতি ধর্মই সৃষ্টিকর্তার একত্বতে বিশ্বাসী। কিন্তূ তাদের জীবনচরণের সাথে মিশে যায় -এভাবে উপাসনা করে। কেউ কর্ম দিয়ে, কেউ ভক্তি আর ভালোবাসা দিয়ে, কেউবা বিধাতাকে অনুসন্ধান করে জ্ঞানের আলোয়। ভাষা অনুযায়ী তাঁকে নানান শব্দ দিয়ে ডাকে। এই উপাসনার পদ্ধতি আর সম্বোধনের বিভিন্নতার কারণেই বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। অথচ দেখ, তারা কিন্তূ সবাই একই প্রভুর উপাসনা করে । প্রভুকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকলেই কি তিনি ভিন্ন হয়ে যান ? আমাদেরও তো কত নাম, বৃক্ষ, গাছ, তরু, বিটপি – আমরা তো আলাদা হয়ে যাই নি। আর সৃষ্টিকর্তার ডাকে তাঁর দিকে চলার পথও একটাই হবে, তা কেন ? এই যে কেউ যদি আমার কাছে আসতে চায় তাহলে সবাইকে একই রাস্তা দিয়ে আসতে হবে ,এমন কোনও কথা নেই । আমার চারপাশের ,দশদিকের যেকোনো রাস্তা দিয়েও আসতে পারে। পথ যেটাই হোকনা কেন মূলস্থানে এসে পৌছানোটাই হল আসল। অথচ মানুষ নিজে যে পথে চলে ,সেটাকেই একমাত্র সঠিক ভাবে, অন্য গুলো ভুল। তার পথে যারা চলে তারা সবাই স্ব্ধর্মী আর অন্য সবাই বিধর্মী। আর প্রত্যেক ধর্মের মানুষই বিধর্মীদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে। কিছু কিছু সুবিধাবাদী মানুষ এই ঘৃনাকে উস্কে দেওয়ার ইন্ধন জোগায়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ায়। ফলে সারা পৃথিবীতে আজ ধর্মের নামে মারামারি ..হানাহানি!”
আহা রে ! মানুষ কেন এত খারাপ ! আমার খুব আফসোস হয়। ভাগ্যিস মানুষ হয়ে জন্মাইনি। বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বৃক্ষ হয়ে জন্মাতে পেরে আমি ধন্য!
ধীরে ধীরে আমি হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে বড় হতে লাগলাম। আমার গায়ের রঙ গাঢ় হতে লাগলো। চকচকে সুন্দর শরীর নিয়ে বাতাস বন্ধুদের সাথে গলাগলি করে হাসি, পাখি বন্ধুদের সাথে সুর মিলিয়ে নাচি, গাই । সারা শরীরে আমার পুলক!
একদিন এল দস্যু, মানুষ !তারা চারদিক দলে মলে অবশেষে দিদুর সামনে এসে বললো ,”এই বুড়ো গাব গাছটা রাখার দরকার কি ? এইটা কেটে ফেলো। এই গাছের বিরাট গুড়ি দিয়ে ভাল নৌকা হবে। তাছাড়া আরেকটা ছোট গাছতো রয়েছেই।”তারা কুঠার নামের সেই যন্ত্রটা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে দিদুকে কেটে ফেলল তারপর করাত নামের অস্ত্র শরীরে ঢুকিয়ে কুরে কুরে তক্তা বানাল, তারপর ডালপালা, তক্তা সব গুছিয়ে নিয়ে আশপাশ লণ্ডভন্ড করে দিয়ে চলে গেল। আমি শোকে দু:খে কেঁদেকেঁদে দিন পার করতে লাগলাম। অবশেষে মা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝাল, দিদু বুড়ো হয়ে গিয়েছিল, এমনিতেই একদিন মরে যেত। তখন তার দেহ পচে যেত, পোকায ধরতো। তার চেয়ে এই ই তো ভাল, দিদু ভাল কাজে ব্যবহৃত হবে। তা অবশ্য ঠিক । আমি আস্তে আস্তে শোক সামলে নিলাম।
আমাদের এই নির্জন বনে মাঝে মাঝেই হামলা চালায় অমানুষের দল। নানান পোশাক পরে তারা আসে।তারা নাকি কেউ পুরুষ, কেউ নারী। এই অমানুষের দল বনটাকে তছনছ করতে আসে। ফুল নেয়, ফল নেয়, পাতা আর লাকড়ি কুড়ায়। পাখির বাসা ভাংগে, ডিম নিয়ে যায়, পাখি মারে, ডাল ভাংগে, গাছ উপড়ায় – কী ভয়াবহ!
কথাবার্তা আমার সবার সাথেই হয়। তবে মা র সাথেই বেশি। একদিন মা কে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা মা, আমরা বৃক্ষরা কি শুধুই নারী ? পুরুষ বৃক্ষ নাই ? মানুষরা তো দেখি নারীর সাথে সাথে পুরুষও আছে।”
মা বললো,”আমরা একই সাথে নারী আর পুরুষ। প্রতিটা জীবকেই সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। বৈশিষ্ট্যের তারতম্য অনুযায়ী চেহারা হয় আলাদা। আমাদের এক দেহের মধ্যে উভয় বৈশিষ্ট্য সমান। মানুষের মধ্যেও মাঝেমাঝে দেখা যায়, কোনও নারী হঠাত্ পুরুষ হয়ে গেল, আবার কোনও পুরুষ ক্রমে নারী। সৃষ্টির স্বার্থেই মানুষের নারী পুরুষের মিলন হওয়া দরকার। তবে এমন একদিন আসবে যখন সন্তান জন্মদানের জন্য নারীদের অন্য কোনও পুরুষ প্রয়োজন হবে না। নিজের ভিতরকার পুরুষ সত্তার সঙ্গে নারী সত্তার মিলন ঘটিয়ে, নারী একাই সন্তানের জন্ম দেবে। পুরুষ ছাড়া নারীর সন্তান লাভ … হুম্মম..মানুষের মধ্যে এমন নজির নাই যে, তা না। তবে এখনো পর্যন্ত মানুষের জ্ঞান ও বিজ্ঞান এতটা উন্নত হয় নি, যাতে ব্যাপারটা তারা মেনে নেবে। এই ব্যাপারটাকে তারা ঐশ্বরিক, অলৌকিক ব্যাখ্যা দিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। তবে মানতে একদিন হবেই! এমন একদিন আসবে, যখন পৃথিবীতে একটাও পুরুষ থাকবে না। থাকার প্রয়োজনও হবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থেও তো নারীর প্রাধান্য বর্ণনা করা হয়েছে। কোথাও বলছে, মাযের পদতলে সন্তানের স্বর্গ! অর্থাত্ মা সন্তুষ্ট থাকলেই – মুক্তি! কিয়ামতের দিন সবাই মাযের পরিচয়েই পরিচিত হবে অথচ সেই সময়ে মানুষের কোনও বিষয়ই কারও অগোচর থাকবে না পিতৃ পরিচয়ে পুনর্জাগরণ কোনও সমস্যা হওয়ার কথা না। আবার কোনও কাহিনীতে দেখা যায়, স্বর্গ অসুরদের দখলে। এত এত দেবতাদের শক্তি – কোনই কাজে আসছে না। অবশেষে প্রয়োজন হয়েছে, দেবী দুর্গার ! তাদের আদ্যাশক্তি মহামায়াও নারী, জগজ্জননী নারী !
নারীকে যে বিধাতা অসীম শক্তির আধার করে সৃষ্টি করেছেন, এটা পুরুষেরা বহু আগেই বুঝতে পেরেছিল। পুরুষের ছিল ধুরন্ধর বুদ্ধি আর গায়ের জোর! নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তারা নারীকে বশীভূত করার উপায় অনুসন্ধান করেছে। অবশেষে বুঝতে পেরেছে, বেঁচে থাকার প্রধান যে রসদ, তা হল খাদ্য । এই খাদ্য উপার্জনের অধিকার নারীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেই একমাত্র নারী পুরুষের অধীনতা মেনে নেবে। তারা কৌশলে নারীদের বোঝাল, খাদ্য উপার্জন, আমরাই করে দেব। তোমরা শুধু বসেবসে খাবে আর ভালোবাসা দেবে। সরল আর কোমলমতি নারী পুরুষের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেনি। কেন আর খাদ্যের জন্য এত কষ্ট করা ! তারা পুরুষের এই ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুঠারাঘাত ক’রে পঙ্গু জীবন বেছে নেয় আর পুরুষের অধীনস্ত হয়ে যায়। তবে সবদিন একরকম যায় না। নারী জাতি একদিন না একদিন তাদের ভিতরের বিপুল শক্তির নাগাল পাবেই! কারণ প্রকৃতির সর্বত্রই তো নারী সত্তার জয় জয়াকার , পুরুষের নয়।”
আমি বেশ বড় হয়ে উঠলাম। বাইরের চপলতা কিছুটা প্রশমিত হল বটে কিন্তূ মনেমনে কিসের যেন আকুলতা, হাহাকার ! অবশেষে একদিন কি যেন ঘটে গেলো ! প্রচন্ড বেদনা আর আনন্দের কি এক বিস্ফোরণ ঘটে গেলো আমার মধ্যে ! আমি বিস্ময়ে, আবেগে অভিভূত হয়ে ডাকলাম, “মা !”
মা বললো , “ওরে সোনা, পুষ্প মঞ্জরী জন্ম নিয়েছে তোর বুকে, তুই যে মা হবি!”
মা হবো ! আমি হতবাক হয়ে নিজের দিকে তাকালাম । তা ই তো ! আমার কচকচি দু বাহুর মাঝখানে কুসুম মঞ্জরী! আনন্দে আমার বাকরোধ হয়ে গেলো !পরম আদরে মঞ্জরীগুলিকে কচি পাতার আড়ালে আগলে রাখলাম ! কয়েকটা উপরের শাখায়, কয়েকটা নিচের দিকে। এরপর একটু একটু করে কুসুম কলির আকার নিল তারা । তারপর একদিন বিকশিত হয়ে ফুটে উঠল ! কত অলি, ভ্রমর বাতাসের বুকে দোল খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফুলের বুকে ! চুম্বনে, আলিঙ্গনে মধুপান করে গেলো ! কি আনন্দ ! কি আনন্দ ! ফুলের পাপড়ির মাঝখানে জন্ম নিল ফল ! আমার শরীরের অংশ, প্রথম ফল ! ফলগুলি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল। কি নধর তাদের গড়ন ! পুষ্ট হল, গায়ে রঙ ধরল । আহা রে আমার সোনা ফল !এদের আমি কার হাতে সমর্পণ করব ! বিধাতার কাছে প্রার্থনা করলাম, আমার এই প্রাণের ধনদের যেন অপাত্রে দান না করতে হয় !
অবশেষে একদিন সে এলো, এদিক ওদিক চাইতে চাইতে, সন্তর্পণে ! এক অমানুষের বাচ্চা! আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম ! ফলগুলির জন্য যতটা না, তার চেয়েও বেশি – আমার ডালের ফাঁকে একটা বুলবুলি বাসা বেঁধেছে, সেখানে সে তার ছানাগুলিকে ডানা দিয়ে আগলে রেখেছে, তাদের জন্য ! আমার ভয় হল, নিশ্চয় এই অমানুষের বাচ্চাটা ছানা গুলোকে কেড়ে নিতে এসেছে ! এইতো কিছু দিন আগেই ওই বড় গাছটায় একটা ঘু ঘু বাসা বেঁধে ডিম পেরেছিল । মা ঘুঘুটা মাত্র খাবার জন্য বাসা থেকে উঠে একটা ডালে গিয়ে বসেছে, এমন সময় এক অমানুষের বাচ্চা বনে এসে গুলতি দিয়ে পাখিটাকে মেরে ফেলল, তারপর গাছে উঠে ঘুঘুর ডিম গুলি নিয়ে পকেটে ভরলো, আবার হাচড়ে পাচড়ে গাছ থেকে নেমে মরা ঘুঘুটাকে তুলে নিয়ে চলে গেলো । আমরা সব বৃক্ষরা মিলে কত কাঁদলাম ! অমানুষের বাচ্চাটাকে অভিশাপ দিলাম !
আজ আবার আরেক জন এসেছে ! ভীরু ভীরু চোখে এদিক ওদিক চাইছে! একা একা বনে এসে মনে হয় ভয় পেয়েছে ! যা না, চলে যা না ! আমার দিকে চোখ পড়তেই তার চোখ দুটো চকচক করে উঠল ! নিচু ডালের একটা ফল ধরার জন্য হাত বাড়াল। লাফ দিল। আমি শক্ত করে ফলটি ধরে রাখলাম। বাতাস বন্ধুকে বললাম,”খবরদার , সে যেন ফলের নাগাল না পায়! আমাকে নিচের দিক থেকে ঠেলে দাও!”
অমানুষের বাচ্চাটা আবার লাফ দিতেই, বাতাস বন্ধুর ঠেলা খেয়েই আমি ঝাঁকি দিয়ে ডালটা উঁচুতে তুলতে গেলাম আর তখনই সর্বনাশটি ঘটে গেলো ! ঝাঁকি লেগে অপরিসর বাসা থেকে একটা ছানা নিচে পড়ে গেলো! মা পাখিটা আর্তনাদ করে উঠল, সেই সঙ্গে আমরাও! হায়রে হায় !এখনি তো অমানুষের বাচ্চাটা ছানাটা নিতে আসবে ! হ্যা , তাই হল ! সে এসে হাত বাড়িয়ে ছানাটা তুলে নিল তারপর মুখ তুলে বাসাটার দিকে তাকাল। এখনি সে গাছের কাছে আসবে, আর গাছে উঠে বাসাথেকে ছানা গুলিকে নিয়ে যাবে, বাসাটা ভাঙ্গবে ! অমানুষের বাচ্চাটা ছানা হাতে আমার দিকে এগিয়ে এলো। ছোট ছোট ডাল পালা খামচে ধরে গাছে উঠতে শুরু করল !
আমি চোখ বন্ধ করে চিত্কার করতে লাগলাম, “ওরে শয়তান, অমানুষের বাচ্চা, তুই নিপাত যা, নিপাত যা ! আশেপাশের সব গাছই চিত্কার করে ধিক্কার দিচ্ছিল ! হঠাত্ করে চারদিক নিশ্চুপ হয়ে গেলো। আমার চিত্কার, আমার কানেই বিকট হয়ে বাজল ! ব্যাপারটা কি ? আমি চিত্কার করতে করতেই চোখ মেলে তাকালাম। কিন্তু, একি দেখছি ! অমানুষের বাচ্চাটা বুলবুলির ছানাটিকে বাসার মধ্যে নামিয়ে দিয়ে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে আছে ! তারপর ঠোঁট সরু করে ছানা গুলিকে আদর জানালো ! এবং আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে গেলো!
“ওরে ও অমানুষের বাচ্চা – না না মানুষের বাচ্চা ! তুই এ কি করলি ? তাহলে কি তুই মানুষ ! তুই আমাদের এত দিনের ধ্যান ধারনা ভেঙে দিয়ে, মানুষ হয়ে গেলি ! তোকে যে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে রে সোনা ছেলে ! কি দিয়ে তোকে ভালবাসা জানাই !”
আমি আমার উপরের ডাল থেকে লাল ফলটা ফেলে দিলাম। ছেলেটা খুশি হয়ে দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে নিল । নিচু ডালের ফলটিও নেওয়ার জন্য লাফ দিল। বাতাস বন্ধুকে বললাম, “ওই মানুষের বাচ্চাটা যখন লাফ দেবে, আমাকে একটু নিচে নামিয়ে দিও । এইবার সে ফলটা ধরতে পারল । ছিড়ে নিয়ে হাসলো, আমিও হাসলাম ! সে এদিক ওদিক দেখছিল । জামগাছ শুকনো পাতার উপর কয়েকটা পাকা জাম ফেলে দিলো । বাতাস বন্ধু ভালই ধাক্কা দিচ্ছিল । সে দৌড়ে গিয়ে জামগুলো তুলে নিল । খুশিতে তার চোখ দুটো চকচক করছিল । একটা জাম একটু মুছে নিয়ে মুখে পুরে দিলো । আম গাছ তার সবচেয়ে পাকা আমটি ফেলে দিলো । এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে সে আমটি দেখতে পেয়ে তুলে নিল । তারপর ভয়ে ভয়ে চারদিক দেখে নিয়ে বন থেকে চলে গেলো ।
“তুমি আবার এসো–ও গো মানুষ ! তুমি আবার এসো ! “আমরা সমস্বরে চিত্কার করে বললাম, “তুমি তো অমানুষ না ! তুমি তো মানুষ ! তুমি মানুষ !”