আফসোস

আফসোস

ঢাকা বুশরা আর্টস প্লেস হল। চমৎকার শৈলীতে চারুকার্য্যে সাজানো হলটি। পুরো চার দেয়াল জুড়ে চমৎকার সব ওয়ালমেট আর হাতের চিত্রশিল্পে নয়নাভিরাম দৃশ্য। এ হলেই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। সে অনুষ্ঠানগুলোর কিছু দেশের স্বনামধন্য টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। এই বুশরা আর্টস প্লেস ‘অনুসন্ধানী প্রাইভেট লিমিটেড” এর নির্মিত বিশাল অডিটোরিয়াম। যার স্বত্বাধিকারী ড. আতিকুল ইসলাম চৌধুরী। বিশাল অর্থবিত্তের মালিক। ঢাকার বুকে চার-পাঁচটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। প্রতি বছরই বাংলাদেশ নাগরিকদের দেশে ও বিদেশে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁর এই প্রতিষ্ঠান হতে সংবর্ধনা দিয়ে থাকেন।

প্রতিবারের মত এবার তিনিও প্রতিষ্ঠানের ‘বুশরা আর্টস্ প্লেস’ হলে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটি কর্মীদের দিয়ে সুসজ্জিত করেছেন। বুশরা ছিলেন তার একমাত্র মেয়ে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে লেখাপড়া শেষে দেশে ফেরার সময় বিমান দূর্ঘটনায় মারা যায়। সেই থেকে মেয়ের স্মৃতি ধরে রাখতেই ‘বুশরা আর্টস প্লেস’ ভবন তৈরি করেন। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য কয়েক বছর আগেই দৃষ্টিনন্দিত হয়েছে। এ বছর বুশরা আর্টস প্রাইভেট লিমিটেড এর অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে ‘আলোকচিত্র ও সাংবাদিক সীমান্ত মাহমুদ ও কবি শারমিন নিশাত নিহানা যুগল দম্পতিকে। সীমান্ত মাহমুদ একধারে সাংবাদিক, আলোকচিত্রী এবং মানুষ মানুষের জন্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। এবং তিনি ‘চাইল্ড ফর বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড’ এর অন্যতম উদ্যেক্তা।

আর শারমিন নিশাত নিহানা নারীর এগিয়ে চলার সাহসী নারী। কর্মজীবি, সাংবাদিক, থিয়েটার প্রযোজক ও কবি। দেশ ও আন্তর্জাতিক ভাবে দুজনেই পুরস্কার প্রাপ্ত। এমন এক দম্পতি সফলতার জন্য ড.আতিকুল ইসলাম চৌধুরী তার অনুসন্ধান টিম গিয়ে খুঁজে বের করে প্রতিষ্ঠান পুরস্কার ক্যাটাগরির মধ্যে সংবর্ধনা ও সম্মানা পুরস্কার দেয়ার আমন্ত্রণ জানান। এ আমন্ত্রণে সাড়া দেয় সীমান্ত-নিহানা দম্পতি। সেরই সংবর্ধনা ও সম্মাননা পুরস্কার ঘিরে এই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মঞ্চের সামনের খালি আসনগুলোয় অতিথিরা বসতে শুরু করেছেন। প্রথমে সংবর্ধনা, পরে সংগীতানুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিক অতিথিদের মধ্যে আকাশ আহমেদ সস্ত্রীক নীলছায়াকে নিয়ে এসেছেন। মঞ্চের দ্বিতীয় সারিতে মাঝপথে বামপাশের প্রথম চেয়ারটায় বসলেন তারা। ডানে নীলছায়া আর বামে আকাশ আহমেদ। অনুষ্ঠানটা কেমন জানি নিজের কোন পরিচিতজনকে নিয়ে সাজানো হয়েছে, এমন অনুভূত হয় নীলছায়ার মনে। অবচেতন মন বলে উঠে, নীল…তোর এক পরিচিত জনকেই এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি রূপে দেখতে পাবি। বুকের ভিতর এ কেমন পরিচিত গুঞ্জন। এই কী তাই! যে অবচেতন মন কিছু ঘটার পূর্বে সংকেত দিতে শুরু করে? নীলছায়া মঞ্চের দিকে তাকায়, মঞ্চের সামনে হাটাহাটি করছে সুন্দর সাজে তরুণ-তরুণীরা। প্রত্যেকের ঠোঁটে মুখে মিটিমিটি উল্লাসময় হাসি। মুহুর্তটা ভাল লাগছে, ডান হাটটা দিয়ে স্বামীর বাহুটা আলতো করে মাথা ঠেকায়।

মঞ্চে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে এক সুদর্শন তরুণ বলে যাচ্ছে, সম্মানিত দর্শকবৃন্দ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘খুঁজে ফেরি সাফল্যের মুখ’ শুরু হতে যাচ্ছে। আপনারা নিজ নিজ আসন নিয়ে বসুন। অতিথিরা এসে পড়েছেন। আপনারা লক্ষ্য করছেন, প্রতি বছরের মত এবারও ‘অনুসন্ধানী প্রাইভেট লিমিটেড’ নিয়মিত সংবর্ধনা ও সম্মাননা দিতে যাচ্ছে দেশের এ সময়ের তারুণ্যের গর্ব, বাংলাদেশের গর্ব সীমান্ত মাহমুদ এবং শারমিন নিশাত নিহানা।

তারা উভয়ই দম্পতি। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক ভাবে সীমান্ত মাহমুদ বিরল সম্মাননায় পুরস্কার অর্জন করেছেন আলোকচিত্রে। অনলাইন ব্লগ প্রতিযোগিতায় সেরা হয়ে পুরস্কার প্রাপ্ত হয়েছেন। এছাড়াও তিনি চাইল্ড ফর বিউটিফুল অর্থাৎ শিশুদের সুন্দর পৃথিবী’ উদ্যেক্ততার জন্য বিশ্বের বুকে অভাবনীয় সাড়া পেয়েছেন। বিশ্ব জাতিসংঘ তার এই উদ্যোক্ততার জন্য বিশেষ পুরস্কার গ্রহণ ও সম্মাননার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিশ্বের ৩৯টি দেশে সীমান্ত মাহমুদ সফর করেছেন এবং চাইল্ড ফর বিউটিফুল ওয়ার্ল্ডের শাখা ভিত্তি স্থাপন করেছেন। সম্মানিত দর্শক এবার আশি শারমিন নিশাত নিহানার সম্পর্কে। তিনি একাধারে নারী কবি, টিভি নাট্য প্রযোজক এবং ‘এগিয়ে চলো নারী’ সংস্থার সফল উদ্ভাবক ও সংগঠক। এ তিনটির জন্য দেশীয় ভাবে পেয়েছেন জয়ীতার পুরস্কার ও সাহিত্য পুরস্কার। আমাদের প্রতিষ্ঠান হতে তাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।

উপস্থাপকের ভাষ্য শুনে থ হয় নীলছায়া। মনের ভিতর পরিচিত টান জাগে। কে এই সীমান্ত মাহমুদ? নামটা খুব পরিচিত। জীবনের একটা অংশ জড়িয়ে আছে এই নামের সাথে। পনের বৎসর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সম্পর্ক হয় সীমান্ত মাহমুদের সাথে। সম্পর্ক থেকে প্রেম। প্রেম থেকে পালিয়ে বিয়ে। মাত্র ১ মাস স্থায়িত্ব ছিল সে দাম্পত্য। পরে ডিভোর্স দিয়ে পরে আকাশ আহমেদকে বিয়ে করেছে। মানুষের মস্তিস্কে বহু তথ্য ভান্ডার সংরক্ষিত থাকে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চিন্তা ও স্বপ্ন উদ্ভাব ঘটলেও নিস্ক্রিয় ঘটনাগুলো কখনো কখনো জ্বলন্ত আগ্নেগিরির মত জেগে উঠে।

নীলছায়ার অতীতের পুরোনো গল্প মনের ক্যানভাসে ফুটে উঠে। অতীতের সেই গল্পে ফিরে যায় সে। মনের পর্দায় ভেসে উঠে সীমান্তের ছবি। ভার্সিটির প্রায় চারটি বছর কেটেছে তার হাত ধরে। ক্যাম্পাসে, ক্যান্টিনে আর পার্কে এমনকি হলেও একান্তে সময় কেটেছে সীমান্তের সাথে। জীবনের খেলাঘর ভেঙ্গেছে নীলছায়া নিজেই। সীমান্ত মাহমুদের সামান্য অভাব-দারিদ্রতা দেখেই চলে এসেছিল বাবার বাড়ি। আর ফিরে যায়নি স্বামীর কাছে। ডিভোর্স দিয়ে বিয়ের ছন্দপতন। তারপর ‘জাগৃত কল্যাণ সংস্থা’ নামে এক বেসরকারি এনজিও কর্মকর্তা আকাশ আহমেদের সাথে মুঠোফোনে প্রেমের জাল বুনে। পরিবারের সম্মতিতে নীলছায়া বিয়ে করে আকাশ আহমেদকে।

জীবনের সাইকেল চলে পৃথিবী ঘূর্ণমান কমলার মতই। ঘুরতে ঘুরতে কখনো ফেলে আসা পুরাতনের সাথে দেখা হয়ে যায়। হয়তো পনের বছর আগের ভার্সিটির চার বছরের হাতধরা লোকটির সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। প্রতীক্ষার সময় ধীরে ধীরে বহে। নীলছায়ার মন প্রধান অতিথি ও তার স্বধর্মিনী কবি নিহানাকে দেখতে অধৈর্য্য হয়ে উঠলো।

জীবনের দ্বিচক্র যানে বিরহ সময় কেটেছে সীমান্ত মাহমুদের। নীলছায়ার সাথে সম্পর্ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর অনার্স করতে আসে ঢাকায়। শাহবাগেই গ্রামের এক পরিচিতের কাছে উঠে। গ্রামের পরিচিত লোকটির নাম সামসুদ্দিন। ব্যবসা করেন। সংসারে ছোট্ট একটা মেয়ে আর স্ত্রী। সীমান্তের মেধা ও পড়াশোনার ঝোক দেখে অবাক হয়েছিলেন গ্রামে গিয়ে। ইন্টারমিডিয়েটে প্রায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে গিয়েছিল। মাত্র দশ পয়েন্টের জন্য জিপিএ ফাইভ পাওয়া হয়ে উঠেনি। সামসুদ্দিন সীমান্তে দূর সম্পর্কের মামা হোন।

সীমান্তদের পারিবারিক অবস্থা ভাল নয়। চরম দারিদ্রতার মধ্যে জীবন কাটাতে হয়। বাবা আবুল কাশেম কৃষি কাজ করেন। পালে এক ডজন গরু আর দেড় ডজন ছাগল ছিল। আরও ছিল ৯ বিঘে জমি। সীমান্তের মা আয়শা খাতুনের ক্যান্সার রোগে ৭ বিঘা জমি বন্ধক ও গরু বিক্রি করে চিকিৎসা করা হয়েছে। আর ২ বিঘা জমি আদি দিয়ে সেগুলো থেকে বৎসরে কয়েক মণ ধান আসে। ছয় মাস চলে তা। বাকিসব কিনে খেতে হয়। একটা মাত্রই ছেলে।

আয়শা খাতুনের সাতটি ছেলে সন্তান জন্মেছিল। ওরা বেঁচে থাকলে দু:খ আর কষ্ট কিসের। কলেরা, আমাশয় আর জন্ডিসের কারণে ছয় ছেলে শিশু বয়েসেই অকালপ্রাত হয়েছে। শেষ মেষ কুলের ধন সীমান্ত। তারপরেও তার লেখাপড়ার খরচ চালাতে মায়ের হাড়ভাঙা খাটতে হয়। রাস্তায় হাতুরি পিটিয়ে পাথর ভাঙতে হয়। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকেছে জেনে মা খুশিতে আত্মহারা। পালের খাসীটা বিক্রি করে দুর সম্পর্কের ভাই সামসুদ্দিনের কাছে পাঠিয়ে দেন সীমান্তকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত