স্যার, শিউলী’পা দিলো—একদৌঁড়ে এসে ফুলস্কেপ সাইজের একটা সাদাখাতা বেডের ওপর ছুঁড়ে দিয়েই ছুটে যাচ্ছিল মেয়েটা। ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে চটজলদি ডাক দেয় কায়েস, এ-ই সুমি শোন—। ততক্ষণে সে রুমের বাইরে চলে গেছে। ডাকশুনে ফিরে আসে এবং রুমে ঢুকেই ফিক করে হেসে দেয়। এটাই ওর স্বভাব, কারো মুখোমুখি হলে হাসা চাই-ই? বয়স বেশী নয়, দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। আর ইমরম্নল কায়েস হলো ওদের যৌথপরিবারের সবারই ’কমন স্যার !’ যদিও তার কাছে পড়ে তার ইস্কুলেরই ছাত্র, সুমির চাচাতো ভাই জুয়েল। স্যারের ডাকে ভড়কে যাওয়ায় জড়সড় হয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন ডাকলেন, স্যার?
কায়েস লক্ষ্য করে খাতাটার মাঝখানে লালকালিতে বড় করে লেখা ’শিউলী’ আর ওর নিচে ছোট অক্ষরে ’ইংরেজি নোটখাতা।’ চিন্তায় পড়ে যায় সে। হয়তোবা অন্য কাউকে দেয়ার কথা; ভুল করে সুমি তাকেই দিয়েছে, ভাবে কায়েস। তাই খাতাটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে, এটা কি আমাকেই দিয়েছে তোমার আপা?
: হ্যাঁ—ঘাড় দুলিয়ে জবাব দেয় সে।
: এ দিয়ে কী করবো আমি, কেনো দিলো—-
: আমি কী জানি, ব্যস্—- দ্বিরুক্তির কোন মওকা না দিয়ে পালিয়ে যায় সুমি।
পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি আমেজে কায়েসের মনে আজ কবিতা লেখার ভাবোদয় হলেও সকালের খাতার ঘটনাটাই বারবার ঘুরপাক খায় মাথায়? অগত্যা কী আর করা, খাতাটা বারকয়েক উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখে সে। কিন্তু কতগুলো ইংরেজি প্রশ্নোত্তর ব্যতীত কিচ্ছু নেই ওতে। অচেনা-অদেখা একটা যুবতীর রহস্যজনক খাতা তাকে বেশ টেনশনে ফেলে দেয়। খাতাটা টেবিলে রেখে পশ্চিমের জানলা দিয়ে অস্তায়মান লাল টুকটুক থালার মতো সূর্যের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে। পশ্চিমাকাশজুড়ে বিস্তৃত রঙ্গিন আলোকমালা মেঘে মেঘে ছড়িয়ে কী অদভুত আল্পনা এঁকে দিয়েছে! রঙ্গিন পাখিগুলো দলেদলে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। একটু পরে নিস্তেজ সূর্য লুকিয়ে যাবে তার গোপন আস্তানায় আর অন্ধকারের ভয়ংকর কালো দত্যি গিলে খাবে চলমান দিনটাকে! এসব দেখতে দেখতে মাথায় একটা আইডিয়া খেলে যায় তার তাইতো–শিউলী হয়তো ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্যই খাতাটা পাঠিয়ে থাকবে। এবার সে এইচএসসি পরীক্ষার্থিণী, সুমিরই সহদরা! শিক্ষকদের এ-ই হলো বিপদ, এ বলবে এটা দেখিয়ে দাও, সে বলবে ওটা দেখিয়ে দাও– কথাটা ভাবতেই মনে মনে হাসেও একচোট!! কিন্তু নীলাকাশের ঝুলন্ত সূর্য কখন যে অন্ধকারের সমুদ্রে হারিয়ে যায়, টের পায়না সে। মেসমেট নুরম্নল হুদার কথাতেই চমক ভাঙ্গে—কী ব্যাপার স্যার, কী করছেন? টেবিলের খাতার ওপর নজর পড়ায় ব্যঙ্গাত্মক একটা প্রশ্নও ছুঁড়ে দেন, শিউলীর খাতা যে; এখানে কেন! অত্যন্ত লাজুক কায়েসের মুখ লজ্জায় একেবারে রাঙ্গা হয়ে ওঠে।
: নাঃ মানে, ইংলিশ প্রশ্নোত্তরগুলো কারেকশন করে দিতে বলেছে তো, তাই —–আমতা আমতা করে সে।
: বাহ্ ছাত্রীতো ভালোই জুটেছে একখান—আবার টিপ্পনী কাটেন হুদা।
কায়েসের এ মেসমেটটি এখনো ছাত্র। আর তাকে তো এমএ পাশের পর লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে হাইস্কুলের চাকরিটা জোগাড় করতে হয়। অবশ্য এটাই তার প্রথম চাকরি এবং মেসজীবনের অভিজ্ঞতাও এ-ই প্রথম? চাকরি হবার পর নুরুল হুদাই মেসমালিক সুমির দাদাকে রাজী করিয়ে তিনবেলা খাবারের জুঁৎসই ব্যবস্থাটা করে দেন। ফলে না লজিং না টিউশনি, এমন অভিনব ব্যবস্থায় জুয়েল হয়ে যায় ডবল ছাত্র। রোজ সন্ধ্যায় এসে একবেলা পড়ে যায় আর সময়মতো তিনবেলা টিফিন ক্যারিয়ারে আসে খাবার!
সন্ধ্যার পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে যায় রংপুর শহর। কৃষ্ণপক্ষ চলছে, লোডশেডিং না হলে হয়তো বুঝাই যেতো না। জুয়েল পড়ছে, এমন সময় বিড়ালের মতো নিঃশব্দে রুমে ঢোকে সুমি; কিন্তু টের পায় না কায়েস। খাতাটা কি দেখা হয়েছে, স্যার? সুমির প্রশ্নে ভুতদেখার মতোই চমকে ওঠে সে– নাতো? আচছা দেখবো’খন, কাল নিয়ে যেও— অপ্রস্ত্তুত অবস্থায় একদমে কথাগুলো বলে বিদায় করে দেয় ওকে। এখন অবশ্য আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে, উদ্দেশ্যমূলকভাবেই পাঠানো হয়েছে খাতাটা। পরক্ষণে ভাবে, কিন্তু কেন–শিউলীর সাথে তো কোনরকম আলাপ-পরিচয়ই হয়নি? বিষয়টাকে সাংঘাতিকভাবে নেয় এবার। তবে প্রেম করতে চায় নাকি মেয়েটা—এমন আজগুবি চিন্তা উদয় হওয়ামাত্র কেমন একটা পুলকিতভাবও ঢেউ খেলে যায় অন্তরে। ফলে চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে নিজেকে ধমকে ওঠে সে, ছিঃ ছিঃ, শিক্ষকতার মহান পেশায় থেকে একি ভাবছি আমি! একজন টগবগে তরুণ হলেও কায়েস বিয়েপূর্ব প্রেম, প্রণয় বা ভালোবাসার ঘোরবিরোধী। কেননা এধরণের প্রেমের ফাঁদে পড়ে সহপাঠি অনেক মেধাবী বন্ধুর শিক্ষাজীবন শুধু নয়, ক্যারিয়ার এমনকি উজ্জ্বল ভবিষ্যতও নষ্ট হতে দেখেছে সে। নিজেও যে ছাত্রজীবনে এমন মোহময় মরিচিকার খপ্পড়ে পড়েনি, তা নয়। কিন্তু বৈমাত্রেয় নির্যাতনের শিকার তার অসহায় মা, ভাই-বোনদের প্রতি স্বতস্ফূর্ত দায়িত্ববোধ তাকে এপথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে বারবার। এমনকি নারীরূপী বিমাতার অকথ্য নির্যাতন স্বচক্ষে দেখেশুনেই ভবিষ্যতে কোন নারীকে বিয়ের চিন্তা দূরে থাক, বরং মেয়েদের এড়িয়েই চলে সে।