রিনিঝিনি সুরের নূপুর পায়ে বৃষ্টি বালিকা নেচে চলেছে বিরামহীন। স্বপ্নের সূবর্ন রেখায়, আমার একাকী প্রহরে মুহ্যমান স্মৃতিরা আনমনে বিল কাটছে কিশোরী মনের সবুজ মাঠে। আমি হারিয়ে যাচ্ছি অনেক বছর আগের স্মৃতিময় দিনগুলির মাঝে।
বহমান গড়াই নদীর পাশে ছোট্ট ছায়াঘেরা আমাদের গ্রামখানি অতি চমৎকার, ছবির মতে কাব্যময়। নদীর পাড় ঘেঁষে একটি পাড়া-নাম ছিল পালপাড়া। প্রতি বছর বর্ষা এলেই শীর্ণ নদী যৌবন হয় এবং এই নিঁচু পাড়াটির বাড়ি ঘরে পানি ঢোকে। তবু তারা দীর্ঘবছর ধরে বাস করছে সেখানেই। এই পাড়ার এক সাহসী বধূ-নাম তার কমলা রাণী। রূপে, গুনে আচার -আচরনে সবার কাছে সে অতি প্রিয় ‘কমল বৌ’ নামে পরিচিত। স্বপ্নের নোলক দুলিয়ে পথ চলত কমল বৌ। লাল পাড় সবুজ শাড়ীতে চমৎকার মানাতো তাকে। ডাহুক ডাকা বর্ষা বিকেলে সে কলসী কাঁখে পানি নিতে আসতো আমাদের পুকুরে। ভেজা শাড়ির কমল বৌ কে দেখে আমার মনে পড়তো কবি নজরুলের বিখ্যাত কবিতার লাইন গুলি-
ডাকত ডাহুক জল পায়রা, নাচত ভরা বিল
জোড়া ভ্রু ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল।
হঠাৎ জলে রাখতে পা -কাজল দীঘির শিউরে গা
কাঁটা দিয়ে উঠত মৃনাল ফুটত কমল ঝিল
ডাগর চোখে লাগত তোমার কাজল দীঘির নীল।
হঠাৎ একদিন! তার চোখের নীল হারিয়ে গেল। নাকের নোলক দুলে উঠল কঠিন বেদনার বাতাসে। স্বামীহারা শোককে পাশ কাটিয়ে ছোট দু’টি সন্তানকে নিয়ে বাস্তবের ভাঙা নৌকোর হাল ধরল সে। একসময় আমিও চলে এলাম অন্য ঘরে । গ্রামে গেলেও নানা ঝামেলায় তার আর খোঁজ নেয়া হতো না। অনেক বছর পর একবার বর্ষার সময় গ্রামে গেলাম। নতুন পানিতে চারিদিক থই থই করছে। কিশোরী উচ্ছলতায় দুলে উঠল মন। হঠাৎ মনে পড়লো কমল বৌ এর কথা। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গিয়ে দাঁড়ালাম কমল বৌ এর উঠোনে। আনন্দে ঝলসিত মুখ আমার মূহুর্তে বেদনায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
কাঁচা পাকা চুলের কমল বৌ এর মুখখানিতে সন্ধ্যার কালো ছায়া। পরনে শাড়ি শতচ্ছিন্ন। ঘরের পচা ছনের ভ্যাপসা গন্ধে সারা আঙিনা ভরে আছে। বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য চালের ছিদ্র গুলিতে পলিথিন গুজে দেওয়া। কিছু জিগ্যেস করার আগেই বলল সে, তোকে কোথায় বসতে দি, বলতো দিদি ভাই! চোখের জল গোপন করে বললাম, না গো বৌদি বসবো না। বৃষ্টির পানিতে অনেক দিন ভিজি না তো তাই বেরিয়েছিলাম। বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কমল বৌ বলল, ওহ! তাই বুঝি!
প্রচন্ড একটা ধাক্কা লাগল বুকে। নিজেকে বড্ড বোকা মনে হলো। বাড়ি ফেরার পর নীরবে নিভৃতে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল কমল বৌ। ধিক্কারের আগুনে পুড়ে আমার কোমল হৃদয়টাতে সেদিন হয়েছিল প্রচন্ড রক্তক্ষরন। এখানে বর্ষা এলেই কদম ফোটে। ডাহুকের কান্নার সুরে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। রংঝরা হলুদ কষ্ট গুলো চেতনার কোষে জাগায় বিরহী আকুলতা। বর্নীল ইচ্ছেরা ময়ূরের মতো পেখম মেলে হারাতে চায় দূরে-বহুদূরে। আটপৌরে সময়ের একাকীত্ব নিয়ে বিষন্ন বৃষ্টি বেলায় যখন বিলাসের পংক্তিমালা সাজাতে ব্যস্ত হই, ঠিক তখনি মনে পড়ে কমল বৌ এর কথা। আহা কমল বৌ! হয়তো এখনো প্রচন্ড বৃষ্টি এলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে, আহ্ ভগবান! আর তো পারি না! কিন্তু হায়! বৃষ্টি ও বধূর কান্না এক হয়ে মিশে যায় কোথায়, কেউ তার খবর রাখি না।











