খুব সাদাসিধে আর অদ্ভূত রকমের সুন্দরী মেয়েটির নাম ইতি। ইতি অন্য আট দশটা মেয়ের মতো না। কম কথা বলতে পছন্দ করে আর নিজের অনুভূতিগুলো সহজে কারও কাছে প্রকাশ করেনা সে। শিহাবের কাছে ইতি অসাধারণ একটি মেয়ে। সেই ক্লাস নাইনে প্রথম যেদিন শিহাব ইতিকে দেখেছিলো ঐদিন থেকেই ইতিকে ওর খুব ভালো লাগতো। কিন্তু ইতিকে আর বলা হয়ে উঠছে না। এভাবে করে তাদের কলেজ পড়া শেষ হলো কিন্তু এখনও ইতিকে শিহাবের বলা হয়নি ভালোবাসে তাকে। এরপর দৈবক্রমে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভর্তি এমনকি একই ডিপার্টমেন্টে।
শিহাব ইতিকে নিয়ে নানান স্বপ্নে বিভোর থাকে। গত চার-পাঁচ বছর ধরে কম করে হলেও শ-খানেক কবিতা লিখে ফেলেছে ইতিকে নিয়ে। অথচ সেই ইতি আজও জানেনা এই অবুঝ ছেলেটি তাকে কতটা ভালোবাসে। এই চার-পাঁচ বছরে শিহাব ইতিকে দেখছে, কোনদিন এমন কিছু দেখেনি যাতে ইতিকে সে ভুল বুঝতে পারে।
আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। ইতি তাই লাল শাড়িতে খুব সুন্দর করে সেজে এসেছে। তার খোঁপায় গন্ধরাজের সাথে বেলী ফুলের মালা জড়ানো আর কোন ধরনের অলংকার সে আজ ব্যবহার করেনি। গলায় বকুল ফুলের মালা আর কানে টিউলিপ ফুল বাধা তার। ইতিকে দেখতে আজ মনে হচ্ছে আকাশ থেকে সাদা মেঘে ভর করে স্বর্গের কোন অমরাবতী নেমে এসেছে। ইতি কোন ধরনের মেকআপ আজ ব্যবহার করেনি। একদম প্রাকৃতিক সাজে সেজেছে সে। শিহাব অডিটোরিয়ামে বসে আড্ডা দিচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হতে আরও সময় লাগবে তাই একটু বাহিরে আসলো। হঠাৎ শিহাবের চোখ বকুলতলায় পড়লো, দেখলো দীঘল কেশী আর মায়াবী হাসির রূপবতী ইতিকে। শিহাব ইতির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই রইলো। শিহাব ডুবে গেল কোন এক সমুদ্রে যেখানে রূপময়ী গান গাইছে হাসির ছন্দে আর অমায়িক চাহনিতে বেধে রেখেছে তাকে। মাঝে মাঝে ঢেউ এসে শিহরণ দেয় শিহাবের হৃদয়ে আর সৃষ্টি করে ভালোবাসা নামক অবিচ্ছেদ্য সত্ত্বাকে।
-এই কিরে?
শিহাবের বন্ধু রাজন তাকে ডাক দিচ্ছে। অথচ শিহাব যেন রাজনের কথা শুনছেই না।
-হুম
-আরে বেটা স্ট্যাচু হয়ে গেলি নাকি?
তখনও শিহাব ইতির দিকেই তাকিয়ে ছিল। রাজন উপায় না পেয়ে শিহাবের গালে কষে এক চড় বসিয়ে দিল।
-ঐ শালা মেয়ে দেখলে হুস থাকেনা?
-কিরে? একজনকেই তো দেখি শুধু!
-আরে বদমাশ যাকে দেখছিলি ও তো কখনই অডিটোরিয়ামে চলে গেছে
-তাহলে কাকে দেখছিলাম?
-কেন পুষ্পকে। দেখ ও এদিকেই আসছে
-দোস্ত তাড়াতাড়ি চল। আমার ইতিকে দেখলে কি যে হয় বুঝতেই পারিনা। ইতিকে দেখলেই হারিয়ে যাই কল্পনার দেশে। আর পুষ্প হয়তো ভাবছে ওর দিকে আমি তাকিয়ে ছিলাম।
-দোস্ত পুষ্পও কিন্তু কম না!
-আরে ধ্যাৎ চলতো
রাজন আর শিহাব অডিটোরিয়ামে ঢুকলো আর ঠিক ইতির পেছনের সারিতেই বসলো। রাজনের আজ তাই আর মঞ্চের দিকে তাকানোর সময় নেই। শুধু ইতির দিকেই তাকিয়ে থাকে। ইতির সাথে শিহাবের অবস্থান স্থানাঙ্কের বিচারে করলে ইতির অবস্থান (-5, 2) হলে শিহাবের অবস্থান (5,-2) যখন তাদের দুই সারির মাঝ দিয়ে x-অক্ষ ও এরসঙ্গে লম্ব বরাবর y-অক্ষ কল্পনা করা হয়। শিহাবের অবস্থান থেকে ইতিকে একপাশ থেকে ভালো করেই দেখা যাচ্ছে। আজ ইতিকে আসলেই খুব সুন্দরী লাগছে তাই হয়তো শিহাবের মন আজ আর মানছেনা দূরে বসে থাকতে। ইতি যখন মুচকি হাসি দিচ্ছে তখন শিহাবও এক অদ্ভুত হাসি দিচ্ছে। শিহাবের এই অদ্ভুত হাসি দেখে রাজন অবাক হয়ে গেল।
-ঐ শালা পাগল হয়ে গেলি নাকি
-দোস্ত ইতিকে চাই
-যা ওর পাশের সিটে যেয়ে বস, খালি আছে
-সব যে মেয়ে সেখানে
-তাতে কি!
-পুষ্পও তো আছে ঐখানে
-পুষ্ট তোকে কি করবে?
-যদি বলে বসে ওর দিকে কেন তাকিয়ে ছিলাম তখন
-তুই বলবি ওর দিকে তাকাসনি
-ইতি শুনে ভুল বুঝবে
-আরে না
-তুই যা তো
-সত্যি বলছিস
-হুম, যা
শিহাব সত্যি সত্যিই উঠে চলে গেল ইতির পাশে বসার জন্য। শিহাব ঠিক ইতির পাশের সিটে বসে পড়লো। তখন পুষ্প শিহাবকে দেখে হাসি দিয়ে বসলো। ইতি পুষ্পের হাসি দেখে পাশের সিটে তাকাতেই শিহাবকে দেখে হাসিতে ফেটে পড়লো। ভারী মিষ্টি করে হাসতে পারে ইতি। শিহাবও ইতির সাথে হাসা শুরু করলো।
-এই তুমি মেয়েদের মাঝে এসে বসলা কেন?
-কই মেয়েদের পাশে বসলাম, তোমার পাশেই তো
-আমি কি মেয়ে না
-হুম
-তাহলে
-স্কুল থেকেই তো তোমাকে দেখছি তাই মাঝে মাঝে ভুলে যাই তুমি যে মেয়ে
-মানে
-তোমার আর আমার মাঝে যে লিঙ্গ বৈষম্য আছে তা ভুলে যাই
-ও তাই
-জী
-সবাই তো আর বুঝবে না, ভুল বুঝবে
-বুঝুক আমার কি?
-মানে
-কোন সমস্যা নাই
-পাগল হয়ে গেছ তুমি
-হুম
-সবাই খারাপ ভাববে তোমাকে
-ভাবুক, তুমি ভালো ভাবলেই হলো
-যাও তো তুমি
-না, যাব না
-তোমার কান ধরে এখন পিছনে নিয়ে যাব
-সত্যি
-হ্যাঁ
-তাহলে তো ভালোই
-তোমাকে নিয়ে আর পারলাম না
-হুম
-চুপ হয়ে বসে থাকো
শিহাব ইতির পাশে চুপচাপ বসে রইলো। কিন্তু সমস্যা হলো কাছে বসে ইতিকে তো ভালো করে দেখতে পারছে না। তাই আস্তে করে উঠে পিছনের আগের সিটে যেয়ে বসে পড়লো।
ইতি ভেবেছে শিহাব হয়তো পাশেই বসে আছে। হঠাৎ করে তাকিয়ে যখন দেখে শিহাব নেই তখন পেছনের দিকে তাকলো আর দেখলো খুব মায়া নিয়ে শিহাব তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর শিহাব খেয়াল করলো ইতি গোমরামুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শিহাব বুঝতে পারলোনা কেন ইতির হাসিমাখা মুখটি হঠাৎ গোমরা হয়ে গেল। এর কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল।
কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে ইতির সাথে শিহাবের দেখা হচ্ছে না। তাই সারাদিন শিহাব মনমরা হয়ে পরে থাকে। এদিকে ইতিও কেমন মনমরা হয়ে থাকে। শিহাবের কাছে ইতির ফোন নাম্বার আছে তবুও সে ইতিকে ফোন করতে ভয় পায় যদি ইতি ভুল বুঝে তাকে। কিন্তু আর পারছে না। খুব খারাপ লাগছে তাই ইতিকে ফোন দিয়ে বসলো।
-হ্যালো
-কে বলছেন?
-শিহাব
-হুম বলো
-কেমন আছ?
-ভালো, তুমি?
-এইতো
-কি করছো?
-বসে আছি বারান্দায়
-কেন বারান্দায় কি কর?
-বাহিরের মানুষ দেখছি
-পুরুষ মানুষ না মেয়ে মানুষ দেখছো?
-সবই দেখি, কেন মেয়ে মানুষ দেখলে কি হবে?
-কিছু হবেনা, এমনি বলছি
-তোমার কন্ঠটা না অনেক মিষ্টি
-তাই
-হুম
-আর কিছু বলবে
-অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু
-কিন্তু কি
-কিছুনা, এখন যাই
-আচ্ছা
ফোনটা কেটেই শিহাব খুশি হয়ে লাফালাফি করতে লাগলো অপরদিকে ইতি আরও কিছু একটা শোনার জন্য চাইছিল কিন্তু শিহাব তা বুঝতেই পারেনি।
দুইদিন পর সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলো। অনেকদিন পর একে অপরকে দেখে খুশি হয়ে কথা বলছে। শিহাব ইতিকে খুঁজতেছে মনে মনে কিন্তু কোথাও না দেখতে পেয়ে মন খারাপ করে একা একা বকুলতলায় বসে আছে।
রাজন শিহাবের মন খারাপের কারণ বুঝতে পেরে শিহাবের পাশে যেয়ে বসলো। শিহাবের চুল অনেক বড় হয়ে আছে আর সেভও করেনি।
-ইতি কেন আসেনি জানিস?
-কেন?
-তুই দেবদাস হয়ে আছিস তাই
-ও কি দেখছে আমাকে
-আর তোকে এই অবস্থায় দেখলে কি ও যতোক্ষণ পছন্দ করবে
-যা তো শুধু উল্টাপাল্টা কথা বলিস
রাজন দূরে ইতিকে দেখতে পেল।
-শিহাব ভাবী চলে আসছে
-কই
-ওই কানা সোজা তাকা
শিহাব দূরে ইতিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। ভাবলো এমনই হয়তো দাড়িয়ে আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যা দেখলো তা দেখে শিহাবের মন খারাপ হয়ে গেল। দেখলো অন্য একটা ছেলের সাথে ইতি অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে। রাজন বিষয়টা বুঝতে পারলো।
-ইতি হয়তো ঐ ছেলেটার সাথে অন্য বিষয়ে কথা বলছে
-এতক্ষণ কি বলে ও
-থাকতে পারে না
-ধ্যাৎ
শিহাব উঠে চলে গেল। ঐদিন থেকে শিহাব আর ইতির দিকে তাকিয়ে থাকে না। সামনে পেলেও কথা বলছে না। ইতি বিষয়টা বুঝতে পারছে যে শিহাব এখন আর আগের মতো নেই। শিহাব ইতিকে প্রায়ই ঐ ছেলেটির সাথে কথা বলতে দেখে খুব রাগ করে উঠে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শিহাব সারাদিন ফোনে বিভিন্ন ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলে সময় পার করতে থাকে। ইতি শিহাবের সারাদিন ফোনে কথা বলা দেখে মন করে শিহাব হয়তো কারও সাথে সম্পর্ক গড়েছে। এভাবে করে ইতি আর শিহাবের দূরত্ব দিনদিন বেড়েই চলছে। হয়তো মনে মনে তাদের ভালোবাসা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু দুইজনের বাস্তব জীবনের ব্যবহার একে অপরকে আঘাত করার ফলে তাদের মনে মনে ব্রেক আপ হয়ে গেছে। ব্রেক আপ হওয়ার পরও কিন্তু একে অপরকে ভালোবাসে যার ফলে মাঝে মাঝে দুই মেরুর মানুষ একে অপরের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করে।
এদিকে ইতি একা একা প্রায়ই কান্না করে। রাতে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মনমরা হয়ে বসে থাকে। ইতির এই বিষয়টি পুষ্পের চোখে পড়ে।
-আচ্ছা কি হইছে তোর?
-কই কিছুনা
-তুই শিহাবকে অনেক ভালোবাসিস?
-আমি কেন ওকে ভালোবাসবো?ওর তো ভালোবাসার মানুষ আছেই।
-নাওতো থাকতে পারে
-তুই জানিস
-আচ্ছা আমি খবর নিয়ে তোকে জানাচ্ছি
এরপর দুপুর সময়ে পুষ্প রাজনকে দেখে ডাক দিল।
-রাজন
-কি খবর?
-এইতো, একটা খবর দিবে
-কি?
-শিহাবের সাথে কারও রিলেশন আছে?
-কেন তুমি কি ওকে পছন্দ কর?
-আরে না, আগে সত্য কথা বলোতো।
-নাই
-তাহলে হয়েই গেল
-কি হলো?
-ইতি আর শিহাবের রিলেশন
-কেন ইতির না রিলেশন আছে?
-কে বলছে তোমাকে ওর রিলেশন আছে?
-প্রায়ই সময় যে ও একটা ছেলের সাথে কথা বলে দেখিয়ে
-আরে ঐ ছেলে ওর চাচাতো ভাই আর ওতো ইতির চেয়ে ছোট
-কি বলো! জান শিহাব ওকে কতটা ভালোবাসে
-একটা ভুল বুঝাবুঝির কারণে তো আর ওরা দুঃখ পেতে পারেনা
-তাহলে চল ওদের বুঝিয়ে বলি
-আচ্ছা ঠিক আছে
পরদিন শিহাব বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাপ বাগান থেকে সবচেয়ে বড় গোলাপ নিয়ে আসলো। ইতিও খুব সুন্দর করে সেজে এসেছে। ইতিকে দেখেই শিহাব দৌড়ে কাছে গেল। যেয়েই গোলাপ ফুলটা ইতির হাতে দিয়ে বলে দিল ভালোবাসি। যেতেতু গোলাপটি বাগান থেকে পেরে নিয়েছিল তাই গোলাপে কাঁটা ছিল। ইতি গোলাপ হাতে নিতেই একটা কাঁটা তার আঙ্গুল ভেদ করলো আর ইতি চিৎকার দিয়ে উঠলো। শিহাব ইতির আঙ্গুল থেকে রক্ত পরা দেখে কি করবে বুঝতে না পেরে ইতির আঙ্গুলটি নিজের মুখে পুড়িয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর আঙ্গুল বেড় করলো। তখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখে সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইতি লজ্জা পেয়ে শিহাবকে তখন জড়িয়ে ধরলো আর শিহাবকে ভালোবাসি বলে দিল।