এখন যেখানে আছি তার ফুট পাঁচেক সামনে পড়ে আছে কিছুক্ষণ আগে খুন হওয়া একজন মানুষ। লাশটি মধ্যবয়স্ক এক পুরুষের। লোকটার দেহে মাংসের বাড়াবাড়ি, বিন্যাসেও অসামঞ্জস্যতা চোখে লাগে। তার দিকে তাকালে বিশাল ভুঁড়িটা দৃষ্টি আকর্ষণ করত সবার আগে। এখন অবশ্য সেটা নেতিয়ে পড়েছে। প্রকাণ্ড আর ধারালো এক ছুরি এফোঁড় ওফোঁড় করে চিড়ে দিয়েছে ভুঁড়িটা। রক্তে গড়াগড়ি! বিশ্রী অবস্থা! আর তা চেয়ে চেয়ে দেখতে হচ্ছে।
মানুষ কী করে খুন হয়, এই নিয়ে মনে বিশ্রী রকম একটা কৌতূহল কাজ করত। শোবার ঘর লাগোয়া পাশ-বারান্দায় বসে প্রায় প্রতি সকালেই এ বাড়ির কর্তা আশফাক চায়ের কাপে চুমুক দিত আর পা নাড়াত। নানান ফুলগাছে ভরা আলো আধারির ব্যালকনির টেবিলটায় সকাল আটটা বাজতে চলে আসত দুটো খবরের কাগজ। কাগজের হেডলাইনে চোখ বুলিয়ে আশফাককে প্রায়ই হতাশ মনে হতো। কেমন একটা ক্ষোভ আর দুঃখ ভরা কণ্ঠ বলতে শুরু করত—খুনের কথা, হত্যার কথা, ধর্ষণের পরে জবাই করে নির্মমভাবে মেরে ফেলার কথা। আমি ওর গলার স্বর শুনে বুঝতে শিখলাম, মন খারাপ হলে মানুষ এমন করে। ও একবার চিৎকার দিয়ে বলেছিল, ‘মানুষ কি কোনোদিন সভ্য হবে না?’ কত দিন ভেবেছি আর কৌতূহলী হয়ে উঠেছি এইসব আজেবাজে বিষয় নিয়ে। খুন, ধর্ষণ এগুলো কী, কেউ যদি বলে যেত, পেপারটা যদি পড়ে দেখতে পারতাম!
দ্বিতীয় খুনটা ছিল নির্মমতার অন্য মাত্রা। তার বর্ণনা সম্ভবত শুধু মানুষই দিতে পারবে।
বহুদিনের সেই অসংযত আকাঙ্ক্ষা মিটে গেছে আজ ভয়ংকরভাবে। একটা ভয়াল বিভীষিকা এসে যেন নগ্ন করে দেখিয়ে গেল অসভ্যতার কালো লোমশ বাহুটা। দু’দুটো খুনের দৃশ্য দেখতে হলো আজ, একই রাতে! প্রথমটি দেখার পরই আমার সর্বাঙ্গে শুরু হয় ভীতিপ্রদ কাঁপন, কেমন সবকিছু এলোমেলো মনে হয়। চাইছিলাম ছুটে বেরিয়ে যেতে। পালিয়ে যেতে এ ঘর ছেড়ে অনেক দূরে। কিন্তু পারি নি, ধরের ধারক ছাড়ে নি আমাকে, উল্টো গেঁথে রেখেছে শক্ত তারকাঁটায়। আমার নড়বার ইচ্ছা, শব্দহীন আকুতি একটুও স্পর্শ করে নি, সে ছিল মহাকালের মতো নির্বিকার।
দ্বিতীয় খুনটা ছিল নির্মমতার অন্য মাত্রা। তার বর্ণনা সম্ভবত শুধু মানুষই দিতে পারবে। আমার জন্য এটি আরো কষ্টের। বেখাপ্পা ধরনের ফাঁকা বড়সড় শয়নকক্ষে আশফাকের স্ত্রী সোমা খুন হলো কিছুক্ষণ আগে। ওর লাশটা পড়ে আছে শ্বেতশুভ্র চাদরের বিছানাতে। অদ্ভুতরকম এলোমেলো হয়ে ভাঁজ পরে আছে চাদরটায়। চিরে গেছে কিছু জায়গায়। অবশ্য হবার কথাই ছিল। পাষণ্ড খুনিটা যেভাবে খুবলে খেয়ে নিয়েছে সর্বস্ব, যেভাবে মৃত্যুর কোলে সোমাকে শুইয়ে দিয়েছে নিখুঁত নিপুণতায়, যেভাবে নিথর দেহের ভিতরেও খুঁজে নিয়েছে নিজের আদিতম সুখের ঠিকানা; তাতে এই শাদা চাদরের ছেঁড়া কিংবা বিছানার আলুথালু অবস্থা কোনো অর্থ বহন করে না। বরং জঘন্য রকম নোংরা হয়ে থাকা এই বিছানা পত্র—অনিবার্যই ছিল, ঘটনাক্রমের সাথে।
এগুলো কী ভাবছি আমি? একটু আগে চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল দু’দুটো রক্ত মাংসের মানুষ। তাদের একজন যত্ন দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে আমায় আপন করে নেয়া সোমা। আর আমি শোকের বদলে সাদা চাদরে ছোপ ছোপ রক্তের নোংরা আর চিড়ে ফালাফালা হবার বিষয়টা নিয়ে বকে যাচ্ছি!
ভেতরটা কি বদলে গেছে আমার, হঠাৎ এই খুনোখুনি দেখে? চোখের দৃষ্টিতে কি এখন অশ্লীল নিস্তব্ধতা, অন্তহীন গভীর অভিব্যক্তি হীনতা নিয়ে ঘুরছি? খুনিটার মতন মৃত্যু ও হত্যা বিষয়টা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার মানসিক ধীশক্তি আমিও কি অর্জন করে ফেলেছি? এখন সোমা যে কোনো মৃতদেহ, শুধুই একটা লাশ; আর দশটা সাধারণের মতো? জানি না আমি। আর ভাবতে পারছি না, নিজেকে ধিক্কার দিতে মন চাইছে। মনে হচ্ছে এখুনি ঝাঁপ দেই এই স্থবিরতা থেকে। আমি মুক্তি চাই। নীরব, হে অটল, যে তুমি আমায় বাঁধো নিজের বাধনে, তোমার কাছে অনুরোধ—আমায় মুক্তি দাও!
বেশিদিন আগের কথা নয়, এই তো মাত্র দিন সাতেক আগে আশফাক বের করে দিতে চেয়েছিল আমাকে এ ঘর থেকে। ক্ষুব্ধ হয়ে বলছিল আমি নাকি অপয়া, অভিশপ্ত জিনিস একটা। নিজের হাতে রেখে এসেছিল বসার ঘরের এক কোনে। শুরুতে সোমা ওকে বাধা দিয়েছিল। দিন দুয়েক পর আশফাকের রাগ কমলে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে এ ঘরে। জানত কি সোমা, তোমার জীবনে কালরাত্রি ঘনিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। অন্ধকারের প্রেতাত্মা গ্রাস করে নেবে, এই কালো জগৎ? জানতে বোধহয়, তাই রাখতে চেয়েছিলে প্রত্যক্ষদর্শী এই অসাড় আমাকে। হায়, আমার অনুচ্চারিত কথামালা তোমরা কি কোনোদিন শুনতে পাবে মানব জাতি, আমার ঈশ্বরেরা?
সেদিন সকাল থেকেই কেমন আনন্দে ভাসছিলাম আমি। ওর মুখে অনেক দিন পরে শুনি চেনা সেই গানটা। প্রতিদিন ধুলোর অনাবশ্যক আক্রমণ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসত সে। সেদিন এল অন্য রকম আনন্দ নিয়ে। তখনই বুঝেছিলাম আজ ওর মন রঙিন, আজ ভীষণ সুখের দিন। সত্যিই তাই হলো। কিছুক্ষণ পরে ফেরত দেয়া হলো আমার জীবনীশক্তির সর্বশেষ ও চতুর্থ অংশটুকু, যার অভাবে ছিলাম অসাড়, মূঢ়। পৃথিবী টিকে আছে শব্দের খেলায়। শব্দহীন জীবন কেমন অনর্থক মনে হয়! সোমার বদান্যতা আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দিল আবারো।
এর আগে একটি মাস কেন যে আশফাক আমার কণ্ঠ রুদ্ধ করে রেখেছিল, শুধু সেই হয়তো বলতে পারবে। বেচারা আশফাক, ঠুনকো আমাকে অপয়া ভেবেছিল। কিন্তু কী মহা অপয়া, অভিশাপের খপ্পরে পড়েছে তোমার সংসার, প্রিয়তমা স্ত্রী তুমি জানতেও পার নি।
আমি সেদিন শেষ বারের মতো গেয়ে উঠেছিলাম প্রতি ঘণ্টার গান। গেয়েছিলাম চিৎকার করে, প্রাণের সবটুকু শক্তি, সবটুকু আনন্দ নিয়ে। আমি গেয়েছিলাম মাঝরাতে, ঠিক বারোটায়। এরপরেও গেয়েছি ঠিক যখন সময় এল দুবার, পালা করে। তারপর হঠাৎ শুরু হলো সোমার দুঃস্বপ্ন।
ঘুমে অচেতন আশফাক, তার পাশে শয়নরতা সোমা। সেও ছিল ঘুমিয়ে কিন্তু সে ঘুম ছিল না আনন্দের, ছিল না পরিতৃপ্তির। বরং মুখভঙ্গিতে ছিল স্পষ্ট ভয়ের রেখা। নিজের গলায় হাত দিয়ে বারবার অদৃশ্য কোনো শ্বাপদের হাত সরিয়ে ফেলতে চাইছিল। হয়তো চিৎকার করে বলতে চাইছিল, বাঁচাও বাঁচাও! কিন্তু দম বন্ধ করা অন্ধকারের মাঝে হিংস্র কালো হাতের থাবা, আটকে দিচ্ছিল তার কণ্ঠ নিঃসৃত শব্দমালা। আর ওদিকে মুখোশধারী মূর্তিটা বারবার বলে চলেছে—তুই মর, তুই মর। শ্বাস রোধ হয়ে আসতে থাকে ওর। এভাবে ছটফট করতে করতে ভয়ংকর কিছু হলেও হয়ে যেতে পারত।
কিন্তু স্বস্তির কথা রাত তিনটা বাজল। আমার কথা বলার সময় চলে এল। চিৎকার করে উঠলাম তারস্বরে। তখন সোমার চাপা গোঙানি বেড়েই চলছিল হিংস্রতা কিছু একটার অবিশ্বাস্য আক্রমণে। আশফাকের গভীর নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে। সোমার আকুতির হাত তার পেটে সশব্দে পতিত হয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন দশা থেকে মুক্তি মেলে তার। চেয়ে দেখে নিজের থুতনির নিচে হাত দুটি দিয়ে কি যেন সরিয়ে দিতে চাইছে সোমা, অভিব্যক্তিতে ভয়ের ছাপ। সম্ভবত মৃত্যুর। কাঁদতে শুরু করেছে সোমা নিজের অজান্তে, ঘুমের মাঝেই ।
আশফাকের সজোর ধাক্কায় ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে সে। শুনতে পাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আর বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের বয়ান। কেউ একজন তাকে মেরে ফেলতে চাইছিল। সব ক্রোধ যেন ছিল তার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। জঠরাগ্রে বেড়ে উঠতে থাকা আগামীর স্বপ্নটাকে শেষ করে দিতে। বারবার বলে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো করে—আলোর মুখ দেখবে না এ ঘরে কোনো নতুন জীবন। সোমার ছ’মাসের নিরন্তর সাধনা, অনাগত বাবুটার জীবন প্রদীপ অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে যাবার অশনি সংকেত দিয়ে যায় সেই হন্তারক। শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে যাবে কালো একটা হাত।
রহস্যময় কালো মুখোশধারীটার শুধু একই কথা—তুই মর, তুই মর। প্রায় প্রতি রাতেই শ্বাসরোধ চেষ্টা আর ধস্তাধস্তি হতো মূর্তিটার সাথে। প্রথম দিকে যখন মুখোশধারী গলা টিপে ধরতে যেত, তখন মুখোশ ধরে টান দিলেই পালিয়ে যেত। এ রকম হয়েছে বেশ কিছু দিন। কিন্তু আস্তে আস্তে আরো রূঢ় রুদ্রমূর্তি নিয়ে সামনে এল মুখোশধারী। প্রতি রাতের স্বপ্নেই বাড়ছিল গোঙানির সময়। যদিও মুখোশ টেনে খুলতে পারে নি সোমা দুতিন মাসের উপরে, কিন্তু এ কাল্পনিক হাতাহাতির ফাঁকে প্রতিদিনই একটু একটু করে উন্মোচন হচ্ছিল আড়ালে লুকিয়ে থাকা জান্তব হাসি, পৈশাচিকতার নির্মম রূপ। সে রাতেই প্রায় মাস তিনেক পর স্বপ্নে সোমা লোকটার মুখোশ পুরোপুরি খুলে ফেলতে সক্ষম হয়। ঘুম থেকে উঠে ভয়ার্ত কণ্ঠে আশফাকের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে, সেই খুনি পশুটা আর কেউ নয় আব্দুল।
এখন ভীষণ হাসি পাচ্ছে আমার। হা হা করে হাসতে ইচ্ছা করছে। নিথর সোমার লাশটির স্তব্ধ পাপড়িগুলো মেলে দিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, মানুষ চেনো তুমি মেয়ে, চেনো না। কিচ্ছু জানতে না সোমা, কিচ্ছু না। মনের সবটুকু ক্ষোভ নিয়ে বললাম, তুমি নির্বোধ। এমনকি সরলও নও, খুব বোকাটে; একদম অবলা নারী। মৃত্যু তোমার নিজের হাতে আয়োজন করা। দেহ খাঁচায় কান্না দমকে দমকে আসে। ওকে খুব ভালোবাসতাম। তার হাসিতে হেসেছি, কান্নায় কেঁদেছি। এখন নিস্তব্ধ, নিথর দেহ পানে চেয়ে থাকতে হবে অনির্দিষ্ট সময়ব্যাপী, এর চেয়ে বড় দুঃখ আর হয় না।
জানলায় ভারী কাপড়ের পর্দা। পর্দার কঠিন প্রাচীর রক্ষা সুতোর ফাঁক গলে ভোরের দিকে ঘরে ঢোকে দু এক ফোটা আলো। এই আলো আসবার সময়টা দেখতে কী যে উন্মুখ হয়ে থাকি বলে বোঝাতে পারব না। আশ্চর্য এক স্নিগ্ধ অনুভূতির জন্ম হয় এই সময়টুকুতে। আমাকে ঘিরে থাকা বাতাসের কানাকানিতে শুনি প্রভাত সংগীত। কিন্তু আজ কোনো স্নিগ্ধতা নেই, আলো নেই, আনন্দ নেই। কোমল সজীব সকাল এখন কল্পনা—চারদিকে শুধুই কদর্যতার প্রদর্শনী। কাদার মতো থিকথিকে হয়ে আছে মেঝের রক্ত ও মেদ। অশ্লীলভাবে বেরিয়ে আছে গেলে দেয়া ভুঁড়ি নাড়ির অংশবিশেষ।
কখনো রাত দেখার সৌভাগ্য হয় নি ঘরের বাইরে গিয়ে। তবু অনুভব করতে পারি, কালো ছায়া কাটছে আলো, সকাল হচ্ছে। এই তো আর কিছুক্ষণ পর আসবে একটি দুঃসহ দিন।
কত কী হবে ঘরে কেই বা জানে?
হয়তো আশপাশের বাড়িগুলো থেকে নাম না জানা অনেক লোক আসবে, দুদিন পর হয়তো আশফাক আসবে। কান্না, দুঃখ, মূল্যহীন সান্ত্বনার বাণী প্রদান, সমস্তই হতে থাকবে আগামী দিনগুলোতে।
হয়তোবা আজকেও।
আর আমি শব্দহীনতার অভিশাপ নিয়ে সেগুলো শুনতে থাকব। সত্যিই ভাবা কঠিন কাল কিংবা পরশু সকালে কে এসে প্রথম দেখবে সোমার লাশ, পুলিশ নাকি আশফাক! আমি জানি না, সত্যি, ভাবতেও চাই না কান্নারত আশরাফের মুখভঙ্গির কথা।
আশফাকের সঙ্গে সংসার শুরুর পর থেকে সোমা খুব আনন্দেই ছিল। অনাথ সে, স্বামীটিও পিতৃমাতৃহীন। তাই দুজনার ঘরকন্না চলছিল ভালোই। সমস্যা দেখা দেয় অন্তঃসত্ত্বা হবার মাস তিনেক পর। সেই সমস্যার প্রকাশে আমিও অনেকটা জড়িয়ে যাই। রাত দুটোর সময় আমি কথা বললেই সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। প্রতিদিন একই স্বপ্ন। চিকিৎসায় তেমন কোনো ফল পাওয়া যায় নি। দু-তিন দফা বদল হয়েছে ডাক্তার। কিন্তু দুঃস্বপ্ন কমে নি বরং বেড়েছে।
মৃত সোমার নিথর ঠোঁটদুটোতে বিষ ঢেলে অন্তিম সুখ নিয়েছে খুনিটা।
প্রথম দিককার কথা, তখন স্বপ্ন দেখত সপ্তাহে দু-একটি করে। এর প্রাথমিক ফল হিসেবে সোমার প্রতিক্রিয়া হলো বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য। নিজের জগতে গুটিয়ে গেল সে। অফিসে আশফাক যাবার পর থেকে প্রচণ্ড একটা আতঙ্ক ঘিরে ধরত তাকে। সন্ধ্যার দিকে ঘরে ফেরার পর সবকিছু একদম ঠিকঠাক। এ আচরণকে সে নিজেই একবার ব্যাখ্যা করেছিল শিকারের ভয়ে ভীত একটা মায়া হরিণের সাথে। আশফাক ঘরে থাকলে সে যেন নিজের পুরুষের কাছে থেকে নিশ্চিন্ত বোধ করে। দিনকে দিন পরিস্থিতি হলো আরো অস্থিতিশীল, জটিল। দিনের একাকিত্ব অদ্ভুত নেশার মতো গ্রাস করল তাকে রাতের বেলাতেও। প্রথমে সপ্তাহ, পরে দু একদিন পরে পরেই দুঃস্বপ্ন ।
মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলির কথা। নতুন সংসার গুছিয়ে নেয়ার নানা পরিকল্পনা ঘুরছিল সোমার মাথায়। গান গাইত গুন গুন করে, সারাদিন অবিশ্রাম। ওর গানের গলা ছিল বেশ। পাশের বাড়ির মোনা ভাবির প্রশংসা শুনেছি বেশ ক’বার। আগে উনি মাঝেমাঝেই আসতেন। ওদের নতুন সংসারে আমি নব সংযোজন তখন।
আমার থাকার জায়গা ঠিক করা হয়েছিল খাবার ঘরে। ও নিজেই রান্না করত নানা ধরনের নতুন খাবার। আর আমি সেসবের গল্প শুনতাম। খাবার ঘরে যেদিকে ছিলাম তার ঠিক উল্টো দিকে সোমা দুটো তৈলচিত্র ঝোলায়। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম ছবিগুলো। একটাতে ফুল ভারে নত ফুলদানি। অন্যটি কিসের আমি বুঝতে পারি নি। মনে মনে ভাবতাম কি করে মানুষ আঁকে এমন সব ছবি? এত জীবন্ত! মানুষ আসলেই মহান, আমাকে যারা তৈরি করেছেন, সেই ঈশ্বরেরা মহাজ্ঞানী।
আজ সেই ছবিগুলোর কথা ভাবার পর, আমার কাছে আর জীবন্ত মনে হচ্ছে না। বিমূর্ত সেই চিত্রকলাটির নতুন এক মানে খুঁজে পেয়েছি আমি। এই ছবিটি একজন মৃত্যু ভয়ে কাতর মানুষের বেঁচে থাকার শেষ আর্তিটুকুর বয়ান, নিথর হয়ে যাবার আগ মুহূর্তের গোঙানি!
সোমার ভয় দূর করার জন্য সেই স্বপ্ন দর্শনের পর আশফাক অফিসে যায় নি দুদিন। এ দুদিন ঘুরে বেড়িয়েছে পুরোনো দিনের প্রেমিক জুটির মতন। পার্কের বেঞ্চিতে বসে হাতে হাত রেখে বসেছিল অনেকটা সময়। পুরোনো দিনের রোমান্সের স্বাদ দেবার জন্যেই লোকের অগোচরে আশফাক নিজের অধর স্থাপন করে বিষণ্ণ সোমার উষ্ণতা হারানো ঠোঁটে। তাদের ক্ষণিক মিলনের সবুজ করুণ খেলায় কিছুক্ষণের মধ্যেই হারানো হাসি ফিরে আসে শুষ্ক ঠোঁটে। ঘরে এসে এই কথা বলবার সময়ও সলজ্জ ছিল সোমার মুখ।
সেই ঠোঁটে এখন আর আকর্ষণ নেই, থাকতে পারে না। মৃত সোমার নিথর ঠোঁটদুটোতে বিষ ঢেলে অন্তিম সুখ নিয়েছে খুনিটা। মুখে কয়েকটা কামড়, আরো অসংখ্য আঁচড়ের দাগ। পারলে বোধহয় কাচা খেয়ে নিত। চাকু দিয়ে কেটে নিয়েছে সুপুষ্ট স্তন দুটো।
কী বীভৎস!
মানুষ এত নোংরা হয় আমার জানা ছিল না। সত্যিই অনেক জানলাম, অনেক শিখলাম আজ। এত বেশি তো শিখতে চাই নি! মহান ঈশ্বরের জাতি আমার সামনেই এমন পাপাচারে লিপ্ত হবে কোনো দিন ভাবি নি। ভাবতে পারি নি। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে এ অসভ্যতা দেখার পর থেকে। মনে হচ্ছে আমিও খুন করেছি বাহারউদ্দিনের সাথে সাথে।
মেঝের দিকে চোখ পড়ে আমার। হায় বোকা আব্দুল! পারলে না তুমি সোমার বিশ্বাস অর্জন করতে। দিন পনের আগে কেন ঢুকেছিলে শোবার ঘরে? আমাকে বাক্য দিতে, মুখে কথা বলার শক্তি, চলনের চাবিকাঠিটা তুলে দিতে? কোনো প্রয়োজন ছিল না তার। সেদিনের সেই ভুলের মাশুল দিলে আজকের মৃত্যু দিয়ে। তুমি নিজে হারিয়েছ এ বাড়ির বাবুর্চির পদ, এই সরকারি কোয়ার্টারে ঢোকার প্রবেশাধিকার আর তরান্বিত করেছ নিজের মৃত্যুক্ষণ। কী ভীষণ দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছিলে? হায়, বোকা আব্দুল।
সোমার রাগত ভঙ্গি এখনো মনে পড়ে। আব্দুলকে সে কখনোই পছন্দ করে নি। আব্দুলের রান্না আশফাকের পছন্দ বলেই কখনো কিছু বলে নি তাকে। অনাবশ্যক ছোক ছোক, খাজুরে আলাপ করতে আসা—এসবই অপ্রিয় ছিল তার। আর এই ঘটনার পরে আব্দুলকে বদলি করা হলো পাশের বাড়িতে। আর আব্দুলের বিদায় বাগানের মালীর জন্য হলো শাপেবর। এমনিতেই সোমা তাকে পছন্দ করত কম কথা বলার স্বভাবের কারণে।
যেমন করে আব্দুলকে নিয়ে ভুল করেছিল সোমা, তেমনি আমাকেও ভুল বুঝেছিল আশফাক। আমাকে ভেবেছিল অপয়া। আমাকে শোবার ঘরে নিয়ে যাবার পর থেকেই নাকি সোমার এই দুঃস্বপ্নের শুরু। তাই মাসখানেক আগে আমাকে বৈঠক ঘরে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। আর তাই বাহারউদ্দিনকে প্রথমবারের মতো দেখার সুযোগ হয়।
প্রায় সকালেই ফুল দিয়ে যেত মালী বাহারউদ্দিন। সংসার ছিল না বাহারের। বিয়ে করেছিল, একটা ছেলেও ছিল। তবে ছেলে এখন সাথে থাকে না। বহু আগেই বাপের সাথে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কেন গেছে তা বলে নি বাহার। আর বউ নাকি একবছরের দুধের ছেলেকে ফেলে পরপুরুষের সাথে ভেগে যায়। এইসব যাবতীয় গল্প সোমাকে বলত। চলে যাবার পর মা ছেলেকে একটিবার চোখের দেখাও দিতে আসে নি আর।
এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে ওর বউ কি সত্যিই পরপুরুষের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল? কোনো মা কি নিজের দুধের শিশুকে ফেলে যেতে পারে! অবিশ্বাস্য ওর গল্পটা। নাকি সে নিজেই মেরে গুম করে ফেলেছে তার লাশ? কেউ জানে না। তবে নিরাসক্ত নির্বিকার ভাব ধরার অভিনয় করেছিল চমৎকার। নিপুণ অভিনয়ে জয় করেছিল সোমার মন।
ওর দিয়ে যাওয়া ফুল সাজাত সোমার বসার ঘর থেকে শুরু করে শোবার ঘরটুকু। স্নিগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে বাহার উদ্দিন বশ করেছিল তার মন, হিংস্রতার মরণ কামড় দেবার জন্যে। প্রথম প্রথম ফুল দিয়েই চলে যেত। দিনে দিনে অবস্থিতি বেড়ে গেল। ফুল দিতে এসে এ কথা, সে কথা তুলত। সোমা ফুল নিয়ে ভিতরে চলে গেলেও সে ঘর থেকে বের না হয়ে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকত সোমা আর আশফাকের যুগল ছবিগুলোর দিকে। দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো কী দৃষ্টিতে ও দেখেছে আমি দেখি নি।
গত সপ্তাহ থেকে সোমার শরীর মন প্রায় সবসময়েই খারাপ থাকার কারণে বাহারউদ্দিন ফুল দিয়ে যেত নতুন কাজের লোক রহিমাকে। গত দুদিন কাজে যোগ দেয় নি সে। কাউকে কোনো খবর না দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কোথায় ছিল কেউ তা জানে না।
সকাল আটটা। পাশের বাড়ির কেউ এখনো টের পায় নি খুনের কথা। অবশ্য পাবেই বা কী করে? এত দূরে দূরে কোয়ার্টারগুলো, রীতিমতো বাংলো। তাই কখন পুলিশ আসবে, কখন এ দুঃস্বপ্নের সমাপ্তি হবে, জানি না। আশফাকের কথা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে। বেচারা, তুমি তোমার সন্তানের, স্ত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে ফেলে রেখে গেলে, কিন্তু কী হলো?
গতকাল আশফাক ঢাকা যায় অফিসের কাজে। কাল রাতে সোমার খুব ভালো ঘুম হয়েছিল নতুন ডাক্তারের চিকিৎসায়। তাই সকালে উঠে বলেছিলে আশফাকের সাথে সেও যেতে চায়। রাতের বেলা, এত বড় দোতলা বাড়িতে একা একা, তার জন্যে অস্বস্তির। কিন্তু অদ্ভুত শব্দের হাসি শোনা, দমবন্ধ ভাব কিংবা মৃত্যু সঙ্কেত সব তুচ্ছ করে দিল আশফাক। কিচ্ছু হবে না—এই চিরকালীন সান্ত্বনার বাণী দিয়ে চলে গেল। স্ত্রীকে চিরতরে হারাবে কি না, এমন ভাবনা সে কল্পনাতেও আনতে পারে নি একথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। অবশ্য আমিও ভাবতে পারি নি এমন কিছু হবে। হায় দুঃস্বপ্নের রাত!
রাত এগারোটায় সোমা দুটো কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে। বোধ করি আব্দুল কিছু টের পেয়েছিল বাহারউদ্দিনের গতিবিধি। সে ছিল বাড়ির দরজার ধারে। বাধা দেয়ার শব্দ, আব্দুলের প্রতিরোধ টের পাচ্ছিলাম ভেতর থেকেই। কিন্তু সোমা ছিল গভীর তৃপ্তির শেষ জাগতিক ঘুমে। এমন ঘুমুতে দেখি নি অনেক দিন।
কী আশ্চর্য, ক’মিনিট পরেই যার ঘুম হবে চিরদিনের, যখন আর জেগে ওঠা বলে থাকবে না কোনো প্রাত্যহিক রুটিন, সেটা যদি জানত সোমা এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে; তবে হয়তো ঘুমের ওষুধ দুটো খেত না। আমি চিৎকার করতে চেয়েছি বারবার কিন্তু পারি নি। কেউ কিছু শুনতেও পায় নি। জীবনচালিকা ছিল না আমার, ছিল না আর কোনো উপায়। লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে ছাড়ে নি মহাকালের মতো স্থাণু হয়ে থাকা ধূসর দেয়ালটা। মূঢ় আমি কেঁদে গেছি অনবরত। কিন্তু কোনো ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি নেই আমার, তাই দেখা যায় নি চক্ষু জল।
এমন প্রগাঢ় শোকের সময়ে গাইছি নাচছি; জানি না আর কতক্ষণ আমাকে এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।
হঠাৎ দরজায় ভীষণ আঘাত, ভেঙে গেল শোবার ঘরের প্রবেশদ্বার। অসুরের মতন শক্তি বাহারের শরীরে, সেটা কখনোই জানতে পারি নি। অবশ্য জানবার কথাও নয়। এর আগে দেখি নি কখনো তাকে। সোমার দিকে আগাবার আগেই আব্দুল আবার এসে ধরে ফেলে তাকে। আব্দুলের মুখে রক্ত, ঘুসিতে ঠোঁট ফাটা। বোধহয় সহকর্মী বলেই বাহারউদ্দিন তাকে মারতে চায় নি প্রথমে। এ ঘরে প্রবেশ মাত্র আব্দুলকে শুইয়ে দেয় লাথির আঘাতে। অণ্ডকোষ বরাবর প্রচণ্ড লাথি, ককিয়ে ওঠে আব্দুল। এর পরেই ছুরি বের করে খুনিটা। এফোঁড় ওফোঁড় করে চিরে দেয় আব্দুলের বিশাল ভুঁড়িটাকে। আমি আর্তনাদ করে উঠি নিজের মনে। আব্দুলের চিৎকারে ঘুম ভাঙে মৃত্যুর ডাক এসে যাওয়া সোমার।
বিহ্বল সোমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কণ্ঠনালী চেপে ধরে বর্বর লম্পটটা। কয়েক মিনিটেই নেতিয়ে পরে সে। এরপর মৃতের চরিত্রহনন আমায় স্তব্ধ করে দেয়। কী করে সেসব সহ্য করলাম জানি না। সামান্য আমাকে নিয়ত দেয়ালে ঝুলে থেকে, শক্তির যোগান পাওয়া মাত্র বেজে চলতে হয় মহাকালের আজ্ঞা নিয়ে জীবৎকালের সবটুকু ব্যাপী।
কত স্মৃতি যোগ হয় জীবনে, কিন্তু এমন অপঘাত সহ্য করতে হবে এমনটা ভাবি নি। ইচ্ছা করলেই চোখ দুটো বন্ধ করার স্বাধীনতা আমার নেই। জানি না আর কতক্ষণ এ জিনিস চোখের সামনে থাকবে আর তাকিয়ে দেখতে হবে।
যাবার আগে খুনিটা নির্মম রসিকতা করে গেল আমার সাথে। খাটের পাশের টেবিলে রাখা একটা পেন্সিল ব্যাটারি পেয়ে লাগিয়ে দিয়ে গেল। ইচ্ছে করেই করে গেল, কেননা লাগাবার পরে অসভ্য কণ্ঠের হাসি আর চোখে কৌতুকের ঝিলিক দেখতে পাই। রক্ত মাখা কালো হাতটা, আমার গায়ে লাগতেই ঘিন ঘিন করে উঠল দেহ।
এখনো আমার পিছনে রক্ত, সোমা আর আব্দুলের। পরবর্তী প্রতিটি ঘণ্টায় আমার নিম্নাঙ্গে থাকা দোলকের প্রেমিকযুগল নেচে উঠতে লাগল নিজস্ব নিয়মে এই মৃত্যূন্মাদ অন্ধকার সময়ে। আমার সমস্ত দিয়েও বন্ধ করতে পারি নি এই প্রেম-নৃত্য। আমি যে নিয়মের কাছে অসহায়। এমন প্রগাঢ় শোকের সময়ে গাইছি নাচছি; জানি না আর কতক্ষণ আমাকে এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। মুক্তি চাই নিয়তির কাছে, সহসা মিলবে বলে মনে হয় না।
সকাল নটা। আমি চিৎকার দিলাম। আজকের দিনের শেষবারের মতো। দরজায় খুটখাট শব্দ! কে এল আশফাক না পুলিশ? ও নিয়ে নিয়ে ভাবিত নই। আমি শুধু ভাবছি, যেই আসুক এ লাশ সরিয়ে নেবে। আমি খুলতে পারব আমার বন্ধ করা চোখ দুটো…