তখন আমার কতইবা বয়স, বড় জোর বার কিবা তের। সবেমাত্র ষষ্ঠশ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে সহপাঠি যাদের পেলাম তাদের মধ্যে আমার মামার শালক ‘শান্ত’ অন্যতম। আমি মাহারা। আমার জন্মের পর মা যখন পরলোক চলে গেলেন তখন থেকে আমি মামার বাড়িতেই মানুষ। মামার শ্বশুরবাড়ির দূরত্বটা একটু বেশি, ওই দুর্গম এলাকায় কোন উচ্চবিদ্যালয় না থাকায় শান্ত বোনের বাড়িতেই বিদ্যার্জন করতে আসে। সেই সুবাদে শান্তকে আমি বন্ধুহিসেবে পাই। একে মামার শালক তার পরেও বয়সে সে আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হতে পারে, সেকারণে তাকে আমি ‘তুই’ না বলে ‘তুমি’ বলে বলতাম। এর পরেও তার দেহের যা গঠন, সেই বয়সে সে পুরাদস্তুর নওজোয়ান। তার সামনে যেন আমি এক মশক। যদিওবা আমাদের সম্পর্কটা মামাভাগ্নের সেটা বলতে গেলে মামামামির গোচর পর্যন্ত।
দুনিয়াতে শান্ত যমকেও ভয় করত না কিন্তু মামার নাম শুনলে একশ চার ডিগ্রি তাপের চোটে হাতপা কাঁপতে লাগত। ওঁর সামনে দাঁড়ালে মনে হত ফেরেশতা যেন এরূপ। তার ছলের ঢং দেখে আমি মনে মনে হাসতাম আর বলতাম, শালার পুত, শয়তানের রূপ দেখলে তোরে দেখতে হয় আর এখন হয়চ ফেরিশতা। মাথা এমন নিচু করে থাকত যেন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কোন ফাঁসির দণ্ডিত আসামী। আমি মনে মনে হেসে বলতাম, চোরের কী ভক্তি দেখ। যতই সে দোষী হোকনা কেন, বলবে, আমার কোন দোষ নেই, ঐ রঞ্জু বেটাই ত করচে সব। শিয়ালের পুত সকল দোষ আমার ঘাড়ে চেপে সব সময় পার পেতে চাইত। আমি যতই বলি, আমি নির্দোষ। কে শোনে কার কথা। সুতরাং খইফুটার মতো পড়তে থাকত বেত। এরকম বহুত প্রমাণ দেওয়া যায়, তার দুষ্টবুদ্ধিতে শয়তানের নানিকেও হার মানায়। মিথ্যাকে এমনভাবে উপস্থাপন করত যেন খোদাপ্রদত্ত বয়ান।
যখন আমরা মেট্রিক পাস করলাম তখন আমাদের একটু বয়স বেড়েছে মনে হয়। কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি অতটা বেড়েছে বলে মনে হয় না। কারণ আমি প্রথমস্থান পাওয়াতে যত বেশি আনন্দিত হলামনা, তারচেয়ে অনেক বেশি আনন্দিত হয়েছি শান্তর দ্বিতীয় হওয়াতে। তার কি যে কান্নাকাটি! কাটা গায়ে যেন মামি আরও লবণ ছিটাচ্ছে, রঞ্জুর মুত খা গরু। মেয়েদের মতো কাঁদিস্ ক্যান্, লজ্জা লাগে না…বদমাশের ডাহা কোথাকার। আমার আনন্দ যেন মনে ধরে না। আমি মনে মনে হেসে–শালার পুতকে মামা এবার রামছাগলের বদলে গরুছাগল বলবে।
কিছু দিনপর আমরা কলেজে ভর্তি হলাম। রাতে খাবার টেবিলে বসছি। একটুপর দেখি ডাকাডাকি ছাড়া মামা এসে টেবিলে হাজির। সব সময় দেখতাম ডাকতে ডাকতে সকলে খেয়ে চলে যাচ্ছে তার পরেও ওঁ আসছে না। আজ দেখি খাবার সাজানোর আগেই এসে হাজির। শান্ত আমার দিকে, আমি শান্তর দিকে; আমরা সঙ্কোচে মুখচোরা বাঁদরের মতো একে অপরের দিকে চেয়ে আছি। মামা এসে বলল, কিরে, দুজন বিড়বিড় করছিস্ কেন? আর শোন্, কলেজে ভর্তি হয়েছিস্, আমি যেন কোন কিছু না শোনি। এখানে কেউ পড়তে যায় আর কেউ পড়তে যায়। মামার ইঙ্গিত কিন্তু দৌরাত্ম্যে বা দুরন্তপনায় নয়, ছিল মেয়ের্থে। শান্ত পড়া আর পড়ার অর্থ কী বুঝল জানি না, আমি তবে সহজে বুঝে নিতে পারিনি মামার ‘পড়া’ কথার অর্থটা। যাদের বুদ্ধি খাটো তারা মনে হয় একথার অর্থ মোটেও বুঝবে না। কারণ পড়া আর পড়া দুনোটাই যে একই শব্দ বরং চেহারাও এক, তা হলে আমরা পরিচয় পাই কীভাবে? এটার একটা সদ্গতি হওয়া উচিত ছিলনা? মামি বলল, কি, দুজনের মুখে কোন রা শব্দ নেই দেখি, খুব ভাল মানুষ বুঝা যাচ্ছে। এমন হলে ত আর কথাই ছিল না। আমি মনে মনে বললাম, আমার ব্যাপারে প্রথম পড়া বুঝতে পারেন আর আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে দ্বিতীয় পড়া। বাঁদর মরার সময়ও লাফালাফি ছাড়ে না আর এ ত বাঁদরের বাপ। শয়তানকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু আপনার ভাইকে নয়।
কলেজে তখন আমাদের এক বছর পার হয়েছে। বেশ সহপাঠি ও সহপাঠিনী বন্ধুবন্ধুনী জুটেছে। তন্মধ্যে স্বস্তির বন্ধুত্বটাকে সকলে অন্যতম ভাবত। কারণ ওর মতো সুন্দরী পৃথিবীজুড়ে খুঁজেও বোধহয় দুচারটা বের করা যাবে না। যেমন ছাঁট তেমন গায়ের রং, তেমন ফিগার, তেমন হাসি, তেমন চুলের ফ্যাশন। বলতে গেলে এ কলেজে সকলকে ছাড়িয়ে সে এক জন। অনেক ছাত্র পড়া কামাইয়ের চেয়ে তার সান্নিধ্যকামাই বেশি কামনা করত। শান্ত ত একেবারে পাগল। একদিন ওর দেখা না পেলে দিশেহারা হয়ে যেত, নিশ্চয় কোন অসুখবিসুখ।
আটই ফাল্গুন, সেদিন খুব ভোরে ওঠে শহিদমিনারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শান্ত আমার হাতে একটা ভাজ করা কাগজের টুকরো দিয়ে বলল, একটু পড়ে দেখ ত রঞ্জু কেমন হইচে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রসন্নতার এক অপূর্ব ভাব। বেটা ভিতরে ভিতরে দেখি শেষগোছানোর সম্পূর্ণ কাজ সমাধা করে আছে। তবে তাতে স্বস্তির কতটুকু সম্মতি এ চিঠিতে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। আমি হাসতে হাসতে বললাম–আরে, এটা কোন চিঠি হইল! না আছে ভাষার মান, না আছে লেখার শ্রী। এ চিঠি যেকেউ পড়লে ভূতের আছরের চেয়ে ভূত তাড়ানোতে তেড়ে আসবে। পরমুহূর্তে শান্ত দেখি মুখটা কাচুমাচু করে রেগেমেঘে বলছে, দে হারামজাদা, আমার চিঠি দে। তার এমন অশান্তরূপ আগে কখনো দেখিনি। আমি রাগের ছলে বললাম, নাও তোমার বেকার চিঠি। বরং এটা পানিতে গুলে ওষুধের ন্যায় খেতে পারলে দেখবে তোমার মাথায় কিলা ভাষার জোয়ার বইচে। আমার উদ্দেশ্য তাকে ঠাট্টার ছলে নাস্তানাবুদ করা। মনে মনে আরও বললাম, বেটা দাঁড়া, তোর পেমের ভূত তাড়াতে না পারলে আমার নাম রঞ্জু পোদ্দার না। যেকোনকিছুতেই মামামামির নাম উল্লেখ করলে নাকফোঁড়া মহিষের মতো কাবু।
শান্ত শয়তানের কলকাঠি নাড়াতে পারত ঠিকই কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন একটা খাটিয়েখুটিয়ে চলতে পারত না। কখনো কখনো এমনই কাণ্ড করে বসত যে, বোকাকেও হার মানাত। সেদিন আমার সঙ্গে রাগ করে যখন আস্ত চিঠিটাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলল তখন আমি মনে মনে হেসে বলছি, শালার পুত, কখনো যদি বোকার রাজ্য গড়ে ওঠত তা হলে তোকেই একমাত্র প্রধান করতে হত। হবুচন্দ্র কোথাকার।
যেকোন খেলাধুলায় এবং স্মরণীয়দিনোদ্যাপনে আমাদের কলেজমাঠটাই বলব একমাত্র প্রধানকেন্দ্র। আমরা যেকোন উৎসবে যোগ না দিলেও মহান ভাষাদিবসোদ্যাপনে যোগ দিবই। কারণ এ দিনটির মর্যাদা আলাদা। খালি পায়ে হাঁটা। ফুলে ফুলে শহিদমিনার ঢেকে দেওয়া। সমকণ্ঠে সম্মিলিতভাবে দেশের গান গাওয়া। শোকের এ দিনটিকে কখনো আমরা ভুলতে পারব না। না ভুলতে পারব ভাষার জন্যে ও স্বাধীনতার জন্যে রক্তদেওয়া সকল শহিদের অবদানের কথা। ওঁরা আমাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে গেছে। আমরা কীভাবে ওঁদের আত্মদানের কথা ভুলতে পারি। তাই মনে করি শহিদমিনারে শহিদদের সম্মানার্থে আমাদের ফুলদেওয়া মানে শুধু স্মরণ নয়, প্রার্থনাও বটে।
আমরা যখনই শহিদমিনারে ফুল দিতে আসতাম আমার কল্পনার মনজুড়ে ভেসে ওঠত ইতিহাসবর্ণিত অসংখ্য শহিদের মুখ। প্রায়ই দিতাম আমরা সাদাগোলাপ। সেদিন দিলাম জবাফুলের মালা। শান্তও এসে দেখি জবাফুলের মালা দিচ্ছে। দুজনের মিল শুধু এখানে নয়, অনেক ক্ষেত্রেও ছিল। তার ওঠদুটো কেমন কালচে হয়ে গেছে। আমার দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। চোখদুটো কেবল স্বস্তির দিকে। বটতলায় একঝাঁক ছাত্রছাত্রীদের আড্ডা চলছে। স্বস্তিকে সেখানে মধ্যমণি দেখা যাচ্ছে। আমি একটু তফাতে বসে আছি। মাঠে মানুষে সরগরম। দেশাত্মবোধক গানে বিমোহিত সব। স্বস্তি আমাকে দেখে ফিক করে হাসি দিল। আমিও তার সঙ্গে একটু করে হাসলাম। শান্ত দেখে যেন জ্বলেপুড়ে ছাই হয়। স্বস্তি আমাকে তাদের আড্ডায় ডাকছে। আমি ‘না’ করে চুপচাপ নিজের খেয়ালে বসে আছি। একটুপর দেখি শান্তকে ডাকছে। তাদের কতটুকু ঘনিষ্ঠতা হয়েছে আমি জানি না। তবে শান্তকে দেখে প্রেমে পড়বে না এমন বোকা মেয়ে বোধহয় পৃথিবীতে জন্ম নেয়নি। আমাদের সহপাঠিদের মধ্যে শান্তই অন্যতম। দশজনকে বাদ দিয়ে সে-ই আগে নজর কাড়ে। বলতে গেলে ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন ছিল একমাত্র শান্ত আর মেয়েদের মধ্যে সুদর্শনা একমাত্র স্বস্তি। কিছুক্ষণ আলাপের পর দেখি স্বস্তিকে বিরলে ডেকে নিল শান্ত। সেকি! আমাকে হিট দিয়ে দেখি তার হাত-একটা বুকের কাছে চেপে ধরল। কাগজের মতো দেখি কি যেন একটা হাতেও দিল। আমি রীতিমতো অবাক। স্বস্তি ইশারায় আমাকে বারবার তাদের নিকটে ডাকছে। আমি হাত দিয়ে জানালাম না যাওয়ার কথা। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা শেষ হয়ে চলল কিন্তু দুজনের কথার শেষ হচ্ছে না। জানি, এমুহূর্তে পৃথিবীর বিখ্যাতসব প্রেমকাহিনীর বর্ণনা কি শেষ না করে ওঠা যায় কখন। প্রেমের রূপ কেন এরকম হয় জানি না।
ঘরে এসে শান্ত কী করবে ভেবে কূল পাচ্ছে না। বিবেকের কাছে সম্ভবত বারবার লজ্জিত হচ্ছে। অপরাধ যা করেছে আল্লাহ্র আদালতে ক্ষমা পেলেও মামামামির আদালতে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়। তাই বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। হঠাৎ এসে আমার হাতদুটো ধরে বলছে, ভাগ্নে! তুই আমার বাপ। আমি সামান্য হেসে বললাম, কিরে মামু, তোমার মুখে আজ এত মধু ঝরে ক্যান্! দেখি মিনতির স্বরে বলছে, তোর দুটো পায়ে ধরি, এই কথা যেন তিন কান না হয়। আমি গম্ভীরভাবে বললাম, তিন কান ত হয়েই গেছে। সে মুখটা মসিকালো করে বলল, আপা কি জেনে ফেলেছে? আমি হাসতে হাসতে ঠাট্টাগলায় বললাম, বোকার পুত, তোর মতো এক জন বোকার জন্ম হলে দশ জন বুদ্ধিমানের বুদ্ধি লোপ পায়। সে কিছুই বুঝতে পারল না। কতূহলে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে থাকল। আমি বললাম, তোমার বুঝার ক্ষমতা আবার কোন জন্মে যদি হয় তবে হবে কিন্তু এজন্মে সেই আশা করা ভুল। তুমি আমি সে। বুঝিয়ে বললে গরুও বুঝে। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।
আমাদের বন্ধুত্বটা যত বেশি আমোদের তারচেয়ে ঝগড়াঝাটিও কম ছিল না। কথায় কথায় রাগবিরাগ-মানাভিমান নিত্যনৈয়মিক ছিল। তবে শান্ত এসব রাগবিরাগ-মানাভিমান বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারত না। তার মনটা ছিল পানির মতো কোমল। অনেক সময় মাতামাতি বন্ধটা দিনদুয়েকের বেশি স্থায়ী হলে বেথ করে কেঁদে দিতেও দেখা যেত। তার তুলনায় আমার মনটা জানি কেমন একটু কঠিন ছিল। আমি যেদিকে তাকাব না বললে সোনা ঝরলেও আর সেদিকে তাকাই না। সৃষ্টিকর্তা কেন জানি একেক সৃষ্টির মধ্যে একেক রহস্য লুকিয়ে রাখে।
শান্তর অশান্তভাব দেখলে তখন চণ্ডীদাসের কথা মনে পড়ত। সে যেন দিনের দিন কেমন হচ্ছে। চেহারার রোনক দিনদিন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। প্রেমে পড়লে বুঝি মানুষ এভাবে মজে যায়? এ নিয়ে আমাদের সহপাঠি বন্ধুবান্ধবীদের মধ্যে কতূহলের শেষ ছিল না। অনেকের মধ্যে হাসাহাসির ব্যাপক রংতামাশাও ছিল। কেউ কেউ কানাঘুষায় জ্বলেপুড়ে বলত, আমরা বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি নতুন একটা অমরপ্রেমের ইতিহাস সৃষ্টি হতে দেখব!
দুচার মাসপর দেখা যাচ্ছে শান্ত মধ্যে মধ্যে হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিয়মিত কলেজ যাবে দূরের কথা, ঠিকমতো ঘুমোতেও পারে না। কি অসুখের তাড়নায়, কি স্বস্তির প্রেমের কারণে তখন ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। সব সময় একধরণের অস্বস্তিবোধ করত। আর তখন খুব লাচার মনে হত। কিছু প্রেম মানুষকে মহামানবে পরিণত করে। আর কিছু প্রেম মহান থেকে শয়তানে। প্রেমের প্রকৃতি কিন্তু এক। তবে আকৃতি মনে হয় দুই। শান্তর আকৃতি তবে বুঝা যাচ্ছিল মহৎ। বয়সে আমার বড় হয়েও এখন আমাকে খুব মানে, পরামর্শ করে, বুদ্ধি চায়। মধ্যে মধ্যে আমিও ঠাট্টা করে বলতাম, সারা জনম কইচ আমার বুদ্ধি যে লবু তার মাথায় কাউয়া হাগে আর এখন কথায় কথায়–একটু বুদ্ধি দে ভাগ্নে…আমি যেন বুদ্ধির ঘটি।
একদিন ছুটির পর হল থেকে বের হয়ে আমি একলা মাঠের দখিন পুকুরপাড়ের নির্জনপথটি ধরে চলছি। হঠাৎ পিছন থেকে শোনছি স্বস্তির আওয়াজ–রঞ্জু, একটু দাঁড়াও! আমি থমকে দাঁড়ালাম। স্বস্তি এসে বলল, আজ এ পথ দিয়ে কেন? আমি বললাম, জানি না। তবে কান্তার কূল যেতে এ পথটা সংক্ষিপ্ত মনে হল। সেখানে কেন বা কার কাছে যাব সেই প্রশ্ন আর স্বস্তি করেনি। শান্তকে কান্তার কূল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তখন তিন দিন। আমাকে বলল, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে, যদি নিমতলায় একটু বসতে। আমি হেসে বললাম, ঠিক আছে। মনে মনে ভাবছি শান্তর সম্বন্ধে অজানা কিছু জানতে চাইবে বোধহয়। দেখি না, যা বলল অবাক হওয়ার কথা। আমাকে সে ভালবাসতে পারে এমন কল্পনা ত স্বপ্নেও করা যায় না। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, এটা ত বেইমানি। এমন হলে মেয়েদের প্রতি পুরুষের আস্থা একেবারে উঠে যাবে। তোমাকে একজন পাগলের মতো ভালবাসে। আর যে ভালবাসার কথা পৃথিবীর মাটি থেকে আকাশের তারা পর্যন্ত কারও অজানা নেই। তার কথা অন্তত একবার হলেও ত মনে করা উচিত। কাউকে দুঃখ দিয়ে হয়তো ক্ষণিকের জন্যে সুখ পাওয়া যায় তবে চিরশান্তি লাভ করা যায় না। স্বস্তি দুঃখপ্রকাশ করে বলল, কারও সম্বন্ধে পুরোপুরি তথ্য না জেনে এরকম যুক্তিহীন মন্তব্য করা কি ঠিক? আমি আশ্চর্য অনুভব করে বললাম, মানে? সে বলল, শান্ত আমাকে ভালবাসে ঠিক কিন্তু আমি কখনো শান্তকে ভালবাসতে পারিনি। আমি মনেপ্রাণে সব সময় তোমাকেই কামনা করছি রঞ্জু। আমি অবাক হলাম–বললাম, সেকথা শান্ত জানে? সে বলল, জানে। তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলার কথা বললে আমি আরও অবাক হলাম এবং দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম, এটা তুমি ভাল করনি স্বস্তি, যে তোমাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসে তাকে তুমি অবহেলা করলে। আর যাকে তুমি ভালবাসলে সে তোমাকে স্বপ্নেও কোনদিন কল্পনা করেনি। আমার মধ্যে এমন কী আছে বল? না আছে আমার কোন গুণ, না আছে আমার শ্রী। সুতরাং আমাকে ভালবাসা মানে অসুন্দরের সঙ্গে গলাগলি করা। শান্ত বিরাট ঘরের ছেলে। রূপেগুণে শান্তর মতো ছেলে তুমি দেশজুড়েও খুঁজে পাবে না। সে আজকাল খুব অসুস্থ। হয়তো এটা তোমার অবহেলার কারণ। এটা শোনার পর স্বস্তি কেঁদে ফেলল। যতই বিপদ হোক, তক্ষুণ্নি শান্তকে দেখার আগ্রহপ্রকাশ করল। আর বলল, আমি ত রূপ আর গুণ কী জিনিস জানি নে, শুধু আমার মন বলল তোমার চেয়ে ভাল জীবনসঙ্গী আমার আর কেউ হতে পারে না। তোমার নীরবতায় কেন জানি আমাকে তোমার কাছে টানে। এটা আমার অপরাধ হতে পারে তবে মনের দোষ নয়।
হাসপাতালে ক্যাবিনে ঢুকে দেখলাম নানি পাশে বসে শান্তর মাথায় হাত বুলাচ্ছে। মানে তার মা। শান্ত বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। ছোট্ট একটি টুলে বসে আছে নেনু। অর্থাৎ তার ছোট বোন নাহিনা। আদর করে সকলে ডাকত ‘নেনু’। আমাদের দেখে টুল ছেড়ে বলল, বসেন। নানি বলল, নাতি, শান্ত তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে করতে এমাত্র ঘুমোইচে। স্বস্তিকে দেখে বলল, ও কে? আমি বললাম, আমাদের সঙ্গে পড়ে। বাড়ি ডেওতলা। ওর বাবার বিরাট কারবার। জুতার কয়েকটা কারখানা আছে। শান্তকে দেখতে এসেছে। আমার উদ্দেশ্য ছিল স্বস্তিকে চিনানো। কারণ তার রূপের কাছে বুড়ির বংশের গরব কত টিকে দেখতাম। যার জন্যে বুড়ির মনে বহুত বিষ ঝরত। শান্তকে কত গালমন্দ করত, কনো অবংশের মেয়ে যেন্ আমার শ্বশুরচধুরিবাড়িতে না ঢুকে। আমি মরার পর তোর যেন্ ইচ্ছে করিস্। এর কারণ হল, বুড়ি কার কাছে শোনেছে স্বস্তির বাবা একজন মুচি থেকে মানুষ। হোকনা তাই। তাই বলে কি মুচিরা মানুষ নয়? দেখলাম, বুড়ি স্বস্তিকে চিনতে পারেনি। নেনু ঠিক চিনেছে, ও স্বস্তি না? আমি বললাম, হাঁ। এমন সময় দেখি মামি আসছে। মামির পিছে পিছে দেখি একজন নার্সও আসছে–এসে বলল, কেউ একজন অফিসে আসেন। নানি মামিকে বলল, রঞ্জুকে নিয়ে তুই যা। স্বস্তিকে বলল, মা, তুমি আমার পাশে বস। মামি স্বস্তিকে দেখলে নানি বলে, ও শান্তদের সঙ্গে পড়ে, তাকে দেখতে এসেছে। আমাকে লক্ষ্য করে–কি নাম জানি বলল নেনু? আমি নীরব দেখে নেনুও কিছু বলল না। নানি নিজে নিজেই স্বস্তির নামোচ্চারণের ব্যর্থ চেষ্টা করল, স-হ-তি…কি জানি…আমার মুখে আসবে না রে ভাই। মামি স্বস্তিকে তখন কতটুকু চিনেছে জানি না তবে আচরণে মনে হল না সম্পূর্ণ চিনেছে। কিবা শত্রু নিজেই ঘরে এসেছে বলে বিধি লঙ্ঘন করেনি কে জানে।
ডাক্তারের রিপোর্ট দেখে আমরা যেন পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলাম। মামির কী কান্না। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ্, শান্তর পরিবর্তে তুমি আমাকে নিয়ে যাও। তবু ওর জীবনটা ফিরিয়ে দাও। তার সব আছে, আমার ত কেউ নেই। তার জীবনটা অনেক মূল্যবান। মামির চোখে দেখেছি সেদিন ভাইয়ের জন্যে একজন বোনের কতটুকুন ভালবাসা। আমাকে বলল মামা ছাড়া আর কাউকে জানাবে না একথা। আমি বললাম, ঠিক আছে, এটাই ভাল হবে। ক্যাবিনে এসে আমি গম্ভীর বসে আছি। মামি বসে হাসিখুশি ভাব দেখাচ্ছে। নানি জিজ্ঞেস করল, সানু, ডাক্তার কী বলল? আমার মনে এমন কেন লাগছে জানি না। মামির নাম সাহানা। সবাই তাকে ‘সানু’ বলে ডাকত। ওঁরা তিন ভাইবোনের মধ্যে শান্ত মধ্যম। মামি বলল, কোন চিন্তা করো না ত মা, এরকম রোগবালাই কি মানুষের হয় না; সব আল্লাহ্র ইচ্ছে। ওনি সহ্যের বাইরে কাকে কষ্ট দেন না। যে যত সহ্য করতে পারে তারচেয়ে আরও কিছু কম। যত কষ্ট দেন তারচাইতে আরও বেশি দয়াও করেন। যিনি দেওয়ার মালিক, নেওয়ার অধিকারও তাঁর। মামির পেঁচানো কথা নানি কিছুই বুঝতে পারল না। একথা-ওকথা ঘুরাতে ঘুরাতে বারবার আসলকথা এড়িয়ে চলছে। শান্তর ফুসফুসের ক্যান্সার ধরা পড়েছে! একথা সে একজন মাকে কীভাবে বলবে। কারণ সেও ত তখন একজন মা। আর মাদের হৃদয়ের কথা মা ছাড়া বেশি আর কে জানে।
শান্ত জেগে ওঠল। সবার সঙ্গে স্বস্তিকে দেখে আশ্চর্য হওয়ার চেয়ে বোধহয় অনেকবেশি খুশি হল। মনে মনে সম্ভবত প্রভুর কাছে প্রার্থনা করল, খোদা, এ-জীবনে আর স্বস্তিকে পাওয়ার আশা করি না, ও-জীবনে যেন সে আমার হয়। স্বস্তিকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তার। গত দিন আমার কাছে প্রকাশ করেছে সেই ইচ্ছের কথা। এমন দুরাশা যখন প্রভু পুরুন করেন তখন প্রভুর প্রতি যেকারও অমন আস্থা বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। যে আস্থা শান্তর বেড়ে গিয়েছিল তখন। স্বস্তিকে না পাওয়ার কোন আফসোস ছিল না। তবে তার কোন সদ্গতি দেখে যেতে পারল না বলে একটা দুঃখ বোধহয় মনের কোথাও ছিল। প্রকৃত প্রেম একপ্রকারের এবাদত।
শান্তর দুচোখ বেয়ে বয়ে যাচ্ছে কান্নার জল। মামি তার চোখের পানি মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল, কাঁদছিস্ কেন? সে বলল, আপা, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। নেনুকে ডেকে বলল মাকে নিয়ে বাড়ি যেতে। আমাকে ইশারা করে বলল স্বস্তিকে নিয়ে যেন আমি থাকি। কিছুক্ষণপর নেনু এবং নানি চলে গেলে মামিকে বলল তার পাশে বসতে। আমাকে বলল তাকে যেন একটু হেলান দিতে পারে মতো সোজা করে বসিয়ে দিই। দরদের কণ্ঠে মামিকে বলল তার সব জানা হয়ে গেছে। মামি কেঁদে বলল, কী জেনেছিস্ তুই? সে বলল, আল্লাহ্ অন্তরে আছে। সে সবকিছু মানুষকে জানান দেয়। কিন্তু সবাই উপলব্ধি করতে পারে না। সে মরে গেলে তার বাবার কবরের পাশে যেন তাকে কবর দেয়। এবং মাকে যেন সান্ত্বনা দেয়। সন্তানহারাশোকে প্রত্যেক মা পাগল হয়। এ সে স্বস্তি। স্বস্তিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল। দুনিয়াতে যাকে সে বেশি ভালবেসেছে। অবশ্য বলল এ ভালবাসা তার একার। স্বস্তির দিকে চেয়ে সান্ত্বনার হাসি হেসে বলল, ও রঞ্জুকে খুব ভালবাসে। বরং সেটা ওর দোষ নয়। মন আমাদের কিন্তু মনের মালিক আমরা নই। বোনের হাতদুটো ধরে অনুরোধ করে বলল, আপা, ও খুব ভাল মেয়ে। সকল হিংসেবিদ্বেষ ভুলে ওকে রঞ্জুর প্রতি বরণ করলে মরলেও আমি শান্তি পাব। বংশ দিয়ে মানুষের পরিচয় নয় বরং কর্ম দিয়েই পরিপূর্ণ মানুষ। তখন মনে করো রঞ্জুর মধ্যে আমি আছি। আমাদের মিলবন্ধনটা দেখে যেতে পারবে না বলে দুঃখটা থাকবে। মামি কেঁদে স্বস্তিকে জড়িয়ে ধরল। স্বস্তি কেঁদে বলল, শান্ত, আজ থেকে আমি তোমাকেই ভালবাসি। একথা একজন মুমূর্ষুকে খুশি করার লক্ষ্যে বলা সেদিন অস্বাভাবিক মনে হল না।
শান্ত আর বেশি দিন বাঁচল না। তার মৃত্যুতে বোধহয় আমার চেয়ে বেশি দুঃখ কেউ পায়নি। যদিওবা সে আমার রক্তের কেউ নয়। তবু মনে করি বন্ধুত্ব এমন এক জিনিস যা রক্তের চেয়ে কম নয়। অশ্রু যা আড়ালে ঝরছে আল্লাহ্ ছাড়া বেশি আর কেউ দেখেনি। তার মৃত্যুর পর নিজেকে আমি অসহায় মনে করলে স্বস্তি সান্ত্বনায় আমার আরও কিছু কাছে আসে। তবু শান্তর অপূর্ণীয় ক্ষত পুরুন হবে মনে হল না। হোক সে একজন অতুলনীয়া। প্রেম আর বন্ধুত্ব এক নয়। যেখানে যাচ্ছি শান্তর ইয়াদ ছাড়া কিছুই মনে আসছে না। তার হাসিঠাট্টা-মান-অভিমান সব সময় আমার সঙ্গী হয়ে চলছে। ডাহুক মরে গেলে ডাহুকি যেমন মরে যায়। কিবা ডাহুকি মরে গেলে ডাহুক যেমন আর বাঁচতে চায় না। শান্তকে হারিয়ে তেমন বেগতিক পথ চলছি আমি। কিন্তু…
আমার মুখের কথা নয়। অনেকের বলাবলিতে : কারও মুখে হাত দেওয়া যায় না–যেপ্রেম আগে কখনো হয়নি সেপ্রেম আবার রঞ্জু পোদ্দার আর স্বস্তি ঋদ্ধারের মধ্যে সৃষ্টি হতে চলল? অনেকে ‘না’ বললেও অনেকের ‘হাঁ’ শব্দ শোনা যাচ্ছিছিল। প্রেমের সৃষ্টি ত নিত্যনতুন আছেই তবে মানুষের বলাবলি কানাঘুষা এসব আর নতুন করে সৃষ্টি হওয়া লাগবে না। এসব পুরাতনের গণ্ডিতে চিরাবদ্ধ থাকবেই। যতটুকু রটেছে অত ঘনিষ্ঠতা মনে হয় আমাদের ছিল না। তবে হাঁ, শান্তর অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে কিছুটা যে ছিল না এমন কথাও নয়। কিছু রটে ত কিছু বটে। তবে স্বস্তির ব্যাপারে কেন জানি আমার মধ্যে একটা সঙ্কোচ কাজ করত। অনেকের মতে সেটাকে গভীরপ্রেম বললেও আমার মতে অপ্রেমটাই বেশি বলব।
একদিন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে বাস্তব যমের দেখা পেলাম। গাড়িদুর্ঘটনায় পা একটি ভেঙে দুই টুকরো হয়নি কপাল ভাল। তবু কৃত্রিম পায়ের আশ্রয়ে মাস ছয়েক চলতে হল। স্বস্তি প্রথম দুয়েক মাস বেশ আসাযাওয়া করছে। তারপর আস্তে আস্তে কেন জানি দূরত্ব বজায় চলছে। কারণ কিছুই মাথায় আসছে না। পা মোটামুটি চলার অক্ষম না রইলেও ভাগ্য খারাপ চোখটির আর শুভদৃষ্টি ফিরে এল না। মনে হয় স্বস্তিকে অবহেলার এ পরিণতি। কথায় আছে, মানুষের মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান। এক চোখ দিয়ে এবার পৃথিবীর অপূর্বতা দেখার চেয়ে স্বস্তির সৌন্দর্যই বেশি দেখব আশা করলাম। কিন্তু ভাগ্য যেখানে বিপরীত সেখানে সবকিছুই নির্মম হয়। স্বস্তির দূরত্বের কারণ জানতে পারলাম সে যাকে ভালবেসেছে সে রঞ্জু আমি নই! কারণ, সেই রঞ্জু সক্ষম এই রঞ্জু অক্ষম। কোন কানাখুঁড়াকে সে ভালবাসতে পারে না। আমি প্রথমবার আকাশ থেকে পড়লাম।
সবকিছু ভুলে মামার ব্যবসায় মন দিলাম এবার। ওঁর দুঃখটা কতটুকু ঘুচাতে পারলাম জানি নে তবে বুঝা যাচ্ছে মনে খুব ফুর্তি। ওঁ এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। আমার তবে ব্যস্ত সময় পার হচ্ছে। মনে করি জীবনে উত্তীর্ণ হতে হলে অনেক কিছু ত্যাগ দিতে হয় এবং অনেক কিছু ভুলে যেতে হয়। নাহয় সঠিক গন্তব্য মিলা কঠিন। যার কাছ থেকে দুঃখ মিলে তাকে বারবার স্মরণ করে জীবনের গতি রুখে দেওয়া বোকামি। কয়েক বছর কেটে গেল। একদিন শুনলাম স্বস্তি বড় ঘরের ঘরনি–একেবারে রাজবধূ। আনন্দে ভরে ওঠল মন। যাক, শান্তর মনোকামনা নাইবা পুরল অন্তত আমি ত দেখে যেতে পারলাম তার সুখ। হিংসে আমার মোটেও হল না। কারও সুখে হিংসে যারা করে তারা মানুষ হতে পারে না। আমি মানুষ হতে চাই, হিংসুক নয়।
বেশ কিছু দিন কেটে গেল। আরেকদিন শুনলাম স্বস্তির সমস্ত গা ছেয়ে গেছে বসন্তগোটার মতো কি একধরণের রোগে! চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যথানুভূতিহীন এ রোগের নাম কী বলে জানি না তবে সচরাচর লোকের মুখে শুনা যায় ‘চর্মকর্কট’। দেশবিদেশ ঘুরে এ চিকিৎসার অন্ত রাখেনি। শরীর নাকি বিশ্রীরকমের হয়ে গেছে। অবশেষে স্বামী ত্যাগ করছে। পাগলের মতো হয়ে বর্তমানে বাপের বাড়ি আছে। এখন বারবার আমাকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করছে! আমি দ্বিতীয়বার আকাশ থেকে পড়লাম।
ইতোমধ্যে অনেক দুঃখবিষাদের মুহূর্ত আমার জীবনেও এসেগেল। মামা মারা গেল। মামার শোকে শোকে মামিও আরেকদিন ওপারে চলে যায়! আমাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন বোধহয় মামার ছিল। আমার জন্যে একশ এক পাত্রী দেখেও আমার ‘হাঁ-সম্মতি’ পাননি বলে দুঃখটা সম্ভবত সঙ্গে নিল। মামা যতই শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান লোক হোক কিন্তু আমার মতো লোকের মনের দুঃখটা বোঝার ক্ষমতা কোন বুদ্ধিমানের থাকতে পারে বলে মনে হয় না। একে ত আমি অক্ষম দ্বিতীয়ত…
অতঃপর অনুভব করলাম আমার কাঁধে দায়িত্বের ভার। আট-দশ বছরের দুই মামাত ভাইবোনকে মানুষ করার একমাত্র কর্তব্য। দিন একরকম কেটেই যাচ্ছে। আরেকদিন হঠাৎ হাসপাতালের অপরিচিত এক ফোনকলে আমি শুধু বিস্মিতই নই একেবারে বাকহারা বলতে হয়। কে যেন আমার জন্যে চোখ দান করে গেছে! আমার চোখের শুভদৃষ্টি ফিরে এল কিন্তু চলে গেল শুভপল। আমার দৃষ্টিদাতার নাম ‘স্বস্তি’! আমি তৃতীয়বার আকাশ থেকে পড়লাম। স্বস্তি একটা চিঠি লিখে আত্মহত্যা করছে। অপরাধ কিবা ভুল তার মর্মপীড়াই তাকে বাঁচতে দিচ্ছে না। জীবনের পরিসমাপ্তিই একমাত্র প্রায়শ্চিত্তবোধ। কী আর করি, প্রতিদিন তার কবরে একমুঠো ফুল দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু ফেলে বাকি জীবন কেটে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করি।