পৌষের হঠাৎ নামা শীতে গ্রামটা যেন গুটিয়ে গেছে হুট করেই। শীত বেশ হালকা ছিল সপ্তাহখানেক আগেও। বলা নেই কওয়া নেই গত সপ্তাহ থেকে শীত বুড়ি ছানাপোনাসহ হানা দিয়েছে গ্রামে। কুয়াশা জেঁকে বসছে সূর্য পশ্চিমে হেলার সাথে সাথেই। যে কারণে গ্রামের ছেলে, বুড়ো, জোয়ান, সবাই সন্ধ্যা নামতে না নামতেই যে যার কাজ সেরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে আরামদায়ক উষ্ণতায়। উষ্ণতা বলতে অধিকাংশেরই অবশ্য কপালে জোটে মাটিতে খড়বিচালি বিছিয়ে তার ওপরে খেজুর পাতার পাটি, ওপরে একটা দুটো ছেঁড়া-ময়লা কাঁথা। গায়ে জোটে বহুকালের পুরোনো, তেল চিটচিটে বিবর্ণ ওয়াড়হীন লেপ। কারও কারও আরও কম। মোটা দু চারটে কাঁথার তলে সেঁধিয়েই তারা দিব্যি কাটিয়ে দেয় শীতের কয়েকটা মাস। সে নিয়ে তেমন কোনো আক্ষেপও নেই কারও। জন্মাবধি শীতকে এভাবেই বরণ করে আসছে পুরো গ্রাম। শৈত্য মোকাবেলার এই অনাতিশয্য তাই মোটেই অস্বাভাবিক নয় কারও কাছেই। রাহেলার শীতটা বরাবরই বেশি। আজ আরও বেশি লাগছে। বহুকালের পুরোনো ওয়াড়হীন লেপটার নিচে নিজের তাঁতের ছেঁড়া শাড়িটা ভাঁজ করে নিয়েও শীতে ঠকঠক কাঁপছে। একটু আগে বাড়ির পেছনের খেজুর গাছে লাগানো রসের ভাঁড় ছোটভাই আব্বাসকে দিয়ে পাড়িয়ে পরপর দু গ্লাস খেয়েছে। শীতের রস। কড়া মিষ্টি। কনকনে ঠান্ডা। খাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল যেন তরল বরফ ঢালছে গলায়। দাঁতগুলো কামড়ে ধরছিল ঠান্ডায়। তবু শীতের খেজুর রস খাওয়ার আনন্দের তুলনায় এই সমস্যাটা অতি নস্যি ঠেকেছে তার, অতীব তুচ্ছ।
চোখ বুজে খেয়ে নিয়েছ ঢকঢক। আহ্! শীতের এই এক মজা। আল্লার খাস রহমত। সকালে খেলে মজাটা আরও বেশি পাওয়া যাবে। আপাতত দু গ্লাস খেয়েছে রাহেলা। সকালে বাকিটা দেখা যাবে। সকাল হতে হতে ভাঁড়ে রস জমবে অনেক। তেমন বেশি হলে খেজুর রসের পায়েসও হতে পারে। কদিন আগেই ধান কাটা পড়েছে। এখন পিঠা পায়েস খেতে তেমন আপত্তি করবে না মা হাজেরা বানু। অন্য সময় পিঠা পায়েসের নাম শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে তার মা। শুধু এই নতুন ধানের মওসুমে তার মন-মেজাজ বেশ ফুরফুরে থাকে। তাদের বুড়ো বাপের সাথেও এসময়টায় হাজেরা বানুর পিরিত যেন ঘন হয় আরও। রাহেলার তেমনই ঠেকে। ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায়ও জ্বলে। বুড়ির ঢঙ দেখ!—নিজের মনেই গজগজ করে মাঝে মাঝে। খেজুর রসের প্রভাবে শীতে হি হি কাঁপতে কাঁপতে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল রাহেলা। পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। টিনের চালায় নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে টুপটাপ শিশির ঝরার শব্দ বাজে শুধু। ভাই আব্বাস বারান্দায় ঘেরা জায়গাটাতে চৌকি পেতে ঘুমোয়। তার নাক ডাকার আওয়াজ আসছে কানে। পাশের রুমে মা হাজেরা বানু আর বাপ আক্কাস আলীর প্রেম-পর্বও সারা হয়েছে সম্ভবত। অনেকক্ষণ আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিত।
রাহেলার কোনো পিছুটান নেই। বিয়ে হয়েছিল অল্পবয়সে। শ্বশুরবাড়ির সাথে বনিবনা না হওয়ায় চলে এসেছিল বছর খানেকের মধ্যেই। একটা মেয়ে হয়েছিল সে ঘরে। মেয়েটা আঁতুড় ঘরেই মারা গেছে। ল্যাঠা চুকেছে। বর তাকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে সেই কালেই। রাহেলার বিয়ে নিয়ে তার বাপ-মাকে তেমন একটা তোড়জোড় করতে দেখা যায় নি আর। সে নিয়ে অবশ্য রাহেলারও বিশেষ খেদ নেই। সংসার মানেই দাসত্ব। বন্দি পাখির জীবন। তারচে এই বেশ আছে সে। ইচ্ছেপাখির দাসত্ব। কারও চোখ রাঙানির তোয়াক্কা নেই। সমাজের সাথে কোনো বিরোধ নেই তার। সমাজ মুখোশ ভালোবাসে, মুখ নয়। মুখোশে আপত্তি নেই রাহেলার। তার শুধু চাই উড়তে পারার সুখ, চড়তে পারার আনন্দ।
একতরফা সুখে তার বিশ্বাস নেই। দুঃখেও। সে সুখ কেনে সুখের বিনিময়ে।
যুদ্ধে শীতকে কাবু করে রাহেলা ঘুমকে জয় করে ফেলেছিল প্রায়। আবেশে বুজে এসেছিল দু চোখের পাতা। হঠাৎই উৎকর্ণ হলো কান। ভীত, অনভ্যস্ত হাতের দ্বিধাগ্রস্ত শব্দ। কিন্তু এ শব্দ আজ হওয়ার কথা নয়। আজ কারও সাথে কোনো রফা হয় নি তার। এই শীতে সেই প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে এই শব্দের অর্থ কী? কে করছে এমন শব্দ? কেনই-বা? নির্দিষ্ট কিছু মানুষ তার নির্দেশিত সময় মাফিক গভীর রাতে টোকা দেয় তার ঘরের পেছনের টিনের বেড়ায়। সে টোকার একটা বাধা ছন্দ আছে। তাতে রাহেলা বোঝে যা বুঝার। সন্তর্পণে বের হয় ঘর ছেড়ে। আদিমতম সুখ কিনে সে ফেরত আসে নিজের ডেরায়। বিকিয়েও। একতরফা সুখে তার বিশ্বাস নেই। দুঃখেও। সে সুখ কেনে সুখের বিনিময়ে। সুখ দিয়ে দুঃখ কিনতে সে রাজি নয় একচুল। কিন্তু আজকের এ শব্দের ছন্দ তার অচেনা। অপটু হাতের আনাড়ি ছন্দ। তাতে না আছে সুখ কেনার আহ্বান না দুঃখ বিকোনোর আকুতি। কপট ঘুমের ভানে পড়ে থাকে রাহেলা। বুক ধুকপুক করে অকারণ। সে নিশ্চিত হতে চায় শব্দটা কিসের আশলে, কেই-বা করছে, কী উদ্দেশ্যে।
টুকটুক শব্দটা থেমে যায়, আবার হয়। আবার থেমে যায়। রাহেলার বুকের ধুকপুকানি থামে না। ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে, ভীষণ চমকিত। শব্দের উৎস জানতে উৎসুক হৃৎপিণ্ড বের হয়ে আসতে চায় খাঁচা ছেড়ে। কিন্তু সমস্ত উত্তেজনা দমন করে মটকা মেরে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। কোনো একটি কণ্ঠের অপেক্ষা করে। যাতে করে সে নিশ্চিত হতে পারে শব্দের উৎস ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে।
অবশেষে ফিসফিসে, প্রায় শোনা যায় না এমন অস্পষ্ট একটা কণ্ঠ সে শুনতে পায়। এবং বিস্মিত, হতভম্ব রাহেলা নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না প্রথমে। একটা নারীকণ্ঠ ফিসফিসে, শিউরে ওঠা শব্দ তুলে বেড়ার ওপাশ থেকে ডাকে, রাহেলা! রাহেলা!
উত্তেজনায়, বিস্ময়ে নিজের হৃৎপিণ্ডে দ্রুততালে বাজা ডুবডুব শব্দটা নিজেই সে স্পষ্ট শোনে। কোনো নারীকণ্ঠ কী কারণে তাকে এমন শীতের রাতে ডাকে, কেন এমন ব্যগ্র, অধীর স্বরে জপ করে তার নাম, কিসেরই বা এত গোপনীয়তা তার, ভেবে প্রায় ঘেমে ওঠে রাহেলা। অপেক্ষা করে আরও কিছুক্ষণ। নিশ্চিত হতে চায়। শীতের রাতে অনেক সময় ‘নিশি’ ডাকে, শুনেছে সে। তারা ডেকে নেয়, তারপর ভোরের দিকে কাদার মধ্যে পুঁতে রেখে চলে যায়, জন্মের পর থেকে অমন বহু গা ছমছমে গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছে রাহেলা। নিশির ডাকে সাড়া দেবে, তেমন বোকা সে নয় মোটেই। গায়ের ওপর চেপে থাকা লেপটা আরেকটু জড়িয়ে সে কান পেতে থাকে। কণ্ঠটা কিছুক্ষণ বিরতি নেয়। যেন দোটানায় ভোগে। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে আবার তেমনই ফিসফিসে, গা ছমছমে স্বরে বলে, রাহেলা! অ রাহেলা! গোমাইচিস তুই? আমি জয়নবের মা!
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে রাহেলা। এমন চমকানো বহুদিন চমকায় নি সে। জয়নবদের বাড়ি তাদের কয়েক বাড়ি পরেই। জয়নবের বয়স বছর ষোলো-সতেরো। কালো, বাড়ন্ত শরীরে তার মোটার ধাঁচ ব’লে দেখায় আরও বেশি। বিয়ে দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে তার বাপ-মা। কিন্তু পাত্রপক্ষ আসে, ভরপেট খায়, তারপর জয়নবের নানান রকম খুঁত মজলিসে বসেই বিচার বিশ্লেষণ শেষে যৌতুকের টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে নিজপথে হাঁটা দেয়। নুন আনতে পানতা ফুরোনো জয়নবের বাপ-মা যৌতুকের টাকাও জোগাড় করতে পারে না, জয়নবের বিয়েও হয় না আর। সেই জয়নবের মা হঠাৎ কেন রাহেলার ঘরে এসে টোকা দেয়, ভেবে কিছুতেই কূলকিনারা পায় না রাহেলা। জয়নবদের পরিবারের সাথে তাদের সম্পর্কও যেখানে মোটেই স্বস্তির নয়।
বেড়ার কাছে, যেখান থেকে কণ্ঠটা আসছিল, লেপের উষ্ণতা ছেড়ে সেখানে এগিয়ে যায় রাহেলা। সদ্য ছেড়ে আসা লেপের ওম তার শরীর ছেড়ে যায় মুহূর্তেই। দাঁত বসায় কনকনে শীত। ঠকঠক কাঁপতে কাঁপতে সে-ও ফিসফিসে স্বরে বলে, কী অয়চে, অ চাচি?
মা রে! জাইগে আচিস? তোর পায় পড়িচি অ মা! শিগগির একবার আমা বাড়িত আয়তো মা!
ক্যা চাচি? কী অয়চে? সহালে গেলি অবিনানেকো?
মা আমার বাআআলো! এহনই চলো! আমার জয়নবের যবর বিপদ! মা রে! তুই এহনই চল!
আচ্চা, আপনে দাঁড়ান হোনেই। আমি আসতিচি।
ফিসফিসে আলাপনটা থেমে যায়। অন্ধকার হাতড়ে মাথার পাশে ভাঁজ করে রাখা উলের চাদরটা মুড়ি দিয়ে সাবধানে দরজা খুলে বের হয় রাহেলা। কোনো শব্দ না তুলে অভ্যস্ত, পাকা হাতে বাইরে থেকে শেকল তুলে বের হয়ে আসে, ঘরের পেছনে দাঁড়ানো আবছা ঘোমটা টানা মূর্তিটার কাছে গিয়ে ফিসফিসে স্বরে আবার প্রশ্ন করে, কী অয়চে, অ চাচি?
কী যে অয়চেরে মা, আর তোকই বা কী কবো! আমার সাতে চল। নিজির চোহিই দেহিসিনে কী অয়চে! হারামজাদি মিয়া আমার সব্বোনাশ কইরে দেচে। আমার মান-সুম্মান ডুবো দেচে সপ! তুই য্যেয়া বাঁচা এহন! মা রে! তোর পায় পড়িচি!
কথা আর বাড়ায় না রাহেলা। পা চালায় দ্রুত। সে ভেবে পায় না কী এমন করেছে জয়নব, যাতে এত রাতে রাহেলাকে দরকার পড়ল তার। রাত বিরাতে অনেকে তাকে ডাকে, সে-ও যায়, কিন্তু সে ব্যাপারটা ভিন্ন। জয়নবের সাথে সে-সবের কোনো সম্পর্ক সে খুঁজে বের করতে পারে না কিছুতেই। সে আর থৈ পায় না ভেবে। গিয়েই দেখবখন। মনে মনে ভাবে সে।
বাড়ির পেছন দিকে পায়ে চলা পথ। দু পাশ ঘাসে ছাওয়া, তার মাঝখান দিয়ে সরু পথ। কুয়াশায় ভেজা। পায়ের চটি ভেদ করে কুয়াশা ভিজেয়ে দেয় পা। শীতে শরীরে কাঁপুনি উঠতে চায়। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে রাহেলা। হু হু কুয়াশা ঢুকে যায় নাকে। রাণুদের বাড়ির পেছনের হাসনাহেনা আর শিউলি থেকে সুবাস আসে দারুণ। কুয়াশার সাথে সাথে সে সুবাসও টেনে নেয় নাক। মাথার ভেতর কেমন একটা আবেশ টের পায় রাহেলা। কেমন নেশা নেশা। রাতের আবছা অন্ধকারে শিউলি গাছের নিচটা শাদা দুধের মতো ভেসে আছে, দেখে ঘোর লেগে যায় চোখে। ফেরার সময় কুড়িয়ে নেবে, মনে মনে ভেবে রাখে। মনের মধ্যে তেমন কোনো দুর্ভাবনা জাগে না তার। জয়নবের কী এমন হয়েছে, যাতে এতটা উতলা হয়ে এই গভীর রাতে ডাকতে এসেছে তার মা, ভাবনাটা আরেকবার ঘাই মারে মনে। তলিয়ে যায় পরক্ষণেই। মুচকি হাসে রাহেলা। কী আর হবে! বয়সের দোষ! নিশ্চয়ই প্রেম-ঘটিত কোনো ব্যাপার হবে। কারও সাথে লটর-পটর করে ছ্যাঁকা খেয়েছে। তারপর অভিমান করে মরতে বসেছে। এখন তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে স্বাভাবিক করতে হবে। জীবনে এসব ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটে, তাতে জীবন থেমে থাকে না, বরং গতি পায় আরও, খুঁজে নেয় নতুন চলার পথ, সে-সবই বুঝিয়ে বলতে হবে এই রাত দুপুরে। চেনা গল্প। ভাবতেই বিরক্তির মৃদু একটা ঢেউ ওঠে মনে। তলিয়ে যায় তখন তখনই আবার। ক্লান্তি আসে বিপরীতে। ঘুমের রেশ কাটাতে হাই তোলে আনমনে। এই শীতের রাতে না ডেকে সকালে ডাকলেও চলত। খামোখা ঘুমটা কেচিয়ে দিল। ভাবতে ভাবতেই জয়নবদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। উঠোন অন্ধকার। একপাশে গন্ধরাজ গাছটা শরীরে শাদা শাদা জোছনা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গন্ধে ম ম করছে সারা বাড়ি। জয়নবের ঘর থেকে ক্ষীণ এক চিলতে আলো তেরছা হয়ে ঠিকরে পড়েছে পাশের ঘরের বারান্দায়। একটা ছায়া, মূর্তির মতো মাটিতে বসে আছে পাতলা পাঞ্জাবি মতন কিছু একটা গায়ে জড়িয়ে। হাতে জ্বলন্ত এক টুকরো আলো। উঠছে, নামছে। উজ্জ্বল হচ্ছে, ম্লান হচ্ছে। জয়নবের ঘরের ভেজানো দরজা ভেদ করে একচিলতে আলোর সাথে, একটা জান্তব চাপা গোঙানিও ছড়িয়ে পড়ছে হাওয়ায়। কেমন ভৌতিক লাগছে পুরো বাড়ি। রাহেলা মুহূর্তেই বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ঘুরে দাঁড়ায় জয়নবের মায়ের দিকে। আবছা অন্ধকারে মুখটাকে কেমন ভয়ার্ত, ফ্যাকাশে, অসহায় দেখায়। কেমন ভৌতিক।
বিষ খায়চে, চাচি? —ফিসফিসে, উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে রাহেলা।
কলাপাতায় মোড়া অপরিষ্কার, ঘোলাটে নুন এক খাবলা নিয়ে গুঁজে দেয় তুলতুলে, ফোলা ফোলা, টুকটুকে দু ঠোঁটের ফাঁকে।
বিষ খালি তো বাঁচতামই রে মা! তালি তো আর আমার এত চিন্তে করা লাইগতে নানেকো। মইরে যাইতে, আমারও জীবনডা জুড়োইতে। —বলতে বলতে জয়নবের ভেজানো দরজা সাবধানে খুলে ফেলে তার মা। পলকে ঘরের মধ্যে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় রাহেলা। ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে। সাবধানে ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয় দরজা। তারা গ্রামসুদ্ধ মানুষ ঘুণাক্ষরেও এতদিন টের পায় নি কিছুই! আশ্চর্য! —ভেবে বিস্ময়ে থ হয়ে যায় রাহেলা। তারপর গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞাসু, উৎসুক চোখে জয়নবের মায়ের চোখে তাকায়। সে চোখ অনুনয়, অনুরোধ আর অপরাধের ভারে টইটুম্বুর। করুণা ভিক্ষার ব্যগ্রতায় অধীর।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে জয়নবের বিছানা। নির্জীব পড়ে আছে। যেন শব্দটা দূরে না যায়, সে চেষ্টায় প্রাণপণে গিলে নিচ্ছে নিজের গোঙানি। তবু কিছু ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। গড়িয়ে যাচ্ছে ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে।
মুহূর্তেই কর্তব্য বুঝে নেয় রাহেলা। উবু হয়ে বসে জয়নবের পাশে।
গরম পানি আনো চাচি। নুন আনো ছটাকখানেক। মালসায় কয়লার আগুন আনো খানিক। —দরকারি, ফিসফিসে গলায় নির্দেশগুলো দিয়ে গভীর মনোযোগে জয়নবকে দেখে। বোকা মেয়েটা। এই যুগে এরকম বোকাও কেউ আছে ভেবে মনে মনে বিস্মিত হয়, রাগও হয় ভীষণ। সময় মতো তাকে জানালে এই যন্ত্রণা সইতে হতো না জয়নবকে। এমন ঝুঁকিতেও পড়তে হতো না একদম। রাহেলার দাদি এ অঞ্চলের নাম করা দাই ছিল। বুড়ি মরার আগে রাহেলাকে শিখিয়ে গেছে খানিকটা। যদিও এখন আর এসব তেমন কাজে আসে না। মানুষ এখন অনেকটাই সচেতন। ডাক্তারের কাছে যায়, সাধ্যে কুলোলে।
দ্রুত হাতে কাজ করে রাহেলা। সময় হয়ে এসেছে প্রায়। আর অল্প কিছুক্ষণ। শক্তহাতে জয়নবকে ধরে সাহস দেয় রাহেলা।
ধৈর্য ধর, আরেকটু ধৈর্য ধর।—ফিসফিসে কণ্ঠে বলে।
ওঁত পেতে থাকে শিকারি বাঘের সতর্কতায়। চরম সময়টা আসে অতঃপর। খপ করে ধরে ফেলে রাহেলা। পাশেই কলাপাতায় মোড়া অপরিষ্কার, ঘোলাটে নুন এক খাবলা নিয়ে গুঁজে দেয় তুলতুলে, ফোলা ফোলা, টুকটুকে দু ঠোঁটের ফাঁকে। জল্লাদের হিংস্রতায় চেপে ধরে মুখ। পৃথিবীতে প্রথম চোখ মেলে এই অসহ্য অভ্যর্থনার চাপে ভীষণ যন্ত্রণায় চোখ পিটপিট করে অনাহূত সেই আগন্তুক। তার চিৎকারের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় রাহেলার ভয়ংকর শক্ত থাবা। ঝাঁকি দেয় ছোট্ট শরীরটা রাহেলার হাতের মধ্যেই, খাবি খায়। তারপর শান্ত হয়ে যায় সব। থেমে যায় জীবন। জয়নবের মায়ের হাতে জড়বস্তুটা দিয়ে রাহেলা কথা বলে চোখে চোখে। কাপড়ে জড়ানো বস্তুটা নিয়ে বেরিয়ে যায় জয়নবের মা। ততক্ষণে জয়নবের দিকে মনোযোগ দেয় রাহেলা।
ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে প্রায় ভোররাতের দিকে ঘরের পথে পা চালায় রাহেলা। শিউলি গাছের নিচটা তখন আরও শাদা, আরও ধবধবে। রাহেলা নিচু হয়ে আঁচল ভরে শিউলি কুড়োয়। হালকা হতে থাকা অন্ধকারে পথ হাঁটে আপনমনে। এখন আর শীত করে না তার। বরং পৌষের শীতেও ভীষণ ঘেমে ওঠে সে। বুকের কাছে, আঁচলে রাখা শিউলিগুলো পিষে ফেলে নিজের অজান্তেই। বুকের মধ্যে ফেনিয়ে ওঠে ক্ষোভ, ঘৃণা। বাড়ির কাছটায় এসে পিষে ফেলা শিউলিগুলো ছড়িয়ে দেয় পায়ের নিচে। পুকুরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। নেমে যায় তরতরিয়ে। কুয়াশায় প্রায় ডুবে যাওয়া বরফজলে নেমে সাঁতরায়। পৌষের শীতল জলে ডুবিয়ে দিতে চায় যা কিছু আগুন, নিভিয়ে দিতে চায় বাহুল্য দহন।