এটা কাটপিস আমলের গল্প। এই গল্পে আর আছে লেগুনা। কাটপিসের আমলে ঢাকায় লেগুনা চলত কিনা, এই হিসাব মেলাতে যদি আপনাদের কষ্টও হয় তাহলেও লেগুনা আমি আনব। সময় আর বস্তু মেলাতে যদি আপনাদের ঝামেলা লেগে যায়, তাহলেও এখন যে আর কাটপিসওয়ালা সিনেমা দেখতে হচ্ছে না, সেই খুশিতে আমার এই স্বেচ্ছাচার মেনে নিন প্লিজ। আসলে এই যে রতনের গল্প আমি বলব, এখানে লেগুনা ছাড়াও অন্য বড় গাড়ি্র কথাও আসবে, এমনকি এলিট প্রাইভেট কার পর্যন্ত।
এখন, রতনের গল্প আমি আপনাদের কিভাবে বলব? আমি তো আর রতন নই। কাজেই রতনের কাছ থেকে যা শুনেছি তাই বলতে হবে, যেহেতু রতন নিজে তার গল্প লিখতে পারবে না। তবে রতন নিজের গল্প লিখতে না চাইলেও বলতে তার উৎসাহের কমতি ছিল না। এমনকি তার গল্পের অ্যাডাল্ট অংশও সে বিনা লজ্জায় মেয়েদের সামনেও বলেছে। ভাগ্যিস বলেছে, না হলে আমি অন্যদের মুখে সেন্সরড অংশটাই শুধু শুনতে পেতাম। কাটপিসের গল্প সেন্সরের জালের ফুটা দিয়ে কতটুকু আর বেরোত। তবে আমি আপনাদের বলার সময় একটুও কাঁচি চালাব না, কথা দিলাম।
রতন যখন নিরুদ্দেশ হয় তখন তার বয়স ছিল সতেরো। মানে সে লম্বা যা হওয়ার হয়েছে গ্রাম ছাড়ার আগেই। তখনই দাড়ি গোঁফ উঠে লম্বায় ওর বাপের মাথা প্রায় ছাড়িয়েছে। মানে প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, শরীরের সব ব্যাটা লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার পর গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিল সে। অবশ্য পালানোর আগে তার ভারজিনিটি খোয়া গেছিল কিনা জানি না আমরা। আহা দেখেন, সেন্সরের কাঁচি চালাব না কথা দিয়েও ভারজিনিটির মতো ইংরেজি শব্দের আড়াল নিতে হলো। আসলে রতন যখন ফিরে এলো, তখন ওকে দেখে আমাদের মনে হলো, যাওয়ার আগে লুঙ্গির তলায়ও তার গ্রোথ ঠিকঠাক হয়েছিল কিনা, জানা দরকার। দাড়ি গোঁফ গজালে, শরীরের অন্য লোমও গজিয়েছিল বলেই আন্দাজ পাওয়া যায়। তার উপর রতনের মা বলল, ‘আমি নিজে আমার ব্যাটার লুঙ্গি পায়জামা ধুইয়া দিছি, আমি দেখছি অর স্বপ্নদোষ অইতো’। আচ্ছা সে না-হয় বোঝা গেল, কিন্তু বড় হওয়ার পর মা তো আর ছেলের ন্যাংটা দেখে নাই। তাহলে রতনের কোনো প্রেমিকা ছিল কিনা, থাকলে তার সাথে রতনের কদ্দূর কি হয়েছিল জানা খুব দরকার হয়ে পড়ল। মানে গ্রাম ছাড়ার আগে, একবার অন্তত তার পুরোপুরি সেক্স হয়েছিল কিনা, জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলাম আমরা। আমরা মানে রতনের গ্রামের মানুষ। এই যে দেখেন আবারও সেক্স শব্দের আড়াল নিতে হলো।
নিরুদ্দেশ হওয়ার পাক্কা দশ বছর পরে গ্রামে ফিরল সে, তাকে দেখে চিনতে আমাদের একটুও কষ্ট হলো না, একেবারে বালক রতন! বাড়িতে ঢোকার মুখেই এক বালিকার সাথে দেখা হলে, রতন জানতে চাইল, ‘তুই কেডো?’ বালিকা বলল, ‘আমি তো রত্না। তুই কেডো?’ প্রশ্ন করেই রত্নার মনে হলো, অক কোনে জানি দেকচি এবং বিদ্যুতের গতিতে তার মনে পড়ল, অর ফটো লিয়া কান্দে মা! মাআআ বলে চিক্কুর দেওয়ার আগে, রত্না কখনও না দেখা ভাইয়ের হাত ধরল, যেন ছেড়ে দিলেই আবার পালিয়ে যাবে সে। রত্নার চিৎকারে তার মা আর ভাবি দৌড়ে এলো এক সঙ্গে।
ছেলেকে ফিরে পেয়ে এক দফা আসমান কাঁপিয়ে কেঁদে নিয়ে মায়ের মনে পড়ল সময়ের কথা। ছেলে যখন নিরুদ্দেশ হয় তখন তার ছিল সতেরো, তাগড়া জোয়ান, ফিরল দশ বচ্চর বাদে। তালি পরে এহন সাতাশ না? তালি পরে এহন পাক্কা যুবক হওয়ার কথা তার! কিন্তু রতন এখন তেরোর বালক! মায়ের মনে যখন এটা এলো, তখন একসাথে পুরা গ্রামেরও মনে এলো, রতনের বয়স উল্টাঘুরে গেল ‘কিব্যা হর্যা ?’
কাটপিসওয়ালা সিনেমা দেখে বেরিয়ে রতন বলল, ‘আমার বমি আসে।’
এবার তাহলে আমাদের ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া লাগে। যেদিন বিকালে রতন গ্রাম ছাড়ে সেদিন দুপুরে মানিকের সাথে মারামারি হয়। মানিক তার বড় ভাই। বড় ভাই চিঠি লিখে দিয়ে বলে তার প্রেমিকা দিলারাকে দিয়ে আসতে, ছোট ভাই আদেশের খেলাপ করে। বন্ধুদের নিয়ে সেই চিঠি পড়ে ঘোলা চোখে বলে, ‘একখান প্রেম ইবার করাই লাগবি!’ পরে সেই নানান হাত ঘোরা কোঁচকানো চিঠি আর হবু ভাবির হাতে পৌঁছানো নিরাপদ মনে করে নাই রতন আর তার বন্ধুরা। ফলে উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে মানিকের মাথা গরম হয় সেদিন। কথাবার্তার ঠিক কোন পয়েন্টে গিয়ে দশ বছর আগের মারামারি লাগে তা এখন আর কারো মনে নাই ভালো করে। ঝগড়াও এমন বিষয় নিয়ে যে আকার ইঙ্গিতে করতে হচ্ছিল।
রত্নাকে পেটে নিয়ে তখন খুব কাহিল তাদের মা, প্রায় বুড়া বয়সে আবার পেটে ছাওয়াল এলে ছেলেদের সামনে লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল সে। ছেলেদের মারামারি এই দুই কারণে থামাতে যায় নাই। দুপুর বেলা বাপ বাড়ি ফিরে ছেলেদের মারামারি দেখে খুব রেগে গিয়েছিল, ফলে বাপের হাতে মার খেল রতন। অপরাধ রতনের বেশি ছিল কিনা, না যাচাই করেই মানিককে বেকসুর খালাস দিয়ে রতনের চোখে অপরাধী হয়ে গিয়েছিল বাপ। বাপকে শাস্তি দিতে বাড়ি ছেড়েছিল সে। সেইদিনই বিকালে উল্লাপাড়া গিয়ে ঢাকার কোচে উঠে পড়েছিল। অনেক রাতে আলহামরা কোচ তাকে নামিয়ে দিয়েছিল গাবতলী। সে বছর তার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।
জানুয়ারির শীত তখন। গাবতলী নেমে তার মনে হলো, গায়ে জাম্পার না থাকলি বাপের লাঠির বাড়ি খাওয়ার পর এত পথ বাসে ভাঁজ হয়ে বসে এসে গায়ের বেদনাতে নড়তে পারত না সে। বাপ যে আগে তাকে মারে নাই, এমন না কিন্তু, তার অভিমান হয়েছিল, মা তাকে বাঁচাতে আসে নাই। আগে মায়ের হাতের ফাঁক দিয়ে যেসব পিটুনি পিঠে পড়েছে, সেগুলি মায়ের আদরে মুছে গেছে সাথে সাথেই। এতদিন তো সেই ছিল কোলের ছাওয়াল। রতনের পরে হীরা এসেছিল মায়ের কোলে, কিন্তু সে বাঁচে নাই। মা তাই তাকে বেশি আদর করত। বাপের হাতে লাঠিপেটা খাওয়ার আগে দুপুরে গোসল করে এলে মা বিছানায় শুয়েই চিঁ চিঁ করে বলেছিল, ‘দুইডো জাম্পারই গায় দে বাপ, হাড্ডি গুড়া জার পইরচে।’ হির হির করে কাঁপতে কাঁপতে মায়ের কথা শুনেছিল সে, তাই লাঠির বাড়িতে ব্যথা বেশি লাগে নাই, বাস থেকে নেমে বুঝতে পারল সে। কিন্তু এই যে সে ঢাকায় এসে পড়েছে, কোথায় থাকবে, কী খাবে তার ঠিক নাই। কিন্তু সেসব চিন্তার চেয়ে সে এই ভেবে অবাক হয়ে গেল, ‘ঢাকাত এহেবারে জার নাই, ডবল জাম্পারে ধাপা ধরতেচে।’ সোয়েটার খুলতে খুলতে ভাবতে লাগল, কোন দেশের রাজাদের জানি জার কয়? মতিলাল স্যার একবার রাশিয়ার গল্প বলেছিল। কিন্তু কোনো চিন্তাই সে স্থির হতে পারে না, হঠাৎ মনে হয় ঢাহার মানুষ কি জানে যে আমাগারে উল্লাপাড়ায় শীত রে জার কয়? আর তারপরেই বিড় বিড় করে বলে, ‘ইরিয়াল্লারে রাইত দুপুরেও ঢাহার রাস্তাত এত গাড়ি!’
গাবতলী থেকে কারওয়ান বাজারে গিয়ে কিভাবে নাজিল হলো, সেকথা বলতে পারে না রতন। আমরা বারবার জিজ্ঞাসা করি, ‘ক্যারে গাবতলা থাইকা হেই বাজার কদ্দূর? আমাগারে পুব পাড়ার মজ্জিদ থাইকা পচা পুহুর, এদ্দূর?’ ‘উঁহু গাবতলা লয় গাবতলী’ বলতে বলতে হঠাৎ কি মনে পড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। পচা পুকুরের কথায় ঝামেলা হয়ে গেল, গল্প রেখে সে বলল, ‘যাই ডুব দিয়্যা আসি।’ নাম পচা পুকুর হলেও এটা আমাদের গায়ের সবচেয়ে সানদার পুকুর। আমরা কেউ কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাইরে গেলে, ফিরে এসে আপন জনের মুখ দেখার পরেই চলে যাই পচা পুকুরে, ডুব দিয়ে তবে শান্তি হয়। রতন ফিরে আসার সাতদিন পরে, সে রওনা হয়েছে পচা পুকুরে। তাহলে আমরা নতুন চিন্তায় পড়ি, রতনের কি সব কথা মনে নাই?
পরের দিন আমরা ঠিক করি, রতনের গল্পের মাঝে আর কোনো কথা বলব না।
একবারও থামাব না ওকে। থামালেই গল্প রেখে উঠে যায় সে, আর রতনের বালক হয়ে ওঠার গল্পে ছেদ পরে। পরের দিন কারওয়ান বাজার থেকেই শুরু করে, আর আমরা দম বন্ধ করে শুনতে থাকি।
কারওয়ান বাজারে রতনের যখন ঘুম ভাঙে, সে নিজেকে দুই উঁচা বিল্ডিংয়ের মাঝখানে একটা গলিতে মশারির মধ্যে আবিষ্কার করে। এবং মাশারির মধ্যে সে একা নয়, পাশে ঘুমিয়ে আছে এক বালক। বালক নিশ্চিন্তে একটা পা তুলে দিয়েছে তার গায়ে। সে আস্তে করে পা নামিয়ে উঠে বসে, মাথাটা কেমন ভারী, যেন ইট। পাশেই তার ব্যাগটা দেখে খুশি হয় সে। পাশের জনকে ধাক্কা দিয়ে জাগায়। পরে যার নাম জানা যাবে মুরাদ, সে উঠে বসে বলে, ‘কী হইচে?’ রতন শিশুর মতো বলে, ‘খিদা লাগচে।’ মুরাদ উঠে পড়ে। মশারি, বিছানা ভাঁজ করে। মুগ্ধ হয়ে দেখে রতন, ভাঁজ করে ছোট্ট একটা পোটলা বানিয়ে ফেলল নিমেষে। তারপর আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে, আন্ডারপাসের গা সাজানোর একটা ছবি সরিয়ে ছোট এক গর্তের মধ্যে বিছানার পোটলা চালান করে ঝাড়া হাত পা হয়ে গেল। ছবিটা আবার ফিট করে বেরিয়ে তারা নাস্তা করল। ভরা পেটে মুরাদ বলল, তুমি যত লম্বা লেগুনার হেল্পার তো হতি পাইরবা নাহ। রতন তখন অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘লেগুনা কী?’
লেগুনা কী তা ব্যাখ্যা না করে মুরাদ এতক্ষণে প্রশ্ন করে, তোমার নাম কী?
নাম শোনার পর পরের প্রশ্ন তো রেডিই থাকে, বাড়ি কই?
উল্লাপাড়া শুনে হো হো করে হাসে মুরাদ, ‘উল্টাপাড়া হলি একটা কথা আছিলো, যে পাড়া উল্টা।’ তারপর বলে, ‘নারায়ণগঞ্জে একটা পাড়া আছে, সত্যই উল্টা।’ মুরাদের শয়তানিতে মোটেই মজা পায় না রতন, উল্লাপাড়া নিয়ে হাসাহাসিতে তার রাগ হতে থাকে। কিন্তু মুরাদ বলে, ‘চলো তোমাক আমার ওস্তাদের কাছে নিয়া যাই। দেখি তোমারে কই ফিট করা যায়।’ লেগুনার হেল্পার মুরাদ, নতুন বন্ধু রতনের পেশা নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে।
***ওস্তাদ রতনকে দেখে বিরাট চিন্তায় পড়লেন! এত্ত বড় পোলা কিভাবে ‘লেগুনার হেল্পার হইবে? পাদানিতে ও দাঁড়াইলে আর দুইজন কই দাঁড়াইবে?’ কপালে ভাঁজ ফেলে ওস্তাদ বলেন, ‘মুরাদ রে তর বন্ধুরে নিয়া কী করি, ক তো!’ মুরাদ ততোধিক চিন্তিত হয়ে বলে, ‘ওষুদ খাওয়াইয়া দিমু ওস্তাদ?’***
ওস্তাদ লেগুনার ড্রাইভার। যে সে ড্রাইভার না, জীবনে কখনও এক্সিডেন্ট না করা ড্রাইভার। তার চ্যালারা এখন বাস ট্রাক চালায়। কিন্তু ওস্তাদ লেগুনায়ই রয়ে গেছেন। এই ছোট্ট যানটার জন্য খুব মহাব্বত তার।
ফার্মগেটের ফ্লাইওভারের দিকে তাকাইয়া ওস্তাদ বললেন, ‘দিবি? তাইলে দে খাওয়াইয়া, খাওয়ানির আগে কাটপিস দেহাইয়া উল্টাপাড়া ঘুরাইয়া আনিছ!’
মুরাদ ওস্তাদের দেওয়া দায়িত্ব মাথা পেতে নিল।
কাটপিসওয়ালা সিনেমা দেখে বেরিয়ে রতন বলল, ‘আমার বমি আসে।’ দিলারা আপাকে লেখা মানিকের চিঠিতে শুধু সে নারীদেহের বর্ণনা পেয়েছিল। এখন এই সিনেমায় দেখা নারীদেহের সাথে সেই বর্ণনা কিছুতেই মিলল না। মুরাদ বলল, ‘বমির দেখছ কী! আগে লও এক জায়গায় যাই, ওস্তাদে কইয়া দিছে আইজ রাইতে অইহানেই থাকবা, ফিরা আইসা ওষুদ।’ মুরাদ যে বারবার ওষুদ ওষুদ বলছে, সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে নাই সে। সব সময় এটা হয়েছে যে, যেটা নিয়ে তার ভাবা দরকার, সেটা বাদ রেখে অন্যকিছুতে মাথা ঘামিয়েছে সে। এবার বলল, ‘মুরাদ আবার কিবা নাম? আমাগারে গেরামে কারু নাম মুরাদ লয়।’ মুরাদ ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ইস! তুমি জানো তুরস্ক দ্যাশের পাঁচ পাঁচজন রাজার নাম আছিল, মুরাদ!’
‘তুমি জাইনলা কিবা হইর্যা?’
‘একবার আমার লেগুনায় উঠছিল এক মামা, হেভি মাসলওয়ালা, হেব্বি ইস্মাট। হেই মামায় কইছিল, মুরাদ নাকি বিরাট খানদানি নাম, বুঝলা?’
গল্পে গল্পে তারা পৌঁছে গেল নারায়ণগঞ্জ।
যে ঘরে রতনকে ঢুকিয়ে দিল মুরাদ, সেটা বিলকিস বানুর। বিলকিস বানুকে দেখে রতনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, একটু আগে দেখা কাটপিসের মেয়েটাকে মনে পড়ল। পাশে বসে বিলকিস বলল, ‘ভয় করতেছে? ভয় নাই, তোমারে তো অসুধ খাওয়াইবো, আর তো পারবা না।’ তারপরে বিলকিস বানু খুব মমতা মিশিয়ে রতনের কাপড় খুলল, হালকা গল্প গুজবের ফাঁকে ফাঁকে একটু রাম খাওয়ালো। অন্য কাস্টমার বিদায় করে দিয়ে, অনেক সময় নিয়ে রতনের প্রথম ও শেষ সঙ্গমের সঙ্গী হলো বিলকিস। রতন ঘুমিয়ে পড়লে কাঁদতে কাঁদতে তার গায়ে কাঁথা দিয়ে দিল।
সকালে একসাথে নাস্তা করলো মুরাদ, রতন আর বিলকিস। তারপরে ওষুধ খাইয়ে দিল রতনকে। ঢাকায় ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল। রতনকে ওস্তাদের ডেরায় নিয়ে গেল। রতনের জন্য একটা পাইপ আগেই জোগাড় করে রেখেছিল ওস্তাদ। সেই পাইপের মধ্যে, মায়ের পেটের মতো ওমে পুরা সাতদিন কুণ্ডলী পাকিয়ে রতন খালি ঘুমাল, মাঝে মাঝে তুলে মুরাদ তাকে পাতলা খিচুড়ি খাওয়ালো, ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেল। তারপরের তিনমাসে রতনের পরিবর্তন খেয়াল করল ওস্তাদ আর মুরাদ। দাড়ি গোঁফ পরে গেল ধীরে ধীরে, গলার স্বর বদলে গেল আর লম্বাও কমে গেল। এবার রতনকে হেল্পারের ট্রেনিং দিল ওস্তাদ। খুব শীগগিরই পাকা হেল্পার বনে গেল উল্লাপাড়ার রতন। জিগাতলা ফার্মগেট রুটের লেগুনা হেল্পার। তার নিখুঁত উচ্চারণে ফার্মগেট বলা দেখে খুশি হয়ে নতুন জামা কিনে দিল ওস্তাদ, আগেরগুলা বড় হয় এখন।
ওস্তাদ এদের কথাও ভাবে, তাদের জন্য একজন হিজড়া নিয়ে আসে। পুরুষের শরীরের আর নারীর অনুভূতির শেখ হাসেম।
সারাদিন পরে তারা আড্ডায় বসে, তারা মানে রতন, মুরাদ, ওস্তাদ আরো দুয়েকজন হেল্পার, ড্রাইভার। এর মধ্যে লিটন আবার প্রাইভেট কারের ড্রাইভার। এক সন্ধ্যার আড্ডায় সে বলল, ‘এই যে দেহিস না পেরাইভেট কারে যারা চড়ে, হেরা গাড়িতে চরার আগে এমুন থাহে না। আমি তো হালা মহিলাগুলা চিনিই না।’ সকলে অবিশ্বাসের শব্দ করলে সে বলে, ‘হোনো তাইলে ঘটনা খুলে কই।’ ঘটনা খুলে বলার আগে, সে তার খুলে যাওয়া লুঙ্গির গিট শক্ত করে লাগায়। খোলা ঘটনা সে বলে ষড়যন্ত্রীর গলায় প্রত্যেকদিন ভোর সকাল ছয়টায় সে বেল বাজিয়ে চাবি নেয়। চাবি যে ম্যাডাম দেয় সেটা সে জেনেছে এক বছর বাদে। সবাই সমস্বরে বলে, ‘ক্যান? মুখ ঢাকা থাকে?’ লিটন গলা দুই পরত উঁচা করে বলে, ‘নারে শালা মেকাপ থাকে না, কাজল লিপিশটিক থকে না, ত্যানা জামা পরে এরা ঘরে! আমাদের মা খালারা যেমন গয়না সব পইরাই থাকে এরা তেমুন না। হোনো, ঘটনা ক্যামনে জানলাম, আমি তো ভাবি বাসার কাজের লোক চাবি দেয়। একদিন হইল কি, ম্যাডামের কোন আত্মীয় মইরা গেল, ম্যাডাম কানতে কানতে গাড়িতে উঠল। সাজগোজ নাই। আমি তো আসমান থাইকা পড়লাম, এই বেডিই তো চাবি দেয়!’
শংকর বাস স্ট্যান্ড থেকে সকাল আটটায় রেগুলার প্যাসেঞ্জার পারলারের দুই চাকমা আপা। পরের দিন, রতন জিগায়, ‘আপা, বড় লোক আপাগারে নাকি সাজগোজ না করলি একবারে ফকিন্নি দেহায়?’ আপারা চোখ টিপে বলল, ‘ঘটনা সইত্য।’
এত বড় আবিষ্কার নিয়ে তাদের আড্ডা চলে দুইদিন। আড্ডার সকলেই ওষুধ খাওয়া না। রতন মুরাদ ছাড়া আর একজন আছে, কদম। এরা তিনজনে মাঝে মাঝে আলাদা বসে আড্ডা দিতে। নতুন শরীর নিয়ে আলাপ করে। সাইজে এবং চাহিদায় ছোট হওয়া শরীর নিয়ে তাদের স্বস্তি আর অস্বস্তির গল্প করে। ওস্তাদ এদের কথাও ভাবে, তাদের জন্য একজন হিজড়া নিয়ে আসে। পুরুষের শরীরের আর নারীর অনুভূতির শেখ হাসেম। সে এসে নারীর মমতা আর পুরুষের শিশ্ন নিয়ে এদের সামান্য কাম সুখ দিয়ে যায়। এরা উপুর হয়ে সে সুখ নেয়।
কয়েক বছর কেটে যায় রতনের লেগুনার শরীর চিনতে। লেগুনার শরীর চিনতে চিনতে নিজের শরীরও চিনে নেয়। তারপর একদিন ওস্তাদ বলেন, ‘আয় ইস্টিয়ারিং এ বয় দেহি!’ সেই দিন সে রাজা! লেগুনা উড়ে চলতে শুরু করলে, যাত্রীরা বালক ড্রাইভার খেয়াল করে চিৎকার করে ওঠে। নিজেদের জানের ভয়ে আর স্পিডের উত্তেজনায় তারা কাম সুখ ভোগ করে পুরা দশ মিনিট। ফার্মগেটে নেমে তারা নিজেদের হাত পা অক্ষত দেখে ড্রাইভারের তারিফ করেই আবার শাসন করে, ‘এতো ছোট পোলা গাড়ি চালায়, পুলিশে দিয়া দিমু!’
তারপর রতনের ঢাকা বাসের দিন ফুরিয়ে আসে। এবার ওস্তাদের হাতে মার খায় রতন। সেদিন মারামারি হয় মুরাদের সাথে। সেদিন আর প্রেম পত্র নয়, স্টিয়ারিং। মুরাদকে বেশি বেশি স্টিয়ারিং এ বসালে রাগ হয় রতনের, ফলে ছুটে যায় এতদিনের বন্ধুত্ব। এবার পক্ষপাতের কারণ জানা যায়, রতন বেশি স্পিড তোলে বলে এই পক্ষপাত। মুরাদ বলে, ‘শালা তর লাইগা আমি কি না করলাম!’ রতন বলে, ‘শালা তুই আমারে খোজা বানাইছস!’ এবার বন্ধুর পিঠে দুই কিল মেরে মুরাদ বলে, ‘শালা লেগুনার…’ কথা শেষ করতে না দিয়ে রতন বলে, ‘তর লেগুনার গোয়া মারি আমি!’
সেইদিন রাতেই সে উল্লাপাড়ার বাসে উঠে পড়ে। বালকের শরীর সাথে করে, ফের অভিমান সাথে করে, গ্রামে ফিরে আসে সাতাশের রতন।
এটুকু শুনে আমাদের পুরা দশ বছরের গল্প শোনা শেষ করতে হয়। কারণ, রতনের বাবা মা ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ঢাকায় গিয়ে আর ডাক্তার দেখানোর সাহস করে না তারা। ফলে বড় ছেলে আর বউয়ের কাছে রত্নাকে রেখে, রাজশাহী চলে যায় তারা।