মনমোহনী বৃক্ষ

মনমোহনী বৃক্ষ

একটি মেয়ে বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।মেয়েটা দেখতে অদ্ভুত সুন্দর।মুখমণ্ডল হতে বিচিত্রবর্ণের আলোকপুঞ্জ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।বইছে ফাগুনের মাতাল হাওয়া।মনমোহনী বৃক্ষের নব-কচি পত্রগুলো ঝিকমিক করছে সূর্যের আলোয়।পত্রগুলোর ফাঁক দিয়ে তাকাতেই চোখ ঝাঁঝিয়ে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ আলোতে।ভরদুপুরে মনমোহনীর ছায়ায় ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে মেয়েটা।চোখ বন্ধ করে।এক পরম আনন্দ মেয়েটার চোখে মুখে খেলা করছে।এই সময় উড়ে যায় এক ঝাঁক শালিক টিয়া আর ময়না।আশে পাশের বৃক্ষ হতে ঝির ঝির করে শুকনো পত্রগুলো বাতাসে হেলে দুলে উড়তে শুরু করে।মেয়েটাকে ঠিক এখন মনে হচ্ছে দেবী।নিহাত দীঘিটার দিকে তাকায়।একেবারে স্বচ্ছ জল।জলের একেবারে গভীরে বালি ঝিকমিক করছে,তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।মাতাল বাতাসে একমুঠো জল মেয়েটার মুখের উপর আঁচড়ে পড়ে।মেয়েটা বিস্মিত হয়ে তাকায়।উঠে বসে।বলল-আপনি আমার মুখের উপর জল ঢেলে দিয়েছেন কেন?

নিহাতের বিশ্বাসই হচ্ছে না,মেয়েটা তাকে বলছে।হেসে বলল-আমাকে বলছেন?
-আশে পাশে আর কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
-ও,বলুন।
-মুখে জল ঢেলে দিয়েছেন কেন?
-আমি দেয়নি।জলদেবতা ঢেলে দিয়েছে।দেখুন জলদেবতা কি সুন্দর ঢেউ তৈরি করেছে দীঘিতে?
-মিথ্যে কথা।মুখের উপর জল ঢেলে দিয়ে এখন বলা হচ্ছে জল দেবতা দিয়েছে।
এমন সময় আবার একমুঠো জল মেয়েটার মুখের উপর আঁচড়ে পড়ে।নিহাত হেসে উঠে।বলল-কি এবার বিশ্বাস হল?
মেয়েটা করুণ দৃষ্টিতে তাকায়।বলল-সরি।
নিহাত হূ হূ করে হেসে উঠল।
-হাসলেন যে।
-সরি বললেন তাই।
-সরি বললে ওকে বা অলরাইট বলতে হয়।এই রকম হু হু করে কেউ হাসতে পারে,তা প্রথম দেখলাম।
-সব ক্ষেত্রে নয়।আপনার মত দেবী সামনে থাকলে,কোন ছেলের কখন কি করতে হবে,সব ভুলে যাবে।
-আমি দেবী?
-নিজেকে কখনও আয়নায় দেখেছেন?
-দেখব না কেন?
-তবে বলব এখন পর্যন্ত আপনাকে আপনি ঠিকমত দেখেন নি।
মেয়েটা হেসে উঠে।নিহাত বলল-হাসলেন যে?
-না হেসে উপায় আছে?আপনি এমন করে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে পারেন আর আমি হাসতে পারব না।
-আপনার কেন মনে হচ্ছে,আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি।
-ছেলেরা মেয়েদের প্রশংসা করতে উস্তাত।আপনি তো ছেলেয়,এইরকম যে বলবেন অপ্রত্যাশিত নয়।
-সব ছেলে কিন্তু এক নয়।
-তা ঠিক।আচ্ছা বাবা,মানছি আমি খুব সুন্দরী।খুশি?
-আমি আপনার বাবা হলাম কি করে?
-বাবা হলে দোষ কি?
-বিয়েই করলাম না।তার আগেই বাবা।লোকে কি বলবে বলুন-তো?
-সমস্যা কি?আইনস্টাইনও তো বিয়ের আগে বাবা হয়েছেন।
-আমি আপনার বাবা হতে চাই না।
-তাহলে দাদা বলি?
-সেটাও চাই না।
-তবে ফ্রেন্ড।নাম ধরে ডাকি।
-তবে ফ্রেন্ডও হতে চাই না।নাম ধরে ডাকতে পারেন।
মেয়েটা হেসে উঠে।নিহাতও হেসে উঠে।মাতাল হাওয়ায় উড়তে থাকে মেয়েটার চুল।মেয়েটা বলল-তবে?
-অসংঞ্জায়িত রিলেশন।যার ডেফিনিশন এখনও তৈরি হয় নি।আচ্ছা আপনার নামই তো জানা হল না।
-মোহনী।আপনার?
-নিহাত।অনুমতি দিলে তুমিতে নামতে পারি।
-তাইতো চাচ্ছি।এইরকম আপনে আপনে করে কথা বলে ঠিক মজা পাচ্ছি না।

দুইজনে দীঘির দিকে মুখ করে ঘাসের উপর বসে।এসময় নিহাতের মোবাইলটা বেজে উঠে।
-হ্যালো মা।
নিহাতের মা চিত্রা কল করেছে।–বাবা তুমি কই?
-এইতো মা রাস্তা দিয়ে হাটছি।
-এই একদম হাটবি না।প্রচণ্ড রোদ।এত রোদে হাটলে একটা অসুখ বাধিয়ে ফেলবি।
-আচ্ছা মা।
-কয়টা বাজে খেয়াল আছে?
-বারটা বাজবে হয়তো।
-মোবাইলে দেখ,তিনটা বাজে।তাড়াতাড়ি আস।খাব।
-আমি খেয়ে নিয়েছি।তুমি খাও।
-ঠিক আছে।বেশি দেরি করবি না।
-ওকে মাদার।
মোহনী হাসছে।
-কি ব্যাপার,তুমি হাসছ কেন?
-তোমার সাবলীল ভঙ্গিতে মিথ্যা কথা শুনে খুব মজা পেলাম।
-মিথ্যা কথা না বলে কোন উপায় আছে?
-কেন?
-যদি বলি গাছের ছায়ায় একটি মেয়ের সাথে বসে হাওয়া খাচ্ছি,তাহলে কি ভাবত,মাথায় কিছু ধরে?
মোহনী মুচকি হেসে বলল-কি ভাবত?
-দেখ,ন্যাকামি করবে না।মনে হয়,কিছু বুঝ না,এমন ভাব।
-না আমি কিছু বুঝি না।
-বুঝ না যখন,তখন আর বুঝতে হবে না।অত বুঝে কাজ নেই।
-তোমার বাসায় কে কে আছেন?
-বাবা মা ভাই বোন।একদম সুখি পরিবার।
-তোমার?
মোহনী চুপসে যায়।
-কি হল চুপসে গেলে যে?
-মা বাবা ছোটবেলায় মারা গেছেন।কাকার কাছে বড় হয়েছি।কাকীমা বড় বেশি ঝামেলার।বাড়ির সব কাজ আমাকে দিয়ে করান।
-ভেরি স্যাড।
-গুণ্ডা মতন একটা ছেলের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা আজ।তাই পালিয়ে এসেছি।
-ও তোমার আজ বিয়ে,তাহলে তো খুব মজা।
এই বলে নিহাত নাচতে শুরু করে।এমন কাণ্ড দেখে মেয়েটা হেসে উঠল।বলল-যাও আমার বাড়ি গিয়ে বিয়ে খেয়ে আস।
-অবশ্যই যাব।
-যাও তবে আর দেরি কেন?
-যাব,এখন না,পরে।এই আমাকে উঠতে হবে।
-চলে যাবে?
-তো তুমি কোথায় উঠবে ভেবেছ?
-জানি না।
-ফাজলামি না করে বল,কোথায় যাবে,আমি তোমাকে রেখে আসি।
-আমার যাওয়ার জায়গা নেই।
-তাহলে থাকবে কোথায়?
-এখানে।জায়গাটা তো বেশ।
-এটা ঢাকা শহর বাবা।এইখানে একা একটা মেয়ে থাকলে কি হতে পারে,তোমার ধারণা আছে?
-হলে হবে,এটা আমার নিয়তি।
-আচ্ছা আমার সাথে চল।
দুইজনে রিকসায় উঠল।মিনিট দশেকের ভিতর বাসায় পৌঁছল।
-এই মেয়েটা কে?
চিত্রা মেয়েটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।
-কি মাথা নিচু করে আছিস কেন?
-ও মোহনী।আমাদের সাথেই পড়ে।কয়েকটা দিন এখানে থাকবে।
-থাকবে মানে?
-বাসায় বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করছিল।তাই পালিয়ে এসেছে।
-এই মেয়ে এখানে থাকতে পারবে না।কী ঝামেলা হয়,কিছুতো বলা যায় না।
মোহনী নীরবে কাঁদতে থাকে।
-এই মেয়ে,কাঁদবে না বলছি।কান্নকাটি আমার একদম পছন্দ না।এই রূপা ওকে তোর রুমে নিয়ে যা।
রূপা নিহাতের একমাত্র বোন।রুপা হাত ধরে মোহনীকে রুমে নিয়ে গেল।
চিত্রা ছেলের দিকে ভাল করে তাকাল।বলল-তুই এই কাজটা কিভাবে করলি?
-মা মেয়েটা এখন অসহায়।যাওয়ার কোন জায়গা নেই।
-আর কেউ ছিল না,ক্লাসে তো আর অনেকে ছিল,কেন তোর ঘাড়েয় এসে পড়ল।
-মা এসব বাদ দাওতো।
-বাদ দিব মানে।বল,আসল ঘটনা কি?
-তুমি এমনভাবে কথা বলা শুরু করছ যেন আমি মস্ত-বড় আসামি।
নিহাত বাসা হতে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়াল।মায়ের কথার হাত থেকে বাচার একমাত্র উপায়।তা না হলে বক বক করতেই থাকবে।একটা সিগারেট ধরাল।মাথাটা ভনভন করছে।বাবাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে,কে জানে?মোহনী রুমে একা একা বসে আছে।বেশ গোছানো সবকিছু।দেয়ালে বিভিন্ন ফুলের ছবি লাগানো।বেডের পাশেয় পড়ার টেবিল।তার ডানে একটা কম্পিউটার।বেড হতে সোজা বের হলেয় বারান্দা।বারান্দা থেকে আকাশ স্পষ্ট দেখা যায়।মোহনী বিছানার উপর বসে।এমন সময় রূপা ভিতরে ঢুকে।মনে মনে বলে,চয়েস আছে।গাধাটা এই মেয়েটাকে কিভাবে পটাল,মাথায় ধরছে না।
-ভাবী,এই ভাবী,মাথা নিচু করে আছ কেন?
মোহনী চমকে উঠল।আশেপাশে তাকাল।কাউকে তো আর দেখতে পাচ্ছে না।
-আশেপাশে কি খুঁজছ?
-কিছু না।
-ভাল লাগছে না,তাই না?
-না বোন,ভাল লাগছে।
-দেখ,আমার একটা নাম আছে।নাম ধরে ডাকবে।
-আচ্ছা রুপা বস।
রূপা মোহনীকে জড়িয়ে ধরে বলল-এইতো আমার সুইট ভাবী।
মোহনী কি বলবে ভেবে পেল না।মেয়েটা বারবার ভাবী ভাবী করছে কেন,তার মানে মেয়েটা কি ধরেয় নিয়েছে…ও কী ঝামেলা?
-মা কিন্তু তোমাদের উপর ক্ষেপে আছে।
-হু।
-চিন্তা করো না,ঠিক ম্যানেজ করে ফেলব।চল।সব রুম ঘুরে দেখায়।
-চল।
এই বলে দুইজনে উঠে দাঁড়াল।পাশের রুমে গেল।
-এই রুমে বাবা মা থাকেন।ঐ যে ছবিটা দেখছ,ভাইয়ার ছোটবেলার ছবি।
মোহনী হেসে উঠল।
-হাসলে যে?
-ছোটবেলায় এত হাবলা ছিল?
-আর পাশেরটা ছোট ভাইয়া নীলিত।ভাইয়ার কাছে নিশ্চয় শুনেছ?
-না শুনিনি।
-কি ভাইয়া কখনো তোমায় বলেনি?
-না।
-আমার কথা?
-না।
-আসুক ভাইয়া,মজা দেখাব।
-কি করবে?
-আসলেই দেখতে পাবে।
মোহনী হেসে বলল-মাথায় জল ঢেলে দিবে?
-মাথায় জল ঢালব না,তবে এমন কিছু করব,দেখবে খুব মজা পাবে।এর একটা শাস্তি না হলেই নয়।
-ঠিক একদম ঠিক।এটা তো কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
চিত্রার মাথা ঘুরছে।ছেলেটার মোটিভ কিছু বুঝতে পারছে না।বিয়ে করেছে কিনা কে জানে।ছেলেটাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।আজকালকার মেয়েরাও বাবা,বলা নেই,কওয়া নেই,হুট করে একটি ছেলের হাত ধরে বাসায় উঠল।এদের কাণ্ডজ্ঞান সব গেছে।ছেলেটাকে ভাল করে জিজ্ঞাস করতে হবে,বিয়েটা করেছে কিনা।বিয়ে না করলে ভাল,করে ফেললেও সমস্যা নেই।বাসা হতে কিছুতেই মেনে নিবে না।এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়ে তার ছেলের বউ হতে পারে না।মেয়েটার বাসার ঠিকানা বের করতে হবে।বাসার লোককে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় খবর দিতে হবে।ঘর হতে যত তাড়াতাড়ি আপদ দূর হয় ততই ভাল।
-মা মা?
এই বলে রূপা চিত্রার রুমে ঢুকে।
-মা শুয়ে আছে কেন?
-মাথা ঘুরাচ্ছে?
-তেল দিয়ে দিব।
-না দিতে হবে না।তুই এখান হতে যা।
-মা মেয়েটা খুব ভাল।
চিত্রার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে।মেয়েটা তো খুব সেয়ানা,এর মধ্যেই তার মেয়েকে হাত করে ফেলেছে।এ তো ভাল লক্ষণ না।আস্তে আস্তে সবাইকে হাত করার চেষ্টা করবে।এরপর নীলিত,তাকে,তার বরকে।মেয়েটাকে কিছুতেই এসব করতে দেওয়া যাবে না।
-রূপা মেয়েটার কাছে যাবি না।নীলিতকেও যেতে দিবি না।কথা বলা একদম বন্ধ।
-যাব যাব একশবার যাব।কথাও বলব।
চিত্রা মেয়েটার দিকে বড় বড় করে তাকাল।মেয়েটা-তো দেখা যাচ্ছে বেয়াদপের হাড্ডি।মেয়েটা ভেংচি কেটে রুম হতে বের হল।মনে হল,তখনি মেয়েটার গালে চট করে থাপ্পড় মারতে।বড়দের সম্মান করার বিষয়টা দেশ হতে বুঝি একদম উঠে গেল।এ কেমন যুগ পরেছে বাবা?তারাতো বাবা মায়ের সাথে কথা বলাতও,চোখে চোখ রাখতেই খুব ভয় পেত।
-নীলিত নীলিত?
নীলিতের সাড়া শব্দও খুঁজে পাচ্ছে না।ছেলেটার বদভ্যাস হয়েছে।বিকেল হলেও ছাদে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে।আকাশ দেখে।আকাশ দেখার কি আছে?চট করে একদিন থাপ্পড় মারলে তবে ঠিক হবে।
-নীলিত নীলিত?
নীলিত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে তার খুব ভাল লাগে।বিশেষ করে রাতের আকাশ।ছোট ছোট তারা,ছাদ দিন হলে সব কোথায় হাওয়া হয়ে যায়,কিছুতেই তার মাথায় আসে না।রাতই কেন হয়, দিনই কেন হয়-এমন আলো আধারের রহস্য কি সেটা বড় জানতে ইচ্ছে করে।চিত্রা বিছানা হতে উঠে ছাদে যায়।ছাদে ছেলেটা যথারীতি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।ছেলের কাছে যেয়ে কান ধরল।
-মা লাগছে।
-তোকে কখন হতে ডাকছি খেয়াল আছে?
-মা আমি কিছু শুনিনি।
-এভাবে হা করে আকাশ দেখলে শুনবি কিভাবে?
-মা তারা কোথায়?
পাশের বাসার মেয়েটার নাম তারা।নীলিতের চেয়ে একবছরের ছোট।মানে কি,ছোট-ছেলেটারও পাখা গজিয়েছে।
-ও তুই আকাশ দেখার নাম করে তারাকে দেখতে আসিস।
-হু মা।
-এই বয়সে এত পাকামো।দেখাচ্ছি মজা।
এই বলে টেনে ছাদ ছেলেকে নিয়ে যেতে লাগল।
-মা ছাড়,খুব লাগছে।তুমি যা ভাবছ তা না।
-আমি আকাশের তারা দেখতে এসেছি।
-দিনের বেলা আকাশের তারা থাকে?
-সেটাইতো মা বুঝতে পারছি না।রাতের বেলা তারা দেখি,দিনের বেলা দেখি আরে নেই।এমন কেন হয় মা?
চিত্রা ছেলেকে ছেড়ে দিল।বুঝল,ছেলেটার মাথা গেছে।
-এমনিই তো হবে,রাতের বেলা তারা থাকবে,দিনের বেলা থাকবে না।
নীলিত মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল-এমন কেন হয় মা?
চিত্রা রেগে বলল-তো কি হবে,রাতের বেলা সূর্য উঠবে আর দিনের বেলা তারা।
নীলিত মায়ের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলল না।বুঝতে পারল, মায়ের মন মেজাজ অত্যধিক খারাপ।মায়ের মন মেজাজ এত খারাপ তো কখনো দেখেনি।মায়ের সাথে রুমে বিছানায় বসল।
-তুই আর ছাদে যাবি না।
নীলিত মাথা নাড়ল।
-তুই কি কথা বলতে পারিস না ?
-আচ্ছা মা।
ছেলেটা এখন আচ্ছা বলছে,ঠিকই রাত হলে ছাদে চলে যাবে।
-ঠিক বলছ তো।
-হু মা।
-আর শোন।
-রূপার রুমে যাবে না।
-কেন মা?
-যাবে না বলছি যাবে না।আবার মুখে মুখে কথা কেন?ঠিক আছে?
নীলিত মাথা নাড়ল।রুম হতে বের হল।রুপার আপুর রুমে যেতে ইচ্ছে করছে বেশ।ঘটনাটা কি দেখতে হবে।শুধু খেয়াল রাখতে হবে মা যেন কিছুতেই দেখে না ফেলে।ধরা খেলে ধমুক তো খেতে হবেই তার সাথে থাপ্পড়।আপুর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।একটি মেয়ে বিছানায় বসে আছে।আর রুপা আপু ঘুমাচ্ছে।
-নীলিত ভিতরে আস।
কী ব্যাপার,মেয়েটা তার নাম জানল কিভাবে?তাকে-তো কখনো মেয়েটি দেখেনি।
-কি দাড়িয়ে আছ কেন?
নীলিত ভিতরে ঢুকল।
-আপনে কে?
-আমাকে চিনতে পারছ না?
-না
-আমি জলপরী।
-সেটা আবার কি?
-কেন তুমি পরীদের গল্প শুননি?
-না।
-ভেরি স্যাড।যে পরীরা জলে থাকে তাদের জলপরী বলে।জলে জলে ঘুরে বেড়ায়।
-আপনি এখন আর তো জলে নেই।তবে এখন আপনি স্থল-পরি।
-বা তুমি-তো দারুণ কথা বলতে পার।আমিতো ভেবেই দেখেনি।
-তুমি আমার নাম জানলে কি করে?
-বুদ্ধি খাটিয়ে বল,কিভাবে জানলাম?
-পরীরা তো সবার নামই জানে।
-বা তোমার তো খুব বুদ্ধি।
-তুমি এখানে এসেছ কেন?
-জলে ভাল লাগতেছিল না।তাই ভাবলাম কিছুদিন স্থল দিয়ে ঘুরে আসি।
-আমাকে তোমার সাথে নিয়ে জলে জলে ঘুরে বেড়াবে একদিন?
-অবশ্যই বেড়াব।
-আচ্ছা তুমি-তো সবই জান,তাহলে দিন কেন হয়, রাত কেন হয় বলতো?
-খুবই ভাল প্রশ্ন করেছে তো।এটা তো আমিও জানি না।
-তুমি না পরী,তুমি তো সবই জান।বল না প্লীজ।
মোহনী ধ্যানমগ্ন হল।
-কি হল,ধ্যান করা শুরু করলে যে?
-একটু ওয়েট কর।উত্তর সব পেয়ে যাবে।
নীলিত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর মোহনী চোখ মেলে তাকাল।
-কিরে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?
-উওর পেলে।
-হু।
-কেন হয়?
-সূর্য ও পৃথিবী যার যার অক্ষের চারদিকে ঘুরছে।যখন সূর্যের আলো পৃথিবীর যে অংশে পড়ে সে অংশ দিন বাকি অংশ রাত থাকে।কি বুঝলে?
-বুঝলাম।তুমি থাকাতে আমার তো খুব সুবিধা হল,যখন কোন প্রশ্ন মনে আসবে,তখনি তোমার কাছ হতে সমাধান পাব।
-ইয়েস মাই ডেয়ার ব্রাদার।
নীলিত খুব আনন্দ পেল।বলল-আমি তোমার ভাই হই।ও কি কি আনন্দ!তাহলে তো তুমি আমার আপু।
-আপু তুমি কিন্তু আমাদের ছেড়ে যেতে পারবে না।
-তাতো হয় না ভাই।আমাকে যে যেতেই হবে।
-না আমি তোমাকে কখনো কোথাও যেতে দিব না।
-ঠিক আছে ডেয়ার ব্রাদার।
নীলিত ইয়েস ইয়েস করে রুমের বাইরে চলে গেল।সে যে খুব খুশি,তা তার চোখ মুখ দেখলেই বুঝা যাচ্ছে।মায়ের রুমে গেল।
-মা মা, রূপা আপুর রুমে এক জলপরী আছে।খুব ভাল।
চিত্রা ছেলেটার দিকে তাকাল।মেয়েটা তার ছোট-ছেলেটার মাথাও খেয়েছে।মেয়েটার মতিগতি তো একদম ঠিক মনে হচ্ছে না।
-মা মা,আপু পরীতো।তাই সব জানেন।
চিত্রা রেগে বলল-আপু মানে?
-আমাকে ব্রাদার বলল,তাহলে তো আমার আপুই হবে।
-চুপ একদম চুপ।ওই ডাইনির আশে পাশে তুই যাবি না।
-মা আপু খুব ভাল।তাকে ডাইনি বলবে না।
চিত্রা ছেলের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল।গালে চট করে একটা থাপ্পড় মারল।নীলিত কান্না কান্না করতে রুম হতে বের হল।মোহনীর কাছে গেল।
-কি রে কি হয়েছে তোর,কাঁদিস কেন?
-মা থাপ্পড় দিয়েছে।
-কেন?
-আমি বললাম,তুমি পরী।মা বলল,ডাইনি।
-তুমি ভাই বলতে গেলে কেন?
-যা সত্যি তাইতো বলতো হবে।
-হুম ঠিক আছে।এবার কান্না বন্ধ কর।
নীলিত কান্না বন্ধ করল।এই সময় নিহাত রুমে প্রবেশ করল।
-মোহনী কেমন আছ?
মোহনী নীলিতের চুলে হাত ভুলিয়ে দিতে দিতে বলল-খুব ভাল।
দিনের আলো নিভে গেছে।ধরণীর বুকে নেমে এসেছে আধার।নিহাতের বাবা নীলিন আসার সময় হয়ে গেছে।সাতটা বাজে।সাতটা সাড়ে সাতটার মাঝে বাসায় আসেন।ছেলেমেয়েরা সবাই তাকে বেশ ভয় পায়।ভয়ে টিভির সিরিয়াল পর্যন্ত দেখতে পারে না।টিভি চালাতে দেখলেই খুব রেগে যায়।যেন টিভি দেখা মহা-অপরাধ।
-এই শুন বাবা আসার সময় হয়ে গেছে।
মোহনী নিহাতের দিকে তাকাল-তো?
-নীলিত রূপা রুম হতে এখন যা।
-থাক না,ওদের সামনেই বল।
-না বলা যাবে না।
অনিচ্ছা তবুও রূপা নীলিত রুমের বাইরে গেল।
-বাবা কিন্তু খুব কঠিন মানুষ।
-উনি কি বায়বীয় তরলে রূপান্তরিত হতে পারেন না?
-দেখ এটা ফাজলামি করার সময় না।
মুখে গম্ভীরতা এনে বলল-দেখ এটা ফাজলামি করার সময় না।
-উঃ তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
-হু বল,এবার আমি সিরিয়াস।
-বাবা এসেই তো মনে হচ্ছে হইচই বাজিয়ে দিবে।
-হইচই বাজাবে কেন?
-আসতে না আসতেই মা তোমার কথা কানে দিবে।ভাগ্যে কি আছে তা শুধু গডই জানে।
-ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই,তা নিয়ে ভেবে লাভ কি?
-শুন বাবা তোমাকে জেরা করতে পারে।কোথায় পড়,বাসা কোথায় জানতে চাইতে পারে।বলবে অণুজীব ইংরেজিতে মাইক্রোবায়োলজি ফাইনাল ইয়ার।বাসা আশে পাশে কোথাও বলবে।
-আশে পাশে বলতে?
-বলতে পার আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের পাশে।
-ওকে।কোন বিষয়ে পড়ি বললে?
-অণুজীব।ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে পড়াশুনা।
নিহাত ঠিক ভরসা পেল না।মেয়েটা বাবার সামনে কী গণ্ডগোল করে ফেলে কে জানে?তার কপালে যে শনি আছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
-নিহাত নিহাত?
নিহাতের বুকটা কেপে উঠল।বাবা গেটে দাড়িয়ে।প্রতিদিন গেটে দাড়িয়ে গেট-খুলার জন্য তার নাম ধরে ডাকে।মাথার চুল টানতে লাগল।দেখল পা দুটি কাঁপছে।ভয়ে ভয়ে গেটটা খুলে দিল।
-কিরে কি করছিলি,এত দেরি হল?
-এই তো বাবা পড়ছিলাম।
-তোর চুল এমন কেন?ধর ব্যাগটা ধর।
নিহাত ব্যাগটা ধরল।বাবার মুখটা হাসি হাসি।মনমেজাজ মনে হচ্ছে ভাল।এটাই যা ভরসার কথা।নীলিন রুমে ঢুকলেন।
-রুপা রুপা।
রুপা বাবার কাছে গেল।নীলিন বলল-মা এক গ্লাস সরবত বানা।নীলিত কই?
-বাবা ছাদে গেছে।
-যা সরবত বানিয়ে নিয়ে আয়।ফ্রিজে জল আছে না?
-আছে বাবা।ঠাণ্ডা জল দিয়ে বানাবি।
রুপা সরবত বানাতে গেল।নীলিন ফ্রেশ হয়ে আসল।
-কি তুমি এখন শুয়ে আছ যে?
চিত্রা চোখ বন্ধ করেই বলল-ইচ্ছে হয়েছে তাই শুয়ে আছি।
-তোমার কি শরীর খারাপ?শরীর খারাপ হলে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসি।
-না কিছু হয় নি।আমাকে কিছুক্ষণ ঘুমাতে দিবে প্লীজ।
-শুন একটা ভাল খবর আছে।
-বল।
-নিহাতের জন্য একটা ভাল মেয়ে দেখেছি।ভাবছি ছেলেটার বিয়ে দিয়ে দেয়।
এবার চিত্রা উঠে বসে।
-সে কাজ তোমার ছেলে সেরে ফেলেছে।
নীলিন হতভম্ব হয়ে গেল।তার ওয়াইফ কি তার সাথে মসকারা করছে।
-ছবিটা দেখ।পছন্দ হবে।
-ও দেখে আর লাভ নেই।পাশের ঘরে তোমার ছেলের বউ আছে,শখ থাকলে দেখে আস।
নীলিন রুপার রুমে একটি মেয়েকে দেখেছে।ভেবেছে রুপার বান্ধবী।ছেলেটা এমন কাণ্ড কীভাবে করল ভেবে পেল না।তার ইচ্ছে করছে হারামজাদাটাকে এখনি বাসা হতে বের করে দিতে।
-নিহাত নিহাত?
নিহাত বুঝতে পারল,মা বাবার কানে ঝাড়-মন্ত্র দিয়েছে।আজ খবর আছে তার।
-নিহাত নিহাত?
নিহাত হালকা হালকা ঘামছে।যদিও গরম ঘামার মত না।তার পাও কাঁপছে।বাবার কাছে গেল।
-ঘামছিস কেন?
-বাবা খুব গরম তো তাই।
-খুব গরম মানে,আজকে অন্যান্য দিনের তুলনায় কম।আমি কি ঘামছি?
-না।তাহলে?
-বাবা এমনেতেই ঘামি।ঠাণ্ডা গরম সব সময়।
-মাথার চুলগুলো ঠিক কর।
নিহাত মাথার চুল ঠিক করল।
-তোর নামে এসব কি শুনছি?
-কি শুনেছ বাবা?
-কেন তুই কিছু জানিস না?
-না তো।
-ঘরের মধ্যে একটা মেয়ে এলো কি করে?
-বাবা ও আমার ক্লাসমেট।বাসা হতে জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্চিছিল আজ,তাই চলে এসেছে।
-তা আমার বাসায় কেন?
-মেয়েটার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বাবা।বাবা ঠিক করেছি না।
নীলিন ধমুক দিয়ে বলল-চুপ থাক বল্লুক।
নীলিন উঠে দাঁড়াল।নিহাতের একটা থাপ্পড় খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।না,তা হল না।পাশ কাটিয়ে বাইরে গেল।নিহাত মনে মনে বলল-বাচা গেল।
নীলিন রুপার রুমে গেল।মোহনী উঠে দাঁড়াল।
-তোমার আজ বিয়ে?
মোহনী মাথা নাড়ল।
-তোমার নাম কি?
-মোহনী।
-বিয়েটা করলে না কেন?
-ছেলেটা ভাল না।মদ খায় গাজা খায়,তবুও সেই ছেলেটার সাথে বিয়ে দিতে চাই।বারবার বলেছি ছেলের ক্যারেক্টার খারাপ,সে মানবে নাতো মানবেই না।
-জান তোমার বাবা মা কত অপমান হবে?
-আমার বাবা মা নেই?চাচা চাচীর কাছে মানুষ।
-যারা তোমাকে এত ভালবাসা দিয়ে বড় করল,তাদের তুমি এতটা অপমান হতে দিবে?
মোহনী মাথা নিচু করে রইল।
-কি হল,আনসার মি।
-আর আমার সারাটা জীবন শেষ হবে তাতে,তা দেখলেন না।
-তা আমার বাসায় উঠলে কেন?
-কোন একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই চলে যাব।
-এখন তুমি কি করছ?
-নিহাতের সাথেই আছি।
-ও, গাধাটা এই জন্যই দিন দিন রেজাল্ট খারাপ করছে।তোমার পেছনে পেছনে ঘুরেই ওর এত অধঃপতন।যে ছেলে মেট্রিকে গোল্ডেন,ইন্টারে গোল্ডেন,সে ছেলে এত খারাপ অবস্থা রেজাল্টের সে তোমার জন্যই।আমার ছেলেটার মাথা তুমি খেয়েছ।আমি তোমাকে ছাড়ব না।তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিলাম।এর মধ্যে বাসা থেকে তোমাকে চলে যেতে হবে।
মোহনী মাথা নাড়ল।এমন সময় গেটে কে যেন কড়া নাড়ল।চিত্রা গেট খুলে দিতেই হতভম্ব হল।তার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।
-আমরা শাহবাগ থানা হতে এসেছি।আমাদের কাছে তথ্য আছে যে আপনারা একটি মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছেন।কি হল, সরুন,আমাদের ঢুকতে দিন।
চিত্রা সরে দাঁড়াল।পাঁচ ছয়জন পুলিশ রুমে ঢুকল।
-কি হল চিত্রা,কে এলো?
নীলিন ডাকতেই পেছন ফিরে দেখল কয়েকজন পুলিশ রুমে ঢুকছে।চিত্রার মুখ হতে কোন শব্দ বের হল না।তার পা দুটি খুব কাঁপছে।নীলিন উঠে দাড়াতেই বলল-বসুন আপনি।
নীলিন বসল না।বলল-আপনারা বসুন।আর তোরা ওই রুমে যা।
রুপা আর মোহনী পাশের রুমে গেল।
একজন পুলিশ বলল-আমরা শাহবাগ থানা হতে এসেছি।আমাদের কাছে তথ্য আছে এই বাসাতে একজন মেয়েকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
নীলিনের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
-এসব কি বলছেন?
আরেকজন পুলিশ বলল-স্যার একটা চটকানি দিব।চটকানি দিলে সব তথ্য গল গল করে বের হবে।
তাদের স্যার একটা সিগারেট ধরাল।বলল-ভাইজান এই কাজের সাথে কতদিন ধরে জড়িত?
নীলিন বুঝতে পারছে না,কি বলছে?
-কি ভাইজান,কথা বলছেন না কেন?
-আ আ
-কি আ আ করছেন?
-কোন কাজ ভাই?
-এই গালে একটা থাপ্পড় মারত।
-স্যার আস্তে মারব না জোরে মারব।
-আস্তে দিয়েই শুরু কর
একজন পুলিশ কনস্টবল থাপ্পড় দিল।হালকা করেই দিল।নীলিন ভ্যা ভ্যা করে তাকিয়ে রইল।
-নারীপাচারের সাথে কতদিন?
নীলিন বলল-স্যার আমি একটা কোম্পানির চাকুরীজীবী।
-দেখে তো মনে হয়,কিছু বুঝে না।তুমি যে গুরু সেয়ানা মাল,সে আমরা ভালভাবে জানি।চল,পাশের রুমে চল।
পাশের রুমে গেল।ও রুমে বাকি সবাই বসে আছে।
-ইনি ওয়াইফ,দুই মেয়ে আর দুই ছেলে।
নীলিন মাথা নাড়ল।পাশ হতে নীলিত বলল-না না আমার এক বোন।আর পাশেরটা পরী আপু।
সাথে সাথে স্যার হেসে দেওয়াতে কনস্টবলগুলো হেসে দিল।
-কি জনাব,আপনি যে মাথা নাড়লেন আপনার দুই মেয়ে?
নীলিন মাথা নিচু করে রইল।
-কি কথা বলছেন না কেন?
-ও আমার বোনের মেয়ে।
এমন সময় নীলিত কান্না স্বরে বলল-কি বাবা,তুমি না সেদিন বললে তোমার কোন বোন নেই।
নীলিন ছেলেটার দিকে বড় বড় করে তাকাল।নিজের ছেলে এতটা গবেট হতে পারে,তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না।ইচ্ছে করে ছেলেটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে।
-কি জনাব,নিজের ছেলের দিকে এত বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন কেন?
স্যার ছেলেটার কাছে গেল।মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-বা তুমি-তো খুব ভাল মানুষ।
-কেন?
-যারা সত্য কথা বলে তারা ভাল মানুষ।তো তুমি কি কর বাবা?
-আকাশ দেখি।আকাশ।
-আর কিছু?
-না শুধু আকাশ দেখি।
-বাহ খুব ভাল।
-আচ্ছা বলেন তো রাতে তারা দেখা যায়,দিনে দেখা যায় না কেন?
স্যার অন্যান্য কনস্টবলদের দিকে তাকায়।তাদের মুখের অবস্থা দেখে মনে হল,তারাও বোধহয় পারে না।ছোট-ছেলেটার কাছে নিজেকে তার খুব অসহায় লাগছে।
-সেতো জানি না বাবা।তুমি বলে দাও।
নীলিত হেসে বলল-আমিও জানি না।পরী আপু জানে।
স্যার মোহনীর দিকে তাকায়।
-আপনি পরী আপু?
-হু
-আপনি এ বাসার কে হন?
-কেউ না।
-তাহলে?
-রান্নাবান্নার কাজ করি।
-ও তাই।
স্যার নীলিত ছেলেটার কাছে গেল।বলল-তুমি ভাল আছ তো?
-না।
-কেন বাবা?
-মা আমাকে আকাশ দেখতে দেয় না।আর বাবা পড়াশুনার জন্য ধমুক দেয়।মাঝে মাঝে থাপ্পড়ও দেয়।
-আচ্ছা আমি খুব করে ধমুক দিয়ে দিব।আর?
-বাবাকে সবাই খুব ভয় পায়।বাবা বাসায় বথাকলে ঠিকমত কথাই বলতে পারি না।টিভিতে কত সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান হয়,কোন অনুষ্ঠান দেখতে পারি না।বাবা সবাইকে শুধু কারণে অকারণে বকেন।আজকেও ভাইয়াকে খুব করে বকেছেন।পরী আপুকেও বকেছেন।
স্যার নীলিনের দিকে তাকাল।বলল-আমরা বুঝতে পারছি আপনি নারী পাচারের সাথে যুক্ত না।তবে আপনার মত মানুষ বড় ধরণের অপরাধীই বটে।
-কি অপরাধ করেছে আমি?
-ছেলের মুখেই তো সব শুনলেন।
নীলিন মাথা নিচু করে রইল।ছেলেমেয়েরা এমন সব কথা বলতে পারে,ভাবতেই পারে নি।সারাজীবন তো সবকিছু ছেলেমেয়েদের জন্যই করলেন।
-কনস্টবল,একে কি মামলায় ফাঁসানো যায়?
-স্যার অনেক।শিশু নির্যাতন,নারী নির্যাতন,পরিবার নির্যাতন।অপরাধ তো খুব গুরুতর।একটি পরিবার হচ্ছে সমাজের মূল ভিত্তি।সেই মূল ভিত্তিকেই ভালভাবে বাড়তে দিচ্ছে না।
-আচ্ছা একে হ্যান্ড-কাফ পড়াও।
একজন পুলিশ হ্যান্ড-কাফ পড়াল।স্যার বলল-চল।
এমন সময় চিত্রা বলল-স্যার একে নিয়ে গেলে আমরা বাচব কিভাবে?
-চিন্তা করবেন না চাল ডাল সব পাঠিয়ে দিব।
নীলিত কেঁদে বলল-প্লীজ বাবাকে ছেড়ে দাও।
-বাবা কান্না করে না।তোমার বাবা আবার ফিরে আসবে।তবে তাকে শাস্তি পেতে হবে।সমাজে অপরাধীরা শাস্তি না পেলে তা আমাদের সুন্দর সমাজের জন্য হেতুকর নয়।এখন তুমি বল,আমি কি করব?রেখে যাব না নিয়ে যাব।
নীলিত হাউমাউ করে কেঁদে বলল-নিয়ে যান।
-ধন্যবাদ বাবা।ইউ আর দি ট্রু সান অব দা কান্টি।
পুলিশ নীলিনকে নিয়ে বের হল।সবাই কাঁদতে লাগল।শুধু মোহনী ছাড়া।তারও কান্না করতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু চোখ দিয়ে পানি কিছুতেই বের হচ্ছে না।
পরের দিন সকাবেলা।চিত্রা প্রতিদিন সকালে উঠে রান্না করে।কিন্তু সকাল আটটা পেরিয়ে গেল চিত্রা তবু ঘুম থেকে উঠল না।নীলিতের স্কুল আটটায়,রুপার সাড়ে আটটায় আর আর নিহাতের ক্লাস আজ নয়টায়।মোহনী রান্না রুমে গেল।কিছু একটা রান্না তো করতেই হবে।না হলে যে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।ভাবল খিচুড়ি রান্না করবে।চাল ডাল একসাথে দিয়ে দিলেও হল।নীলিতের স্কুলে যাওয়ার কোন ইচ্ছে দেখা যাচ্ছে না।সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছাদে চলে গেছে।ইচ্ছেমত আকাশ দেখছে,কেউ কিছু বলছে না।রুপা এখনও ঘুম হতে উঠেনি।মনে হচ্ছে না দশটার আগে ঘুম থেকে উঠবে।মেয়েটার ঘুম একটু মনে হয় বেশিই।কালকে বিকেলেও অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে।এমনিতে তো এত দেরি করে উঠতে পারে না,বাবার ধমুক খেয়ে সকালে উঠেছে।তাই আজ বোধহয় ঘুমিয়ে নিচ্ছে।নিহাত সকালেই উঠছে।সকালে উঠে কম্পিউটারে গেমস খেলছে।মাঝে মাঝে গান শুনছে।তাদের মধ্যে বিরাজ করছে স্বাধীনতার এক ধরণের আনন্দ আবার বাবা জেলে যাওয়ার ব্যথা।মিশ্র সুখ দুঃখ।নিহাত মাঝে মাঝে মোহনীর দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটার দিকে যতবার তাকায় ততবারি খুব ভাল লাগে।নিহাত রান্না রুমে গেল।
-কি দেবী,আপনি রান্না রুমে?
-দেবতারা না খেয়ে,রান্না তো করতেই হবে।
-কি রান্না করছ?
-আমার মাথা।
নিহাত মোহনীর মাথার দিকে ভাল করে তাকাল।
-কি আমার দিকে এমন হা করে তাকিয়ে আছ কেন?
-তোমার কি মাথা দুইটা?
-কেন?
-মাথা তোমার ঠিকঠাকই আছে।তবে মাথা রান্না করছ কিভাবে?
মোহনী হেসে দিল।তা দেখে নিহাতও হেসে দিল।মোহনী বলল-যাওতো।
-একটা কথা বলব।
-বল।
-তোমাকে না দেখতে একেবারে ফাটাফাটি লাগছে।
-কি?
-কিছু না।
এই বলে নিহাত রান্না রুম হতে বের হয়ে আসে।মোহনী মনে মনে হাসে।ছেলেটা যে কিনা?খিচুড়ির সাথে আর কি রান্না করা যায়,মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে লাগল।ডিম ভাজি,আলু ভাজি সাথে গরম গরম খিচুড়ি।চিত্রার রুমে গেল।
-খালা খালা।
চিত্রা চোখ মেলে তাকাল।
-খালা নয়টা বেজে গেছে।হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া করেন।
চিত্রার মেয়েটার উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।এই মেয়েটা আসার পর ফ্যামিলিতে যতসব ঝামেলা হচ্ছে।মেয়েটা খালা খালা করছে এটা শুনে তার মনমেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে।তার মা কি তার বোন যে তাকে খালা খালা করবে।
-খালা খালা।
চিত্রা এবার উঠে বসল।বলল-কি বলবে বলে ফেল?
-খালা রান্না হয়েছে।হাতমুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া করেন।
-তুমি আমাকে খালা খালা করছ কেন?তোমার মা কি আমার বোন হয়?
কি মাথা নিচু করলে কেন?উত্তর দাও।
-তাহলে কি বলব?
-কিছু বলতে হবে না।তুমি সামনে হতে যাও।
মোহনী দাড়িয়ে রইল।তার চোখ দিয়ে জল আসবে আসবে ভাব।কোনমতে আটকাল।রুম হতে বের হতেই আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না।উড়না দিয়ে চোখ দুটি মুছল।রুপার রুমে গেল।
-রুপা রুপা উঠ।
-আপু আর একটু ঘুমাই না।
-উঠ।খিচুড়ি ঠাণ্ডা হলে ভাল লাগবে না।সাথে ডিম ভাজি আর আলু ভাজি।
রুপা উঠল।উঠতে যেন তার খুব কষ্ট হল।
-যা ফ্রেশ হয়ে আই।
এরপর মোহনী ছাদে গেল।
-কি আকাশ দেখা হল?
-না।
-চল এখন খাবে।
-একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না যা রাতের বেলা তারা থাকে,দিনের বেলা থাকে না কেন?
-উত্তরটা এখনি জানতে হবে।খাওয়া দাওয়া কর তারপর বলি।
-না এখনি বল।
-দিনের বেলায় সূর্যের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।এই আলোর তুলনায় তারাগুলোর আলো খুব ক্ষীণ।তাই দিনের বেলা তারাগুলো দেখে যায় না,রাতের বেলা দেখা যায়।
-তাই বুঝি?
-কেন?
-আমি আর কত কি ভেবে ফেলেছি?
-আমি ভাবলাম,তারাগুলো অশরীরি আত্মা।তাই দিনের বেলায় দেখা যায় না,রাতের বেলা দেখা যায়।রাতের বেলায় তারাগুলো আকাশে ভর করে।
-এখন চল।এসব কথা পড়ে হবে।খেয়েদেয়ে তারপর।
-আচ্ছা চল।
সবাই খাবার টেবিলে বসল।শুধু চিত্রা ছাড়া।নিহাত ডাকল কয়েকবার।তাতেও কোন সাড়া মেলল না।মোহনী খাবার নিয়ে গেল চিত্রার রুমে।
-আপনার জন্য খাবার এনেছি।
-তোমাকে খাবার দিতে বলেছি?
-সকালের খাওয়ার সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে।
-তোমার মত ডাইনী মেয়ের হাতের রান্না খাব,কিভাবে ভাবলে?তুমি এসে আমার সংসারটা তছনছ করে দিয়েছ।আমি তোমাকে ছাড়ব না।এভাবে দাড়িয়ে থাকবে না।যাও।
মোহনী খাবার টেবিলে গিয়ে বসল।
-চল শুরু করি।
নিহাত মুখে দিয়েই বলল-ও দারুণ।এমন খাবার বাপের জন্মে খাইনি।
মোহনী মুচকি হেসে নিহাতের দিকে তাকিয়ে বলল-এত গালগল্প করতে হবে না।এবার খাও।
-আমি গালগল্প করছি।রুপি বলতো।
রুপা কঠিন গলায় গলায় বলল-তোমাকে কতদিন বলেছি না রুপি রুপি করবে না।
-যা নাম তাই বলছি।
-আমিও কিন্তুও বলে দিব।
-রুপা সোনা বোন আমার।অমন কথা মুখে আনে না বোন।
মোহনী বলল-রুপা বলে ফেল।
-রুপা তুই আমার সোনা বোন।তোকে আইসক্রীম খাওয়াব।
-তোমার আইসক্রীম তুমি খাও।মিথ্যাবাদী একটা।আগেরটা এখনো বাকি।
-আগেরটা সহ খাওয়াব।
-আপু,ভাইয়া না বিছানায় সিসি করে।
মোহনী হেসে দিল।বলল-এই বয়সেও।
নিহাত মনে মনে বলল-দিলে রে সব মাটি করে দিলি।একেবারে প্রেস্টিজ জল করে দিলি।
রুপা বলল-হু।
নিহাত রুপার চুল ধরে বলল-একদম মিথ্যা কথা বলবি না।এত মিথ্যা কথা কই হতে শিখেছিস বল?
-লাগছে ভাইয়া।
-লাগার জন্যই দিচ্ছি।মিথ্যা কথা বলবি আর শাস্তি হবে না,তা হবে না।
-আপু ভাইয়াকে ছাড়তে বল।
মোহনী মুখটা শক্ত করে বলল-নিহাত ছেড়ে দাও বলছি।
নিহাত ছেড়ে দিল।–এরপর যদি কিছু বলেছিস,এমন চটকানি দিব যে সব ভুলে যাবি।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুপার রুমে গেল।
-রুপা স্কুলে যাবি না।
-আজকে যেতে ইচ্ছে করছে না।
মোহনী নিহাতের দিকে তাকাল।
-কি তুমি যাবে না?তোমার ক্লাস সময় হয়ে এসেছে।
-তুমিও চল।ক্লাসটা করে আসি।
-আমি যাব না।তুমি ক্লাস করে আস।
-তাহলে আমিও যাব না।আজকে ঠিক যেতে ইচ্ছে করছে না।
-খালু না থাকায় সবার খুব মজা।মনের ভিতর তো কারও কষ্ট দেখতে পাচ্ছি না।নিহাত বের হ।শাহবাগ থানায় যেতে হবে।খালুকে বের করে আনতে হবে।
নিহাত নীল রংয়ের টি শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পড়ল।মোহনী পড়ল লাল রংয়ের শাড়ি।দুজন বের হবে এমন সময় গেটটায় কে যেন নক করল।নিহাত গেট খুলে বিস্মিত হয়ে গেল।তার বাবা সামনে দাড়িয়ে।
-মা মা বাবা এসেছে।বাবা তুমি ভাল আছ তো?
চিত্রা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।সংশয় হচ্ছে,ভুল শুনল নাতো।সাথে সাথে রুম হতে বের হল।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।নীলিন তার রুমে গেল।সাথে সাথে তার ছেলে মেয়ে ওয়াইফও গেল।চিত্রা রুপাকে বলল-যা এক গ্লাস শরবত বানিয়ে নিয়ে আয়।
রুপা শরবত বানাতে গেল।
-তুমি ঠিক আছ তো।
নীলিন কোন কথা বলল না।বারবার সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
-কি হল কথা বলছ না কেন?
নীলিন বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
-ওরা কি তোমাকে মেরেছে?খুব কষ্ট হয়েছে তোমার?
তবু নীলিন কিছু বলল।চোখটা বন্ধ করল।
-ছোট মরিচটাকে এবার শিক্ষা দিতে হবে।খুব বার বেড়েছে।
নীলিন বলল-না,নীলিতকে তুমি কিছু বলবে না।ও আমার চোখ খুলে দিয়েছে।আমি তোমাদের শাসন করি।কিন্তু মাত্রাটা বোধহয় বেশি হয়ে গেছে।আমি আর কাউকে কিছু বলব না।যে যার ইচ্ছা মত চলবে।তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও।
চিত্রা বরের মাথায় হাত রেখে বলল-এসব কি বলছ?তুমি ওদের বাবা,তুমি ওদের শাসন করবে না তো কে করবে?
-আমি ভাল বাবা হতে পারি নি।আমি শুধু শাসনই করেছি কিন্তু ওদের ভালবাসা দিতে পারি নি।কারণে অকারণে ওদের বকাঝকা করেছি।এটা ঠিক না।যে বাবা তার ছেলেমেয়েদের ভালবাসা দিতে পারে না,তার শাসন করার অধিকার নেই।
-তুমি শান্ত হও।সারা রাত কি জেলেই ছিলে?
-জেলে ঢুকালে জেলে থাকব।আমাকে বাইরে নিয়েই ছেড়ে দিয়েছে।আমার প্রতি যাদের ভালবাসা নেই,তাই তাদের কাছে ফিরে আসতে চাই নি।সারা রাত বাইরে এদিক ওদিক ঘুরেছি।ভাবলাম,তোমাদের সাথে শেষ দেখাটা করেই যাই।আর তোমাদের শাসন করতে আসব না।তোমরা এখন হতে পুরোপুরি স্বাধীন।
এই বলে নীলিন বিছানা হতে উঠল।চিত্রা বলল-কই যাচ্ছ?
-জানি না।
-ওদের দেখবে কে?
-ওরা এখন বড় হয়েছে।নিজেদের দেখাশুনা নিজেরাই করতে পারবে।
-তাহলে আমাকেও সাথে নিয়ে চল।আমিও এখানে থাকতে চাই না।
-আমি কোথায় যাব,তার তো কিছু ঠিক নেই।নিজেই কিভাবে চলব তার ঠিক নেই ,তোমাকে নিয়ে কিভাবে চলব?
-তোমার চললে আমারও চলে যাবে।
এমন সময় তিন ভাইবোন বাবার পায়ে পড়ল।হাউমাউ করে কান্না করল।নিহাত বলল-বাবা এবারের মত আমাদের ক্ষমা করে দাও।আমরা আর তোমার কথার অবাধ্য হব না।
-উঠ পাগলেরা উঠ।
তিন ভাইবোন উঠে দাঁড়াল।নীলিন বলল-তোরা ভাল থাকিস।আমি চললাম।
নীলিন হাটতে থাকে।পিছনে পিছনে আর বাকি সবাই আসতে থাকে।গেট খুলে বের হল।
-তোরা সবাই ভিতরে চলে যা।
নীলিত বলল-না বাবা,আমরাও যাব।তুমি ছাড়া আমরাও এ বাসায় থাকব না।
নীলিন হাটতে থাকে।পাশে তার ওয়াইফ।পিছনে ছেলেমেয়ে আর মোহনী।হাটতে হাটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।প্রচণ্ড খিদে লেগেছে সবার।
নীলিত বলল-বাবা খিদা লেগেছে।
নীলিন বাকি সবার মুখের দিকে তাকাল।সবার চোখ মুখ শুকনা।তার নিজের পেটও যে খা খা করছে।
-তোরা সবাই বাসায় চলে যা।যেখানে আমার নিজের খাবারই নেই সেখানে তোদের খাওয়াব কি করে?
সবাই ফুটপাতের উপর বসে পড়ে।মোহনী বলল-আমার কাছে একশ টাকা আছে।এ দিয়ে কোন হোটেলে শুধু ডালভাত হয়তো খাওয়া যাবে।
একটি হোটেলে ঢুকল।হোটেলের নাম হোটেল ডাল ভাত।হোটেলে গিয়ে বসল।ডালভাত মনে হল অমৃত।খাবার খেয়ে বেড়াল।হাটতে হাটতে এক পার্কে ঢুকল।পার্কের মাঝখানে একটি পুকুর।পুকুরের সামনে গিয়ে বসল।বেশ বাতাস হচ্ছে।বাতাসে শরীরটা একেবারে জুড়িয়ে গেল।সারাদিন খা খা রোদে ঘুরে খুব ক্লান্ত লাগছে।সামনে একটা নৌকা।সবাই নৌকাই উঠল।নীলিন বলল-আমরা ছোটবেলায় জার্নি বাই বোট পড়েছি।আজ তা হয়ে যাক।কি বল সবাই?
চিত্রা কিছু বলল না।তার বরের মাথাটা একেবারে গেছে কিনা কে জানে?ভেবেছিল,কিছুক্ষণ হাটলেই বুঝি বাসায় ফিরে যাবে।এখন তো দেখা যাচ্ছে বাসায় ফেরার কোন নাম গন্ধই পাওয়া যাচ্ছে না।কোনদিন যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না।
নীলিন বৈঠা দিয়ে নৌকা চালাতে লাগল।বলল-নীলিত তুমি জার্নি বাই বোট পড়েছ।
-হু বাবা।ক্লাস ফোরে ছিল।কেমন লাগছে?
-ভাল লাগছে বাবা।পরিবেশটাও খুব সুন্দর।
এভাবে সন্ধ্যা নেমে এলো।রাত্রি আটটার দিকে হোটেলে খেয়ে নিল।এরপর ফুটপাতে বসে রইল।
নীলিত বলল-বাবা আমার খুব ঘুম ধরেছে।
-তাহলে শুয়ে পড় বাবা।
-কোথায় ঘুমাব বাবা?
-আশেপাশের লোকজন কই ঘুমাচ্ছে?
-রাস্তার উপর।পলিথিন বিছিয়ে।
নীলিন কিছুটা রাস্তা পলিথিন বিছিয়ে দিল।এরপর শুয়ে পড়ল।রুপা বলল-বাবা ইট মাথায় লাগে।এছাড়া গাড়ির প্রচণ্ড শব্দ।ঘুম আসছে না।
-আশেপাশের সবাই তো এভাবেই ঘুমাচ্ছে।
এমন সময় একটা লোক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মুখভরা কাশ নীলিনের ঠিক মাথার কাছে ফেলল।লোকটার আক্কেল বলে কি কিছু নেই?তারা ঘুমাচ্ছে,মাথার সামনে কাশ ফেলে চলে গেল।একটা থাপ্পড় মারতে পারলে ভাল হত।চোখটা মেলে আকাশে তাকাল।আকাশে পূর্ণ ছাদ।চাদের আলোয় ঝিকমিক করছে আকাশ।চোখটা বন্ধ করল।মনে হল,জীবনটা খারাপ না।বেশ ঘুম ধরছে।সারাদিন তো আর খাটনি কম হয় নি।
-এই উঠ,শালারা উঠ।শালার নতুন আমদানি।শালারা শুবি শো আমাদের জায়গায় এসে শুতে হবে কেন?
নীলিন চোখ মেলে তাকাল।ছেলেমেয়ে সহ চার পাঁচজন লোক।
-এখানে আমরা ঘুমাই ভাবেই।জায়গা ছাড়েন।
নীলিন বলল-ভাই এখানে কারও নাম লেখা ছিল না।তাই আমরা জায়গা ছাড়ব না।
-শালা মেরে তক্তা বানিয়ে দিব।মুখে মুখে কথা।
নীলিন কিছু বলতে যাবে চিত্রা থামাল।বলল-আমরা ছেড়ে দিচ্ছি।
এই বলে তারা একটু দূরে গিয়ে পলিথিন পাতল।কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল।ঘুম ভাঙ্গল প্রচণ্ড বৃষ্টিতে।নিহাতের মনে হচ্ছিল,কে যে পানি ঢেলে দিচ্ছে।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে।সবাই বসে আছে।শরীরে কাঁপন শুরু হয়েছে।কিছু দিয়ে মুছবে সে জো নেই।কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামল।নীলিত বলল-বাবা ভোরের সূর্য,দেখ কি সুন্দর?চারদিকে আলোক রাশি ছড়িয়ে পড়ছে।
নীলিন তাকাল।ভোরের প্রথম আলো যে কবে দেখেছে তা ঠিক মনে পড়ে না।তাদের সবাই ভোরের প্রথম আলো দেখছে।মোহনী বলল-কী সুন্দর,কী সুন্দর!
এরপর নীলিন তিনটা রিক্সা ডাকল।চিত্রা বলল-রিক্সা ডাকছ কেন?
-কেন আবার,সারাজীবন এখানে পড়ে থাকব নাকি?আমাদের থাকার একটা বাড়ি আছে নাকি?
চিত্রা কি বলবে ভেবে পেল না।তবে তার খুব আনন্দ হচ্ছে।মনে হচ্ছ খুব হইচই করতে।রুপা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল-থ্যাংক ইউ বাবা।
নীলিন বলল-তোদের অনেক কষ্ট দিয়েছি।আর না।
রুপা,নীলিত,নিহাত,মোহনী একসাথে হুররে হু করে উঠল।চিত্রা ও নীলিন তাদের আনন্দ দিচ্ছে।তাদের খুব ভাল লাগছে।
কয়েকদিন পর।নীলিন অফিস হতে ফিরেই নিহাতকে ডাকল।
-তোমার জন্য একটা মেয়ে দেখছি।সামনে রবিবার তোমার বিয়ে।
-বাবা আমার এখনও পড়া শেষ হয় নি।
-সে আমি জানি।মেয়েকে তোমার মাও দেখেছে।আমাদের দুজনের খুব পছন্দ।
-বিয়ে করে খাওয়াব কি?
-সে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।তোমার খাওয়া যেহেতু চলছে সেহেতু তোমার ওয়াইফের খাওয়াও চলবে।মোহনীকে ডাক।
নিহাত ডাকল-মোহনী মোহনী?
মোহনী আসল।
নীলিন বলল-মোহনী আমি মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে খোজ নিয়েছি।এ নামে কেউ নেই।আজিমপুরে বাসার যে ঠিকানা দিয়েছিলে সেটাও ভুল।সে নামে কোন বাসা নেই।সত্য কথা বল।হু আর ইউ?
মোহনী বলল-খালু আমি মিথ্যা কথা বলেছি।আমি সরি।
-তোমার যে বিয়ে ঠিক হয়েছিল,সেটাও কি বানানো?
-না খালু।আমার চাচা চাচী এক চরিত্রহীন ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল।
-তোমার বাড়ি কোথায়?
-টাংগাইল,আকুরটাকুর পাড়া।
-কি করতে?
-কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তাম।মাওলানা ভাসানীতে।
-নিহাতের সাথে আগে পরিচয় ছিল?
-না খালু।
-তাহলে ওর সাথে এখানে আসলে কিভাবে?
-নিহাত আমার অসহাত্ব দেখে বাসায় নিয়ে এসেছিল।রমনা পার্কে আমাদের দেখা হয়েছিল।
-তার মানে বলতে চাইছ নিহাতের সাথে কোন রিলেশন তোমার ছিল না এখনও নেই।
-হু।
-নিহাতের জন্য একটা মেয়ে ঠিক করে ফেলেছি।ছবিটা দেখ।আর তোমার বিয়ের ঝামেলাটা যেহেতু শেষ হয়েছে,তাই এলাকায় যেয়ে পড়াশুনা সম্পন্ন কর।চাচার বাসায় থাকতে হবে না।আমি তোমাকে হোস্টেলে তুলে দিব।মাস মাস টাকা পাঠাব।
-হু।
-যাও।
নিহাত আর মোহনী দুজনে একসাথে রুম হতে বের হল।নিহাতের হাতে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটার ছবি।নিহাতের ইচ্ছে করল ছিঁড়ে ফেলতে।এমন বিশ্রী একটা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে বাবা মা,রুচি বলে কি কিছু নেই?মোহনী হাত হতে ছবিটা নিয়ে বলল-বাহ তোর বউ দারুণ তো।দেখতে তো একদম ঝাক্কাস।
-ঝাক্কাস না ছাই।ও ডাইনিকে আমি বিয়ে করতে পারব না।
-দেখ কপালে টিপটা অনেক সুন্দর লাগছে।
নিহাত মোহনীর হাত ধরে বলল-কিছু একটা কর।
মোহনী নিহাতের দিকে তাকাল।ছেলেটার চোখ ছলছল করছে।হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হেসে বলল-খুব সহজ উপায় আছে।
-কি?
-পালা।বিয়ের পর বাসায় চলে আসবি।
-ভাল একটা দে।
-ভাল না লাগলে নাই।তুমি নিজে খুঁজে বের কর।
এই বলে রুপার রুমে গেল।নিহাতের খুব খুব অস্থির লাগছে।ঘুরে ফিরে মোহনীর কথা মাথায় ঘুরে ফিরে আসে।মেয়েটাকে এত ভাল লাগে কেন বুঝতে পারে না।এই রকম অস্থিরতায় কয়েকদিন গেল।শনিবার বিকেলবেলা।মোহনী আর নিহাত ছাদে দাড়িয়ে আছে।নিহাত বলল- একটা কথা বলব।
-বল।
-আমার বিয়েটা হলে তুই খুশি হবি?
প্রথমে মোহনীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।এরপর হাসি টেনে এনে বলল-তোর বিয়ে আর আমি খুশি হব না,তাই কি হয়?
-নিজেকে এখন আটকে রাখার সময় এখন নয়।
-মানে কি?
-প্রথমে তোর মুখের অবস্থা কি হয়েছিল,তা কি এত সহজে লুকানো যায়?আমার যে তোকে দরকার।খুব দরকার।অন্য মেয়ে তোর মত আমাকে ভালবাসতে পারবে?
-এই সব কি বলছিস?
এবার মোহনীর হাত ধরে বলল-তুই কি আমাকে সত্যিই ভালবাসিস না?
মোহনীর চোখ ছলছল করে উঠল।বুকের ভিতরটা কেমন যেন করতে লাগল।উড়না দিয়ে মুখ ঢাকল।নিহাত ছাদ হতে চলে গেল।এই বিয়েটা তাকে ঠেকাতেই হবে।দরকার হলে বাসা হতে পালাবে।যে মেয়েকে সে ভালবাসে না সে মেয়েকে বিয়ে করার কোন মানে হয় না।
বিয়ের দিন।সন্ধ্যাবেলা।ছেলেকে সকালবেলা হতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সারা ঢাকা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজা হয়েছে।কোথাও পাওয়া যায় নি।মেয়ে পক্ষ ইতিমধ্যে জেনে গেছে।মেয়ের বাবা নীলিনকে বলেছে-দেখুন ছেলে একটি মেয়েকে ভালবাসে।দিয়ে দিন না সে মেয়ের সাথে বিয়ে। আমার মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে কি সর্বনাশ হয়ে যেত বলুন তো?নিজের ছেলের খোঁজখবর রাখেন না কেমন বাবা আপনি?
নীলিন একটা কথাও বলে নি।ছেলেটা এমন কাণ্ড করেছে,কথা শুনা তো তার প্রাপ্য।
চিত্রা এসে বলল-মোহনী,বলতো ছেলেটা কয় গেল?
-আমি কিভাবে বলব খালাম্মা?
রাত বেজে বারটা।চিত্রা কান্না শুরু করেছে ঘন্টাখানেক।নীলিনের মনটাও যেন কেমন করে উঠল।ছেলের অমতে বিয়ে ঠিক করা কিছুতেই ঠিক হয় নি।এমন সময় নীলিন একটা চিরকুট পেল।তাতে লেখা-দেখা হোক তবে মনমোহনীর নিচে।নিজের ছেলের লেখা,তাতে সন্দেহ নেই।এটা আবার কি কে জানে?গবেট ছেলেটা একটু ভাল করে লিখে গেলেই বের করা যেত।নীলিন ডাকল-মোহনী মোহনী।
মোহনী আসল।
-দেখতো এই চিরকুটটা।
মোহনী দেখে বলল-খালু তাড়াতাড়ি বের হন।এই গাছটা আমি চিনি।রমনা পার্কে।
মোহনী চিত্রা আর নীলিন রিকসায় উঠল।নীলিন বলল-মামা একটু জোরে।খুব জলদি।
রিকশাওয়ালা তাড়াতাড়ি পেটেল চালাতে লাগল।খালি রাস্তা।মিনিট পনেরের মধ্যে রমনা পার্কে এসে পড়ল।এরপর ভিতরে ঢুকল।
-কোন দিকে মা?
-এই দিকে খালু।
তারা তিনজন এগোতে থাকে।কিছুদূর এগোতেই দেখে একটি ছেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে তার সামনে বসে আছে।ছেলেটেকে চিনতে কারও ভুল হল না।যদিও আবছা আলোয় মুখ তখনো দেখা যাচ্ছে না।চিত্রা ছেলেকে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।নীলিন বলল-গাধা ছেলে কোথাকার?এখানে বসে কি করছিস?
-বাবা বিয়ে করতে এসেছি।
-এখানে বিয়ে করবি মানে?মাথা ঠিক আছে তোর।
-বাবা আমি যাকে ভালবাসি প্রথম দেখা এই মনমোহনীর নিচেই হয়েছিল।
-এখানে বসে থাকলে মেয়েটা আসবে?
-এসেছে তো বাবা।
-কই?
-তোমরাই তো নিয়ে এলে।
নীলিন মোহনীর দিকে তাকাল।মোহনী লজ্জা পেল।নীলিন মোহনীর হাতটা তার ছেলের হাতে দিয়ে বলল-মা,আমার পাগল ছেলেটাকে তুমি দেখে রেখ।
এরপর দুজনে বাবা মাকে সালাম করল।নীলিন বলল-সুখী হও মা।সুখী হও।
চিত্রা বলল-এবার তাহলে চল।
নিহাত বলল-মা তোমরা যাও।আজকে আমি আর মোহনী মনমোহনীর নিচে কাটাই।সকাল হলেই এসে পড়ব।
নীলিন বলল-আচ্ছা থাক।সকাল হলেই আসিস।
এরপর চিত্রা ও নীলিন বাসায় চলে এলো।মোহনী মনমোহনীর নিচে একটা চাদর বিছাল।এরপর দুইজন পাশাপাশি শুইল।মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল।মোহনী বলল-দেখ,কি সুন্দর জোনাকির আলো?
জোনাকির আলোয় মনমোহনী বৃক্ষকে লাগছে মায়াবী।এলোমেলো বাতাস বইছে।নিহাত মোহনীর দিকে তাকিয়ে বলল-সবচেয়ে সুন্দর লাগছে কি বলতে পারবে?
-কি?
-তোমাকে।তোমার চিরচেনা অপরূপ মুখ।
তাই শুনে মোহনী হেসে উঠে।নিহাত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।মনে মনে ভাবে,এভাবে যদি অনন্তকাল কেটে যেত,তবে বেশ হত!

মনমোহনী বৃক্ষ
একটি মেয়ে বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।মেয়েটা দেখতে অদ্ভুত সুন্দর।মুখমণ্ডল হতে বিচিত্রবর্ণের আলোকপুঞ্জ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।বইছে ফাগুনের মাতাল হাওয়া।মনমোহনী বৃক্ষের নব-কচি পত্রগুলো ঝিকমিক করছে সূর্যের আলোয়।পত্রগুলোর ফাঁক দিয়ে তাকাতেই চোখ ঝাঁঝিয়ে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ আলোতে।ভরদুপুরে মনমোহনীর ছায়ায় ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে মেয়েটা।চোখ বন্ধ করে।এক পরম আনন্দ মেয়েটার চোখে মুখে খেলা করছে।এই সময় উড়ে যায় এক ঝাঁক শালিক টিয়া আর ময়না।আশে পাশের বৃক্ষ হতে ঝির ঝির করে শুকনো পত্রগুলো বাতাসে হেলে দুলে উড়তে শুরু করে।মেয়েটাকে ঠিক এখন মনে হচ্ছে দেবী।নিহাত দীঘিটার দিকে তাকায়।একেবারে স্বচ্ছ জল।জলের একেবারে গভীরে বালি ঝিকমিক করছে,তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।মাতাল বাতাসে একমুঠো জল মেয়েটার মুখের উপর আঁচড়ে পড়ে।মেয়েটা বিস্মিত হয়ে তাকায়।উঠে বসে।বলল-আপনি আমার মুখের উপর জল ঢেলে দিয়েছেন কেন?
নিহাতের বিশ্বাসই হচ্ছে না,মেয়েটা তাকে বলছে।হেসে বলল-আমাকে বলছেন?
-আশে পাশে আর কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
-ও,বলুন।
-মুখে জল ঢেলে দিয়েছেন কেন?
-আমি দেয়নি।জলদেবতা ঢেলে দিয়েছে।দেখুন জলদেবতা কি সুন্দর ঢেউ তৈরি করেছে দীঘিতে?
-মিথ্যে কথা।মুখের উপর জল ঢেলে দিয়ে এখন বলা হচ্ছে জল দেবতা দিয়েছে।
এমন সময় আবার একমুঠো জল মেয়েটার মুখের উপর আঁচড়ে পড়ে।নিহাত হেসে উঠে।বলল-কি এবার বিশ্বাস হল?
মেয়েটা করুণ দৃষ্টিতে তাকায়।বলল-সরি।
নিহাত হূ হূ করে হেসে উঠল।
-হাসলেন যে।
-সরি বললেন তাই।
-সরি বললে ওকে বা অলরাইট বলতে হয়।এই রকম হু হু করে কেউ হাসতে পারে,তা প্রথম দেখলাম।
-সব ক্ষেত্রে নয়।আপনার মত দেবী সামনে থাকলে,কোন ছেলের কখন কি করতে হবে,সব ভুলে যাবে।
-আমি দেবী?
-নিজেকে কখনও আয়নায় দেখেছেন?
-দেখব না কেন?
-তবে বলব এখন পর্যন্ত আপনাকে আপনি ঠিকমত দেখেন নি।
মেয়েটা হেসে উঠে।নিহাত বলল-হাসলেন যে?
-না হেসে উপায় আছে?আপনি এমন করে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে পারেন আর আমি হাসতে পারব না।
-আপনার কেন মনে হচ্ছে,আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি।
-ছেলেরা মেয়েদের প্রশংসা করতে উস্তাত।আপনি তো ছেলেয়,এইরকম যে বলবেন অপ্রত্যাশিত নয়।
-সব ছেলে কিন্তু এক নয়।
-তা ঠিক।আচ্ছা বাবা,মানছি আমি খুব সুন্দরী।খুশি?
-আমি আপনার বাবা হলাম কি করে?
-বাবা হলে দোষ কি?
-বিয়েই করলাম না।তার আগেই বাবা।লোকে কি বলবে বলুন-তো?
-সমস্যা কি?আইনস্টাইনও তো বিয়ের আগে বাবা হয়েছেন।
-আমি আপনার বাবা হতে চাই না।
-তাহলে দাদা বলি?
-সেটাও চাই না।
-তবে ফ্রেন্ড।নাম ধরে ডাকি।
-তবে ফ্রেন্ডও হতে চাই না।নাম ধরে ডাকতে পারেন।
মেয়েটা হেসে উঠে।নিহাতও হেসে উঠে।মাতাল হাওয়ায় উড়তে থাকে মেয়েটার চুল।মেয়েটা বলল-তবে?
-অসংঞ্জায়িত রিলেশন।যার ডেফিনিশন এখনও তৈরি হয় নি।আচ্ছা আপনার নামই তো জানা হল না।
-মোহনী।আপনার?
-নিহাত।অনুমতি দিলে তুমিতে নামতে পারি।
-তাইতো চাচ্ছি।এইরকম আপনে আপনে করে কথা বলে ঠিক মজা পাচ্ছি না।
দুইজনে দীঘির দিকে মুখ করে ঘাসের উপর বসে।এসময় নিহাতের মোবাইলটা বেজে উঠে।
-হ্যালো মা।
নিহাতের মা চিত্রা কল করেছে।–বাবা তুমি কই?
-এইতো মা রাস্তা দিয়ে হাটছি।
-এই একদম হাটবি না।প্রচণ্ড রোদ।এত রোদে হাটলে একটা অসুখ বাধিয়ে ফেলবি।
-আচ্ছা মা।
-কয়টা বাজে খেয়াল আছে?
-বারটা বাজবে হয়তো।
-মোবাইলে দেখ,তিনটা বাজে।তাড়াতাড়ি আস।খাব।
-আমি খেয়ে নিয়েছি।তুমি খাও।
-ঠিক আছে।বেশি দেরি করবি না।
-ওকে মাদার।
মোহনী হাসছে।
-কি ব্যাপার,তুমি হাসছ কেন?
-তোমার সাবলীল ভঙ্গিতে মিথ্যা কথা শুনে খুব মজা পেলাম।
-মিথ্যা কথা না বলে কোন উপায় আছে?
-কেন?
-যদি বলি গাছের ছায়ায় একটি মেয়ের সাথে বসে হাওয়া খাচ্ছি,তাহলে কি ভাবত,মাথায় কিছু ধরে?
মোহনী মুচকি হেসে বলল-কি ভাবত?
-দেখ,ন্যাকামি করবে না।মনে হয়,কিছু বুঝ না,এমন ভাব।
-না আমি কিছু বুঝি না।
-বুঝ না যখন,তখন আর বুঝতে হবে না।অত বুঝে কাজ নেই।
-তোমার বাসায় কে কে আছেন?
-বাবা মা ভাই বোন।একদম সুখি পরিবার।
-তোমার?
মোহনী চুপসে যায়।
-কি হল চুপসে গেলে যে?
-মা বাবা ছোটবেলায় মারা গেছেন।কাকার কাছে বড় হয়েছি।কাকীমা বড় বেশি ঝামেলার।বাড়ির সব কাজ আমাকে দিয়ে করান।
-ভেরি স্যাড।
-গুণ্ডা মতন একটা ছেলের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা আজ।তাই পালিয়ে এসেছি।
-ও তোমার আজ বিয়ে,তাহলে তো খুব মজা।
এই বলে নিহাত নাচতে শুরু করে।এমন কাণ্ড দেখে মেয়েটা হেসে উঠল।বলল-যাও আমার বাড়ি গিয়ে বিয়ে খেয়ে আস।
-অবশ্যই যাব।
-যাও তবে আর দেরি কেন?
-যাব,এখন না,পরে।এই আমাকে উঠতে হবে।
-চলে যাবে?
-তো তুমি কোথায় উঠবে ভেবেছ?
-জানি না।
-ফাজলামি না করে বল,কোথায় যাবে,আমি তোমাকে রেখে আসি।
-আমার যাওয়ার জায়গা নেই।
-তাহলে থাকবে কোথায়?
-এখানে।জায়গাটা তো বেশ।
-এটা ঢাকা শহর বাবা।এইখানে একা একটা মেয়ে থাকলে কি হতে পারে,তোমার ধারণা আছে?
-হলে হবে,এটা আমার নিয়তি।
-আচ্ছা আমার সাথে চল।
দুইজনে রিকসায় উঠল।মিনিট দশেকের ভিতর বাসায় পৌঁছল।
-এই মেয়েটা কে?
চিত্রা মেয়েটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।
-কি মাথা নিচু করে আছিস কেন?
-ও মোহনী।আমাদের সাথেই পড়ে।কয়েকটা দিন এখানে থাকবে।
-থাকবে মানে?
-বাসায় বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করছিল।তাই পালিয়ে এসেছে।
-এই মেয়ে এখানে থাকতে পারবে না।কী ঝামেলা হয়,কিছুতো বলা যায় না।
মোহনী নীরবে কাঁদতে থাকে।
-এই মেয়ে,কাঁদবে না বলছি।কান্নকাটি আমার একদম পছন্দ না।এই রূপা ওকে তোর রুমে নিয়ে যা।
রূপা নিহাতের একমাত্র বোন।রুপা হাত ধরে মোহনীকে রুমে নিয়ে গেল।
চিত্রা ছেলের দিকে ভাল করে তাকাল।বলল-তুই এই কাজটা কিভাবে করলি?
-মা মেয়েটা এখন অসহায়।যাওয়ার কোন জায়গা নেই।
-আর কেউ ছিল না,ক্লাসে তো আর অনেকে ছিল,কেন তোর ঘাড়েয় এসে পড়ল।
-মা এসব বাদ দাওতো।
-বাদ দিব মানে।বল,আসল ঘটনা কি?
-তুমি এমনভাবে কথা বলা শুরু করছ যেন আমি মস্ত-বড় আসামি।
নিহাত বাসা হতে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়াল।মায়ের কথার হাত থেকে বাচার একমাত্র উপায়।তা না হলে বক বক করতেই থাকবে।একটা সিগারেট ধরাল।মাথাটা ভনভন করছে।বাবাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে,কে জানে?মোহনী রুমে একা একা বসে আছে।বেশ গোছানো সবকিছু।দেয়ালে বিভিন্ন ফুলের ছবি লাগানো।বেডের পাশেয় পড়ার টেবিল।তার ডানে একটা কম্পিউটার।বেড হতে সোজা বের হলেয় বারান্দা।বারান্দা থেকে আকাশ স্পষ্ট দেখা যায়।মোহনী বিছানার উপর বসে।এমন সময় রূপা ভিতরে ঢুকে।মনে মনে বলে,চয়েস আছে।গাধাটা এই মেয়েটাকে কিভাবে পটাল,মাথায় ধরছে না।
-ভাবী,এই ভাবী,মাথা নিচু করে আছ কেন?
মোহনী চমকে উঠল।আশেপাশে তাকাল।কাউকে তো আর দেখতে পাচ্ছে না।
-আশেপাশে কি খুঁজছ?
-কিছু না।
-ভাল লাগছে না,তাই না?
-না বোন,ভাল লাগছে।
-দেখ,আমার একটা নাম আছে।নাম ধরে ডাকবে।
-আচ্ছা রুপা বস।
রূপা মোহনীকে জড়িয়ে ধরে বলল-এইতো আমার সুইট ভাবী।
মোহনী কি বলবে ভেবে পেল না।মেয়েটা বারবার ভাবী ভাবী করছে কেন,তার মানে মেয়েটা কি ধরেয় নিয়েছে…ও কী ঝামেলা?
-মা কিন্তু তোমাদের উপর ক্ষেপে আছে।
-হু।
-চিন্তা করো না,ঠিক ম্যানেজ করে ফেলব।চল।সব রুম ঘুরে দেখায়।
-চল।
এই বলে দুইজনে উঠে দাঁড়াল।পাশের রুমে গেল।
-এই রুমে বাবা মা থাকেন।ঐ যে ছবিটা দেখছ,ভাইয়ার ছোটবেলার ছবি।
মোহনী হেসে উঠল।
-হাসলে যে?
-ছোটবেলায় এত হাবলা ছিল?
-আর পাশেরটা ছোট ভাইয়া নীলিত।ভাইয়ার কাছে নিশ্চয় শুনেছ?
-না শুনিনি।
-কি ভাইয়া কখনো তোমায় বলেনি?
-না।
-আমার কথা?
-না।
-আসুক ভাইয়া,মজা দেখাব।
-কি করবে?
-আসলেই দেখতে পাবে।
মোহনী হেসে বলল-মাথায় জল ঢেলে দিবে?
-মাথায় জল ঢালব না,তবে এমন কিছু করব,দেখবে খুব মজা পাবে।এর একটা শাস্তি না হলেই নয়।
-ঠিক একদম ঠিক।এটা তো কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
চিত্রার মাথা ঘুরছে।ছেলেটার মোটিভ কিছু বুঝতে পারছে না।বিয়ে করেছে কিনা কে জানে।ছেলেটাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।আজকালকার মেয়েরাও বাবা,বলা নেই,কওয়া নেই,হুট করে একটি ছেলের হাত ধরে বাসায় উঠল।এদের কাণ্ডজ্ঞান সব গেছে।ছেলেটাকে ভাল করে জিজ্ঞাস করতে হবে,বিয়েটা করেছে কিনা।বিয়ে না করলে ভাল,করে ফেললেও সমস্যা নেই।বাসা হতে কিছুতেই মেনে নিবে না।এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়ে তার ছেলের বউ হতে পারে না।মেয়েটার বাসার ঠিকানা বের করতে হবে।বাসার লোককে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় খবর দিতে হবে।ঘর হতে যত তাড়াতাড়ি আপদ দূর হয় ততই ভাল।
-মা মা?
এই বলে রূপা চিত্রার রুমে ঢুকে।
-মা শুয়ে আছে কেন?
-মাথা ঘুরাচ্ছে?
-তেল দিয়ে দিব।
-না দিতে হবে না।তুই এখান হতে যা।
-মা মেয়েটা খুব ভাল।
চিত্রার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে।মেয়েটা তো খুব সেয়ানা,এর মধ্যেই তার মেয়েকে হাত করে ফেলেছে।এ তো ভাল লক্ষণ না।আস্তে আস্তে সবাইকে হাত করার চেষ্টা করবে।এরপর নীলিত,তাকে,তার বরকে।মেয়েটাকে কিছুতেই এসব করতে দেওয়া যাবে না।
-রূপা মেয়েটার কাছে যাবি না।নীলিতকেও যেতে দিবি না।কথা বলা একদম বন্ধ।
-যাব যাব একশবার যাব।কথাও বলব।
চিত্রা মেয়েটার দিকে বড় বড় করে তাকাল।মেয়েটা-তো দেখা যাচ্ছে বেয়াদপের হাড্ডি।মেয়েটা ভেংচি কেটে রুম হতে বের হল।মনে হল,তখনি মেয়েটার গালে চট করে থাপ্পড় মারতে।বড়দের সম্মান করার বিষয়টা দেশ হতে বুঝি একদম উঠে গেল।এ কেমন যুগ পরেছে বাবা?তারাতো বাবা মায়ের সাথে কথা বলাতও,চোখে চোখ রাখতেই খুব ভয় পেত।
-নীলিত নীলিত?
নীলিতের সাড়া শব্দও খুঁজে পাচ্ছে না।ছেলেটার বদভ্যাস হয়েছে।বিকেল হলেও ছাদে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে।আকাশ দেখে।আকাশ দেখার কি আছে?চট করে একদিন থাপ্পড় মারলে তবে ঠিক হবে।
-নীলিত নীলিত?
নীলিত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে তার খুব ভাল লাগে।বিশেষ করে রাতের আকাশ।ছোট ছোট তারা,ছাদ দিন হলে সব কোথায় হাওয়া হয়ে যায়,কিছুতেই তার মাথায় আসে না।রাতই কেন হয়, দিনই কেন হয়-এমন আলো আধারের রহস্য কি সেটা বড় জানতে ইচ্ছে করে।চিত্রা বিছানা হতে উঠে ছাদে যায়।ছাদে ছেলেটা যথারীতি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।ছেলের কাছে যেয়ে কান ধরল।
-মা লাগছে।
-তোকে কখন হতে ডাকছি খেয়াল আছে?
-মা আমি কিছু শুনিনি।
-এভাবে হা করে আকাশ দেখলে শুনবি কিভাবে?
-মা তারা কোথায়?
পাশের বাসার মেয়েটার নাম তারা।নীলিতের চেয়ে একবছরের ছোট।মানে কি,ছোট-ছেলেটারও পাখা গজিয়েছে।
-ও তুই আকাশ দেখার নাম করে তারাকে দেখতে আসিস।
-হু মা।
-এই বয়সে এত পাকামো।দেখাচ্ছি মজা।
এই বলে টেনে ছাদ ছেলেকে নিয়ে যেতে লাগল।
-মা ছাড়,খুব লাগছে।তুমি যা ভাবছ তা না।
-আমি আকাশের তারা দেখতে এসেছি।
-দিনের বেলা আকাশের তারা থাকে?
-সেটাইতো মা বুঝতে পারছি না।রাতের বেলা তারা দেখি,দিনের বেলা দেখি আরে নেই।এমন কেন হয় মা?
চিত্রা ছেলেকে ছেড়ে দিল।বুঝল,ছেলেটার মাথা গেছে।
-এমনিই তো হবে,রাতের বেলা তারা থাকবে,দিনের বেলা থাকবে না।
নীলিত মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল-এমন কেন হয় মা?
চিত্রা রেগে বলল-তো কি হবে,রাতের বেলা সূর্য উঠবে আর দিনের বেলা তারা।
নীলিত মায়ের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলল না।বুঝতে পারল, মায়ের মন মেজাজ অত্যধিক খারাপ।মায়ের মন মেজাজ এত খারাপ তো কখনো দেখেনি।মায়ের সাথে রুমে বিছানায় বসল।
-তুই আর ছাদে যাবি না।
নীলিত মাথা নাড়ল।
-তুই কি কথা বলতে পারিস না ?
-আচ্ছা মা।
ছেলেটা এখন আচ্ছা বলছে,ঠিকই রাত হলে ছাদে চলে যাবে।
-ঠিক বলছ তো।
-হু মা।
-আর শোন।
-রূপার রুমে যাবে না।
-কেন মা?
-যাবে না বলছি যাবে না।আবার মুখে মুখে কথা কেন?ঠিক আছে?
নীলিত মাথা নাড়ল।রুম হতে বের হল।রুপার আপুর রুমে যেতে ইচ্ছে করছে বেশ।ঘটনাটা কি দেখতে হবে।শুধু খেয়াল রাখতে হবে মা যেন কিছুতেই দেখে না ফেলে।ধরা খেলে ধমুক তো খেতে হবেই তার সাথে থাপ্পড়।আপুর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।একটি মেয়ে বিছানায় বসে আছে।আর রুপা আপু ঘুমাচ্ছে।
-নীলিত ভিতরে আস।
কী ব্যাপার,মেয়েটা তার নাম জানল কিভাবে?তাকে-তো কখনো মেয়েটি দেখেনি।
-কি দাড়িয়ে আছ কেন?
নীলিত ভিতরে ঢুকল।
-আপনে কে?
-আমাকে চিনতে পারছ না?
-না
-আমি জলপরী।
-সেটা আবার কি?
-কেন তুমি পরীদের গল্প শুননি?
-না।
-ভেরি স্যাড।যে পরীরা জলে থাকে তাদের জলপরী বলে।জলে জলে ঘুরে বেড়ায়।
-আপনি এখন আর তো জলে নেই।তবে এখন আপনি স্থল-পরি।
-বা তুমি-তো দারুণ কথা বলতে পার।আমিতো ভেবেই দেখেনি।
-তুমি আমার নাম জানলে কি করে?
-বুদ্ধি খাটিয়ে বল,কিভাবে জানলাম?
-পরীরা তো সবার নামই জানে।
-বা তোমার তো খুব বুদ্ধি।
-তুমি এখানে এসেছ কেন?
-জলে ভাল লাগতেছিল না।তাই ভাবলাম কিছুদিন স্থল দিয়ে ঘুরে আসি।
-আমাকে তোমার সাথে নিয়ে জলে জলে ঘুরে বেড়াবে একদিন?
-অবশ্যই বেড়াব।
-আচ্ছা তুমি-তো সবই জান,তাহলে দিন কেন হয়, রাত কেন হয় বলতো?
-খুবই ভাল প্রশ্ন করেছে তো।এটা তো আমিও জানি না।
-তুমি না পরী,তুমি তো সবই জান।বল না প্লীজ।
মোহনী ধ্যানমগ্ন হল।
-কি হল,ধ্যান করা শুরু করলে যে?
-একটু ওয়েট কর।উত্তর সব পেয়ে যাবে।
নীলিত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর মোহনী চোখ মেলে তাকাল।
-কিরে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?
-উওর পেলে।
-হু।
-কেন হয়?
-সূর্য ও পৃথিবী যার যার অক্ষের চারদিকে ঘুরছে।যখন সূর্যের আলো পৃথিবীর যে অংশে পড়ে সে অংশ দিন বাকি অংশ রাত থাকে।কি বুঝলে?
-বুঝলাম।তুমি থাকাতে আমার তো খুব সুবিধা হল,যখন কোন প্রশ্ন মনে আসবে,তখনি তোমার কাছ হতে সমাধান পাব।
-ইয়েস মাই ডেয়ার ব্রাদার।
নীলিত খুব আনন্দ পেল।বলল-আমি তোমার ভাই হই।ও কি কি আনন্দ!তাহলে তো তুমি আমার আপু।
-আপু তুমি কিন্তু আমাদের ছেড়ে যেতে পারবে না।
-তাতো হয় না ভাই।আমাকে যে যেতেই হবে।
-না আমি তোমাকে কখনো কোথাও যেতে দিব না।
-ঠিক আছে ডেয়ার ব্রাদার।
নীলিত ইয়েস ইয়েস করে রুমের বাইরে চলে গেল।সে যে খুব খুশি,তা তার চোখ মুখ দেখলেই বুঝা যাচ্ছে।মায়ের রুমে গেল।
-মা মা, রূপা আপুর রুমে এক জলপরী আছে।খুব ভাল।
চিত্রা ছেলেটার দিকে তাকাল।মেয়েটা তার ছোট-ছেলেটার মাথাও খেয়েছে।মেয়েটার মতিগতি তো একদম ঠিক মনে হচ্ছে না।
-মা মা,আপু পরীতো।তাই সব জানেন।
চিত্রা রেগে বলল-আপু মানে?
-আমাকে ব্রাদার বলল,তাহলে তো আমার আপুই হবে।
-চুপ একদম চুপ।ওই ডাইনির আশে পাশে তুই যাবি না।
-মা আপু খুব ভাল।তাকে ডাইনি বলবে না।
চিত্রা ছেলের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল।গালে চট করে একটা থাপ্পড় মারল।নীলিত কান্না কান্না করতে রুম হতে বের হল।মোহনীর কাছে গেল।
-কি রে কি হয়েছে তোর,কাঁদিস কেন?
-মা থাপ্পড় দিয়েছে।
-কেন?
-আমি বললাম,তুমি পরী।মা বলল,ডাইনি।
-তুমি ভাই বলতে গেলে কেন?
-যা সত্যি তাইতো বলতো হবে।
-হুম ঠিক আছে।এবার কান্না বন্ধ কর।
নীলিত কান্না বন্ধ করল।এই সময় নিহাত রুমে প্রবেশ করল।
-মোহনী কেমন আছ?
মোহনী নীলিতের চুলে হাত ভুলিয়ে দিতে দিতে বলল-খুব ভাল।
দিনের আলো নিভে গেছে।ধরণীর বুকে নেমে এসেছে আধার।নিহাতের বাবা নীলিন আসার সময় হয়ে গেছে।সাতটা বাজে।সাতটা সাড়ে সাতটার মাঝে বাসায় আসেন।ছেলেমেয়েরা সবাই তাকে বেশ ভয় পায়।ভয়ে টিভির সিরিয়াল পর্যন্ত দেখতে পারে না।টিভি চালাতে দেখলেই খুব রেগে যায়।যেন টিভি দেখা মহা-অপরাধ।
-এই শুন বাবা আসার সময় হয়ে গেছে।
মোহনী নিহাতের দিকে তাকাল-তো?
-নীলিত রূপা রুম হতে এখন যা।
-থাক না,ওদের সামনেই বল।
-না বলা যাবে না।
অনিচ্ছা তবুও রূপা নীলিত রুমের বাইরে গেল।
-বাবা কিন্তু খুব কঠিন মানুষ।
-উনি কি বায়বীয় তরলে রূপান্তরিত হতে পারেন না?
-দেখ এটা ফাজলামি করার সময় না।
মুখে গম্ভীরতা এনে বলল-দেখ এটা ফাজলামি করার সময় না।
-উঃ তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
-হু বল,এবার আমি সিরিয়াস।
-বাবা এসেই তো মনে হচ্ছে হইচই বাজিয়ে দিবে।
-হইচই বাজাবে কেন?
-আসতে না আসতেই মা তোমার কথা কানে দিবে।ভাগ্যে কি আছে তা শুধু গডই জানে।
-ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই,তা নিয়ে ভেবে লাভ কি?
-শুন বাবা তোমাকে জেরা করতে পারে।কোথায় পড়,বাসা কোথায় জানতে চাইতে পারে।বলবে অণুজীব ইংরেজিতে মাইক্রোবায়োলজি ফাইনাল ইয়ার।বাসা আশে পাশে কোথাও বলবে।
-আশে পাশে বলতে?
-বলতে পার আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের পাশে।
-ওকে।কোন বিষয়ে পড়ি বললে?
-অণুজীব।ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে পড়াশুনা।
নিহাত ঠিক ভরসা পেল না।মেয়েটা বাবার সামনে কী গণ্ডগোল করে ফেলে কে জানে?তার কপালে যে শনি আছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
-নিহাত নিহাত?
নিহাতের বুকটা কেপে উঠল।বাবা গেটে দাড়িয়ে।প্রতিদিন গেটে দাড়িয়ে গেট-খুলার জন্য তার নাম ধরে ডাকে।মাথার চুল টানতে লাগল।দেখল পা দুটি কাঁপছে।ভয়ে ভয়ে গেটটা খুলে দিল।
-কিরে কি করছিলি,এত দেরি হল?
-এই তো বাবা পড়ছিলাম।
-তোর চুল এমন কেন?ধর ব্যাগটা ধর।
নিহাত ব্যাগটা ধরল।বাবার মুখটা হাসি হাসি।মনমেজাজ মনে হচ্ছে ভাল।এটাই যা ভরসার কথা।নীলিন রুমে ঢুকলেন।
-রুপা রুপা।
রুপা বাবার কাছে গেল।নীলিন বলল-মা এক গ্লাস সরবত বানা।নীলিত কই?
-বাবা ছাদে গেছে।
-যা সরবত বানিয়ে নিয়ে আয়।ফ্রিজে জল আছে না?
-আছে বাবা।ঠাণ্ডা জল দিয়ে বানাবি।
রুপা সরবত বানাতে গেল।নীলিন ফ্রেশ হয়ে আসল।
-কি তুমি এখন শুয়ে আছ যে?
চিত্রা চোখ বন্ধ করেই বলল-ইচ্ছে হয়েছে তাই শুয়ে আছি।
-তোমার কি শরীর খারাপ?শরীর খারাপ হলে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসি।
-না কিছু হয় নি।আমাকে কিছুক্ষণ ঘুমাতে দিবে প্লীজ।
-শুন একটা ভাল খবর আছে।
-বল।
-নিহাতের জন্য একটা ভাল মেয়ে দেখেছি।ভাবছি ছেলেটার বিয়ে দিয়ে দেয়।
এবার চিত্রা উঠে বসে।
-সে কাজ তোমার ছেলে সেরে ফেলেছে।
নীলিন হতভম্ব হয়ে গেল।তার ওয়াইফ কি তার সাথে মসকারা করছে।
-ছবিটা দেখ।পছন্দ হবে।
-ও দেখে আর লাভ নেই।পাশের ঘরে তোমার ছেলের বউ আছে,শখ থাকলে দেখে আস।
নীলিন রুপার রুমে একটি মেয়েকে দেখেছে।ভেবেছে রুপার বান্ধবী।ছেলেটা এমন কাণ্ড কীভাবে করল ভেবে পেল না।তার ইচ্ছে করছে হারামজাদাটাকে এখনি বাসা হতে বের করে দিতে।
-নিহাত নিহাত?
নিহাত বুঝতে পারল,মা বাবার কানে ঝাড়-মন্ত্র দিয়েছে।আজ খবর আছে তার।
-নিহাত নিহাত?
নিহাত হালকা হালকা ঘামছে।যদিও গরম ঘামার মত না।তার পাও কাঁপছে।বাবার কাছে গেল।
-ঘামছিস কেন?
-বাবা খুব গরম তো তাই।
-খুব গরম মানে,আজকে অন্যান্য দিনের তুলনায় কম।আমি কি ঘামছি?
-না।তাহলে?
-বাবা এমনেতেই ঘামি।ঠাণ্ডা গরম সব সময়।
-মাথার চুলগুলো ঠিক কর।
নিহাত মাথার চুল ঠিক করল।
-তোর নামে এসব কি শুনছি?
-কি শুনেছ বাবা?
-কেন তুই কিছু জানিস না?
-না তো।
-ঘরের মধ্যে একটা মেয়ে এলো কি করে?
-বাবা ও আমার ক্লাসমেট।বাসা হতে জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্চিছিল আজ,তাই চলে এসেছে।
-তা আমার বাসায় কেন?
-মেয়েটার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বাবা।বাবা ঠিক করেছি না।
নীলিন ধমুক দিয়ে বলল-চুপ থাক বল্লুক।
নীলিন উঠে দাঁড়াল।নিহাতের একটা থাপ্পড় খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।না,তা হল না।পাশ কাটিয়ে বাইরে গেল।নিহাত মনে মনে বলল-বাচা গেল।
নীলিন রুপার রুমে গেল।মোহনী উঠে দাঁড়াল।
-তোমার আজ বিয়ে?
মোহনী মাথা নাড়ল।
-তোমার নাম কি?
-মোহনী।
-বিয়েটা করলে না কেন?
-ছেলেটা ভাল না।মদ খায় গাজা খায়,তবুও সেই ছেলেটার সাথে বিয়ে দিতে চাই।বারবার বলেছি ছেলের ক্যারেক্টার খারাপ,সে মানবে নাতো মানবেই না।
-জান তোমার বাবা মা কত অপমান হবে?
-আমার বাবা মা নেই?চাচা চাচীর কাছে মানুষ।
-যারা তোমাকে এত ভালবাসা দিয়ে বড় করল,তাদের তুমি এতটা অপমান হতে দিবে?
মোহনী মাথা নিচু করে রইল।
-কি হল,আনসার মি।
-আর আমার সারাটা জীবন শেষ হবে তাতে,তা দেখলেন না।
-তা আমার বাসায় উঠলে কেন?
-কোন একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই চলে যাব।
-এখন তুমি কি করছ?
-নিহাতের সাথেই আছি।
-ও, গাধাটা এই জন্যই দিন দিন রেজাল্ট খারাপ করছে।তোমার পেছনে পেছনে ঘুরেই ওর এত অধঃপতন।যে ছেলে মেট্রিকে গোল্ডেন,ইন্টারে গোল্ডেন,সে ছেলে এত খারাপ অবস্থা রেজাল্টের সে তোমার জন্যই।আমার ছেলেটার মাথা তুমি খেয়েছ।আমি তোমাকে ছাড়ব না।তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিলাম।এর মধ্যে বাসা থেকে তোমাকে চলে যেতে হবে।
মোহনী মাথা নাড়ল।এমন সময় গেটে কে যেন কড়া নাড়ল।চিত্রা গেট খুলে দিতেই হতভম্ব হল।তার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।
-আমরা শাহবাগ থানা হতে এসেছি।আমাদের কাছে তথ্য আছে যে আপনারা একটি মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছেন।কি হল, সরুন,আমাদের ঢুকতে দিন।
চিত্রা সরে দাঁড়াল।পাঁচ ছয়জন পুলিশ রুমে ঢুকল।
-কি হল চিত্রা,কে এলো?
নীলিন ডাকতেই পেছন ফিরে দেখল কয়েকজন পুলিশ রুমে ঢুকছে।চিত্রার মুখ হতে কোন শব্দ বের হল না।তার পা দুটি খুব কাঁপছে।নীলিন উঠে দাড়াতেই বলল-বসুন আপনি।
নীলিন বসল না।বলল-আপনারা বসুন।আর তোরা ওই রুমে যা।
রুপা আর মোহনী পাশের রুমে গেল।
একজন পুলিশ বলল-আমরা শাহবাগ থানা হতে এসেছি।আমাদের কাছে তথ্য আছে এই বাসাতে একজন মেয়েকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
নীলিনের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
-এসব কি বলছেন?
আরেকজন পুলিশ বলল-স্যার একটা চটকানি দিব।চটকানি দিলে সব তথ্য গল গল করে বের হবে।
তাদের স্যার একটা সিগারেট ধরাল।বলল-ভাইজান এই কাজের সাথে কতদিন ধরে জড়িত?
নীলিন বুঝতে পারছে না,কি বলছে?
-কি ভাইজান,কথা বলছেন না কেন?
-আ আ
-কি আ আ করছেন?
-কোন কাজ ভাই?
-এই গালে একটা থাপ্পড় মারত।
-স্যার আস্তে মারব না জোরে মারব।
-আস্তে দিয়েই শুরু কর
একজন পুলিশ কনস্টবল থাপ্পড় দিল।হালকা করেই দিল।নীলিন ভ্যা ভ্যা করে তাকিয়ে রইল।
-নারীপাচারের সাথে কতদিন?
নীলিন বলল-স্যার আমি একটা কোম্পানির চাকুরীজীবী।
-দেখে তো মনে হয়,কিছু বুঝে না।তুমি যে গুরু সেয়ানা মাল,সে আমরা ভালভাবে জানি।চল,পাশের রুমে চল।
পাশের রুমে গেল।ও রুমে বাকি সবাই বসে আছে।
-ইনি ওয়াইফ,দুই মেয়ে আর দুই ছেলে।
নীলিন মাথা নাড়ল।পাশ হতে নীলিত বলল-না না আমার এক বোন।আর পাশেরটা পরী আপু।
সাথে সাথে স্যার হেসে দেওয়াতে কনস্টবলগুলো হেসে দিল।
-কি জনাব,আপনি যে মাথা নাড়লেন আপনার দুই মেয়ে?
নীলিন মাথা নিচু করে রইল।
-কি কথা বলছেন না কেন?
-ও আমার বোনের মেয়ে।
এমন সময় নীলিত কান্না স্বরে বলল-কি বাবা,তুমি না সেদিন বললে তোমার কোন বোন নেই।
নীলিন ছেলেটার দিকে বড় বড় করে তাকাল।নিজের ছেলে এতটা গবেট হতে পারে,তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না।ইচ্ছে করে ছেলেটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে।
-কি জনাব,নিজের ছেলের দিকে এত বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন কেন?
স্যার ছেলেটার কাছে গেল।মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-বা তুমি-তো খুব ভাল মানুষ।
-কেন?
-যারা সত্য কথা বলে তারা ভাল মানুষ।তো তুমি কি কর বাবা?
-আকাশ দেখি।আকাশ।
-আর কিছু?
-না শুধু আকাশ দেখি।
-বাহ খুব ভাল।
-আচ্ছা বলেন তো রাতে তারা দেখা যায়,দিনে দেখা যায় না কেন?
স্যার অন্যান্য কনস্টবলদের দিকে তাকায়।তাদের মুখের অবস্থা দেখে মনে হল,তারাও বোধহয় পারে না।ছোট-ছেলেটার কাছে নিজেকে তার খুব অসহায় লাগছে।
-সেতো জানি না বাবা।তুমি বলে দাও।
নীলিত হেসে বলল-আমিও জানি না।পরী আপু জানে।
স্যার মোহনীর দিকে তাকায়।
-আপনি পরী আপু?
-হু
-আপনি এ বাসার কে হন?
-কেউ না।
-তাহলে?
-রান্নাবান্নার কাজ করি।
-ও তাই।
স্যার নীলিত ছেলেটার কাছে গেল।বলল-তুমি ভাল আছ তো?
-না।
-কেন বাবা?
-মা আমাকে আকাশ দেখতে দেয় না।আর বাবা পড়াশুনার জন্য ধমুক দেয়।মাঝে মাঝে থাপ্পড়ও দেয়।
-আচ্ছা আমি খুব করে ধমুক দিয়ে দিব।আর?
-বাবাকে সবাই খুব ভয় পায়।বাবা বাসায় বথাকলে ঠিকমত কথাই বলতে পারি না।টিভিতে কত সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান হয়,কোন অনুষ্ঠান দেখতে পারি না।বাবা সবাইকে শুধু কারণে অকারণে বকেন।আজকেও ভাইয়াকে খুব করে বকেছেন।পরী আপুকেও বকেছেন।
স্যার নীলিনের দিকে তাকাল।বলল-আমরা বুঝতে পারছি আপনি নারী পাচারের সাথে যুক্ত না।তবে আপনার মত মানুষ বড় ধরণের অপরাধীই বটে।
-কি অপরাধ করেছে আমি?
-ছেলের মুখেই তো সব শুনলেন।
নীলিন মাথা নিচু করে রইল।ছেলেমেয়েরা এমন সব কথা বলতে পারে,ভাবতেই পারে নি।সারাজীবন তো সবকিছু ছেলেমেয়েদের জন্যই করলেন।
-কনস্টবল,একে কি মামলায় ফাঁসানো যায়?
-স্যার অনেক।শিশু নির্যাতন,নারী নির্যাতন,পরিবার নির্যাতন।অপরাধ তো খুব গুরুতর।একটি পরিবার হচ্ছে সমাজের মূল ভিত্তি।সেই মূল ভিত্তিকেই ভালভাবে বাড়তে দিচ্ছে না।
-আচ্ছা একে হ্যান্ড-কাফ পড়াও।
একজন পুলিশ হ্যান্ড-কাফ পড়াল।স্যার বলল-চল।
এমন সময় চিত্রা বলল-স্যার একে নিয়ে গেলে আমরা বাচব কিভাবে?
-চিন্তা করবেন না চাল ডাল সব পাঠিয়ে দিব।
নীলিত কেঁদে বলল-প্লীজ বাবাকে ছেড়ে দাও।
-বাবা কান্না করে না।তোমার বাবা আবার ফিরে আসবে।তবে তাকে শাস্তি পেতে হবে।সমাজে অপরাধীরা শাস্তি না পেলে তা আমাদের সুন্দর সমাজের জন্য হেতুকর নয়।এখন তুমি বল,আমি কি করব?রেখে যাব না নিয়ে যাব।
নীলিত হাউমাউ করে কেঁদে বলল-নিয়ে যান।
-ধন্যবাদ বাবা।ইউ আর দি ট্রু সান অব দা কান্টি।
পুলিশ নীলিনকে নিয়ে বের হল।সবাই কাঁদতে লাগল।শুধু মোহনী ছাড়া।তারও কান্না করতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু চোখ দিয়ে পানি কিছুতেই বের হচ্ছে না।
পরের দিন সকাবেলা।চিত্রা প্রতিদিন সকালে উঠে রান্না করে।কিন্তু সকাল আটটা পেরিয়ে গেল চিত্রা তবু ঘুম থেকে উঠল না।নীলিতের স্কুল আটটায়,রুপার সাড়ে আটটায় আর আর নিহাতের ক্লাস আজ নয়টায়।মোহনী রান্না রুমে গেল।কিছু একটা রান্না তো করতেই হবে।না হলে যে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।ভাবল খিচুড়ি রান্না করবে।চাল ডাল একসাথে দিয়ে দিলেও হল।নীলিতের স্কুলে যাওয়ার কোন ইচ্ছে দেখা যাচ্ছে না।সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছাদে চলে গেছে।ইচ্ছেমত আকাশ দেখছে,কেউ কিছু বলছে না।রুপা এখনও ঘুম হতে উঠেনি।মনে হচ্ছে না দশটার আগে ঘুম থেকে উঠবে।মেয়েটার ঘুম একটু মনে হয় বেশিই।কালকে বিকেলেও অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে।এমনিতে তো এত দেরি করে উঠতে পারে না,বাবার ধমুক খেয়ে সকালে উঠেছে।তাই আজ বোধহয় ঘুমিয়ে নিচ্ছে।নিহাত সকালেই উঠছে।সকালে উঠে কম্পিউটারে গেমস খেলছে।মাঝে মাঝে গান শুনছে।তাদের মধ্যে বিরাজ করছে স্বাধীনতার এক ধরণের আনন্দ আবার বাবা জেলে যাওয়ার ব্যথা।মিশ্র সুখ দুঃখ।নিহাত মাঝে মাঝে মোহনীর দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটার দিকে যতবার তাকায় ততবারি খুব ভাল লাগে।নিহাত রান্না রুমে গেল।
-কি দেবী,আপনি রান্না রুমে?
-দেবতারা না খেয়ে,রান্না তো করতেই হবে।
-কি রান্না করছ?
-আমার মাথা।
নিহাত মোহনীর মাথার দিকে ভাল করে তাকাল।
-কি আমার দিকে এমন হা করে তাকিয়ে আছ কেন?
-তোমার কি মাথা দুইটা?
-কেন?
-মাথা তোমার ঠিকঠাকই আছে।তবে মাথা রান্না করছ কিভাবে?
মোহনী হেসে দিল।তা দেখে নিহাতও হেসে দিল।মোহনী বলল-যাওতো।
-একটা কথা বলব।
-বল।
-তোমাকে না দেখতে একেবারে ফাটাফাটি লাগছে।
-কি?
-কিছু না।
এই বলে নিহাত রান্না রুম হতে বের হয়ে আসে।মোহনী মনে মনে হাসে।ছেলেটা যে কিনা?খিচুড়ির সাথে আর কি রান্না করা যায়,মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে লাগল।ডিম ভাজি,আলু ভাজি সাথে গরম গরম খিচুড়ি।চিত্রার রুমে গেল।
-খালা খালা।
চিত্রা চোখ মেলে তাকাল।
-খালা নয়টা বেজে গেছে।হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া করেন।
চিত্রার মেয়েটার উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।এই মেয়েটা আসার পর ফ্যামিলিতে যতসব ঝামেলা হচ্ছে।মেয়েটা খালা খালা করছে এটা শুনে তার মনমেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে।তার মা কি তার বোন যে তাকে খালা খালা করবে।
-খালা খালা।
চিত্রা এবার উঠে বসল।বলল-কি বলবে বলে ফেল?
-খালা রান্না হয়েছে।হাতমুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া করেন।
-তুমি আমাকে খালা খালা করছ কেন?তোমার মা কি আমার বোন হয়?
কি মাথা নিচু করলে কেন?উত্তর দাও।
-তাহলে কি বলব?
-কিছু বলতে হবে না।তুমি সামনে হতে যাও।
মোহনী দাড়িয়ে রইল।তার চোখ দিয়ে জল আসবে আসবে ভাব।কোনমতে আটকাল।রুম হতে বের হতেই আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না।উড়না দিয়ে চোখ দুটি মুছল।রুপার রুমে গেল।
-রুপা রুপা উঠ।
-আপু আর একটু ঘুমাই না।
-উঠ।খিচুড়ি ঠাণ্ডা হলে ভাল লাগবে না।সাথে ডিম ভাজি আর আলু ভাজি।
রুপা উঠল।উঠতে যেন তার খুব কষ্ট হল।
-যা ফ্রেশ হয়ে আই।
এরপর মোহনী ছাদে গেল।
-কি আকাশ দেখা হল?
-না।
-চল এখন খাবে।
-একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না যা রাতের বেলা তারা থাকে,দিনের বেলা থাকে না কেন?
-উত্তরটা এখনি জানতে হবে।খাওয়া দাওয়া কর তারপর বলি।
-না এখনি বল।
-দিনের বেলায় সূর্যের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।এই আলোর তুলনায় তারাগুলোর আলো খুব ক্ষীণ।তাই দিনের বেলা তারাগুলো দেখে যায় না,রাতের বেলা দেখা যায়।
-তাই বুঝি?
-কেন?
-আমি আর কত কি ভেবে ফেলেছি?
-আমি ভাবলাম,তারাগুলো অশরীরি আত্মা।তাই দিনের বেলায় দেখা যায় না,রাতের বেলা দেখা যায়।রাতের বেলায় তারাগুলো আকাশে ভর করে।
-এখন চল।এসব কথা পড়ে হবে।খেয়েদেয়ে তারপর।
-আচ্ছা চল।
সবাই খাবার টেবিলে বসল।শুধু চিত্রা ছাড়া।নিহাত ডাকল কয়েকবার।তাতেও কোন সাড়া মেলল না।মোহনী খাবার নিয়ে গেল চিত্রার রুমে।
-আপনার জন্য খাবার এনেছি।
-তোমাকে খাবার দিতে বলেছি?
-সকালের খাওয়ার সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে।
-তোমার মত ডাইনী মেয়ের হাতের রান্না খাব,কিভাবে ভাবলে?তুমি এসে আমার সংসারটা তছনছ করে দিয়েছ।আমি তোমাকে ছাড়ব না।এভাবে দাড়িয়ে থাকবে না।যাও।
মোহনী খাবার টেবিলে গিয়ে বসল।
-চল শুরু করি।
নিহাত মুখে দিয়েই বলল-ও দারুণ।এমন খাবার বাপের জন্মে খাইনি।
মোহনী মুচকি হেসে নিহাতের দিকে তাকিয়ে বলল-এত গালগল্প করতে হবে না।এবার খাও।
-আমি গালগল্প করছি।রুপি বলতো।
রুপা কঠিন গলায় গলায় বলল-তোমাকে কতদিন বলেছি না রুপি রুপি করবে না।
-যা নাম তাই বলছি।
-আমিও কিন্তুও বলে দিব।
-রুপা সোনা বোন আমার।অমন কথা মুখে আনে না বোন।
মোহনী বলল-রুপা বলে ফেল।
-রুপা তুই আমার সোনা বোন।তোকে আইসক্রীম খাওয়াব।
-তোমার আইসক্রীম তুমি খাও।মিথ্যাবাদী একটা।আগেরটা এখনো বাকি।
-আগেরটা সহ খাওয়াব।
-আপু,ভাইয়া না বিছানায় সিসি করে।
মোহনী হেসে দিল।বলল-এই বয়সেও।
নিহাত মনে মনে বলল-দিলে রে সব মাটি করে দিলি।একেবারে প্রেস্টিজ জল করে দিলি।
রুপা বলল-হু।
নিহাত রুপার চুল ধরে বলল-একদম মিথ্যা কথা বলবি না।এত মিথ্যা কথা কই হতে শিখেছিস বল?
-লাগছে ভাইয়া।
-লাগার জন্যই দিচ্ছি।মিথ্যা কথা বলবি আর শাস্তি হবে না,তা হবে না।
-আপু ভাইয়াকে ছাড়তে বল।
মোহনী মুখটা শক্ত করে বলল-নিহাত ছেড়ে দাও বলছি।
নিহাত ছেড়ে দিল।–এরপর যদি কিছু বলেছিস,এমন চটকানি দিব যে সব ভুলে যাবি।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুপার রুমে গেল।
-রুপা স্কুলে যাবি না।
-আজকে যেতে ইচ্ছে করছে না।
মোহনী নিহাতের দিকে তাকাল।
-কি তুমি যাবে না?তোমার ক্লাস সময় হয়ে এসেছে।
-তুমিও চল।ক্লাসটা করে আসি।
-আমি যাব না।তুমি ক্লাস করে আস।
-তাহলে আমিও যাব না।আজকে ঠিক যেতে ইচ্ছে করছে না।
-খালু না থাকায় সবার খুব মজা।মনের ভিতর তো কারও কষ্ট দেখতে পাচ্ছি না।নিহাত বের হ।শাহবাগ থানায় যেতে হবে।খালুকে বের করে আনতে হবে।
নিহাত নীল রংয়ের টি শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পড়ল।মোহনী পড়ল লাল রংয়ের শাড়ি।দুজন বের হবে এমন সময় গেটটায় কে যেন নক করল।নিহাত গেট খুলে বিস্মিত হয়ে গেল।তার বাবা সামনে দাড়িয়ে।
-মা মা বাবা এসেছে।বাবা তুমি ভাল আছ তো?
চিত্রা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।সংশয় হচ্ছে,ভুল শুনল নাতো।সাথে সাথে রুম হতে বের হল।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।নীলিন তার রুমে গেল।সাথে সাথে তার ছেলে মেয়ে ওয়াইফও গেল।চিত্রা রুপাকে বলল-যা এক গ্লাস শরবত বানিয়ে নিয়ে আয়।
রুপা শরবত বানাতে গেল।
-তুমি ঠিক আছ তো।
নীলিন কোন কথা বলল না।বারবার সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
-কি হল কথা বলছ না কেন?
নীলিন বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
-ওরা কি তোমাকে মেরেছে?খুব কষ্ট হয়েছে তোমার?
তবু নীলিন কিছু বলল।চোখটা বন্ধ করল।
-ছোট মরিচটাকে এবার শিক্ষা দিতে হবে।খুব বার বেড়েছে।
নীলিন বলল-না,নীলিতকে তুমি কিছু বলবে না।ও আমার চোখ খুলে দিয়েছে।আমি তোমাদের শাসন করি।কিন্তু মাত্রাটা বোধহয় বেশি হয়ে গেছে।আমি আর কাউকে কিছু বলব না।যে যার ইচ্ছা মত চলবে।তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও।
চিত্রা বরের মাথায় হাত রেখে বলল-এসব কি বলছ?তুমি ওদের বাবা,তুমি ওদের শাসন করবে না তো কে করবে?
-আমি ভাল বাবা হতে পারি নি।আমি শুধু শাসনই করেছি কিন্তু ওদের ভালবাসা দিতে পারি নি।কারণে অকারণে ওদের বকাঝকা করেছি।এটা ঠিক না।যে বাবা তার ছেলেমেয়েদের ভালবাসা দিতে পারে না,তার শাসন করার অধিকার নেই।
-তুমি শান্ত হও।সারা রাত কি জেলেই ছিলে?
-জেলে ঢুকালে জেলে থাকব।আমাকে বাইরে নিয়েই ছেড়ে দিয়েছে।আমার প্রতি যাদের ভালবাসা নেই,তাই তাদের কাছে ফিরে আসতে চাই নি।সারা রাত বাইরে এদিক ওদিক ঘুরেছি।ভাবলাম,তোমাদের সাথে শেষ দেখাটা করেই যাই।আর তোমাদের শাসন করতে আসব না।তোমরা এখন হতে পুরোপুরি স্বাধীন।
এই বলে নীলিন বিছানা হতে উঠল।চিত্রা বলল-কই যাচ্ছ?
-জানি না।
-ওদের দেখবে কে?
-ওরা এখন বড় হয়েছে।নিজেদের দেখাশুনা নিজেরাই করতে পারবে।
-তাহলে আমাকেও সাথে নিয়ে চল।আমিও এখানে থাকতে চাই না।
-আমি কোথায় যাব,তার তো কিছু ঠিক নেই।নিজেই কিভাবে চলব তার ঠিক নেই ,তোমাকে নিয়ে কিভাবে চলব?
-তোমার চললে আমারও চলে যাবে।
এমন সময় তিন ভাইবোন বাবার পায়ে পড়ল।হাউমাউ করে কান্না করল।নিহাত বলল-বাবা এবারের মত আমাদের ক্ষমা করে দাও।আমরা আর তোমার কথার অবাধ্য হব না।
-উঠ পাগলেরা উঠ।
তিন ভাইবোন উঠে দাঁড়াল।নীলিন বলল-তোরা ভাল থাকিস।আমি চললাম।
নীলিন হাটতে থাকে।পিছনে পিছনে আর বাকি সবাই আসতে থাকে।গেট খুলে বের হল।
-তোরা সবাই ভিতরে চলে যা।
নীলিত বলল-না বাবা,আমরাও যাব।তুমি ছাড়া আমরাও এ বাসায় থাকব না।
নীলিন হাটতে থাকে।পাশে তার ওয়াইফ।পিছনে ছেলেমেয়ে আর মোহনী।হাটতে হাটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।প্রচণ্ড খিদে লেগেছে সবার।
নীলিত বলল-বাবা খিদা লেগেছে।
নীলিন বাকি সবার মুখের দিকে তাকাল।সবার চোখ মুখ শুকনা।তার নিজের পেটও যে খা খা করছে।
-তোরা সবাই বাসায় চলে যা।যেখানে আমার নিজের খাবারই নেই সেখানে তোদের খাওয়াব কি করে?
সবাই ফুটপাতের উপর বসে পড়ে।মোহনী বলল-আমার কাছে একশ টাকা আছে।এ দিয়ে কোন হোটেলে শুধু ডালভাত হয়তো খাওয়া যাবে।
একটি হোটেলে ঢুকল।হোটেলের নাম হোটেল ডাল ভাত।হোটেলে গিয়ে বসল।ডালভাত মনে হল অমৃত।খাবার খেয়ে বেড়াল।হাটতে হাটতে এক পার্কে ঢুকল।পার্কের মাঝখানে একটি পুকুর।পুকুরের সামনে গিয়ে বসল।বেশ বাতাস হচ্ছে।বাতাসে শরীরটা একেবারে জুড়িয়ে গেল।সারাদিন খা খা রোদে ঘুরে খুব ক্লান্ত লাগছে।সামনে একটা নৌকা।সবাই নৌকাই উঠল।নীলিন বলল-আমরা ছোটবেলায় জার্নি বাই বোট পড়েছি।আজ তা হয়ে যাক।কি বল সবাই?
চিত্রা কিছু বলল না।তার বরের মাথাটা একেবারে গেছে কিনা কে জানে?ভেবেছিল,কিছুক্ষণ হাটলেই বুঝি বাসায় ফিরে যাবে।এখন তো দেখা যাচ্ছে বাসায় ফেরার কোন নাম গন্ধই পাওয়া যাচ্ছে না।কোনদিন যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না।
নীলিন বৈঠা দিয়ে নৌকা চালাতে লাগল।বলল-নীলিত তুমি জার্নি বাই বোট পড়েছ।
-হু বাবা।ক্লাস ফোরে ছিল।কেমন লাগছে?
-ভাল লাগছে বাবা।পরিবেশটাও খুব সুন্দর।
এভাবে সন্ধ্যা নেমে এলো।রাত্রি আটটার দিকে হোটেলে খেয়ে নিল।এরপর ফুটপাতে বসে রইল।
নীলিত বলল-বাবা আমার খুব ঘুম ধরেছে।
-তাহলে শুয়ে পড় বাবা।
-কোথায় ঘুমাব বাবা?
-আশেপাশের লোকজন কই ঘুমাচ্ছে?
-রাস্তার উপর।পলিথিন বিছিয়ে।
নীলিন কিছুটা রাস্তা পলিথিন বিছিয়ে দিল।এরপর শুয়ে পড়ল।রুপা বলল-বাবা ইট মাথায় লাগে।এছাড়া গাড়ির প্রচণ্ড শব্দ।ঘুম আসছে না।
-আশেপাশের সবাই তো এভাবেই ঘুমাচ্ছে।
এমন সময় একটা লোক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মুখভরা কাশ নীলিনের ঠিক মাথার কাছে ফেলল।লোকটার আক্কেল বলে কি কিছু নেই?তারা ঘুমাচ্ছে,মাথার সামনে কাশ ফেলে চলে গেল।একটা থাপ্পড় মারতে পারলে ভাল হত।চোখটা মেলে আকাশে তাকাল।আকাশে পূর্ণ ছাদ।চাদের আলোয় ঝিকমিক করছে আকাশ।চোখটা বন্ধ করল।মনে হল,জীবনটা খারাপ না।বেশ ঘুম ধরছে।সারাদিন তো আর খাটনি কম হয় নি।
-এই উঠ,শালারা উঠ।শালার নতুন আমদানি।শালারা শুবি শো আমাদের জায়গায় এসে শুতে হবে কেন?
নীলিন চোখ মেলে তাকাল।ছেলেমেয়ে সহ চার পাঁচজন লোক।
-এখানে আমরা ঘুমাই ভাবেই।জায়গা ছাড়েন।
নীলিন বলল-ভাই এখানে কারও নাম লেখা ছিল না।তাই আমরা জায়গা ছাড়ব না।
-শালা মেরে তক্তা বানিয়ে দিব।মুখে মুখে কথা।
নীলিন কিছু বলতে যাবে চিত্রা থামাল।বলল-আমরা ছেড়ে দিচ্ছি।
এই বলে তারা একটু দূরে গিয়ে পলিথিন পাতল।কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল।ঘুম ভাঙ্গল প্রচণ্ড বৃষ্টিতে।নিহাতের মনে হচ্ছিল,কে যে পানি ঢেলে দিচ্ছে।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে।সবাই বসে আছে।শরীরে কাঁপন শুরু হয়েছে।কিছু দিয়ে মুছবে সে জো নেই।কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামল।নীলিত বলল-বাবা ভোরের সূর্য,দেখ কি সুন্দর?চারদিকে আলোক রাশি ছড়িয়ে পড়ছে।
নীলিন তাকাল।ভোরের প্রথম আলো যে কবে দেখেছে তা ঠিক মনে পড়ে না।তাদের সবাই ভোরের প্রথম আলো দেখছে।মোহনী বলল-কী সুন্দর,কী সুন্দর!
এরপর নীলিন তিনটা রিক্সা ডাকল।চিত্রা বলল-রিক্সা ডাকছ কেন?
-কেন আবার,সারাজীবন এখানে পড়ে থাকব নাকি?আমাদের থাকার একটা বাড়ি আছে নাকি?
চিত্রা কি বলবে ভেবে পেল না।তবে তার খুব আনন্দ হচ্ছে।মনে হচ্ছ খুব হইচই করতে।রুপা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল-থ্যাংক ইউ বাবা।
নীলিন বলল-তোদের অনেক কষ্ট দিয়েছি।আর না।
রুপা,নীলিত,নিহাত,মোহনী একসাথে হুররে হু করে উঠল।চিত্রা ও নীলিন তাদের আনন্দ দিচ্ছে।তাদের খুব ভাল লাগছে।
কয়েকদিন পর।নীলিন অফিস হতে ফিরেই নিহাতকে ডাকল।
-তোমার জন্য একটা মেয়ে দেখছি।সামনে রবিবার তোমার বিয়ে।
-বাবা আমার এখনও পড়া শেষ হয় নি।
-সে আমি জানি।মেয়েকে তোমার মাও দেখেছে।আমাদের দুজনের খুব পছন্দ।
-বিয়ে করে খাওয়াব কি?
-সে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।তোমার খাওয়া যেহেতু চলছে সেহেতু তোমার ওয়াইফের খাওয়াও চলবে।মোহনীকে ডাক।
নিহাত ডাকল-মোহনী মোহনী?
মোহনী আসল।
নীলিন বলল-মোহনী আমি মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে খোজ নিয়েছি।এ নামে কেউ নেই।আজিমপুরে বাসার যে ঠিকানা দিয়েছিলে সেটাও ভুল।সে নামে কোন বাসা নেই।সত্য কথা বল।হু আর ইউ?
মোহনী বলল-খালু আমি মিথ্যা কথা বলেছি।আমি সরি।
-তোমার যে বিয়ে ঠিক হয়েছিল,সেটাও কি বানানো?
-না খালু।আমার চাচা চাচী এক চরিত্রহীন ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল।
-তোমার বাড়ি কোথায়?
-টাংগাইল,আকুরটাকুর পাড়া।
-কি করতে?
-কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তাম।মাওলানা ভাসানীতে।
-নিহাতের সাথে আগে পরিচয় ছিল?
-না খালু।
-তাহলে ওর সাথে এখানে আসলে কিভাবে?
-নিহাত আমার অসহাত্ব দেখে বাসায় নিয়ে এসেছিল।রমনা পার্কে আমাদের দেখা হয়েছিল।
-তার মানে বলতে চাইছ নিহাতের সাথে কোন রিলেশন তোমার ছিল না এখনও নেই।
-হু।
-নিহাতের জন্য একটা মেয়ে ঠিক করে ফেলেছি।ছবিটা দেখ।আর তোমার বিয়ের ঝামেলাটা যেহেতু শেষ হয়েছে,তাই এলাকায় যেয়ে পড়াশুনা সম্পন্ন কর।চাচার বাসায় থাকতে হবে না।আমি তোমাকে হোস্টেলে তুলে দিব।মাস মাস টাকা পাঠাব।
-হু।
-যাও।
নিহাত আর মোহনী দুজনে একসাথে রুম হতে বের হল।নিহাতের হাতে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটার ছবি।নিহাতের ইচ্ছে করল ছিঁড়ে ফেলতে।এমন বিশ্রী একটা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে বাবা মা,রুচি বলে কি কিছু নেই?মোহনী হাত হতে ছবিটা নিয়ে বলল-বাহ তোর বউ দারুণ তো।দেখতে তো একদম ঝাক্কাস।
-ঝাক্কাস না ছাই।ও ডাইনিকে আমি বিয়ে করতে পারব না।
-দেখ কপালে টিপটা অনেক সুন্দর লাগছে।
নিহাত মোহনীর হাত ধরে বলল-কিছু একটা কর।
মোহনী নিহাতের দিকে তাকাল।ছেলেটার চোখ ছলছল করছে।হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হেসে বলল-খুব সহজ উপায় আছে।
-কি?
-পালা।বিয়ের পর বাসায় চলে আসবি।
-ভাল একটা দে।
-ভাল না লাগলে নাই।তুমি নিজে খুঁজে বের কর।
এই বলে রুপার রুমে গেল।নিহাতের খুব খুব অস্থির লাগছে।ঘুরে ফিরে মোহনীর কথা মাথায় ঘুরে ফিরে আসে।মেয়েটাকে এত ভাল লাগে কেন বুঝতে পারে না।এই রকম অস্থিরতায় কয়েকদিন গেল।শনিবার বিকেলবেলা।মোহনী আর নিহাত ছাদে দাড়িয়ে আছে।নিহাত বলল- একটা কথা বলব।
-বল।
-আমার বিয়েটা হলে তুই খুশি হবি?
প্রথমে মোহনীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।এরপর হাসি টেনে এনে বলল-তোর বিয়ে আর আমি খুশি হব না,তাই কি হয়?
-নিজেকে এখন আটকে রাখার সময় এখন নয়।
-মানে কি?
-প্রথমে তোর মুখের অবস্থা কি হয়েছিল,তা কি এত সহজে লুকানো যায়?আমার যে তোকে দরকার।খুব দরকার।অন্য মেয়ে তোর মত আমাকে ভালবাসতে পারবে?
-এই সব কি বলছিস?
এবার মোহনীর হাত ধরে বলল-তুই কি আমাকে সত্যিই ভালবাসিস না?
মোহনীর চোখ ছলছল করে উঠল।বুকের ভিতরটা কেমন যেন করতে লাগল।উড়না দিয়ে মুখ ঢাকল।নিহাত ছাদ হতে চলে গেল।এই বিয়েটা তাকে ঠেকাতেই হবে।দরকার হলে বাসা হতে পালাবে।যে মেয়েকে সে ভালবাসে না সে মেয়েকে বিয়ে করার কোন মানে হয় না।
বিয়ের দিন।সন্ধ্যাবেলা।ছেলেকে সকালবেলা হতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সারা ঢাকা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজা হয়েছে।কোথাও পাওয়া যায় নি।মেয়ে পক্ষ ইতিমধ্যে জেনে গেছে।মেয়ের বাবা নীলিনকে বলেছে-দেখুন ছেলে একটি মেয়েকে ভালবাসে।দিয়ে দিন না সে মেয়ের সাথে বিয়ে। আমার মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে কি সর্বনাশ হয়ে যেত বলুন তো?নিজের ছেলের খোঁজখবর রাখেন না কেমন বাবা আপনি?
নীলিন একটা কথাও বলে নি।ছেলেটা এমন কাণ্ড করেছে,কথা শুনা তো তার প্রাপ্য।
চিত্রা এসে বলল-মোহনী,বলতো ছেলেটা কয় গেল?
-আমি কিভাবে বলব খালাম্মা?
রাত বেজে বারটা।চিত্রা কান্না শুরু করেছে ঘন্টাখানেক।নীলিনের মনটাও যেন কেমন করে উঠল।ছেলের অমতে বিয়ে ঠিক করা কিছুতেই ঠিক হয় নি।এমন সময় নীলিন একটা চিরকুট পেল।তাতে লেখা-দেখা হোক তবে মনমোহনীর নিচে।নিজের ছেলের লেখা,তাতে সন্দেহ নেই।এটা আবার কি কে জানে?গবেট ছেলেটা একটু ভাল করে লিখে গেলেই বের করা যেত।নীলিন ডাকল-মোহনী মোহনী।
মোহনী আসল।
-দেখতো এই চিরকুটটা।
মোহনী দেখে বলল-খালু তাড়াতাড়ি বের হন।এই গাছটা আমি চিনি।রমনা পার্কে।
মোহনী চিত্রা আর নীলিন রিকসায় উঠল।নীলিন বলল-মামা একটু জোরে।খুব জলদি।
রিকশাওয়ালা তাড়াতাড়ি পেটেল চালাতে লাগল।খালি রাস্তা।মিনিট পনেরের মধ্যে রমনা পার্কে এসে পড়ল।এরপর ভিতরে ঢুকল।
-কোন দিকে মা?
-এই দিকে খালু।
তারা তিনজন এগোতে থাকে।কিছুদূর এগোতেই দেখে একটি ছেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে তার সামনে বসে আছে।ছেলেটেকে চিনতে কারও ভুল হল না।যদিও আবছা আলোয় মুখ তখনো দেখা যাচ্ছে না।চিত্রা ছেলেকে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।নীলিন বলল-গাধা ছেলে কোথাকার?এখানে বসে কি করছিস?
-বাবা বিয়ে করতে এসেছি।
-এখানে বিয়ে করবি মানে?মাথা ঠিক আছে তোর।
-বাবা আমি যাকে ভালবাসি প্রথম দেখা এই মনমোহনীর নিচেই হয়েছিল।
-এখানে বসে থাকলে মেয়েটা আসবে?
-এসেছে তো বাবা।
-কই?
-তোমরাই তো নিয়ে এলে।
নীলিন মোহনীর দিকে তাকাল।মোহনী লজ্জা পেল।নীলিন মোহনীর হাতটা তার ছেলের হাতে দিয়ে বলল-মা,আমার পাগল ছেলেটাকে তুমি দেখে রেখ।
এরপর দুজনে বাবা মাকে সালাম করল।নীলিন বলল-সুখী হও মা।সুখী হও।
চিত্রা বলল-এবার তাহলে চল।
নিহাত বলল-মা তোমরা যাও।আজকে আমি আর মোহনী মনমোহনীর নিচে কাটাই।সকাল হলেই এসে পড়ব।
নীলিন বলল-আচ্ছা থাক।সকাল হলেই আসিস।
এরপর চিত্রা ও নীলিন বাসায় চলে এলো।মোহনী মনমোহনীর নিচে একটা চাদর বিছাল।এরপর দুইজন পাশাপাশি শুইল।মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল।মোহনী বলল-দেখ,কি সুন্দর জোনাকির আলো?
জোনাকির আলোয় মনমোহনী বৃক্ষকে লাগছে মায়াবী।এলোমেলো বাতাস বইছে।নিহাত মোহনীর দিকে তাকিয়ে বলল-সবচেয়ে সুন্দর লাগছে কি বলতে পারবে?
-কি?
-তোমাকে।তোমার চিরচেনা অপরূপ মুখ।
তাই শুনে মোহনী হেসে উঠে।নিহাত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।মনে মনে ভাবে,এভাবে যদি অনন্তকাল কেটে যেত,তবে বেশ হত!
নিহাত ডাকল-মোহনী মোহনী?
মোহনী আসল।
নীলিন বলল-মোহনী আমি মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে খোজ নিয়েছি।এ নামে কেউ নেই।আজিমপুরে বাসার যে ঠিকানা দিয়েছিলে সেটাও ভুল।সে নামে কোন বাসা নেই।সত্য কথা বল।হু আর ইউ?
মোহনী বলল-খালু আমি মিথ্যা কথা বলেছি।আমি সরি।
-তোমার যে বিয়ে ঠিক হয়েছিল,সেটাও কি বানানো?
-না খালু।আমার চাচা চাচী এক চরিত্রহীন ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল।
-তোমার বাড়ি কোথায়?
-টাংগাইল,আকুরটাকুর পাড়া।
-কি করতে?
-কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তাম।মাওলানা ভাসানীতে।
-নিহাতের সাথে আগে পরিচয় ছিল?
-না খালু।
-তাহলে ওর সাথে এখানে আসলে কিভাবে?
-নিহাত আমার অসহাত্ব দেখে বাসায় নিয়ে এসেছিল।রমনা পার্কে আমাদের দেখা হয়েছিল।
-তার মানে বলতে চাইছ নিহাতের সাথে কোন রিলেশন তোমার ছিল না এখনও নেই।
-হু।
-নিহাতের জন্য একটা মেয়ে ঠিক করে ফেলেছি।ছবিটা দেখ।আর তোমার বিয়ের ঝামেলাটা যেহেতু শেষ হয়েছে।এলাকায় যেয়ে পড়াশুনা সম্পন্ন কর।চাচার বাসায় থাকতে হবে না।আমি তোমাকে হোস্টেলে তুলে দিব।মাস মাস টাকা পাঠাব।
-হু।
-যাও।
নিহাত আর মোহনী দুজনে একসাথে রুম হতে বের হল।নিহাতের হাতে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটার ছবি।নিহাতের ইচ্ছে করল ছিঁড়ে ফেলতে।এমন বিশ্রী একটা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে বাবা মা,রুচি বলে কি কিছু নেই?মোহনী হাত হতে ছবিটা নিয়ে বলল-বাহ তোর বউ দারুণ তো।দেখতে তো একদম ঝাক্কাস।
-ঝাক্কাস না ছাই।ও ডাইনিকে আমি বিয়ে করতে পারব না।
-দেখ কপালে টিপটা অনেক সুন্দর লাগছে।
নিহাত মোহনীর হাত ধরে বলল-কিছু একটা কর।
মোহনী নিহাতের দিকে তাকাল।ছেলেটার চোখ ছলছল করছে।হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হেসে বলল-খুব সহজ উপায় আছে।
-কি?
-পালা।বিয়ের পর বাসায় চলে আসবি।
-ভাল একটা দে।
-ভাল না লাগলে নাই।তুমি নিজে খুঁজে বের কর।
এই বলে রুপার রুমে গেল।নিহাতের খুব খুব অস্থির লাগছে।ঘুরে ফিরে মোহনীর কথা মাথায় ঘুরে ফিরে আসে।মেয়েটাকে এত ভাল লাগে কেন বুঝতে পারে না।এই রকম অস্থিরতায় কয়েকদিন গেল।শনিবার বিকেলবেলা।মোহনী আর নিহাত ছাদে দাড়িয়ে আছে।নিহাত বলল- একটা কথা বলব।
-বল।
-আমার বিয়েটা হলে তুই খুশি হবি?
প্রথমে মোহনীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।এরপর হাসি টেনে এনে বলল-তোর বিয়ে আর আমি খুশি হব না,তাই কি হয়?
-নিজেকে এখন আটকে রাখার সময় এখন নয়।
-মানে কি?
-প্রথমে তোর মুখের অবস্থা কি হয়েছিল,তা কি এত সহজে লুকানো যায়?আমার যে তোকে দরকার।খুব দরকার।অন্য মেয়ে তোর মত আমাকে ভালবাসতে পারবে?
-এই সব কি বলছিস?
এবার মোহনীর হাত ধরে বলল-তুই কি আমাকে সত্যিই আমাকে ভালবাসিস না?
মোহনীর চোখ ছলছল করে উঠল।বুকের ভিতরটা কেমন যেন করতে লাগল।উড়না দিয়ে মুখ ঢাকল।নিহাত ছাদ হতে চলে গেল।এই বিয়েটা তাকে ঠেকাতেই হবে।দরকার হলে বাসা হতে পালাবে।যে মেয়েকে সে ভালবাসে না সে মেয়েকে বিয়ে করার কোন মানে হয় না।
বিয়ের দিন।সন্ধ্যাবেলা।ছেলেকে সকালবেলা হতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সারা ঢাকা শহর তন্ন করে খুঁজা হয়েছে।কোথাও পাওয়া যায় নি।মেয়ে-পক্ষ ইতিমধ্যে জেনে গেছে।মেয়ের বাবা নীলিনকে বলেছে-দেখুন ছেলে একটি মেয়েকে ভালবাসে।দিয়ে দিন না সে মেয়ের সাথে বিয়ে। আমার মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে কি সর্বনাশ হয়ে যেত বলুন তো?নিজের ছেলের খোঁজখবর রাখেন না কেমন বাবা আপনি?
নীলিন একটা কথাও বলে নি।ছেলেটা এমন কাণ্ড করেছে,কথা শুনা তো তার প্রাপ্য।
চিত্রা এসে বলল-মোহনী,বলতো ছেলেটা কয় গেল?
-আমি কিভাবে বলব খালাম্মা?
রাত বেজে বারটা।চিত্রা কান্না শুরু করেছে ঘন্টাখানেক।নীলিনের মনটাও যেন কেমন করে উঠল।ছেলের অমতে বিয়ে ঠিক করা কিছুতেই ঠিক হয় নি।এমন সময় নীলিন একটা চিরকুট পেল।তাতে লেখা-দেখা হোক তবে মনমোহনীর নিচে।নিজের ছেলের লেখা,তাতে সন্দেহ নেই।এটা আবার কি কে জানে?গবেট ছেলেটা একটু ভাল করে লিখে গেলেই বের করা যেত।নীলিন ডাকল-মোহনী মোহনী।
মোহনী আসল।
-দেখতো এই চিরকুটটা।
মোহনী দেখে বলল-খালু তাড়াতাড়ি বের হন।এই জায়গাটা আমি চিনি।রমনা পার্কে।
মোহনী চিত্রা আর নীলিন রিকসায় উঠল।নীলিন বলল-মামা একটু জোরে।খুব জলদি।
রিকশাওয়ালা তাড়াতাড়ি পেটেল চালাতে লাগল।খালি রাস্তা।মিনিট পনেরের মধ্যে রমনা পার্কে এসে পড়ল।এরপর ভিতরে ঢুকল।
-কোন দিকে মা?
-এই দিকে খালু।
তারা তিনজন এগোতে থাকে।কিছুদূর এগোতেই দেখে একটি ছেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে তার সামনে বসে আছে।ছেলেটেকে চিনতে কারও ভুল হল না।যদিও আবছা আলোয় মুখ তখনো দেখা যাচ্ছে না।চিত্রা ছেলেকে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।নীলিন বলল-গাধা ছেলে কোথাকার?এখানে বসে কি করছিস?
-বাবা বিয়ে করতে এসেছি।
-এখানে বিয়ে করবি মানে?মাথা ঠিক আছে তোর।
-বাবা আমি যাকে ভালবাসি প্রথম দেখা এই মনমোহনীর নিচেই হয়েছিল।
-এখানে বসে থাকলে মেয়েটা আসবে?
-এসেছে তো বাবা।
-কই?
-তোমরাই তো নিয়ে এলে।
নীলিন মোহনীর দিকে তাকাল।মোহনী লজ্জা পেল।নীলিন মোহনীর হাতটা তার ছেলে হাতে দিয়ে বলল-মা,আমার পাগল ছেলেটাকে তুমি দেখে রেখ।
এরপর দুজনে বাবা মাকে সালাম করল।নীলিন বলল-সুখী হও মা।সুখী হও।
চিত্রা বলল-এবার তাহলে চল।
নিহাত বলল-মা তোমরা যাও।আজকে আমি আর মোহনী মনমোহনীর নিচে কাটাই।সকাল হলেই এসে পড়ব।
নীলিন বলল-আচ্ছা থাক।সকাল হলেই আসিস।
এরপর চিত্রা ও নীলিন বাসায় চলে এলো।মোহনী মনমোহনীর নিচে একটা চাদর বিছাল।এরপর দুইজন পাশাপাশি শুইল।মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল।মোহনী বলল-দেখ,কি সুন্দর জোনাকির আলো?
জোনাকির আলোয় মনমোহনী বৃক্ষকে লাগছে মায়াবী।এলোমেলো বাতাস বইছে।নিহাত মোহনীর দিকে তাকিয়ে বলল-সবচেয়ে সুন্দর লাগছে কি বলতে পারবে?
-কি?
-তোমাকে।তোমার চিরচেনা অপরূপ মুখ।
তাই শুনে মোহনী হেসে উঠে।নিহাত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।মনে মনে ভাবে,এভাবে যদি অনন্তকাল কেটে যেত,তবে বেশ হত!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত