ভর দুপুর, মাথার উপর সূর্যটা এক মনে উত্তাপ ছড়িয়ে চলেছে। সব্বাই কোন না কোন ছায়া আশ্রয়ে একটু শীতলতা পাবার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। তার মাঝেও দু একটা ব্যতিক্রম প্রকৃতিতে চোখে পড়ার মত। শান্ত রোদে জ্বালা খন-হীন(ফসল) নাড়া প্রান্তরে রাখালের ছেড়ে রাখা গরু এক মনে ঘাস খেয়ে চলেছে। আর রাখালরা গরু ছেড়ে সবায় কোন না কোন গাছের ছায়ায় নিশ্চিন্তে দুপুরের ভাত ঘুম দিচ্ছে। কারণ গরু গুলি খুব দূরে বাংলাদেশের সীমান্ত পার হলেও সন্ধ্যায় খেদিয়ে আনা যায় অনায়াসে।
চরতে থাকা গরু গুলির পিছে পিছে গ্রামের এক বধূ ডালিতে করে গোবর কুড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে কোমর ভাজ করে গোবর কুড়িয়ে হাতে ধরা ডালিতে গোবর রাখছে। দূর হতে যে কেও দেখলে বুঝবে নিঃসঙ্গ গ্রামের কোন বধূ গোবর সংগ্রহ করছে জ্বালানী তৈরির জন্য।
আসলে তার সম্পূর্ণটাই ভান। এই অভিনয় শুধু সীমান্তের প্রহরী( বি এস এফ)দের চোখে ধুলা দেবার প্রচেষ্টা। আর এটি গ্রামের ঐদিকে খুব সাধারণ দৃশ্য। তাই সহজে সন্দেহ করাও কারণ নেই যে ডালির নিচে পলি-ব্যাগে ১৫টা ইন্ডিয়ান সাড়ী আর গোটা পাঁচেক কাশ্মীরি শাল লুকিয়ে রাখা। কেও ওর ডালির দিকে তাকালে দেখবে গোবরে প্রায় পূর্ণ ডালি। আসলে বিচুলির উপর গোবরের নাদি দিয়ে কৌশলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে নিচের ব্লাক করা বস্তু।আর সীমান্তের প্রহরী( বি এস এফ) যদিও ধরে তা হলে পাশের গ্রামে ওর ইন্ডিয়ান মহাজন এর ঠিক করা বাড়ির মালিক হরিদাস পালের বিবি বলে পরিচয় দিতে হবে। যা একেবারে নিশ্চিন্ত।
এই সময়টায় সীমান্তের প্রহরী( বি এস এফ) এর খাবার সময়, আর রোদে এই সময় তারা টহলে আসে না বললেই চলে। টহলে বের হবে সেই বিকেলে। তাই মায়া ও ওর মত ব্লাকিরা এই ভর দুপুর বেলাটা সীমান্ত পারাপারে বেছে নেয়। খুব সাবধানে গোবর কুড়ানোর ফাঁকে রেকি করে চলেছে মায়া। হাত পঞ্চাশেক দুরেই বাংলাদেশের বর্ডার। ওপারে পার হতে পারলেই কেল্লাফতে।কারণ ওপারের বিডিয়ার গুলি তেমন কাজের না। না আছে তাদের তেমন টহল না আছে পর্যাপ্ত চৌকি। ও যেখান দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে তার আশেপাশে নেই বিডিয়ারদের কোন চৌকি। তাই নিশ্চিন্ত ও, ঐ দিকে কোন সমস্যা নেই। আর ধরা পড়লেও একশ দুইশ দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়া যায়। নিজ দেশ বলে কথা।
ও আর গরু গুলি ছাড়া চোখ যতদূর যায় তত-দুর কোন জনমানবের চিহ্ন নাই। রাখাল গুলিও কোন গাছের ছায়ার নিচে ঘুমন্ত। অবশ্য ওরা দেখলে সমস্যাও ছিল না। কারণ ওরা ওই ব্লাকি মহাজনের গ্রামের ছেলে পুলে। ওরা জানে এই ভর দুপুরে গোবর কুড়ানোর মানে কি?
কারণ ওদের বাবা-মা, ভাই-ব্রাদাররা কেও না কেও এপার ওপারের এই ব্যবস্যায় জড়িত।
শেষবার রেকি করে ডালি কোমরের নিয়ে সীমান্তের দিকে একটু তেরছা ভাবে নিশ্চিন্তে এগিয়ে চলছে মায়া। যদিও ওর ব্লাকি জীবনে ও কক্ষনো ধরা খায়নি। সীমান্তের হাত বিশেক দূরে একটা গরু ঘাস খাচ্ছে। ওটার কাছে গিয়ে গোবরের নাদি তোলার ভান করে পিছেনে ফেলা আসা গ্রামের ও প্রান্তরের দিকে আর একবার চেয়ে দেখল মায়া। সেই একই তাপ তরঙ্গের নাচ ও জন শূন্য।
এবার সব ভয় দূরে ঠেলে ডালি নিয়ে ওপারে পার হবার জন্য পা বাড়ায় মায়া। মনে ভরে উঠে আনন্দে। ভাবে ওর গ্রামের মল্লানির( মণ্ডল এর বউ) কাছে কত দাম হাঁকানো যায়।লাভ লোকসানের হিসেব বড় প্রয়োজন ওর সংগ্রামী জীবন যুদ্ধের একলা পথচলার বাঁকে বাঁকে।
সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া দেবার আগে উমুক্ত সীমান্ত পথে এভাবেই আমাদের গ্রামের কিছু মহিলা সীমান্ত চোরাচালান( ব্লাক) করত। আর গ্রামের কিছু ধনী মহিলা ( আমার মা কেও দেখেছি তাদের কাছ হতে অনেক কিছু কিনতে)
তাদের কাছে নিজেদের জন্য শাল, শাড়ি, স্টিলের তৈজস পত্র এনে দেবার জন্য অর্ডার দিত। আমাদের গ্রাম হতে সীমান্ত ৫-৬ মাইল দূরে।