তবে কে ছিলো?

তবে কে ছিলো?

-আবার কবে দেখা হবে?
-কি জানি?
-মানে
-হবে হয়তো কোন একদিন এমনই ভাবে
-দেখো….
-কি দেখবো?

পুতুলটার চোখ ভিজে গেলো। কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে গেলো। শাওন পুতুলের এরকম কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। পুতুলের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আজ যেন পুতুলও তার কান্না থামাতে পারছেনা। শাওন পুতুলের চোখ মুছে দিচ্ছে।

-আমি ভাবছিলাম কি না কি দেখাবে! আর এখন দেখি কেঁদে দেখাচ্ছো। কি এমন করলাম যে এভাবে কাঁদতেছো? সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে আসছি কি তোমাকে কাঁদানোর জন্য।
-না বুঝে কথা বলো কেন?
-কি?

আবার চুপ হয়ে গেলো পুতুল। এবার পুতুল অভিমান করলো সত্যি সত্যি। চোখ বেয়ে পানি ঝরছে আর রাগের মুডে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে।

-তুমি যাওতো আর আসতে হবেনা তোমার। কখন যাবে যাও এখনই।
-এতো রাগ করো কেন বলোতো?
-রাগ করিনি আমি
-অভিমান করছো?
-কিছু করিনি, তুমি যাও। আমাকে বাড়ি যেতে হবে?
-তুমি না মেস থেকে কলেজে যাও বললে
-এখন বাড়ি যাব, দরকার আছে।
-কি দরকার?
-দরকার বলছি বেস, আবার এতো কিছু জিজ্ঞাসা করো কেন?
-আজই কিন্তু আমাদের প্রথম দেখা হয়েছে, তুমি এরকম করে কথা বলোনা তো।
-কথা তো আগে থেকেই বলছি তাইনা?
-সরাসরি আর ঐ কথায় অনেক পার্থক্য
-জী না
-সত্যিই এখন চলে যাবো? আমি জানি তুমি কাঁদবে, আমাকে বকা দিছো তা ভেবেই চিল্লাচিল্লি করবে আর যদি মরে যাই তখন খুব আফসোস করবে বলবে ” শাওনটা খুব কষ্ট পেয়ে গেলো “।

এ কথা বলার সাথে সাথে পুতুল শাওনকে জড়িয়ে ধরলো।
-তুমি কোথ্থাও যাবেনা।
-যাবো
-প্লিজ
-বুঝোনা কেন বাবু!
-আচ্ছা যাও, খুব তাড়াতাড়ি যেন আবার দেখা হয়। আমি পারবোনা থাকতে কিন্তু হুমম

পুতুলটা আবার কাঁদতেছে। এ কান্না প্রচন্ড ভালোবাসা প্রকাশের এক অনন্য উপায়। পুতুলের কান্নার এক অসাধারণ শক্তি আছে যা শাওনকে সেই প্রথম থেকেই খুব আকৃষ্ট করে আসছে।

এরপর তিনবছর কেটে গেলো। এখন সেই পুতুল আর নেই, সেই শাওনও আর নেই। তারা পাল্টে গেছে দুইজনই। তাদের একটা মেয়ে ও একটা ছেলে হয়েছে। মেয়েটির নাম প্রাপ্তি জাহান আভা আর ছেলের নাম স্বপ্নিল হাসান শিহাব। মেয়েটা বড়, দেড় বছর হবে। শিহাব সাত /আট মাসের হলেও দিব্যি দুষ্টামি করে পুরো বাড়ি জুড়ে। তাদের বাবা শাওনের কোন শাসনই নেই তার ছেলেমেয়েদের উপর, যা চায় তাই দিবে এনে। শাসন যতটুকু করার মা করে তবে শাওনের সামনে করতে পারেনা। কারণ শাওন মেরে শাসন করা পছন্দ করেনা।

পুতুল আজও শাওনকে বুঝতে পারেনা। শাওন কি সত্যিই তাকে ভালোবাসে, নাকি বাসেনা। আজ এতো কাছে দুজন, খুব পাশাপাশি তবুও পুতুল কিছু একটার অনুপস্থিতি বারবার অনুভব করে চলে। পুতুলও কি শাওনকে সত্যিই ভালোবাসে নাকি একটুও বাসেনা। এ দ্বিধা তাদের মাঝে বারবারই দোলা দেয়।

একটা পুরুষ একটা নারীর মাঝে কি জৈবিক চাহিদা পূরনের জন্যই ভালোবাসার সম্পর্ক হয় নাকি এর মাঝে অন্য কোন বিষয় কাজ করে। হয়তো একটা পুরুষ ও একটা নারী একে অপরকে নিবিড় সান্নিধ্যে পেলে কিংবা খুব গভীর ভাবে ভাবলে অবশ্যই জৈবিক চাহিদা পূরনের তাগিদ বেড়ে যাবে, যা অতি স্বাভাবিক একটি বিষয়। তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অবাধে ঐ সম্পর্কটি হয়ে উঠে তীব্র কুরুচীপূর্ণ ও অসৎ কাজ। হয়তো সেই নারী-পুরুষ তাদের ঐ জৈবিক তাড়নাকে খারাপ ভাবে না কিংবা সেই ধরনের জ্ঞান তাদের মাথায় ঢুকে না। আসলে ভালোবাসাটা কোথায়, দুইটি দেহের একে অপরে নিমজ্জিত হয়ে থাকা নাকি আধ্যাত্মিক কোন শক্তি। ভালোবাসা ভালোবাসাই, এর বেশিরভাগ ক্ষেত্র আধ্যাত্মিক ও অনুভবের খাঁচায় বন্দী আর অল্পটুকু জৈবিক চাহিদায় প্রবিষ্ট যা কেবল একটা নারী ও পুরুষের ভালোবাসার বৈধতা পত্র নিশ্চিত হওয়ার পরই কাম্যতা লাভ করে।

পুতুল আর শাওনের ভালোবাসাও ঠিক ওরকমই। আধ্যাত্মিক ও অনুভবের সীমানায় আজও নিমগ্ন। জৈবিক সম্পর্কের রেশ কেটে গেলেও তারা আজ যে জিনিসটি নিজেদের মাঝে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাহলো ভালোবাসা, যা তারা অনুভব করেছিলো একজন আরেকজনকে তীব্র ভাবে মিস করা সত্ত্বেও দেখতে না পেরে অভিমান করা, দেখা হলেও দূরে চলে যাওয়ার সময় চোখের অশ্রু ঝরা।

ছয় মাস পর….

আভা মনির আজ দ্বিতীয় জন্মবার্ষিকী। পুতুলের ইচ্ছে আজ আভার বাবা আভাকে অনেক উপহার দিবে, চকলেট দিবে। অথচ শাওনের আজ মনেই নেই যে আভার জন্মদিন আজ।

-তুমি কেমন বাবা?
-কেন কি করলাম? আভা আর শিহাব কোথায়?
-ওরা ঠিক আছে কিন্তু আভার যে আজ জন্মদিন সে খেয়াল আছে তোমার!
-কেন? আজ নাকি?
-জী, কেমন বাবা তুমি, মেয়ের জন্মদিন মনে রাখতে পারোনা।
-আচ্ছা ঠিক আছে, সকাল সকাল বলে দিছো আজ বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরবো ওকে
-মা বলছিলো কেক অর্ডার করে বানিয়ে আনতে আর ভালো রান্না করতে আজ।
-তাহলে তো হলোই
-বাজার করে দিবে কে শুনি
-তুমি আর মা যেয়ে করে নিয়ে আসো
-আমিও না মাও না, তুমি করবে আজ সব। মা বলছেন।
-ও তাই। আচ্ছা আমি দেখে নিবো মা কি বলে।

-মা, মা
-কি হলো পুতুল?
-দেখেন না আপনার ছেলে অফিসে চলে যাচ্ছে, আভার জন্মদিনের কি হবে!

-কিরে শাওন!
-অফিস না করলে কি হবে!
-একদিন ছুটি নিলেই তো পারিস
-আজ জরুরি কাজ আছে
-আভার জন্মদিন,
-মা, চাকরি তো করতে হবে। আমি চেষ্টা করবো, ওকে
-আমরা কিন্তু তোর জন্য বসে থাকবো, তুই সব কিনে আনবি এরপর আভার জন্মদিনের আয়োজন হবে
-ঠিক আছে আমি যাই এখন।

শাওন অফিসে গেছে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে, বিকাল ছুই ছুই অবস্থা কিন্তু শাওনের কোন হদিস মিলে নাই এখনও।

সন্ধ্যা ছয়টায় কলিংবেল বাজলো। কেউ একজন আসছে। দরজা খোলতেই সবকিছু নিয়ে হাজির শাওন। বিরানির প্যাকেট সবার জন্য, জন্মদিনের কেক, চকলেট, পুতুল সব নিয়ে আসছে। আভা তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে নাচা শুরু করলো।

-বাবা বাবা
-হুম
-তুমি না অনেক ভালো
-তাই
-তোমাকে এত্তোগুলো পাপ্পি দিবো।

এরপর আভা দৌড়ে বাবার কোলে উঠে গালে পাপ্পি দিলো। এ দেখে সবাই হেসে শেষ। এরপর যথারীতি সবাই আভার জন্মদিন পালন করলো।

কিছুদিন পর। পুতুল শাওনকে বারবার ফোন দিয়েও বন্ধ পাচ্ছে। এরপর পুতুল শাওনের বন্ধু সীমান্তকে ফোন করে।

-হ্যালো ভাইয়া
-আমাকে চিনতে পারছেন?
-হ্যাঁ পুতুল বলো
-আপনার বন্ধুকে তো আজ ফোন দিয়ে পাচ্ছি না, কি হইছে ওর
-কেন তুমি জানোনা?
-কি জানবো ভাইয়া
-আমি তো ওর সাথে কালকেও কথা বলছিলাম, ফেসবুকেও তো চ্যাট হইছে অনেক
-তুমি কি বলছো এসব! শাওন তো আরও এক মাস আগেই আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে।
-আমার সাথে মজা নিচ্ছেন ভাইয়া?
-না, সত্যিই ও আর নাই পুতুল
-ভাইয়া

পুতুল কান্নাকাটি করে ফোন কেটে দিলো। কতক্ষণ ফুপিয়ে কাঁদলো। এরপর আবার শাওনের নাম্বারে ফোন দিলো কিন্তু শাওনের নাম্বার বন্ধ, ফেসবুকে ঢুকে দেখলো ফেসবুকেও শাওন নেই। একমাস আগের একটা স্ট্যাটাস আছে, এরপরের কোন স্ট্যাটাস নাই, এমনকি গতকাল যে কবিতা শাওন লিখছিলো পুতুলের জন্য, সেটাও নেই। পুতুলের মাথায় কিছুই কাজ করছে না। তাই আবার সীমান্তকে ফোন দিলো। সীমান্ত এবার যা বললো তা শুনে পুতুল অনেক শক খেলো।

-পুতুল বিশ্বাস করো, শাওন তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর যখন ঢাকা আসলো এর কিছুদিন পর হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেই মারা যায়।
-তাহলে আমার সাথে এতদিন কে কথা বললো?

পুতুল কি করবে বুঝতে পারছে না। এরপর প্রায় এক মাসের মতো পুতুল অনেকটাই পাগলের মতো হয়ে গেলো।

যার সাথে এতো কথা, পুরো সংসার হয়ে গেছে যার সাথে মনের অস্তিত্ব জুড়ে। এই আভা, শিহাব ওরা কই গেলো। তাদের কল্পনার সংসারের প্রতিদিনকার কথাগুলো কোথায় গেলো আজ। আর কেনইবা একমাস আগে শাওন মরে গেলো, এইমাসে কে পুতুলের সাথে কথা বললো তাহলে। পুতুল আজও তার রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি।

শাওন হয়তো পুতুলের কান্নায় সত্যিই অনেক কষ্ট পেতো। তাই সে মরে যাওয়ার পর পুতুল যাতে কষ্ট না পায় সেজন্য তার অবর্তমানে কোন এক অশরীরি পুতুলকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য চলে আসছে। প্রতিটি মানুষের জীবনেই এমন কিছু ঘটতে পারে, এমন রহস্য ক্রমাগত ঘটেই চলছে আমাদের চারিপাশে। তবে পুতুলের সাথে শাওনের এই রহস্যময়তা খুব কমই ঘটে থাকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত