ইটের বৃত্ত

ইটের বৃত্ত

সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বুয়া জানালো যে তার স্বামীর মানসিক অসুখটা বেড়েছে, ঔষধ কিনতে হবে। তাই তার স্বামীর জন্য ঔষধ কেনার টাকা দিলাম। কৃতজ্ঞতায় তার চোখে পানি এসে গেল।

অসুস্থ স্বামী এবং ছোট তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তার অভাবের সংসার। কিছুদিন আগে সে আমাকে বলেছিল, “আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।”

শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম।

মিরপুর বারো নাম্বার বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে ম্যাক্সি-তে চড়লাম। একটা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ-এ চাকরি করি। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ট্রাক স্ট্যান্ডের উত্তরে অফিস। সকাল আটটায় অফিসে গিয়ে বাসায় ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে যায়।

স্কুল জীবনের বন্ধু জাহাঙ্গীর এবং শফিকের সঙ্গে মেসে থাকি। এতো ব্যস্ততার মধ্যেও রাতে ব্রিজ খেলি। এতে সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি দূর হয়ে মনে আসে আনন্দ।

ছাত্র ও বেকার জীবনের মুক্ত অবস্থার ইতি টেনে চাকরিতে জয়েন করারপর প্রথম দিকে বাঁধাধরা নিয়মে চলতে খুব কষ্ট হতো। সকালে ঘুমটা অসম্পূর্ণ রেখেই বিছানা ছাড়তাম। তাই গাড়িতে ওঠার পর ঘুমে চোখ বুঁজে আসতো।

একদিন গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভাঙতেই দেখি ফার্মগেইট পার হয়ে অনেক দূর মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে চলে এসেছি। আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি রিক্সা নিয়ে অফিসে যখন পৌঁছালাম তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল।আরেকদিন এভাবে চলে গিয়েছিলাম শাহবাগ। এখন এই জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

একদিন হেঁটে যাওয়ার সময় কে যেন “ভাইয়া” সম্বোধন করে সময় জানতে চাইলো। দেখলাম, লাল পোশাক পরা, লম্বা মতো ফর্শা একজন মেয়ে।বললাম,“আমার ঘড়ি নেই।”

মেয়েটার চোখ খুব সুন্দর। সে হাসতে হাসতে বললো, “একটা ঘড়ি কিনলে সমস্যা কি!”

এক ইঞ্চি উঁচু হিলওয়ালা কালো স্যানডাল পরেছিল সে। সুন্দর পায়ে চমৎকার মানিয়েছিল। আমি আর কোন কথা না বলে এগিয়ে গেলাম।

অফিসে যাওয়ার পর মিরপুর দেখা মেয়েটির কথা বার বার মনে পড়ছিল। তাই তাড়াতাড়ি অফিস শেষ করে মিরপুর গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়ার জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। আশা করছিলাম, আবার তার দেখা পাবো। কিন্তু দেখা মিললো না।

এক ছুটির দিনে সন্ধ্যার পর তার দেখা পেলাম। শাদা একটা পোশাক পরেছিল। মাথায় ওড়না। গলা ও বুক ওড়নায় আবৃত। খোঁপাটা উপরের দিকে একটু উঁচু করে বাঁধা। খুব আকর্ষণীয় লাগছিল তাকে। একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে বললো, “আপনার জন্য একটা ঘড়ি কিনেছি।”

ইতস্তত করছি দেখে সে বললো, “ঠিক আছে, এর দামটা আপনি পরে আমাকে দিবেন, এবার হলো তো!”

আমি তো হতবাক!

মুচকী ও রহস্যময় হাসি দিয়ে সে আবার বললো, “আর হ্যাঁ, ঘড়ি পরলে আপনার মতো সুন্দর পুরুষকে কিন্তু আরো সুন্দর দেখাবে।”

প্যাকেটটা নিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”

সে বললো, “না না, আমাকে আপনি করে বলবেন না। আমি তো আপনার অনেক ছোট! আমাকে নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম উর্মি।”

কয়েকদিন পর সকালে ম্যাক্সিতে চড়ে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আবছাভাবে দেখলাম যে হন্তদন্ত হয়ে এক মেয়ে ম্যাক্সিতে উঠলো। আমার পাশে বসার পর তার ব্যাপারে কৌতূহল জাগলো। তাকিয়ে দেখি পূর্বে দেখা সেই মেয়ে। চোখাচোখি হতেই সে জিজ্ঞাসা করলো, “কোথায় যাচ্ছেন?”

আমি জানতে চাইলাম, “অফিসে। তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

সে জবাব দিলো, “ফার্মগেইট।”

ফার্মগেইট পৌঁছে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কোথায় পড়াশোনা করো?”

সে বললো, “আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কি চাকরি করেন আপনি?”

বললাম, “একটা প্রতিষ্ঠানে জুনিয়র মার্চেন্ডাইজার হিসাবে আছি।“

সে কিঞ্চিৎ হেসে বললো, “আচ্ছা, আসি। আবার দেখা হবে, কথা হবে।”

তার শেষের কথায় আমি অবাক হলাম।

অফিসে যাতায়াতের সুবিধার্থে তেজকুনিপাড়ায় একটা রুম ভাড়া করলাম।

একদিন উর্মির অনুরোধে টিএসসিতে বেড়াতে গেলাম।

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বসে গল্প করার এক পর্যায়ে সে জানালো যে কখনো কোনো ঝড় এসে যদি আমাদের দু’জনকে দুই দিকে ঠেলে দেয় তাইলে! এই তার ভয়। তাই এ রকম কিছু হওয়ার আগেই আমাদের বন্ধনটা সুদৃঢ় করতে চায়। আমার আপত্তি না থাকলে পরদিনই আমাকে বিয়ে করতে চায়।

পরদিন উর্মি এলো লাল একটা শাড়ি পরে। ম্যাচ করা ব্লাউজ। লাবণ্য যেন ওর চোখ-মুখ ঠিকরে বের হচ্ছিল।

বিয়ে সম্পন্ন হলে আমরা যখন একা হলাম তখন তার দিকে তাকাতেই লজ্জা আমাকে পেয়ে বসলো।এই সুন্দর মেয়েটি আমার স্ত্রী! শরীরের মধ্যে শিহরণ অনুভব করলাম। তার হাতটা তুলে নিয়ে একটা আংটি পরিয়ে দিলাম।বাহু দু’টো ধরতেই কেঁপে উঠলো সে।

দিনের আলো কমে আসছিল দেখে বুঝলাম অনেক সময় পার হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আবিস্কার করলাম, আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি আর সে আমার বাম বাহুতে মাথা রেখে আমার দিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে।

রাতে উর্মিকে মিরপুর ওদের বাড়ির কাছে পৌঁছে দেওয়ার পর বেশ কয়েকদিন কেটে গেলেও তার কোনো খবরাখবর না পাওয়ায় এক বিকেলে মিরপুর গেলাম। গাড়ি থেকে নেমেই রোডের এক জায়গায় ইটের বৃত্ত চোখে পড়লো। একজনকে কারণটা জিজ্ঞাসা করায় তিনি সবকিছু খুলে বললেন।

গার্মেন্ট-এর কর্মচারীদেরকে সারা মাস পরিশ্রম করিয়ে যে বেতন দেওয়া হয় তা বাসা ভাড়া, খাওয়া এবং আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর পর নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই বাড়িতে ফেলে আসা গরিব পিতামাতা এবং ছোট ভাই-বোনদের মলিন মুখ মনে পড়লে কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তখন পৃথিবীতে জন্ম নেয়াটাই বৃথা মনে হয়। এ জন্য বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত কর্মচারীরা কয়েকদিন আগে গাড়ি ভাংচুর করতে এগিয়ে যেতেই পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি ছোঁড়ে।গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে নিরাপদ জায়গায় যাচ্ছিল একটা মেয়ে। মাথায় গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

মেয়েটির নাম এবং সে কোথায় থাকতো তা লোকটি জানেন কিনা জিজ্ঞাসা করায় তিনি যা বললেন তা শুনে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। স্থান, কাল ভুলে বৃত্তটার কাছে বসে পড়লাম। বৃত্তটার ভেতরে হাত বুলাতেই উর্মির স্পর্শ পেলাম যেন।ক্লান্তি এসে ভর করলো। একটা দোকানের সামনের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম।

অনেকক্ষণ পর একটি কণ্ঠশুনে সংবিৎ ফিরে পেলাম। আমাকে বললো, “বাবা, অমন করে কাঁদছো কেন?”

দেখলাম, বৃদ্ধ একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত