”মা আমি বিয়ে করে বৌ নিয়ে বাড়ী যাচ্ছি।তুমি সব রেডী রাখো।নয়তো বলে দাও বাড়ী যাব না। অন্য ব্যবস্থা করব।”
অনি মানে অনিকেতের এমন আকস্মিক ফোন পেয়ে অনিমা চক্রবর্তী কিছুক্ষণ মোবাইল হাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।সত্যি শুনছেন কথাগুলো! নাকি স্বপ্ন দেখছেন! বুঝতে পারলেন না।তার এমন পাগল ছেলে! কি করতে কি যে করে বসে তার ঠিক নেই।তাই দ্রুত মনটাকে কিছুটা ঠিক করে স্বাভাবিক গলায় বললেন-
”না না অনি তোকে অন্য কোথাও যেতে হবে না।আমি সব রেডী রাখছি তুই বৌ নিয়ে বাড়ী আয়।আমি এইসব টেনশন নিতে পারিনা একদম।”
”আচ্ছা মা আমি আসছি।তুমি চিন্তা কোরোনা।চন্দননগর থেকে যেতে একটু টাইম লাগবে।গিয়ে সব বলছি।”
বলেই ফোনটা কেটে দিল অনিকেত।
এদিকে অনিকেতের মায়ের তো হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।অনির বাবাকে কি বলবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না।এক সপ্তাহের জন্য বন্ধুর বোনের বিয়েতে গিয়ে নিজে বিয়ে করে ফেলবে এ তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।অনি ওদের একমাত্র সন্তান।সবে ডাক্তারী পাশ করেছে। মেডিকেল কলেজে জয়েন করবে এইবার।অনির মা কত কি ভেবেছিলেন কত ধূমধাম করে একমাত্র ছেলের বিয়ে দেবেন।তার কপালটাই খারাপ।তিনি ভাবেন একরকম আর হয় আর একরকম। ইদানীং অনি এরকম খামখেয়ালী হয়ে গেছে।হঠাৎ-হঠাৎ কি যে করে বসছে।কেমন জেদী হয়ে উঠেছে ছেলেটা।কি যে করে দেখাতে চায় কে জানে!
অনির বাবা অলকেন্দু চক্রবর্তী বড় হার্ট স্পেশালিষ্ট।দক্ষিণ কলকাতার বিরাট একটা বাড়ীতে অনিরা তিনজন যেন তিনটে দ্বীপের বাসিন্দার মত বাস করে।অলকেন্দু চক্রবর্তী স্বল্পভাষী, গুরুগম্ভীর, অহঙ্কারী।আর অনিমা দেবী ততোধিক সরল সাধাসিধে মমতাময়ী কোমলপ্রাণা।অনি জ্ঞান হবার পর থেকে দেখছে, সারাদিনের পর বাবা যখন বাড়ীতে ফিরত তখন নিজের ঘরে চলে যেত।সেখানে বই পড়া,টিভিতে প্রায় সব ভাষার নিউজ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শোনা,গুরুগম্ভীর আলোচনা, ফোনে বিভিন্ন লোকের বিভিন্নরকম সমস্যার সমাধান,নয়তো চেম্বারে বসে পেশেন্ট দেখা, এই নিয়েই বাবা ব্যস্ত থাকত।আজ অনি এত বড় হয়ে গেল বাবার এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি।এই ক- বছরের জীবনে খুব কম-বার বাবা-মা আর অনি একসাথে বাইরে ঘুরতে গেছে বা কারো বাড়ী বেড়াতে গেছে।সবসময় মা আর মা।মা-ই অনির জগৎ।হিসেব মত তাকে তৈরী করার কারিগর ওর মা। ও দেখতো কখনও দরকার হলে মা বাবাকে কোনোকিছু বলতে যেতে সাহস করতো না।যদি বা কখনও কিছু বলতো বাবা বলতো-
”আহ্! সবসময় বিরক্ত কোরোনা তো অনিমা।তোমার মত সারাদিন আমি বাড়ীতে বসে থাকিনা।অনেকরকম দায়িত্ব আছে আমার।বাজে সাংসারিক কথা বলে সময় নষ্ট করার মত সময় আমার নেই।শুধু এই সংসারটা নিয়েই তো আছো সেটাও ঠিকমতো সামলাতে পারো না!”
মা ভয়ে-ভয়ে ফিরে আসতো।প্রয়োজনীয় কথা আর বলা হত না।কি করে যে বাবা-মা প্রেম করে বিয়ে করেছে সেটাই এখনও রহস্য অনির কাছে।কিন্তু সংসার সামলাতে গেলেও তো স্বামীর সাথে কথা বলতে হয়।ভাল- মন্দ,সুখ-দুঃখ আদান-প্রদান করতে হয়।অনি একটু বড় হওয়ার পর বুঝেছে বাবার কাছে মা শুধু এই সংসার পরিচালনার যন্ত্র মাত্র।অনির মনে-মনে বড় কষ্ট হতো।কষ্টটা ঠিক কিরকম সেটা নির্দিষ্ট করে কাউকে বোঝাতে পারত না।খালি মনে হত অন্য বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতদের বাবা-মায়েদের সম্পর্কের মত তার বাবা-মায়ের সম্পর্কটা ঠিক যেন স্বাভাবিক নয়।বাবা বাবার ঘরে। মা মায়ের ঘরে।আলাদা-আলাদা।কেমন একটা অদৃশ্য পাঁচিল দুজনের মাঝে।কথা কেমন মাপা -মাপা।হাসি নেই গান নেই।দম আটকে আসতো অনির।
অনি ভাবতো ও যখন ইন্দ্রাক্ষিকে বিয়ে করবে তাকে কখনও কষ্ট দেবে না।এক আকাশ ভালবাসায় ভরিয়ে রাখবে।তাই সবসময় ইন্দ্রাক্ষিকে ভালবাসায় ভরিয়ে দিতে চাইত সে।কলেজ জীবনে ইন্দ্রাক্ষির সাথে ওর আলাপ।সে-ও ডাক্তারীর ছাত্রী ছিল।কি যে হল পড়া থামিয়ে দিল মাঝপথে।তবু পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় স্বপ্ন-সাগরের বেলাভূমিতে ওকে অনি আদরে-আদরে ভরিয়ে দিতে চাইত মনে-মনে।এক লহমায় ইন্দ্রাক্ষিকে নিজের হদয়টাও তুলে দিতে পারত অনি।কিন্তু কেন জানেনা কিছুতেই তাকে সন্তুষ্ট করতে পারত না। ইন্দ্রাক্ষি কি যে চায় হয়তো ও নিজেও জানেনা!তাই ইদানীং খালি ঝগড়া আর ঝগড়া।খালি ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখানো।তাই অনি আজকাল ভাবে যাক্ চলে যাক ও চিরদিনের জন্য।বার-বার এমন কষ্ট পাওয়ার থেকে একবার যন্ত্রণা পাওয়া অনেক ভাল।দরকার হলে সে যন্ত্রণার বোঝা বয়ে চলবে অনি সারাজীবন।সে বরং ভাল—-আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না অনির!ইন্দ্রাক্ষি কি যে চায়—–!
ছোটবেলা থেকে মা অনিকে বই পড়ার নেশাটা ধরিয়ে দিয়েছিল।অনেক বই পড়েছে অনি এখনও পড়ে। একটা সি ডি প্লেয়ারে মাঝে-মাঝে অনি গান শোনে আস্তে -আস্তে।জোর আওয়াজ বাবার নাকি পছন্দ না।অথচ নিজে তারস্বরে টিভি দেখে। পড়াশোনার ফাঁকে অনেক বাইরের বই পড়লেও, মাথাটা তার অসম্ভব ভাল।তাই অল্প পড়েই ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া তার বরাদ্দ ছিল।সেই রেজাল্ট নিয়েও বাবার কোনো উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা কিছুই ছিল না।যেন খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।আরও অনেক ভালরা চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।অনি এমন কিছু বাহাদুরি করেনি।বরং অনেক বিষয় বেশ খারাপ করেছে।এইরকম রেজাল্ট মোটেই আশা করা যায় না ড.অলকেন্দুর ছেলের থেকে।সব ব্যাপারে এমন বিরূপ মন্তব্য শুনতে-শুনতে নিজের মনে-মনে একটা দুঃখ নদীর তীর সৃষ্টি করেছিল অনি।সেই নদীর তীরে একলা-একলা মন মরা হয়ে বসে থাকত মাঝে-মাঝে।কারো সাথে কথা বলত না।মা বুঝতো শুধু।মা সেই সময় অনিকে বলতো আয় তোকে গান শোনাই।বলে মা গান গাইতো-
”তোমারেই করিয়াছি
জীবনের ধ্রুবতারা।
এ সমুদ্রে আর কভু
হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো
তুমি প্রকাশিত থাক,
আকুল নয়নজলে
ঢালো গো কিরণধারা।”
মা তন্ময় হয়ে যেত।অনির মনটাও কেমন উদাস হয়ে যেত।মায়ের দুচোখ দিয়ে বিন্দু-বিন্দু মুক্তো যেন টপ্ টপ্ করে কোলের ওপর ঝরে পড়ত।অনি তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে সরে আসতো।দুহাতে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিত।ভাবত ও কোনোদিন কাউকে কষ্ট দেবে না।অনির কখনও শরীর খারাপ হলে বাবা তাকে দেখত, ওষুধ লিখে দিত।কিন্তু কখনও আদর করে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করত না সে কেমন আছে?ওষুধ খেয়েছে কিনা?অথচ সবই তো স্বাভাবিক।বাবার অঢেল টাকা, বাড়ী- গাড়ী।খাওয়া পরার অভাব নেই।তবু কি একটা শূন্যতা! কেমন যেন বুক হু হু করে উঠত ওর মাঝে মাঝে।একটু ছোটবেলায় মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে হঠাৎ করে খুব কান্না পেত অনির। বলত-
”আমাকে ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না তো মা কোনোদিন?”
চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত ওর।মা ওকে আদর করে কপালে চুমু খেয়ে বলতেন-
”ধূর পাগল কোথায় যাব?তোকে ছাড়া আমি থাকতেই পারি না।”
এই থাকতে না পারার মর্মটা বুঝেছিল অনি বড় হয়ে।বাবা আছে এই পর্যন্তই।বাবা মায়ের মনের বাইরেটায় বিচরণ করে।মায়ের মনের দরজাটা কবে বন্ধ হয়ে গেছে।সে দরজা খোলে শুধুমাত্র অনির ডাকে।মনের ভেতর যত্ন করে যে ঘরটা সাজানো আছে ,তাও অনির জন্য।অনিকে নিয়েই মায়ের জগৎ সংসার।তাই তাকে ছাড়া মা থাকবে কি করে!মাঝে মা গভীর ডিপ্রশনে চলে গেছিল।ডাক্তার বলেছিল মাকে আনন্দে রাখতে।খুব ভালবাসতে।আসলে মানসিক অসুখ তো অন্য জায়গায় সে ওষুধ তো ডাক্তারের কাছে ছিল না।তাই অনি মাকে জড়িয়ে আর অনির মা অনিকে জড়িয়ে বেঁচে ছিল।ইন্দ্রাক্ষির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর অনি ভেবেছিল অনির অপূর্ণতা- গুলো ইন্দ্রাক্ষি পূর্ণ করে দেবে।কিন্তু যার নিজের মনেরই পূর্ণতা নেই সে আর অন্যের দুঃখ বুঝবে কি করে!এমন একটা কঠিন ভাঙা-গড়ার সময়ে শতদ্রুর বোন প্রিয়ার বিয়েতে ঘটে গেল ঘটনাটা।
মেয়েটার নাম মধুপর্ণা।বেশ লক্ষ্মীশ্রী আছে।দুধে-আলতা গায়ের রঙ পদ্মকলির মত আঙুল।চোখে এক করুণ মায়াময়তা।বিয়ের আসরের একপাশে ভয়ে জড়-সড় হয়ে বসে আছে।কিছুতেই সে বিয়ের আসরে আসতে চাইছিল না।বাড়ীর লোকেরা অনেক বুঝিয়ে তাকে আসরের একপাশে বসিয়ে দিয়ে গেল।রূপম আর শতদ্রু মধুপর্ণার সাথে কথা বলছিল।উৎসাহী আত্মীয়-স্বজন কি সব আলোচনা করছে,মধুপর্ণার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে।কিন্তু মধুপর্ণার মনটা কেমন অন্যমনস্ক। সে সব দিকে তার মন নেই।কিছুই যেন ভাল লাগছে না তার।শতদ্রু অনির সাথে মধুপর্ণার আলাপ করিয়ে দিল।গায়ে কাপড় জড়িয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে মেয়েটা।কতকালের দুঃখ স্রোত বয়ে যাচ্ছে যেন অনবরত তার মনের ভেতর দিয়ে।চোখদুটো ছল-ছল করছে।এ জগৎ সংসারে সে যেন ব্রাত্য। অনাবশ্যক ভার বোঝা সকলের।
শতদ্রু অনিকে বলল-
”ও মধুপর্ণা।আমার এক দূর সম্পর্কের মাসীর মেয়ে।মাসী-মেসো কিছুদিন আগে একটা ট্রেন দুর্ঘটনায় হঠাৎ মারা গেছেন।সেই থেকে মেয়েটা গভীর মানসিক অবসাদে চুপ করে গেছিল।আমরা দিনকতক আমাদের কাছে এনে ওকে রেখেছিলাম।কিন্তু ওর বাড়ীর কাকা-কাকীর সেটা পছন্দ হল না।ওকে বাড়ী নিয়ে গেল।আসলে মাসী- মেসোর অঢেল টাকা।সেখান থেকে ওর মানসিক অবসাদের সুযোগে কিছুটা বা পারলে পুরোটা নিয়ে নেবার প্রবল ইচ্ছে ছিল ওদের।কি অবস্থায় ওর বিষয়-আশয় আছে যদিও আমরা কেউই জানিনা।ওর কাকা তো মোটেই ভাল নয়।অকস্মাৎ মা-বাবাকে একসাথে হারিয়ে মধুপর্ণা আর নিজের ভেতর নেই।”
শতদ্রু বলতে-বলতে একটু থামল।কিন্তু অনির মনের ভেতর কেমন মোম গলে যাওয়ার মত একটা অনুভূতি হতে লাগল।তার মনের ভেতর যে শূন্যতার ফাঁপা বাষ্প জমে ছিল বহুদিন ধরে;মনে হল সেই জায়গাটায় কেমন অনুভূতির উষ্ণতা জাগছে যেন! বাষ্পগুলো এইবার হয়তো মেঘ হয়ে জমাট বাঁধবে।ঐ পেঁজা তুলোর মত অসহায় মেঘগুলোকে যদি তার মনের আকাশে উড়তে দিতে পারে অনি! অসহায় মেঘের মত আশ্রয়হীন নিরাপত্তাহীন একজন মানুষকেও যদি আগলে রাখতে পারে অনি, তাহলে হয়তো ও কিছুটা শান্তি পাবে মনে।কি জানি কেন মাঝে-মাঝে এইসব উদ্ভট ভাবনা ঘোরাফেরা করে ওর মনে ও জানেনা!
”বর এসেছে বর এসেছে।”—-
চেঁচামেচি শুরু হতেই সকলেই হুড়মুড় করে বর দেখতে ছুটল।অনি সেদিকে না গিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াবে ভাবল।সেইসময় হঠাৎ মধুপর্ণা চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে গেল। অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি!অনি তাড়াতাড়ি ছুটে গেল।পাশে রাখা জলের বোতল থেকে আঁজলা করে জল মধুপর্ণার চোখে মুখে ছেটাতে লাগল।ওর গা হাত পা বরফের মত ঠান্ডা।নতুন কনের সাজে প্রিয়াও ভয় পেয়ে গেছে।জল ছিটোবার পরও তো জ্ঞান এল না।কি করবে অনি!মধুপর্ণা, মধুপর্ণা কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকল অনি।কিন্তু কোনো সাড় নেই।মধুপর্ণার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না অনি।যেন সদ্য ফোটা স্বর্গের পারিজাত ফুল একটা! পৃথিবীতে নেমে এসেছে।কি এমন হল ওর, যে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল?পালস্ টা দেখল অনি।পালস্ ঠিক নেই।প্রেসারটা মাপা দরকার।অনি মোবাইলে শতদ্রুকে ফোন করল।কিন্তু কল এন্ড হয়ে গেল দুবার।চেঁচামেচি-আওয়াজে শুনতে পাচ্ছে না হয়তো।শতদ্রুর বোন প্রিয়া বলল-
”অনিদা চল তুমি আর আমি ধরাধরি করে ওকে ঘরে শুইয়ে দি।এখনি কেউ না কেউ এসে পড়বে। আর তুমিই তো ডাক্তার অনিদা।দেখ না গো কি করা যায়।কদিন ধরে ও এরকম মাঝে-মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।আসলে মনে একটা চরম আঘাত লেগেছে তো!”
অনি আর প্রিয়া মধুপর্ণাকে ধরাধরি করে ঘরে খাটের ওপর শুইয়ে দিল।আবার কিছুটা জল ছিটিয়ে দিল অনি মধুপর্ণার চোখে-মুখে।এইবার একটু-একটু জ্ঞান আসছে ওর।হাত বাড়িয়ে কিছু একটা অবলম্বন খুঁজছে ও।কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে অস্ফুটে।অনি কি করবে বুঝতে না পেরে কেন জানেনা নিজের হাতটা এগিয়ে দেয় মধুপর্ণার দিকে।হাতটা শক্ত করে ধরেছে মধুপর্ণা।আস্তে-আস্তে চোখ খুলেছে।অনির মনে পড়ে যাচ্ছে ছোটবেলাকার ওর সেই অসহায় অবস্থার কথা।যখন মাকে জড়িয়ে ধরে ও বলত –
”মা আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তো?”
মধুপর্ণার চোখে কি সেই একই ঘোলাটে দৃষ্টি?হারাবার আশঙ্কায় ভীতা হরিণীর মত অসহায়।অনি কি করবে?মাথার ভেতরটা কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে অনির! কেন বুঝতে পারছে না।যাইহোক ততক্ষণে শতদ্রু এসে পড়েছে।
বলল-
”আবার সেন্সলেস হয়ে গেছে মেয়েটা?”
অনি ওর ডাক্তারী সরঞ্জাম নিয়ে মধুপর্ণাকে পরীক্ষা করল।কয়েকটা টেস্ট করতে হবে।অনি বলল-
”আচ্ছা শতদ্রু মধুপর্ণা কি আগেও এরকম অজ্ঞান হয়ে যেত?ও যেন একটা ট্রমার ভেতর আছে।একটা হারানোর ভয়।একটা নিদারুণ আশঙ্কা।প্রেসার খুব লো।মনে হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া করছে না ঠিকমত।”
শতদ্রু বলল- ”তখন সকলের সামনে সব কথা বলা হয়নি তোকে অনি।যদিও মুখে-মুখে ঘটনাটা সকলেই জেনে গেছে।তবু সর্বসমক্ষে বার-বার সব বলাটা ঠিক নয়।মধুপর্ণার কাকা ভীষণভাবে ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন।এমন কি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতেও উনি পিছপা হবেন না।পিছনে সেই সম্পত্তির লোভ।মধুপর্ণাকে সরিয়ে দিতে পারলেই গোটা বাড়ী টাকা পয়সা উনি হাতিয়ে নিতে পারবেন সহজেই।কদিন আগে মধুপর্ণা পালিয়ে এসেছে বাড়ী থেকে।রাতের বেলা ভাড়া করা গুন্ডাদের দিয়ে ওকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ওর কাকা ওকে দুনিয়া থেকে। কি ঘটনা ঘটেছে সেটা মধুপর্ণা কিছুতেই বলছে না।ভয়ে ভাবনায় মেয়েটা কেমন চুপ করে গেছে।আর মাঝে-মাঝে সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবে যে পালিয়ে এসেছে এটাই একটা মন্দের ভাল।নয়তো আরও কিছু ঘটনা ঘটে যেত হয়তো।আমাকে ফোন করেছিল।স্টেশন থেকে আমি নিয়ে এসেছি।তবে কাকা সহজে ছাড়বেন বলে মনে হয় না।আমাদের পুলিশে একটা ডায়েরী করে রাখতে হবে।”
অনি বলল- ”সে ডায়েরী তো করতেই হবে।ওকে পুরো প্রোটেকশান দিতে হবে।ওর যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকেও নজর দিতে হবে।কাল সকালে আগে এই টেস্টগুলো করাতে হবে।”
বিয়েবাড়ীর হৈ হুল্লোড়ে বিষাদের অন্ধকার সাময়িক চাপা পড়ে গেল।মনের দুঃখ গুলো যেমন পালিশ করা গয়না আর প্রসাধনীর আড়ালে সাময়িক মুখ লুকোয় ঠিক তেমনই আরকি।মধুপর্ণা ঘুমিয়ে পড়েছে।অনি বসে আছে বাইরের বারান্দায়।মাঝে-মাঝে ঘরে এসে দেখে যাচ্ছে মধুপর্ণার পালস্ ঠিক আছে কিনা।শ্বাস চলছে কিনা।এইটুকু সময়ে এমন ব্যাকুলতা কেন জন্মালো ওর?সেকি অনি ডাক্তার বলে?নাকি অন্য কিছু?যাইহোক পরের দিন মধুপর্ণার টেস্টগুলো হতে গেল।
আজ ঠান্ডা শীতের আমেজ।কুয়াশা কেটে সূর্য উঠেছে সবে।মধুপর্ণা একটু ভাল।তবে যথারীতি কথা বলছে না বিশেষ।মাঝে-মাঝে ফ্যাকাসে চোখে তাকাচ্ছে।অনি মধুপর্ণাকে বলল-
”একটু বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসবে?শীতের রোদটা গায়ে পড়লে ভাল লাগবে।বাইরের সবুজ গাছপালার দিকে তাকালে মনটা ভাল হবে।সকালের নরম আলো–।”
মধুপর্ণা আস্তে করে মাথা নাড়াল দুদিকে।না যাবে না।ওর এই তীব্র যন্ত্রণাময় অবসাদ কি করে কাটবে জানা নেই কারো।ফুলের মত মেয়েটা আস্তে-আস্তে শুকিয়ে যাচ্ছে যেন।মধুপর্ণার সাথে-সাথে শতদ্রুর বাড়ীর লোকজনও চিন্তিত।বিশেষত পরের মেয়েকে কতদিন এইভাবে রেখে দেওয়া যায়।যে কোনো সময়েই তো ঝামেলা হতে পারে।কিন্তু এই অসুবিধের কথাটা কেউই মুখ ফুটে বলতে পারছে না।বর-কনে চলে গেছে।সব উচ্ছ্বাস-তরঙ্গ স্হির হয়ে এসেছে।দুদিনের ভেতর মধুপর্ণার সব টেস্টের রিপোর্ট এসে গেল।রিপোর্ট দেখে সকলের মাথায় বজ্রপাত হওয়ার জোগাড়।মধুপর্ণা প্রায় তিনমাসের অন্তঃসত্তা।কি করে হল এমন?সেজন্যই কি এত অবসাদ? এমন হঠাৎ-হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া? মধুপর্ণা আজ কথা বলল-
”আমার বেঁচে থাকার আর কি কোনো মানে আছে?শতদ্রুদা বল? আর কি লাভ আমার বেঁচে?আমাকে তোমরা মরতেই দাও!আমি জানতাম এরকমই কিছু একটা হবে!সেদিনই যদি মরে যেতাম ভাল হতো।এই মুখ আর কাউকে দেখাতে হত না!আর কত সহ্য করব আমি?আমি যে আর পারছি না।মা মাগো কোথায় তুমি?আমাকে ফেলে কোথায় চলে গেলে?তুমি তো বলেছিলে কোথাও যাবে না আমাকে ফেলে!”
অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়লো মধুপর্ণা।বুকের ভেতর পাথরের মত জমা বরফ এতদিনে গলে- গলে পড়তে লাগল যেন।অনি ভাবল কাঁদুক যদি মনের ভারটা একটু হাল্কা হয় তো হোক।মনের ভেতর কি কষ্ট কি কথা জমা হয়ে আছে যদি বলতে পারে ও, তাহলে সুস্হ হয়ে উঠবে তাড়াতাড়ি।কিন্তু সেই সঙ্গে অনিও মনে-মনে একটা নিদারুণ আবেগমিশ্রিত যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল। মনে হতে লাগল হাজার-হাজার ঢেউ আছড়ে পড়ছে ওর মনের দুঃখ নদীর তীরে এসে।
এরপর সত্যিই বলল মধুপর্ণা।তার বাবা-মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর থেকেই কাকা তার ওপর লাগাতার শারীরিক নির্যাতন করে চলেছে।তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সে বুঝেছিল তার কাকার মতিগতি ভাল নয়।নানা অছিলায় তার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা।প্রথম-প্রথম বুঝতে পারত না ঠিক।তারপর বুঝে খুব সাবধানে থাকত।মাকে দু একবার বলেছিল।মা বলত ওর মনের ভুল।কাকা এমন করতেই পারে না।একবার কাকার হাত মচকে দিয়েছিল মধুপর্ণা।কিন্তু কাকার কুদৃষ্টি আর খারাপ স্বভাব বদলাবে কি করে?কাকী বুঝলেও কিছু বলত না।এতদিন অনেক কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়েছিল সে।কিন্তু বাবা-মা চলে গেল।আর বাঁচাতে পারল না নিজেকে।এই পাপের মুখ নিয়ে আর বাঁচতে চায় না সে।কাঁদতে-কাঁদতে বলছে মধুপর্ণা-
”আমার মরে যাওয়াই ভাল সেদিন গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচলেও কাকা তো আগেই আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে।সে জন্যই যাতে আমি মুখ খুলতে না পারি তার আগেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল আমাকে পৃথিবী থেকে।কিন্তু ঠিক সময়ে সব জানতে পেরে আমি পালিয়ে এসেছি।এখন মনে হচ্ছে মরে গেলেই ভাল হত।”
বাড়ীর মহিলা-মহলে আলোচনা কানাঘুষো ছি ছি !ফিস ফাস !শুরু হল।অনি শতদ্রুকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল-
”মধুপর্ণার কাকাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে দ্রুত।ওর প্রাপ্য থেকে ও যাতে একটুও বঞ্চিত না হয়।আর মধুপর্ণার দিকে একটু নজর রাখতে হবে কদিন।খারাপ কিছু না করে বসে। বড় চাপের ভেতর আছে মেয়েটা।”
আজ মাঘী পূর্ণিমার রাত।পরিচ্ছন্ন আকাশে তারাগুলো দুচোখ মেলে যেন ধরণীর শোভা দেখতে-দেখতে বিমোহিত।আকাশে পরিপূর্ণ চাঁদ তার কলঙ্ক মুছে ফেলে পবিত্র আলোকধারায় স্নান সেরে সময়ের তরঙ্গে ভেসে চলেছে।মধুপর্ণার চোখে ঘুম নেই।ঘুম থেকে উঠে ছাদে চলে এসেছে সে।সে বড় একা। তাকে ভালবাসবে না আর কেউ।নিজেকে শেষ করে দিলে তার ভেতর বেড়ে ওঠা আর একটা প্রাণও শেষ হয়ে যাবে।সে যেমন সকলের অবাঞ্ছিত; তার সন্তানও অবাঞ্ছিত হয়ে কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকবে।কে নেবে এই অনাহূত জীবনের দায়িত্ব?না কেউ নেই!ছাদের পাঁচিলের ধার ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে।এই উঁচু পাঁচিল থেকে একবার লাফিয়ে পড়তে পারলেই ব্যস্ শান্তি।পৃথিবী জুড়ে তখন চাঁদের জ্যোৎস্নাভিসার চলেছে।আর দেখতে পাবে না কিছু একটু পরে।অন্ধকার নেমে আসবে দুচোখ জুড়ে।
পিছনে অনি এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি মধুপর্ণা।অনির মনে হল দুধ সাদা শাড়ীতে চাঁদেরদেশ থেকে এক অনামিকা পরী এসে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীতে। তাকে নিয়ে উড়ে যাবে দুঃখসাগরের শেষে ঐ দূরে আকাশপারের বন্ধুর বাড়ী।—যেখানে সকল কোলাহলের অবসান।শান্তির পারাবার।
—-কখন অনির বাহুপাশে আবদ্ধ হয়েছে মধুপর্ণা জানেনা।
—বুঝতে পারেনি অপার ভালবাসায় মিশে গেছে দুটি আত্মা।
—-রাত কখন পেরিয়ে গেছে এভাবেই।গান্ধর্ব মতে বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে।পরের দিন সকালে ফোন করে সেই খবরটাই জানিয়েছে অনি মাকে।