-তোমার সাথে আমি আর সম্পর্ক রাখবোনা। আমার সব ছবি তোমার মোবাইল থেকে ডিলিট করে দিবে। আমার ফেসবুক আইডি ব্লক করে দিবে। আর কোনদিন আমাকে ফোন দিবেনা।
-আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো কাউকে নিয়ে সুখী হউ।
-আমি আর কাউকে জড়াবোনা আমার জীবনের সাথে। একা একাই কষ্ট করে বাঁচবো।
-একা কি চলা যায়। কাউকে সাথে নিও।
-আমাকে নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা। আর কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। তুমি ভালো থেকো।
-ওকে জান
-একটা মেয়ের স্মামী মারা গেলে আরেক জায়গায় তার বিয়ে হলে তার দ্বিতীয় স্মামী কি তাকে আগের স্মামীর কথা বলে ঝগড়া করে, বলো?
-তুমি বিয়ে করা মেয়ে হলে কি তোমার সাথে প্রেম করতাম নাকি!
-করতেনা।
-না। আর তুমি তো বিয়ে করোনি আমাকে ছাড়া কাউকে!
-তোমাকেই বা কবে বিয়ে করছি?
-কেন? মনে নাই।
-না।
হঠাৎ অপর পাশ হতে কোন শব্দ আসছেনা। অর্ণব বারবার হ্যালো হ্যালো করছে কিন্তু মৃন্ময়ীর কোন সাড়াই নেই।
প্রায় ত্রিশ মিনিট পর। অর্ণব আবার ফোন দিলো। কয়েকবার বাজার পর ধরলো।
-হ্যালো, কি হইছে?
-কথা বলার মাঝে কই গেছিলা?
-আমি আবার কোথায় যাবো? আমি তো ঘুম থেকে উঠলাম এখন।
-তুমি না একটু আগে আমাকে বললে আমার সাথে আর যোগাযোগ রাখবেনা।
-কেন তোমার সাথে আবার আমার কি হইছে। সম্পর্ক রাখবোনা কেন?
-তোমার কি মনে নেই?
-কেন মনে থাকবেনা?
-আজ কলেজে তুমি আমার সাথে মেসেজে ঝগড়া করছিলে, হঠাৎ আমার কথা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলে।
-কি সব বলতেছো তুমি!
-আচ্ছা আমার নাম কি?
-তোমার নাম অর্ণব
-সম্পূর্ণ নাম
-কি জানি! আচ্ছা আমার টেবিলে এতো ফল কেন? এতো ওষুধ কেন? আমার কিছু মনে পড়ছেনা কেন?
-আমার সাথে ঝগড়া করতে যেয়ে তুমি জ্ঞান হারাইছিলে।
-আমার তো কিছুই মনে নাই।
-দুষ্টামি করোনা তো।
-কোথায় দুষ্টামি করছি? তুমিই না দুষ্টামি করছো।
-সত্যি তোমার কিছু মনে পড়ছেনা?
-মনে পড়ছে তবে বেশি কিছু না।
অর্ণব মুহুর্তেই দুমড়ে মুচড়ে গেলো। মৃন্ময়ীর এই অবস্থার জন্য নিজেকে খুব বেশি অপরাধী ভাবছে সে এখন। কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা।
-ডাক্তার নাকি মাকে বলছেন আমি নাকি বড় কোন আঘাত পাইছি তাই কিছু মনে করতে পারছিনা এখন।
-কি বলছো? তোমার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী। আমার সাথে ঝগড়া করতে যেয়ে তোমার আজ এমন হইছে। আমাকে তুমি শাস্তি দেও।
মৃন্ময়ী কিছু বলছেনা। সে হয়তো ঠিক বুঝতে পারছেনা কি বলবে এখন। কারণ তার তো মনেই পড়ছেনা কিছু তেমন। সে শুধু মানুষগুলোকেই চিনতে পারছে।
-আচ্ছা আমাদের প্রথম পরিচয় কিভাবে হইছে মনে আছে?
-হ্যাঁ, আমাদের বাড়িতে।
-কি বলছো তুমি? তোমাদের বাড়িতে কোনদিন যাইনি আমি।
-তাহলে
-আচ্ছা আমাদের প্রথম দেখা করার দিনের কথা মনে আছে?
-হ্যাঁ
-কি কি করছিলাম ঐদিন?
-মনে নাই
-তোমার সাথে রিলেশন কিভাবে হইছে তা কি মনে আছে?
-না। আমাকে আর জিজ্ঞেস করোনা তো। আমি কিছু পারছিনা। মা অনেক প্রশ্ন করছে, একটাও পারছিনা।
-আমার ছবি তোমার কাছে থাকে সবসময়?
-হ্যাঁ। মাকে তোমার ছবি দেখিয়ে বলছি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো।
-মা কি বললো?
-তোমাকে দেখা করতে বলছেন।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ
অর্ণব ভাবতেছে, এসব কি করছে ও। স্মৃতিশক্তি ঠিক থাকলে কখনো মৃন্ময়ী এমন করতোনা।
-আমার সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক?
-ভালোবাসার
-আমাকে ভালোবাসো?
-ভালোবাসা, জানিনা আমি।
-আমি যে তোমাকে ভালোবাসি এটা বুঝলে তুমি কেন বলছোনা আমাকে ভালোবাসো? বলোনা আমাকে তুমি ভালোবাসো।
-ভালোবাসি তোমাকে।
এ যে মৃন্ময়ী নয়। এ যে অন্য কেউ। যে মৃন্ময়ী অর্ণবকে ভালোবাসতো তাকে কখনো বলতে হতোনা ভালোবাসি বলতে। মৃন্ময়ী আজ অন্য রকম হয়ে গেছে, ভালোবাসে বুঝতে পারলেও বুঝতে পারছেনা এর গুরুত্ব। অর্ণবের এ ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে, আর ভাবছে ভালোবাসার মানুষটি তার ঠিকই আছে কিন্তু সেই মানুষটির ভালোবাসা আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। যে মৃন্ময়ী খুব আবেগপ্রবণ ছিলো, তার আজ কোন আবেগই নেই। সম্পর্কগুলোকে বুঝতে পারলেও সম্পর্কের গভীরতা সে বুঝতে পারছেনা আজ।
অর্ণব বারবার ফোন দিচ্ছে কিন্তু মৃন্ময়ী ফোন রিসিভ করছেইনা। তিন/চার ঘন্টা পর মৃন্ময়ী মেসেজ করলো সে ঘুমিয়ে ছিলো। যে অর্ণব এক ঘন্টা কথা না বলে থাকতে পারেনা তাকে আজ চার/পাঁচ ঘন্টাও কথা না বলে থাকতে হচ্ছে। আর কথা বললেও সেই মৃন্ময়ীকে তো আর সে খুঁজে পাচ্ছেনা, যার আবেগীয় ভালোবাসায় সে ডুবে থাকতো। এখন মৃন্ময়ীর সাথে কথা বলতে গেলেও আরও কষ্ট হয় অর্ণবের, কারণ মৃন্ময়ীর সাথে কথা বলতে যেয়ে তার মনে হয় অপরিচিত কোন মেয়ের সাথে সে কথা বলছে।
-হ্যালো
-হ্যাঁ
-এখন কেমন লাগছে?
-ভালো
-সবকিছু মনে পড়ছে
-না
-আমার আগামীকাল একটা পরীক্ষা আছে
-পড়ো
-তুমি জানতেনা আমার যে আগামীকাল একটা পরীক্ষা আছে?
-না। আচ্ছা আমার রোল কতো?
-কিসের?
-কলেজে
-আমাকে বলোনি কখনো
-আমার রোল নাম্বার মনে পড়ছেনা
-কোন বিষয়ে পড়ো তা মনে আছে?
-ভূগোল। আমার টেবিলের উপর ভূগোলের একটা বই আছে।
-কি করছো?
-বসে বসে সবার কথা শুনছি।
-ভালো
অর্ণবই সব কথা বলছে। মৃন্ময়ী কখনো উত্তর দিচ্ছে কখনো দিচ্ছেনা। খুব কম কথা বলছে মৃন্ময়ী নিজ থেকে।
-আচ্ছা রাখো, পরে কথা বলবো।
-আচ্ছা।
মৃন্ময়ী কেমন যেন হয়ে গেছে। কাছে থেকেও দূরের মনে হচ্ছে তাকে আজ।
কয়েক ঘন্টা পর অর্ণব মৃন্ময়ীকে আবার ফোন দেওয়া শুরু করলো। মৃন্ময়ী ফোন ধরছেইনা।
-কি হইছে? এতো ফোন দিচ্ছো কেন? ফোন চার্জে। তুমি পড়তে পারোনা, কাল তোমার পরীক্ষা না?
অর্ণব মৃন্ময়ীর প্রায় দেড়দিন পর সেই আগের মতো কথা বলার স্বাদ পেলো, ভাবলো মৃন্ময়ী হয়তো আগের মতো হয়ে গেছে।
-হ্যাঁ পড়বো তো। তুমি কি সুস্থ হয়ে গেছো?
-আমি অসুস্থ ছিলাম কবে?
-তাইতো, তুমি তো সুস্থ।
-সব মনে পড়ছে তাইনা
-হ্যাঁ
-আচ্ছা রাখি
-রাখো
অর্ণব ভাবলো মৃন্ময়ী সুস্থ হয়ে গেছে। মনে মনে খুশী হয়ে অর্ণব দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে পড়া শুরু করলো। পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলো।
অনেকক্ষণ পর মৃন্ময়ী মেসেজ করলো। দেড়দিন পর আজই নিজ থেকে সে মেসেজ করলো।
-আমার মাথায় লাগছে খুব, ঘুম পাচ্ছে।
-ঘুমাও।
এরপর আর রিপ্লাই আসলোনা। ঘুমিয়ে গেলো মৃন্ময়ী। সকাল হতে না হতেই অর্ণব মৃন্ময়ীকে ফোন করা শুরু করলো। অনেকবার রিং বাজার পর ধরলো মৃন্ময়ী।
-হ্যালো
-কোথায় তুমি?
-শুয়ে আছি।
-ঘুম পাচ্ছে খুব।
-আচ্ছা ঘুমাও
-আচ্ছা
মৃন্ময়ীর এমন আচরণ দেখে অর্নব বুঝতে পারলো যে মৃন্ময়ী আসলে সুস্থ হয়নি। সে এখনো কিছু মনে করতে পারছেনা।
পরীক্ষার পর মৃন্ময়ীকে অর্নব ফোন করলো।
কেমন লাগছে এখন?
-ভালো
-মনে পড়ছে কিছু?
-না
-আর কতক্ষণ লাগবে?
-জানিনা
-তুমি কেমন যেন এখন? আগের মতো কিছু অনুভব করতে পারোনা?
-জানিনা
-সকালে নাস্তা করছো?
-হ্যাঁ
-আমার না এখন খুব ক্ষুধা লাগে।
-ক্ষুধা লাগলে খাও।
-আর খুব ঘুম পায়
-হুম।
-জানো আমার রোল নাম্বার মনে পড়ছে
-কতো?
-ছাপ্পান্নো
-খুব ভালো। তাহলে তো তুমি আস্তে সব মনে করতে পারবে।
-জানিনা।
-আচ্ছা আমার কথা সব মনে পড়ছে?
-না।
-এখন যদি অন্য কারও সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করে, তাহলে কি তাকে বিয়ে করবে?
-না। কেন করবো?
-আমার সাথে যে সম্পর্ক কতোটা গভীর তার কিছুই তো তোমার এখন মনে পড়ছেনা।
-এতো কিছু বুঝতে পারিনা আমি।
-কি বুঝো তুমি?
-কিছুনা
-ভালো লাগছে না। কতক্ষণ হলো তুমি আগের মতো কথা বলছোনা।
-তুমি আমাকে দেখতে আসোনা কেন? সবাই আমাকে দেখতে আসে, শুধু তুমি আসছোনা।
-হুম, আমি আসবো। আচ্ছা আমি আসলে কোথায় দেখা করবে?
-কি জানি!
-আচ্ছা তুমি সুস্থ হও তখন আসবো। এখন তো আমাকে ঠিকমতো মনে করতেই পারছোনা।
-আমার খুব ঘুম পাচ্ছে এখন
-তাহলে ঘুমাও তুমি। ঘুম থেকে উঠে আমাকে বলো।
-আচ্ছা।
অর্ণব ফোনটি রেখেই চুপচাপ বসে পড়লো। মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে তার। খুব দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে মৃন্ময়ীকে নিয়ে। অর্ণব অনেক প্রার্থনা করছে আল্লাহর কাছে মৃন্ময়ীর স্মৃতিশক্তি ফিরে আসার জন্য। মৃন্ময়ীর স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ায় হঠাৎ অর্ণব যেন অনেকটা মৃন্ময়ীকে হারানোর কষ্টই পাচ্ছে।
তিন ঘন্টা পর অর্ণব মৃন্ময়ীকে মেসেজ করলো।
-ঘুম ভাঙছে?
-হুম
অর্ণব মৃন্ময়ীর হুম শুনেই বুঝতে পারলো মৃন্ময়ী ঠিক হয়ে গেছে।
-তোমার সব মনে পড়ছে তাইনা?
-কেন? আমার আবার কি হইছে? আমি তো এখনই ঘুম থেকে উঠলাম। দুইদিন অসুস্থ ছিলাম।
-তোমার এই দুইদিন কিছু মনে ছিলোনা।
-কে বলছে তোমাকে?
-আমার সাথে তোমার কথা হইছে।
-কইছে তোমাকে! তোমার না আজ পরীক্ষা ছিলো? পরীক্ষা কেমন হলো?
-হইছে ভালোই। পরীক্ষা আগে তোমাকে বলছিলাম পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। তুমি বলছো যাও।
-কই কখন বললাম? আমার মনে নেই।
-থাক মনে করার দরকার নেই। আমি আমার আগের এই মৃন্ময়ীকেই চাই।
-হুম
-ফোন দেই?
-এখন না গোসল করে আসি আগে।
-না, দেই।
অর্ণব তখনই ফোন করলো।
-হ্যালো
-হুম বলো
-সত্যি তোমার সব মনে পড়ছে?
-হুম জান
-আমি কোথায় পড়ি, কোথায় থাকি, সব কিছু?
-হুম।
-আলহামদুলিল্লাহ।
-হুম
-আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো এতক্ষণ। আমার জন্যই তোমার এমন হইছিলো।
-হুম
-আমার সাথে ঝগড়া করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলে, এরপর ডাক্তার তোমাকে একটা ইনজেকশন দেওয়ায় তোমার এই দুইদিন তেমন কিছু মনে ছিলোনা।
-ও, তাহলে তো সব দোষ তোমার।
-সরি জান
-আর আমাকে কষ্ট দিবে?
-না দিবোনা।
-হুম। আই লাভ ইউ
-হুম। এ দুইদিন নিজ থেকে লাভ ইউ-ও বলোনি।
-তাই বুঝি!
-হুম
-আচ্ছা আজ তোমাকে অনেক লাভ ইউ বলবো।
-কচু
-আবার ঝগড়া করতেছো যে
-কই না তো
-হুম
-তুমি একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলছো
-কি? যে সময় তোমার স্মৃতিশক্তি কম ছিলো তখন তোমার আম্মুকে আমার ছবি দেখিয়ে বলছো আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
-তাহলে তো আমার খবর আছে এখন।
-হুম। তবে এক হিসেবে ভালো হইছে। আমার হবু শাশুড়ি আমাকে আগেই চিনে ফেলছে।
-কইছে তোমারে। আমি যে এখন ঝামেলায় পড়বো।
-তা তুমি সামলে নিবে যে ভাবে হোক।
-হুম
অর্ণব খুব খুশী এখন। কারণ অর্নবের মৃন্ময়ী সত্যিই আবার অর্ণবের কাছে ফিরে এসেছে। হয়তো সত্যি সত্যিই মৃন্ময়ী অর্ণবের জীবন থেকে হারায়নি তবে যে কষ্ট অর্ণব পেয়েছে তা অনেকটা মৃন্ময়ীকে হারানোর মতোই। তবে এতটুকু স্বান্তনা ছিলো কেবল মৃন্ময়ীর স্মৃতি হারালেও তার ভালোবাসা ঠিকই ছিলো। আর এখন সেই মৃন্ময়ী, সেই ভালোবাসা, সবই ঠিক আগের মতো হয়ে গেছে।
এক ঘুম মৃন্ময়ীর স্মৃতি নিয়ে গেছিলো, আরেক ঘুম এসে সেই স্মৃতি আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেলো।