তৎপরে বহুকাল অতিবাহিত হইবার পর ঘটনাচক্রে একদা অন্য এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল। তবে ইহাছিল বাঘটির নিজের অনুমান মাত্র। গতকল্য এক পলায়নপর দুর্বিনীত শশক মারিয়া ভক্ষণ করিবার পর হইতেই তাহার গলায় এই ব্যথা শুরু হইয়াছিল। সুতরাং বাঘের ধারণা হইয়াছিল ভক্ষণকালে শশকটির কোন ক্ষুদ্র হাড় হয়তো তাহার গলায় ফুটিয়া গিয়াছে।
সেজন্য অদ্য চিকিৎসার্থে জেনারেল মেডিসিনের ডাক্তার কচ্ছপের নিকট না গিয়া শল্যচিকিৎসক সারসের নিকট নাম লিখাইল। তাহার নম্বর আসিলে নির্ধারিত ফি বিধিমতে পূর্বেই সম্পূর্ণ পরিশোধ করিয়া তৎপরে চিকিৎসক সন্নিধানে উপনীত হইল।
-কী হয়েছে খুব সংক্ষেপে ঝটপট বলে ফেলুন।
-আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, আমার গলায় ডান দিকে খুব ব্যথা লাগছে, ওখানটায় একটা হাড় ফুটেছে বলে মনে…
-হাড় ফুটেছে না মাস ফুটেছে সেই ডায়গ্নসিসটা কি আপনি করবেন, না আমি করবো?
-না না, সে তো মানে আপনিই….’
-আমার টাইমের দাম আছে। হাঁ করুন তাড়াতাড়ি।
আর কোনও কথা না কহিয়া বাঘ মুখব্যাদান করিল। সারসের বুক সজোরে ধড়াস করিয়া উঠিল। উহার বিকট হাঁয়ের মধ্যে মুন্ড ঢুকাইয়া পরীক্ষা করিবার সময় গর্দভটি যদি হঠাৎ কোনভাবে উহার হাঁ বন্ধ করিয়া ফেলে! কিন্তু রোগীমাত্রই চিকিৎসককে যমের অপেক্ষাও বেশি ভয় পায়। সারসের অসুবিধা হইতে পারে এমন কোন কাজ বাঘ করিবে বলিয়া মনে হয় না। যাহা হউক গলাভ্যন্তর নিরীক্ষণ করিয়া সারস দেখিল যে গলার একটু ভিতরে ডান পার্শ্বে বাঘের অনুমান মত সত্যই অতিক্ষুদ্র একখানি হাড় ফুটিয়া আছে। কিন্তু একজন বৃহৎ চিকিৎসকের পক্ষে কখনই রোগ সম্পর্কে রোগীর অনুমান সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া স্বীকার করা কদাপি সম্ভব নয়।
বাঘের মুখ-গহবর হইতে সন্তর্পণে দীর্ঘ চঞ্চুসমেত নিজের মুন্ড নিরাপদে বাহির করিয়া সারস পৃষ্ঠের পালকে চঞ্চু উত্তমরূপে মুছিয়া স্টেরিলাইজ্ড করিয়া লইয়া যথাসম্ভব কন্ঠ গম্ভীর করিয়া কহিল, –
-হুম্-ম্। গলার ভেতরের পরিস্থিতি তো অত্যন্ত খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে!
-কী হয়েছে ডাক্তারবাবু? হাড়টা দেখতে পেলেন?
-ওখানে হাড় ফাড় কিস্স্যু ফুটে নেই। এখানেই তো পেশেন্ট আর ডাক্তারের পার্থক্য। গলার ভেতরে কী হয়েছে সেটা আপনি আন্দাজে বলছেন, আর আমি নিজের চোখে স্পষ্ট ভাবে দেখে তবে বলছি। ওখানে হাড়ের মত দেখতে একটা জিনিস গজিয়েছে। সম্ভবতঃ গলার একটা হাড় বেড়ে গিয়ে বড় বিপদ হতে চলেছে।
-গলার হাড় বেড়ে গিয়ে বড় বিপদ! কী বিপদ? খারাপ কিছু হয়েছে?
-যে হাড়টা বেড়েছে তার চারপাশটা কালচে নীল ধরণের সবজেটে বেগুনি রঙের হয়ে গেছে। অ্যাট দ্য প্রেজেন্ট সিচ্যুয়েশান, ইমিডিয়েট সার্জারির ব্যবস্থা না নিলে ওখানে এরপর রেট্রোনিউমোপেরিটোরিয়াম হয়ে যেতে পারে। তা থেকে থ্রম্বোঅ্যাংগাইটিক্যাল ওবলিটেরান্স –’
-ওরে বাবা রে বাবা! এত বড় বড় রোগের দিকে যাচ্ছে! এখন উপায় কী ডাক্তারবাবু? বাঁচবো তো?
-সেটা নির্ভর করছে কত তাড়াতাড়ি আপনি এই সার্জারির করার জন্য নির্ধারিত প্রাথমিক ফি-এর পুরোটাই আগে জমা করতে পারবেন তার উপর। তবে সার্জারি করতে দেরি হয়ে গেলে তখন দায়িত্বটা কিন্তু সম্পূর্ণ আপনার। ইন দ্যাট কেস অল রেসপনসিবিলিটিজ উইল রান অনলি ট্যু য়্যু!
-অ্যাঁ! – তাহলে তো আজকেই ফি-টা জমা করতেই হয়। পুরোটাই কী আগাম দিতেই হবে ?
-হ্যাঁ, দিতে হয়। কেননা সেটাই সিস্টেম। নাহলে সার্জারি ক্যমপ্লিট হয়ে যাবার পর ওই যে সেই আপনার মতই কোন একজন পেশেন্ট একজন ডাক্তারকে ফিজ দিতে গিয়ে নাকি বলেছিল – ‘বাঘের হাঁ-এর ভেতর থেকে নিজের মাথা বের করে নিতে পেরেছিস, – এটাই তো তোর মস্তবড় ফিজ’ – এসব ফালতু মাজাকি করা আর অনেকদিন হল চলছে না।
-না না, ছি ছি! সে কী কথা! সেসব কিছু করার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। সেসব কবেকার অনেক পুরনো কথাটথা টেনে এনে আর লজ্জা দেবেন না ডাক্তারবাবু। যেভাবেই পারি, যেমন করেই হোক আমি আজই পুরো ফি জমা করে দেব। কিন্তু অপারেশনটা কখন হবে?
-সার্জারি হবে কাল সকালে, অ্যাট আর্লি মর্নিং। আজ রাতে খুব হালকা কিছু খাবেন। কাল সকাল থেকে একেবারে খালি পেটে থাকতে হবে। সকালে নটার মধ্যেই ফি জমা করার রিসিটটা সঙ্গে নিয়ে চলে আসবেন। আর – হ্যাঁ, আমার টাইমের দাম আছে। সেজন্য আমি টাইম সবসময় স্ট্রিক্টলি মেনটেন করে চলি, – এটা মনে রাখবেন।
সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া বাঘ নিজ গুহায় গমন করিল। সায়াহ্নে কোনরূপ খাদ্য গ্রহণ করিতে তাহার ইচ্ছা হইতেছিল না। কিন্তু চিকিৎসকের নির্দ্দেশ মান্যার্থে কয়েকটি গঙ্গাফড়িং ধরিয়া ভক্ষণ করিল। পরদিবস বাঘ সকাল নয় ঘটিকার কিঞ্চিৎ পূর্বেই চিকিৎসালয়ে আসিয়া শুনিল তখনও পর্যন্ত ডাঃ সারস নিদ্রাভিভূত হইয়া আছেন।
এত বেশি বেলা পর্যন্ত এইরূপ নিদ্রাগত থাকিবার কারণ অনুসন্ধান করিলে ডাক্তারের অ্যাটেনড্যান্ট চামচিকা তাহার স্বভাববিরস কণ্ঠে জানাইল গত রাত্রিতে ডাক্তারবাবুদের এক মহতী পার্টি দেওয়া হইয়াছিল। স্বাভাবিক ভাবে তথায় ঔষধ কোম্পানির পূর্ণ এবং অকাতর স্পন্সরসিপে প্রভূত খাদ্য ও বিবিধ পানীয়ের বিপুল আয়োজন ছিল।
সেসব বিধিমতে সম্পূর্ণ সারিয়া গৃহে ফিরিয়া আসিতে অত্যন্ত লেট-নাইট হইয়া গিয়া – রাত্রি প্রায় তিন ঘটিকা অতিক্রম করিয়া গিয়াছিল।
এখন সেইসবের হ্যাঙওভার চলিতেছে। এমতাবস্থায় ডাক্তারবাবুকে ডাকিয়া বিরক্ত করিবার কোন প্রশ্নই নাই। স্বাভাবিক ভাবে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হওয়া
পর্যন্ত বাঘকে অপেক্ষা করিতেই হইবে।
কেবলমাত্র চিকিৎসকেরই সময়ের মূল্য থাকে বলিয়া বাঘ একাধিক বার শুনিয়াছে। অগত্যা সে ধৈর্য ধরিয়া সেখানে অপেক্ষা করিতে লাগিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল সারসের মাংস খাইতে কিরূপ তাহা সে জানে না। ইতিপূর্বে কখনও সে সারস ভক্ষণ করে নাই।
বাঘের সময় অনেকক্ষণ অতিবাহিত হইবার পর প্রায় একাদশ ঘটিকার পর ডাক্তারের নিদ্রাবসান হইল। অতঃপর চামচিকা বাঘের আগমন সংবাদ জানাইতে ডাঃ সারস গাত্রোত্থান করিয়া বাহিরে আসিয়া বাঘকে তথায় অপেক্ষমাণ দেখিয়া বেশ বিরক্ত ভাবে কহিল,-
-এত সাত সকালেই এসে হাজির হয়েছেন?
-আপনি সকাল নটার মধ্যে হাজির হতে বলেছিলেন। এখন প্রায় এগারোটা বাজে।
-হয়তো তাই হবে – হতেই পারে। গতকাল তিনটে ভাল্লুক, চারটে হায়না আর দুটো চিতার সিরিয়াস সার্জারি ছিল। সব কটাই বাঁচে কী মরে এমন কন্ডিশনে আমার কাছে এনে ফেলেছিল। একজন ডাক্তার হিসেবে ‘না’ তো আর বলতে পারি না। রাত তিনটে পেরিয়ে গেল সব কটা সারতে। ডাক্তারদের অনেক দায়িত্ব, অনেক জ্বালা থাকে। কীহল? ওখানে দাঁড়িয়ে অমন হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? কাছে এসে যতটা পারেন বড় করে হাঁ করুন। আমার হাতে টাইম খুব কম। এই কেসটা করেই আবার দুটো জলহস্তীর সার্জারিতে যেতে হবে।
বাঘ নীরবে নিকটে আসিয়া পূর্বদিনের অপেক্ষা আরও বড় করিয়া মুখব্যাদান করিল। সারসের বুক যথারীতি ধড়াস করিল, তবে তত জোরে নহে। বাঘের হাঁ-এর মধ্যে নিজ মুন্ড প্রবেশ করাইয়া দেখিল হাড়টি যথাস্থানে বিঁধিয়া আছে। প্রত্যাশামত চারিপার্শ্বেই ক্ষত সন্তোষজনকভাবে বিস্তৃত হইয়া অন্ততঃ আরও দুই দিবসের ভিজিটপ্রাপ্তির পাকা বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলেও এই সুযোগেইহার বেশ কিছুক্লিনিক্যাল টেস্টের ব্যবস্থা করাইতেই হইবে। যত্রতত্র গজাইয়া ওঠা ক্লিনিকগুলি আজিকালি যথেষ্ট আন্তরিকতার সহিত এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে যথাযথ কমিশনের মাধ্যমে প্রভূত অর্থ-সহায়তা প্রেরণ করিয়া থাকে।
যথাসম্ভব বেদনা প্রদান করিয়া হাড়ের টুকরাটি তুলিয়া চঞ্চুতে ধারণপূর্বক বাঘের মুখ-গহবর হইতে সারস আপন মুন্ড বাহির করিয়া লইল। বাঘের সামনে ক্ষুদ্রাকৃতি হাড়টি ফেলিয়া দিয়া কহিল, –
-এই দেখুন, এই বাড়তি হাড়টুকু অনেক কষ্টে কেটে বের করলাম। কিন্তু ভেতরে ইনফেকশনের ফলে ঘায়ের অবস্থা খুব খারাপ। থরো চেক-আপ খুবই দরকার। আবার দুদিন পর একবার, তারপর পাঁচদিন পর আরো একবার এই সময়ে অবশ্যই এসে দেখিয়ে যাবেন। তার আগে পেটের আলট্রা-সোনোগ্রাম – হোল অ্যাবডোমেন, চেস্টের এক্স-রে আর এগারো রকমের রক্তপরীক্ষা লিখে দিলাম। সবগুলো ঠিকমত করিয়ে রির্পোট নিয়ে তবেই আসবেন। সবকটি পরীক্ষাই কিন্তু কেবলমাত্র ‘দয়াময় ক্লিনিক’ থেকেই করাবেন।
-ঠিক আছে। আচ্ছা ডাক্তারবাবু, ভয়ের তেমন কিছু নেই তো?
-সার্জারির পর বাহাত্তর ঘন্টা কাটার আগে কিছুই বলা সম্ভব নয়। ওখানে গ্যাংগ্রীন হয়ে যেতে পারে। তা থেকে হয়েযেতে পারে, ওই যে বললাম – রেট্রোনিউমোপেরিটোরিয়াম! তখন আর আমাদের, মানে ডাক্তারদের করার বিশেষ কিছুই থাকে না।
-গলার ওখানে বড্ড বেশি ব্যথা লাগলো কেন বলুন তো?
-হাড়ের টুকরো কেটে বের করলে ব্যথা লাগবে না তো সুড়সুড়ি লাগবে ভেবেছিলেন নাকি? বরং বলা যায় ব্যথা বেশি লেগেছে আমার। মাত্র দুটো ঠোঁটের সাহায্যে এত কঠিন সার্জারিটা করতে হল। যাক এখন বিদেয় হোন দেখি। অন্য পেশেন্টের সার্জারির সময় হয়ে গেছে।
অতঃপর বাঘ সেইদিনের মত বিদায় হইল। চিকিৎসকের নির্দ্দেশমত দুই দিবস ধরিয়া সমস্ত পরীক্ষা সেই দয়াময় ক্লিনিক হইতেই করাইয়া লইয়া পুনরায় চিকিৎসক সন্নিধানে আসিয়াছিল। তবে দুইবারে হয় নাই, মোট তিনবার তাহাকে বরাবরের মত যথযবিহিত ফিজ অগ্রিম পরিশোধপুর্বক সারসের নিকট চিকিৎসার্থে আসিতে হইয়াছিল।
তিনবার আসিবার পর সেই রেট্রোনিউমোপেরিটোরিয়াম এবং তাহা হইতে গড়াইয়া গিয়া শেষ পর্যন্ত থ্রম্বোঅ্যাংগাইটিক্যাল ওবলিটেরান্স নামক ভয়ানক মারণ ব্যাধি বাঘের হইবার সম্ভাবনা ‘আপাততঃ নাই’ বলিয়া ডাঃ সারস সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করিয়াছিল। তবে তিরিশ দিবস পরে আর একবার চেম্বারে আসিয়া সেফটি চেকিং করাইয়া লইলে উত্তম হইবে বলিয়া বাঘকে বিদায় করিল। অতঃপর বিদায় লইয়া আপন গুহাভিমুখে গমন করিতে করিতে বাঘের আরও একবার মনে হইল যে সারসের মাংস খাইতে কিরূপ তাহা সে জানে না, কারণ অদ্যাবধি সে সারস ভক্ষণ করিয়া দেখে নাই।